মোড়ক




সৌভিক বন্দ্যোপাধ্যায়


এক পুংশিশুর বড়ো হয়ে ওঠা
নার্সারি
শুরুতে ছিল লাল-হলুদ-সবুজ সেলোফেন পেপার, চোখে সেঁটে ধরলেই চেনা ম্যাড়ম্যাড়ে দুনিয়া বদলে বিলকুল রঙিন। এমনকী অমন দুধ শাদা টিউবলাইটও রংচঙে। একবার অদ্ভুত, ক্লাসের পেছন বেঞ্চের ছেলে একরাম, ল্যাবাক ল্যাবাক করতে করতে স্কুলে এল, অন্যদিনের মতোই। হাতে একটা মোড়কে ছোলাভাজা, মোড়কটা আসলে একটা কার্বন পেপার। বাড়িতে পইপই - কার্বন পেপার অতি খারাপ জিনিস, হাতে নিলেই সাবান দিয়ে হাত ধোওয়ার উপদেশ...
প্রাইমারি
শরৎচন্দ্রর পথের দাবীর একটা অংশ তখন পাঠ্য। একদিন টিভিতে সব্যসাচী, উত্তমকুমার স্বদেশী, বিপ্লবী। ছদ্মবেশী ফেরিওয়ালা সেজে বাদাম না ছোলা ফিরি
করতে করতে প্রচার করছেন দেশমাতার আহ্বান, সেও ওই ছোলাবাদামের মোড়কে গোপনে লেখা।
অ্যাডোলেসেন্স
নিজেকে সম্পূর্ণ অচেনা লাগার সে শুরু। গোপনাঙ্গেও ছিল এত কারিকুরি! উত্তেজনার কারণ সব সময় স্পষ্ট নয়, তবে ঘটনা ঘটছে। আর ওপরের মোড়ক থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে কে এক ভিনগ্রহী দৈত্য! এবং আগ্রহ প্রজ্ঞার শুরুয়াৎ বইকী...
গভীর গোপন
যে সময় মাধুরী তামাম দেশ মাতাচ্ছেন তাঁর ধক্‌ ধক্‌ করনে লাগা দিয়ে, তখনই কোচিং-এ একসাথে মোনালি, পুরো নাম মোনালিসা। ওর ঠিক উলটো দিকে রাজীব, রাজীবের পাশেই আমি। মোনালি নাকি রোজ রাজীবের চোখে চোখ রেখে, চোখের অনুসরণ-নীতি প্রয়োগ করে বুকের অপার ঐশ্বর্যর সূচীমুখে নিয়ে যেত। আমি বরাবরের ক্যাবলাকান্ত, পরেরদিন আমিও আপ্রাণ চেষ্টা করলাম। কত পরের দিন এল... রাজীব কতটা সমৃদ্ধ হয়েছিল বুঝিনি, তবে এই মোড়কের মর্মোদ্ধার বড়ো সহজ নয় আমার মতো পাবলিকের, এটা সহজেই বুঝেছিলাম।
জীবিকা প্রবেশ
ইন্টারভিউতে বেশ মুশকিলে পড়েছিলাম। ফ্যামিলি স্ট্যাটাস জানাবার সময় বাবা-মার পর দিদির প্রসঙ্গ আসতেই হল ফ্যাসাদ। দিদি কিছু করে না, পড়াশুনোও বেশি কিছু না, বিয়েও হয়নি তখনো... বলেছিলাম একটা এনজিও সংস্থার সাথে যুক্ত, পথশিশুদের নিয়ে কাজ করে পুরো রাজ্য জুড়ে। বিষয়টা এত কনভিন্সিং হয়ে যাবে নিজেও বুঝিনি! কথার মোড়ক সেবারের মতো কাজে লেগেছিল জব্বর।
কাগজের টোপর
এ জীবনে মোড়ক উন্মোচন নিয়ে হরিণত্বরায় তাড়াহুড়ো ঘটেছিল ফুলশয্যার রাতেই, এ বিষয়ে বিশদে না গেলেও পাঠক-পাঠিকারা রস-বঞ্চিত হবেন না জানি!
পরকীয়া
এমন মোড়ক-সর্বস্ব জিনিস দুটো হয় না। চুরি করা মহাপুণ্য, যদি না পড়ো ধরা। কেবল দড়ির ওপর ব্যালান্সের খেলাটা যত্নে-নিষ্ঠায় শিখতে হবে। তারপর, মন দে উড়ান... তবে ক্ষরণ, রক্তপাত কি থাকে না? থাক, সেসব অতিগূঢ় গোপনই থাকুক না হয়...


