জন্মদিন - রাহুল দেব বর্মণ








টিং টং। বিতান নিজের মাথাটা বালিশ থেকে আলগা করে একটু এলোপাথারি হাত চালাতেই মোবাইল টা পেল। ষ্টার হ্যাশ টিপতেই সরাসরি মোবাইল এর আলোটা চোখে এসে পড়ল। ৮ টা ২০। উফ, মনে মনে যেন বলে উঠল বিতান, নতুন কাজের মাসির এই ঝামেলা। নিজের সুবিধে মতো আসা। যেই শনিবার দেখেছে আগে চলে এসেছে। একটুকুও ভাবে না যে আজ দেরী করে উঠবে সে। "আজ সরাসরি কথা বলব, ঠিক সময় এ আসতে হয় এস না হলে নিজেই manage করে নেব"- পাজামা র নিচ টা গোটাতে গোটাতে নিজেকেই নিজে বলল বিতান । কাল শুক্রবার, পেটে পড়েছিল। you tube টাও বন্ধ করার সময় হয় নি। একটা গজল রিপ্লে হয়ে যাচ্ছে। খেয়াল ই নেই কাল কখন শুয়ে পড়েছিল। মাংস আর চাট এর প্লেট টা কে ঘিরে দুটো আরশোলা ঘুরঘুর করছে, গ্লাস গুলো শুকিয়ে গেছে, এসব আগে সরিয়ে রাখতে হবে, জানালা টাও খুলতে হবে। অন্তত ২ মিনিট তো হাওয়া আসুক, না হলে বোটকা গন্ধ টা যাবে না। কাজের মাসি জানে এসব। ঘর ঝাঁট দেওয়ার সময় কতবার তো খালি বোতল গুলো বিক্রি করার কথা বলে, তবুও সকাল সকাল নিজেকে যতটা পারে পরিস্কার করতে ব্যস্ত হয়ে ওঠে বিতান। টিং টং। নাঃ, আজ একটু বেশি তাড়া দিচ্ছেন মাসি। প্লেট গুলো গুটিয়ে অল্প কেশে নিজের অস্তিত্বের প্রমান দিল বিতান।.... "আসছি মাসি "।

দরজাটা এবার মনে হয় owner কে বলিয়ে সারিয়ে নিতে ই হবে। জোরজার করে না খুললে ই নয়। দু তিনবার টানাটানির পর দরজা খুললে, মাসি প্রায় হুরমুর করে ঢুকেই রান্না ঘরের দিকে দৌড় লাগালো। "আজ আমার একটু তাড়া আছে দাদা, তাইত তাড়াহুড়ো করে আসা"। এই এক সমস্যা। প্রতিদিন ই আগে কাজ করতে আসার একটা বাহানা যেন নিজের ব্যাগ এর মধ্যে পুরে আনে মাসি। আগের সপ্তাহে বলেছিলেন ছেলের স্কুল এ ডেকেছে। তার আগের সপ্তাহে গ্রামের বাড়ি যাওয়ার তাড়া ছিল । এরকম প্রতিদিন ই থাকে। "আজকে সোজাসুজি বলতেই হবে, যে আগে আসলে জানিয়ে আসতে হবে, না হলে দরকার নেই তোমার আর " .... কথা গুলো যেন ঠোক্কর মারছে মাথায়। কালকের নেশা নামেনি মনে হয় এখনো, হালকা ধরে আছে। এই মাঝ শীতের হাওয়াতেও মাথা টা গরম হয়ে আছে। "দাদা , এগুলো নিয়ে যাব ?" প্রথম টায় না শুনলেও ঠং করে আওয়াজ এ বিতান ঘুরে দেখে, কোথাকার কোথাকার সব বোতল গুলো জড়ো করে এনেছে মাসি । "অনেক গুলো জমেছে , বিশু র বাবা র স্ট্যান্ড এর পাশে , প্রতি বোতল ২ টাকা পাওয়া যাচ্ছে , বড় গুলোর দাম তিন টাকা পর্যন্ত যেতে পারে "। কি বলবে বুঝতে না পেরে, চুপ করে থাকে বিতান, না শোনার ভান করে টেবিল টাকে দেয়াল এর পাশে টানতে শুরু করে।" এখানে খালি ই পরে আছে , আপনার তো কোনো কাজে লাগবে না ,অনেক জমেছে , আর মশা ও বেড়েছে অনেক " মাসি আবার শুরু করলেন , "আপনি অন্ধকারে না দেখে ভেঙ্গে দিয়ে আবার কোথায় কি করে বসবেন, কে জানে"। অন্যদিন হলে আগেই দিয়ে দিত বিতান। কিন্তু আজ মাথায় শুধু ঘুরঘুর করছে, ওই কাজে আসার টাইমিং নিয়ে কথা বলাটা। কি করে বলবে বুঝতে পারে না। এত কেন থতমত করছে কেন বিতান নিজেই বুঝতে পারে না। এ তো ন্যায্য কথা। "দাদা নিয়ে যাব? বললে না তো?" বিতান এবার একটু বিরক্ত হয়। ভালো মানুষ হওয়ার সুযোগ সবাই নেয় । নিজের উপর বিরক্তি টা বাড়তে থাকে। "ওহহ , এই দেখো আসল কথা টা তো বলাই হয় নি , আমার ব্যাগ টা খোল তো"। "কেন?" অস্ফুটে বলে ওঠে বিতান। " আচ্ছা আমি ই খুলছি " বলে মাসি ব্যাগটা খুলে ভেতর থেকে একটা সাদা plastic এর মতো বিতান এর হাতে তুলে দেয় । "আজ ছোট মেয়েটার জন্মদিন, বুলির "। তাই একটু মিষ্টি আর সন্দেশ এনেছিলাম দাদা , আমাদের আর কি ক্ষমতা । মেয়েটা আমার পড়াশোনায় খুব ভালো, একবার বলবেন টুক টুক করে মনে রাখে । এবার থ্রী ক্লাস । এই এখানে রাখছি । খেয়ে নেবেন দাদা মনে করে । আজ একটু মন্দিরে যাব তাই। .... বোতল গুলো তাহলে কোনায় রেখে গেলুম ..."। " না ওইগুলো তুমি নিয়েই যাও " নিজেকে নিজেই চিনতে পারে না বিতান, " আজ ছুটি নিলেই তো পারতে "। মাসি ঝাড়ু নামিয়ে রেখে সোজা হয়ে দাড়ালেন , " আমাদের গতর খাটানো কাজ দাদা , এত ছুটি নিলে চলে ? আর তোমার মতো সবাই নাকি ? পাশের বাড়ির বৌদি তো আজ বাড়তি কাজ করিয়ে নিলেন, দু মিনিট দেরী হয়েছে কিনা কথা শোনাবে। আর অসুখ বিসুখে র জন্য তো ছুটি বাঁচিয়ে রাখতে হবে। ... আমার মেয়ের জন্মদিন তো ওদের কি? সবাই কাজের সাথে কাজ রাখেন । তোমাকেই বললাম বুলির জন্মদিন এর কথা । বোতল গুলো তাহলে নিয়েই যাই" মাসি কথাগুলো এক নিশ্বাসে বলে গেলেন । "thank you দাদা " বলেই হাসতে লাগলেন মাসি" এটা বুলি শিখিয়েছে "... বিতান বোকার মতো হাসি বিনিময় করে ।

