বাস স্টান্ড -তুস্টি ভট্টাচার্য্য








এই বাসস্টপে রোজ একই সময়ে দাঁড়িয়ে থাকে দাড়িওলা ছেলেটা। কাঁধে একটা ঝোলা ব্যাগ, পরনে কুর্তা আর জিন্স। একই পোশাক, একই দৃষ্টি নিয়ে উদাস মুখ করে ও দাঁড়িয়ে থাকে। একটার পর একটা বাস এসে চলে যায়, ও নড়ে না। যেন ওর কোন গন্তব্য নেই, এই দাঁড়িয়ে থাকাটাই ওর একমাত্র লক্ষ্য। সন্ধ্যে ছটা থেকে আটটা পর্যন্ত একভাবে ও দাঁড়িয়ে থাকে রোজ। কারুর সঙ্গে কথা বলে না, এমনকি ওর মোবাইলও ওরই মত চুপ থাকে।

খুব সাধারণ দেখতে একটি মেয়ে বাস ধরতে এসে ওর পাশটিতে দাঁড়ালো কিছুক্ষণ। তাকালও ওর দিকে দু একবার। কিন্তু সে তো কারুর দিকেই তাকায় না। সামনে ছড়িয়ে দেয় ওর দৃষ্টি। মেয়েটি বোধহয় একটু বেশিই অধৈর্য হয়ে পড়েছে, কিম্বা হয়ত ওর সত্যি খুব তাড়া আছে। ছেলেটির দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করল – এই যে, শুনছেন, নাগেরবাজারের মিনি টা কতক্ষণ আগে গেছে বলুন তো? প্রথমটায় ছেলেটা যথারীতি খেয়াল করে নি। তিনবারের বার বুঝল যে ওকে উদ্দেশ্য করেই এই প্রশ্ন উড়ে এসছে। থতমত ভাব নিয়ে ও বলল – না মানে, আমি লক্ষ্য করিনি আসলে। মেয়েটি ঝাঁঝিয়ে উঠল – তাহলে কি করছেন? ঘোড়ার ঘাস কাটছেন? বলেই হনহন করে অন্যদিকে হাঁটা দিল। ও ভ্যাবাচেকা খেয়ে দাঁড়াল কিছুক্ষণ, কিন্তু ওর সেই তন্ময় ভাবটা আর আসছে না যেন। উসখুস করল আরও কিছুক্ষণ, তারপর অনেক দিনের রুটিন বদলে সাতটার সময়েই ঘরে ফিরল।

বাড়ি যেতে যেতে এই প্রথমবার ও অবাক হল। আজ কেন ও তাড়াতাড়ি ফিরছে, সে নিজেই জানে না। পাশে দাঁড়ানো মেয়েটার রাগ দেখে কি? কিন্তু মেয়েটার মুখ তো ওর মনে পড়ছে না। নিজের মুখটাও দাড়ি কামানোর সময় ছাড়া দেখে না। তাও ওর ছোট্ট আয়নায় গাল দুটোর প্রতিফলনই পড়ে। দুটো তুবড়ে যাওয়া গালকে ও বিলক্ষণ চেনে। মাঝে মাঝে ওর বাবা মাকেও চিনতে পারে না। যে আধা সরকারী অফিসে ও কাজ করে, সেখানেও পাশের টেবিলের লোককে ও চেনে না। স্কুল, কলেজের কোন বন্ধু বান্ধবীর নাম বা মুখ ওর মনে নেই। নেই কোন স্মৃতি। প্রেম ওর জীবনে আসে নি, কারণ কোন মেয়ের প্রতি কোন টান ও অনুভব করে নি। আচ্ছা – ওই মেয়েটারও নিশ্চই একটা নাম আছে, একটা ঠিকানা আছে ! হয়ত এর পরে ওর পাশে এসে দাঁড়ালেও ওকে চিনতে পারবে না ও। তবু কেন জানি, আজ, এই মুহূর্তে, এখুনিই ওর নামটা জানতে ইচ্ছে করছে খুব। হয়ত নাম জানা গেলে পরের মুহূর্তেই ভুলে যাবে সব... তবু, ভয়ানক ইচ্ছে জেগেছে ওই নাম জানতে ! আজ খুব অবাক হচ্ছে ও।

বাড়ি ফিরে বড় আয়নার সামনে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখল ও। অ্যাভারেজ একটা মুখ, কোন স্পেসালিটি নেই। তবে উদাস চোখদুটোর জন্য, ওর ওই ঝোলা আর পোশাকের জন্য, ওর মধ্যে একটা কবি কবি লুক আছে। কিন্তু জীবনে সে একটা লাইনও লেখে নি। মানে লেখার কোন ইচ্ছেই নেই ওর। ওর লিখতে ইচ্ছে করে না, পড়তেও নয়। গানও শোনে না কোনোদিন। নিয়ম মত ভোরে ওঠে, মার কিছু দোকান বাজার করার থাকলে করে দেয়। তারপর অফিস, অফিস থেকে ফিরে সেই বাস স্ট্যান্ড। খেতে হয় খায়, খিদেও বেশি পায় না অবশ্য ওর। কোন বিশেষ খাবারের ওপরও লোভ নেই ওর। মাঝে মাঝে মা বিয়ে করতে বলে, অনেক সময়েই ঘ্যান ঘ্যান করে কাঁদে। ও পাত্তা দেয় না এসবে। কি পাবে বিয়ে করে? ওর যে ভাল্লাগে না এসব।

