চোখের আলোয় - অংশুমান





অর্ঘ্য শিয়ালদা থেকে একটা বাস ধরে দেশপ্রিয় পার্কে নামলো। চারদিকে প্রচুর জ্যাম। পুজোর সময় যাদের নিজের গাড়ি থাকে তাদের সুবিধে। বাস-অটোয় গরমে মোটামুটি ঘোরার ইচ্ছে কিছুক্ষণ বাদেই চলে যায়। তবু যাদের অদম্য ইচ্ছে প্যান্ডেলে ঘুরে ঠাকুর দেখার তাদের আটকে রাখা যায়না। এ এক পাগলামির মতো। আর এটাকেই মার্কেট করে কলকাতার পুজোতে এত টাকা-পয়সার নয় ছয়। অর্ঘ্যর এসব ব্যাপারে খুব একটা টান নেই। কিন্তু অন্য সব বন্ধুরা তো প্যান্ডাল-হপিং করবেই, তাই অগত্যা। রূপসা, দীপায়ন আর শুভব্রত তিনজনেই এসে পৌঁছয়নি, অর্ঘ্য একা দাঁড়িয়ে।


কতরকমের জামা কাপড় পড়ে কতরকমের লোক একই স্রোতে বেরিয়ে পড়েছে এটাই লক্ষ্য করছে অর্ঘ্য। কেউ গরির, কেউ মধ্যবিত্ত, কেউ বড়লোক। জামা কাপড় দেখলে বোঝা যায়, চোখ-মুখ চুল-দাড়ি, জুতো হাঁটা-চলা, কথা বলা সব কিছু দেখলেই বোঝা যায়। কেউ কেউ থাকে যাদের দেখে অবশ্য বোঝাও যায়না। কী একই ঠাকুর দেখার মানে? নাকি আসলে ঘোরাটা মজা? নাকি বিভিন্ন মানুষের বিভিন্ন কারণ, এইসব সাত-পাঁচ ভাবছিলো চারপাশের কোলাহলের মাঝে দাড়িয়ে। কিছু কথা, কিছু শব্দ স্পষ্ট, বাকীটা ঝাপসা। একটা মেয়ে সযত্নে রাস্তা পার হচ্ছে এটা দেখতে দেখতে অর্ঘ্য-র কানে একটা ছোট সংলাপ এলো,

মাঝবয়সী লোক: এরপর কোথায়?

অর্ঘ্যর সমবয়সী মেয়ে: এটা দেশপ্রিয় পার্ক

- এটা দেশপ্রিয় পার্ক তাই না?

-হ্যাঁ এই তো রাস্তাটা পার হয়ে ঐ পাড়ে দেখা যাচ্ছে...

-আমরা তাহলে রাস্তাটা পাড় হই...

-হ্যাঁ আমরা রাস্তাটা পার হবো...


অন্য মেয়েটার রাস্তা পাড় হওয়া দেখতে দেখতেও, কানের পিছন থেকে এই পুরো সংলাপটাই অর্ঘ্যর কানে এলো। মনে হলো এমনভাবে একই কথা বার বার বলার কী আছে! মেয়েটার কথা বলা খুব একটা সফিস্টিকেটেড নয় কিন্তু, মিষ্টি আবার ন্যাকা-ও। তাকিয়ে দেখার আগে ভিড়ের মধ্যে ফেড আউট করে গেলো। বাকিরা ওকে দেশপ্রিয় পার্কের ভেতরে থাকতে বললো ফোন করে। একটা সিগারেট ধরিয়ে রাস্তা পাড় করে অর্ঘ্য দেশপ্রিয় পার্কে ঢুকলো।