মাসি চলে গেলেও দরজাটা খোলা রাখে বিতান । কাজের কথাটাই বল হল না । কাজের মাসি কি ওর ভাল হওয়ার সুযোগ টা আরেকবার নিলেন ? সবার সামনে ভাল হয়ে থাকা টা যেন বাতিক হয়ে উঠেছে ওর । কেমন একটা পরিস্কার রাখার চেষ্টা । আয়নাটা র সামনেতে একটু ঝুল মত জমেছে , সেটা হাত দিয়ে পরিস্কার করে, নিজের মুখটা দেখে । দাড়ি টা বড্ড বেড়েছে , কাটতে হবে । আজকে কি একটু বেশি পরিস্কার হওয়ার চেষ্টা করছে ও ? ভেবে একটা মুচকি হাসি দেখা দেয় ওর মুখে । অনেক বেলা হয়ে গেল । কটা বাজলো ? মোবাইল টা হাতে নেয় বিতান । ষ্টার হ্যাশ টিপতেই আনলক হয়ে গেল মোবাইল টা । কখন একটা sms এসে বসে আছে , সাইলেন্ট ছিল বলে বোঝেনি । এত সকাল সকাল কে আবার ? এবার মোবাইল টা পাল্টাতে হবে । যতক্ষণ না মেসেজ খুলছে বোঝার জো নেই কে পাঠিয়েছে । মেসেজ টা ওপেন করল সে , ক্যাপিটাল এ লেখ্হা বড় বড় করে .... "Dear customer , Airtel wishes you very very happy returns of the day "। জন্মদিন এমন একটা দিন , লোকে অজান্তে খুশি হয়ে যায় । ব্যাপারটা খুব বোকা বোকা আর যুক্তিহীন হলেও কোথা থেকে যেন একটা ভালো লাগা , একটা আনন্দ চলে আসে । ব্যাপারটা নিয়ে বিতান অনেক ভেবেছে। সব যুক্তিহীন জিনিস যে খারাপ হবে এমন মানে নেই, আর সব জায়গাতে যে যুক্তি থাকতেই হবে; মানে থাকতে হবে এটাও কেউ দিব্ব্যি দিয়ে বলে রাখেনি । দরজা খুলে ওর দৃষ্টি পার্ক এর দিকে চলে যায়.... নভেম্বর এর মাঝামাঝি এসেও শীতের সেই তেজ আর নেই। সব কেমন পিছিয়ে পিছিয়ে যাচ্ছে। মাথার ভার টাও কম লাগছে একটু। "আর দেরী না", উঠে পরে বিতান। গজল টা রি - প্লে করে towel নিয়ে বাথরুম এ ঢুকে যায়।




---

Comments