আমার শহর - সম্বিত বসু

.

আমার শহর - সম্বিত বসু

আমি থাকি হাওড়া শহরে। আরও বিশদ করে বললে হাওড়া, শিবপুরে। ওই দ্বিতীয় হুগলী সেতু, যা প্রায়শই দেখা যায় টিভিতে, ক্যালেন্ডারে, সেই সেতু পেরিয়েই বাড়ি। ব্রিজ পেরোতে ভালই লাগে আমার। লাগবেনা কেন? গঙ্গা নদীর উপর দিয়ে এই ব্রিজ জুড়ে দিচ্ছে কলকাতা শহরকে। শীতকালে খুব সকালে, গোটা গায়ে কুয়াশা জড়িয়ে গঙ্গা নদীর ঘুমোনো দেখা, সেটা একটা অভিজ্ঞতা। কিংবা একটু রাত করে, গঙ্গার হাওয়া নিয়ে ছোট সাদা বাসগুলো যখন পার হয় ব্রিজ দিয়ে, আমি দূর থেকে দেখি, ওই কলকাতা শহর কি উজ্জ্বল। মাথায় কত রংবেরঙের আলো নিয়ে বেঁচে আছে। কত বড় বড় বাড়ি, কত আহ্লাদ, কত গাড়ি এই শহরের বুকের ওপর দিয়ে বয়ে যায়। আমিও যাই। তবু ফিরে আসি হাওড়া শহরে।
ব্রিজ থেকে নেমে আমার বাড়ি আসতে বেশিক্ষণ লাগে না। আমি দেখি কত দূর-দূরকার মানুষও, ব্রিজের তলার যে সাইকেল স্ট্যান্ড, সেখানে সাইকেল রেখে ছুটতে ছুটতে আসে। আমি ভাবি, আমার বাড়ি এত কাছে হওয়া সত্ত্বেও যদি বাস না ধরতে পারি টাইমে, অফিসে লেট করি রোজ, তাহলে সেটা কি উচিত হবে খুব। আমি চাই মানুষের মুখের দিকে, বিশেষ করে সোমবারে দেখি বাসের সামনে লাইনটা আরও বড় মনে হয়। বাসে উঠতে দিয়ে দেখি সিনিয়র সিটিজেন সিটে অন্য লোকজন বসে থাকে। আর সিনিয়র মানুষ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে যান। তারা উঠে যেতে বললে অসন্তুষ্ট হন যারা বসে আছেন। এদেরকে বেশিরভাগি আমি দেখি সকালে বাজার যেতে, বিকেলে কুকুরকে নিয়ে মন্দিরের রকে বসে আড্ডা মারতে। এদেরকেই দেখি বাজার করে ফেরার পথে কাগজ নিয়ে ফিরছেন। হয়ত ছেলে বিদেশে থাকে। স্ত্রী আর উনি, বারান্দায় হাল্কা রোদে দুপুরে খাওয়া-দাওয়াটুকু সেরে তারা ঘুমিয়ে পড়বেন ওই হেলানো চেয়ারে।
আমি যেখানে থাকি সেখানে দুজন পাগলও থাকে। দুজনে কখনো কথা বলে কি না জানিনা। তবে দেখেছি, আমার বাবার নাম জানে তারা। তারা বাবাকে ডাকে, বলে দু টাকা দিন, চা খাব। বাবা অনেকসময় দেন, দেনও না অনেকসময়। বাবা বলেন কি করে একজন মানুষ, এভাবে থাকতে পারে ভাবলেই অবাক লাগে। ওদের কোন রোগ হ্য় না? চান করে না? দাঁত মাজে না, অথচ বেঁচে আছে। কি অদ্ভুত! আমি জানলা দিয়ে প্রায়শই এই পাগলকে দেখতে পাই, যখন আমি সুমনের গান শুনি। একদিন সুমনের সেই গানটা, সাপ লুডো খেলছে বিধাতার সঙ্গে শুনছিলাম যখন, দেখতে পেইয়েছিলাম পাগলটা আমাদের সামনের পাঁচিলের গায়ে নতুন বাংলা সিনেমার পোস্টার ১০০% লাভ ওপর পেচ্ছাপ করছি। আমার মনে হয় আমাদের এই লোকদেখানো ভালবাসার চিৎকারের উপর পেচ্ছাপ করছে ঈশ্বর।