তবে আজ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে বিশ্লেষণ করতে চায় ও। ভাবে – আর যা যা সকলের ভালো লাগে, বা অন্য সবাই যেভাবে চলে ফেরে, যেভাবে নিজেদের সুখী করতে চায়, ও তা পারে না কেন? এখন তো ওর সাতাশ চলছে, এই বয়সে কি থিতু হতে হয়? ও বোঝে না ঠিক। নারীর প্রতি, ওদের সুন্দর শরীরের প্রতি ও কেন মনোযোগী হতে পারে না? অথচ ও যে নপুংসক নয়, সেটা ও জানে, বোঝে। কোন কোন রাতে ওর স্খলন তার সাক্ষী। যদিও সেই সময়ে ওর নিজেকে অপরাধী মনে হয়। পরদিন ভোরেই অবশ্য সেসব আর মনে থাকে না ওর। মনে না থাকা নিয়েও ভাবল কিছুক্ষণ ও। কেন কিছুই মনে থাকে না ওর, সে বোঝে না। তাহলে কি আজ পর্যন্ত ওর মনে দাগ কাটার মত কোন ঘটনা ঘটে নি? ওর মনে কোন দুঃখবোধ নেই, সুখবোধ নেই, কোন শূন্যতা নেই, কোন শিহরণ নেই। একটা জমাট বাঁধা রক্ত মাংস পিণ্ডের শরীর ওর, যেখানে কোন মন নেই। প্রায় রোবটের মত দেখতে হয়ে যাচ্ছে ও। এই যে আঙুল নাড়াচ্ছে, ঘাড় বেঁকাচ্ছে, হাত বাড়াল, পা ছুঁড়ল – সবই যেন রোবোটিক কায়দায়। তাহলে কি সত্যিই আর মানুষ নেই ও? কিন্তু তা কি করে হয়? একটা ভালো লাগা, একটা ভীষণ ইচ্ছে, একটা প্রচণ্ড তাগিদ ও অনুভব করে সারাদিন। একমাত্র ওই বাসস্ট্যান্ডই ওকে টানে।

সকালে ঘুম থেকে উঠেই ও ভাবে, এই তো আর একটা দিন এসে গেছে। আরও একটা সন্ধ্যে এসে পড়বে কিছুক্ষণ বাদেই। আবার যাবে সে সেখানে, যেখানে লুকিয়ে আছে ওর প্রাণ ভোমরা, ওর আরাম আয়েশ সুখ দুঃখ, সব সব কিছু। এত কিছু ও সত্যিই ভাবে না অবশ্য, ও সকালে চোখ খুলেই বাস স্ট্যান্ডটা দেখতে পায়, তারপর ব্রাশ করে, বাজার যায়, অফিস যায় বাস স্ট্যান্ডের কথা ভাবতে ভাবতে। বাড়ি ফিরেই চলে যায় ওখানে। ঘোর বর্ষা কিম্বা দারুণ শীত কিছুই ওকে আটকাতে পারে নি।

শুধু আজ সন্ধ্যের ঘটনায় নিয়ম ভাঙল ও। কাল থেকে বাস স্ট্যান্ডে আসা সব মেয়েদের ও খুঁটিয়ে দেখবে, যদি কাউকে কালকের মেয়েটির মত মনে হয়, ও যেচে আলাপ করবে তার সাথে। নাগেরবাজার গামী যত মিনি আছে, সব কটার সময় নির্ঘণ্ট মনে রাখবে, যাতে আর ধমকানি না খেতে হয়। আসলে একটা ভয়ের স্রোত টের পাচ্ছে ওর পায়ের তলায়। এই যে এক অপরিচিত মেয়ে ওকে হটাত ধমক দিল, যেরকম ভাবে আজকাল আর কেউ বকে না ওকে, ধমকায় না। কারণ সবাই জেনে গেছে ওকে বকে, ধমকিয়ে কোন লাভ নেই। ও বদলাবে না। ওই মেয়েটা তো ওর ধরনধারণ জানে না, জানবার কথাও নয়, জানলে নিশ্চই ওকে বকত না। এই না জানাটাই কাল করল ওর। এত ভয় কোনোদিন পায় নি ও। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছে, বুক ঢিপঢিপ করছে ওর। মনে হচ্ছে কোন এক গোপন আততায়ী ছুরি নিয়ে তাড়া করেছে ওকে। ও যতই জোরে দৌড়োয়, খুনিটা আরও বেশি জোরে দৌড়ে ওর কাছাকাছি এসে পড়ছে। হাঁফিয়ে যাচ্ছে ও, আর পারবে না ছুটতে, এবার সামনে মৃত্যু......

মুখে চোখে জল দিয়ে আয়নার সামনে থেকে সরে এলো ও। মা-বাবার ঘরে উঁকি দিয়ে দেখল, দুজনেই মগ্ন টিভিতে। মাকে ডেকে বলল – মা, খুব খিদে পেয়েছে, শিগগিরি খেতে দাও। অবাক চোখে মা ওর দিকে চেয়েই রইল... দাঁত খিঁচিয়ে উঠল ও। হাঁ করে কি দেখছ – শুনতে পাচ্ছ না নাকি আমার কথা? তড়িঘড়ি মা উঠে রান্নাঘরের দিকে চলে গেল। পিছন ফিরে আবারো তাকাল সেই অবাক চোখে। বাবা চেয়ার থেকে একবার উঠেই বসে পড়ল। আমতা আমতা করে কিছু বলতে গেল ওকে... তার আগেই ও বাবার পাশে বসে জিজ্ঞেস করল – আচ্ছা, কেন্দ্রীয় বাহিনী কি জঙ্গল মহল থেকে চলে গেছে? বাবা বিড়বিড় করে কি যেন বলল, বোঝা গেল না ঠিক। ওর চোখ এখন টিভির দিকে, রিমোটে আঙুল খেলছে।



---

Comments