আজ চন্দ্রবিন্দুর গান হওয়ার কথা। ঝলমল করছে দেশপ্রিয় পার্কের প্যান্ডাল। সবকিছুই পণ্য আজ। এক দঙ্গল সুন্দরী মেয়েদের দলকে দেখে অর্ঘ্যর মনটা ফুরফুর করছে। ধীরে ধীরে গম্ভীর ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসছে, দূর্গা ঠাকুরের দিকে তাকিয়ে যেন আরো হালকা হয়ে গেলো। শুধু বাকিদের আসার অপেক্ষা। সবকিছু মন থেকে সরিয়ে মেতে উঠবে উৎসবে। ঘুরবে, খাবে, মেয়ে দেখবে, আড্ডা দেবে দরকার পড়লে একটু নেশাও করে ফেলবে। হালকা সবুজ রঙের শার্টটা টেনে ঠিকঠাক করে নিলো। জুতোটা খুব একটা ভালো লাগছেনা। বাবা যদি আরো একটু বড়লোক হত তাহলে আরো দুর্দান্ত স্টাইল মারা যেত। যাকগে! আবার ভেসে আসে ওই মেয়েদের দলের হাসি। এখানকার থেকে নাকি অন্য কোথাকার ঠাকুরটা বেশি সেক্সি এইসব ঢলাঢলি আড্ডার উপকরণ হালকা শোনা যাচ্ছে। সবকিছুই যেন ঠিকঠাক, পারফেক্ট। পূজোর আড্ডায় মেতে উঠেছে ওরা, নো চিন্তা। হ্যাঁ তাই বুঝি হওয়া উচিৎ। ওদের আরেকটু কাছে গিয়ে দাঁড়াতে ইচ্ছে করছে অর্ঘ্য-র। ঠাকুর দেখার চেয়ে আড্ডাটাই জমবে বেশি আজ বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু আবার ওই অত্যুক্তি, অতিসরল ও ন্যাকা সংলাপ ভেসে আসতে লাগলো পিছন থেকে। সেই মাঝবয়সী লোক আর বছর কুড়ির মেয়েটা,


-এইটাই দেশপ্রিয় পার্ক তাই না?

-হ্যাঁ এটাই দেশপ্রিয় পার্ক।

- ঠাকুরটা দারুন হয়েছে না?

-হ্যাঁ, সবটাই সাদার উপর বলে বেশ ঝলমলে লাগছে।

- পুরোটাই সাদার উপর করেছে তাই না?

- শুধু দূর্গার শাড়িটা লাল বলে আরোই দারুন।

- কত লোক হয়েছে তাই না বল?

- হ্যাঁ অনেক লোক।

- এরপর একডালিয়া তাই না?

- না না এরপর ত্রিকোণ পার্ক দেখবো, তারপর সিংহী পার্ক তারপর একডালিয়া আর ওইদিকে বোসপুকুরটা দেখবো।


অর্ঘ্যর একটু বিরক্ত লাগছে এই ধরণের কথোপকথনটা। মেয়েটাই বা এত ন্যাকা কেন? ঠিক আছে ন্যাকা নয়, মিষ্টি করেই বলছে। তবু লোকটা তো জেনেশুনে এত প্রশ্ন করে যাচ্ছে। আবার,

-প্যান্ডেলটা বেশ করেছে তাই না বল?

- হ্যাঁ তো বাবা অনেক বড়। এবার প্রণাম করে নাও চলো পরেরটা দেখবে তো।

- এরপরেরটা দেখতে হবে। দাঁড়া প্রণাম করে নিই।


অর্ঘ্যর ধ্যান মেয়েদের দলের থেকে সরতে বাধ্য হলো। ডানদিকে ঘুরলো যেখান থেকে কথাগুলো আসছিলো। একটা মেয়ে, রোগা, ওর সমবয়সী, ওই ঢলাঢলি আড্ডার মেয়েগুলোর সাথেও সমবয়সী কিন্তু খুবই সাধারণ দেখতে। অগোছালো সাজ পোশাক, মানে যতটা পেরেছে গোছানোর চেষ্টা করেছে যদিও। চোখে যেন মায়ের স্নেহ আর ব্যাথা নিয়ে মন ভরে ঠাকুর দেখছে, কিছু চাইছে। পাশে মাঝবয়সী লোকটা, হাতে ব্লাইন্ড স্টিক, চোখে অন্ধের কালো চশমা। মেয়েটার বাবা। এখনো কথা বলে যাচ্ছে। অর্ঘ্য আর কিছু শুনতে পাচ্ছে কি না বুঝতে পারছে না। কিন্তু মেয়েটা বলে বলে দেখিয়ে যাচ্ছে দেশপ্রিয় পার্কের দূর্গা ঠাকুর।

অর্ঘ্য আর কোনো ঠাকুর দেখেনি সেদিন, মেয়েও না। কথাও বলেনি, শুধু বন্ধুদের কথা দিয়েছিল পরের দিন ম্যাডক্সে যাবে।

মেয়েটার সাথে ওর বাবা ত্রিকোণ পার্ক, সিংহী পার্ক, একডালিয়া বোসপুকুর আরো কত ঠাকুর দেখতে চলে গেছিলো...




--

Comments