সেটা ছিল ভ্যালেনটাইন্স ডে। আর আমি চা খাচ্ছিলাম সন্ধ্যেবিকালের দিকে। মন্দিরতলার কাছেই যে মাঠ, তার কাছের এক চায়ের গুমটিতে। গুমটিতে বৌদি বসে। তার পরিবার বড়। এক মেয়ে, দুই ছেলে। সেই দেখাল বিকেল শেষের আলোয়, একটি মেয়ে এবং ছেলে প্রচণ্ড হাত পা নেড়ে কিছু বোঝাতে চাইছে। আমি দেখলাম, দেখলাম শেষ হয়ে যাওয়া আলো, যেটুকু বাকি আছে, হাত ধরে সেই আলোর দিকে তারা হেঁটে যাচ্ছে। আর অপরদিকে নতুন গড়ে ওঠা হাওড়া শহরের আভিজাত্য বাড়ানো বড়লোকের বস্তির দিকে শপিং মলের দিকে হেঁটে যাচ্ছে মিনিস্কাটের ঝাঁক। দাবাং চশমার ঝাঁক।
আগে দেখতাম সকালবেলা করে কর্পোরেশান থেকে ময়লা ফেলার গাড়ি আসত। বাঁশি বাজাত। মা একটা সাদা প্লাস্টিকে করে বাড়ির রোজকার ময়লা ফেলে দিতেন সেখানে, আজ কাল সেই বাঁশির আওয়াজ আর শুনতে পাই না। বাড়িতে রোববার করে আসত হিরাকাকু। সবাই মানুষ, কিন্তু সবাই চরিত্র নয়। হিরাকাকু চরিত্র ছিল। ঝুমকা গিরা রে, বড়েলি কে বাজার মে...এই গানটা তার প্রিয় ছিল বোধহয়। কারন প্রতি রোববারই দেখতাম এমনটা গাইতে গাইতে সে পাড়ায় ঢুকে পড়ত। আর বাজার ফিরতি মানুশজন। আমার বাবা, মা বারান্দায় গিয়ে দেখে নিত তাকে। দেখতাম সামনের ওই ভ্যানে করে ছাতুবিক্রেতা খরিদ্দারকে একটু বেশি মালমসলা দিয়ে বানিয়ে দিচ্ছে শরবৎ। তুলনামূলকভাবে সেদিনই সামনের পুরনো বাড়িটার গায়ে পায়রা বেশি বসত। হিরাকাকু পেশায় জমাদার। আমাদের গোটা পাড়াটাকেই জমিয়ে তুলত সেদিন।
শিবপুর বাজার একটা দেখার মত জায়গা। এখানে একেই ত নারায়ণ দেবনাথ-এর বাড়ি। তার উপর হিন্দু গার্লস স্কুল। রাস্তার উপরের ফলমূল, মাছের দোকান, শার্ট-প্যান্ট, চায়ের দোকান, স্টিলের জিনিসপত্র, ব্যাগের দোকান... লিস্ট বাড়িয়ে লাভ নেই সবই পাওয়া যাবে। এই বাজার যাওয়ার রাস্তাতেই পাওয়া যাবে ‘পাবলিক লাইব্রেরী’, সেও তো কত্তদিন আগেকার। কিন্তু এখন গিয়ে দেখি, দুচ্ছাই, কোন নতুন বই আনা নেই, কিছু নেই। কিছু মানুষ সেখানে সারাদিন আড্ডা মেরে কাটাচ্ছেন। আর কিছু মাঝবয়সী লোক, বসে বসে কোন ছোট কাগজ, ম্যাগাজিন পড়ছে। তবে মাঝে মাঝে কিছু অনুষ্ঠান এখনো লাইব্রেরী হলে হয়ে থাকে, এই যা মন্দের ভালো। কে জানে কবে টনক নড়বে লাইব্রেরী অধিকর্তাদের। অবশ্য নড়বেই বা কেন! বই-টই পড়বে কে! মাছি গোটা ১০ লোক তো আসে গড়ে। ছোটদের তো বই পড়া উঠেই গেছে। আরও বিশেষ করে বললে বাংলা বই। এমনও দেখেছি বাংলা বইয়ের ইংরাজি অনুবাদ তারা বইমেলা থেকে কিনে নিয়ে গেছে। অথচ লাইব্রেরীতে সেই বই অনেক আগে থেকেই মজুত ছিল। বাজারের খারাপ অবস্থা যদি বলতে হয়, তবে, তা রাস্তাঘাটে। রাস্তার মাঝখানে পড়ে থাকে গুচ্ছের বাঁধাকপির টুকরো, আগের দিনের ফেলনা খোসা। এইসব ডাই হয়ে থেকে আগে বিকট গন্ধ বেরোত সেখান থেকে। ইদানিং তা একটু কমেছে। তবে তা যে স্থায়ী সচেতনতা, এ বিষয়ে
নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না।
বাসের কথা বলতে গেলে বলতে হবেই মিনিবাসগুলোর কথা। হাওড়া থেকে যা পাওয়া প্রায় ভগবানদর্শনের কাছাকাছি। আমি প্রায়শই সেই বাস ফেল করি। অন্য বাস ধরে কাজিপাড়া থেকে হেঁটে বাড়ি ফিরি। দেখি ব্রিজেরই গায়ে অনেক বস্তি, অনেক সাইকেলের দোকান, অনেক জুয়াখেলার দপ্তর গড়ে উঠেছে। আর উল্টোডাঙ্গা ব্রিজ ভেঙ্গে পড়ার পর, আমি দেখি, দেখে যাই কোথাও ভাঙা নেই তো! কলকাতার সাথে এই যে সহজ যোগাযোগ তা তো এই দ্বিতীয় হুগলী সেতুর কারনেই, নইলে সেই হাওড়া ব্রিজ ধরে যেতে হত। ভাবি আমি খুব লাকি। ১৯৯২ সালে এই ব্রিজ উদ্বোধন হয়। আমার জন্ম ১৯৮৮ সালে। মাত্র চার বছর বয়স থেকেই এইসব সুবিধে উপচে পড়ছে আমার জীবনে। তবে দেখি যারা হাওড়াগামী বাসে যায় তাদের পোশাকে হাওড়া হাওড়া ভাব লেগে থাকে। পোশাকে তেমন ঝিলমিল নেই। ঘরোয়া মনে হয়। কিন্তু কলকাতাগামী বাসে উঠলে তাদেরকেই দেখি অনেক ড্রেস মেরে ওঠেন। একই মানুষ, ভোলবদল দেখে আমার বেশ মজা লাগে। ভাবি, হাওড়া শহর তাহলে আন্তরিক। তাই নিজের মতো করে হেঁটে বেড়ানো যায়। এখন হুগলী ব্রিজ পেরোতে পেরোতে আমি দেখি ওই কূলে হাওড়া ব্রিজ। টাটা করি সেই দূরের যাত্রীদের যারা কেউ বুঝতেই পারছেন না। টাটা করি পুরনো দিনকালকে, যা পায়ে দলে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি বলে ভাবছি। শুধু ভাবছি না মাইক্রোওয়েভ যে রান্নাঘরে থাকে, শিলনোড়াও থাকে সেখানে।
ছোটবেলায় বাজার যেতাম বাবার সাথে। বইয়ের দোকান থেকে বই কেনার জন্য বায়না করতাম। বাজারের ভেতর বইয়ের দোকানের নাম শিবানী বুক স্টল। সেখানে নানা রকমের বই পাওয়া যায়। পাঠ্যবইও। আমি সেই বই কিনতে এসে দেখে যেতাম সত্যজিৎ রায়, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, শিবরাম চক্রবর্তী এঁদেরকে। পরে ঠিক তাক করে থাকতাম ভালো রেজাল্টের দিকে। ফুল মার্কস পাওয়া অঙ্ক পরীক্ষার দিকে। আমার জন্মদিনের দিকে। ধীরে ধীরে সেই দোকানের সাথেও যোগাযোগ আর রইল না তেমন। এখন কলেজ স্ট্রিট-এ গিয়ে বই ঘেঁটে দেখতেই ভালো লাগে বেশি। তাছাড়া এখন কবিতার বই বেশি ভালো লাগে। আর ওই বইয়ের দোকানে কবিতার বই থাকতই না তেমন। শুধু রবীন্দ্রনাথ আর জীবনানন্দ। সেখানে ঋপন আরয, সুপ্রভাত রায়, রোহণ ভট্টাচার্য কিংবা তন্ময় রায়ের বই পাওয়া যাবে কবে, ভাবি এখন!
হাওড়া শহরে আমার সময়ে ভালো স্কুল বলতে ছিল প্রজ্ঞাননান্দ, বি ই কলেজ মডেল, হাওড়া জেলা, কাসুন্দিয়া বিবেকানন্দ। মেয়েদের স্কুলের মধ্যে ভবানী গার্লস, হিন্দু গার্লস এইসব। আমি পড়তাম প্রজ্ঞাননান্দ স্কুলে। মনে আছে, মা প্রতিদিন বেরনোর সময় ১০ টাকা হাতে দিত শুধু রিস্কা করে স্কুলে যাওয়ার জন্য, তাই দিয়ে কোনদিন রাস্তার দোকান থেকে বই কিনতাম। চটি বই, তাতে কখনো থাকত গোপাল ভাঁড়ের গপ্প, কখনো ভূতের গপ্প। মাঝেসাঝে কিশোর ভারতী কিংবা শুকতারা, আনন্দমেলাও কিনতাম। জানিনা কেন, চাঁদমামা তেমনভাবে আমাকে ছোটবেলায় টানেনি। বরং এই দশটাকা আটটাকার চটিবইগুলোই টানত বেশি। ইতিহাস বইয়ের পাতায় গুঁজে রেখে দিব্যি পড়া যেত। এখন সেইসব বইও ইতিহাস। যে বিক্রি করত তারও অনেক বয়স হয়েছিল তখনই। এখন রাস্তায় আর বসতে দেখি না। সেসবও হাওড়া শহরে ইতিহাস হয়ে গেছে হয়ত।
রবীন্দ্রজয়ন্তীতে টুকরো টুকরো পাড়া উৎসব হয়ে থাকে। আমি দেখি পাশাপাশি দুই পার্টি মাইক লাগিয়ে প্রায় যুদ্ধ লাগিয়ে দেয় প্রায়। সেখানে ছোট ছোট মেয়ে নাচ করে। মম চিত্তে... আর পুঁচকে ছেলেগুলো দেখি ‘নমচকার, কবিগুলু লবিন্দনাথ ঠাকুলের...’। আর দুরন্ত উঠতি সব মেয়ে নাচ-গান করে আর পাড়াতুতু উঠতি ছেলেপুলেরা হাঁ করে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকার সুযোগ পায় সেদিন।
তবে, এই হাওড়া শহরের গলিঘুঁজিও, এই শহরের টুকরো টুকরো ছবি। বালির স্তূপ হয়ে আছে যেখানে ডিগবাজি খেয়ে পড়ছে হাফপ্যান্ট পড়া খালিগায়ের ছেলেপুলে। দেখি পুকুরের পাশে জাহির খানের স্টাইলে ছুটে যাচ্ছে একটা ছোট্ট ছেলে। তার গায়ে টিম ইন্ডিয়ার পোশাক তো ছাই, একটা সুতোও নেই। দেখি এভাবেই সে ঝাঁপ দিচ্ছে পুকুরে। পুকুরের জল লাফিয়ে উঠছে। ছড়িয়ে যাচ্ছে চারপাশে। চারপাশ তখন শান্ত। দুপুরের ঘুম দিচ্ছে হয়ত। ওই পুকুরের জল সেই দুপুরেই খেলছে, শরীর দিয়ে বসেছে একটা ছোট্ট ছেলেকে।
আমি এসব যাই বললাম। হয়ত পশ্চিমবঙ্গের সব শহরেই হয়ে থাকে। তবু আমার হাওড়া আলাদা। আলাদা তার ভাষায়। নিজের খুঁত নিয়ে জ্বলজ্বল করছে এই শহর। আমার ঝাঁ চকচকে শহর ভালো লাগে না। খুঁত জমে জমে যে শহর বড় হয়, মাথা তোলে একদিন, আমি সেই শহরের দিকে চেয়ে থাকি। চেয়ে থাকি রিক্সাওয়ালাদের ভাষার দিকে। চেয়ে থাকি বাস ধরার ব্যাস্ততা নিয়ে যে কবি কবিতা পড়ছেন তার দিকে। গলি দিয়ে যেতে যেতে জানলার ভেতর দিয়ে দেখি হারমোনিয়াম নিয়ে সারেগামা করছে ষোড়শী। এই গান আমার শহর ছুঁয়ে থাকে। ছুঁয়ে থাকে শহরের আকাশ। মাটি। কালবৈশাখী ছুঁয়ে থাকে। আমার শহর তাই আমার মতো, আমার কথা বলে। আমার সাথে তার কথা হয়। রোজ। রোজ শহর কিছু না কিছু নতুন দেয়, আর আমার ঝুলি ভরে ওঠে অভিজ্ঞতায়, ঝুলি ভরে ওঠে বেঁচে থাকায়....

Comments