রাংতা মোড়া খুশি

সরোজ দরবার

১)
একটা পরিচিত জোকস দিয়েই শুরু যাক। এক ব্যক্তি দশ টাকা দিয়ে এক প্যাকেট হাওয়া কিনলেন। বাড়ি ফিরে দেখলেন তার মধ্যে দু একটা চিপসও আছে। জোকসটা এখানেই শেষ হয়ে যায়। কিন্তু আমাদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বলে, ওই ব্যক্তি(ভেরিয়েবল ধরলে যার মধ্যে আমি আপনি সবাই পড়ছি) পরদিন গিয়ে আবার ঐ প্যাকেটটাই কেনেন।একই দোকানে আর একটা চিপস বিক্রি হয়, তাতে চিপস অপেক্ষা হাওয়ার পরিমান কম, কিন্তু তিনি সেটার দিকে ফিরেও তাকান না। কারণ সেখানে প্যাকেটটা পাতি সাদা প্ল্যাস্টিকের। হাতে করে বাড়ি নিয়ে গেলে বাচ্চা ছেলেটাও ভাববে, আদতে তাঁর কোন ইয়ে নেই। ইয়ে অর্থে রুচি থেকে পয়সা খরচ করার ইচ্ছে যা কিছু হতে পারে। অর্থাৎ ওই মোড়কের মাহাত্ম্যেই ভদ্রলোকের ইয়েটা বেঁচে গেল। এখানে ইয়েটা কী? উহুঁ এত সহজে তার উত্তর নেই। বরং এই ইয়েটার জন্যেই জীবনটা দিন দিন কেমন যেন মোড়ক নির্ভর হয়ে যাচ্ছে। এই তো সেদিনও দাঁতের মাজনের উপর মোটে দুখানা লবঙ্গের ছবি থাকত। তাই দিয়ে কত শৈশব কৈশোর উতরে গেল। তারপর একদিন সকালে দেখা গেল, মাজনের গায়ে ঝকঝকে এক পাটি দাঁত না দেখালে প্রোডাক্ট আর বাজারে দাঁত ফোটাতে পারছে না। সে দাঁত সেলেবের হলে তো কথাই নেই। নিমপাতা তেতো সে নিয়ে দ্বিমত নেই, সেই নিমপাতার ছবি যদি সাবানের গায়ে থাকে স্নানটাও কেমন তেতো হয়ে যায় না কি? পরিবর্তে যদি সুদৃশ্য প্যাকেটের গায়ে টলি-বলি সুন্দরীর কোমল শরীরের আধোখানি ছবি থাকে, আহা কলঘরে কিরকম একটা রোম্যান্টিক পরিবেশ তৈরি হয় বলুন তো। এদিকে সেই কলঘরের বাইরের নিমগাছ থেকে একটা দিশি পাখি(নাম জানি না) সমানে চেঁচিয়ে যায় ওরে ওটার ৫২ শতাংশ শেয়ার বাইরের কোম্পানি কিনে রেখেছে। তোর পকেটের পয়সা লুটে নিয়ে যাচ্চে বিদেশিরা। কী বলব, হাতের সাবান যেই না গায়ের ওপর থমকে গেছে, অমনি স্পষ্ট বুঝতে পারা যায় একটা বাতাস খেলে গেল সেই গাছের পাতায় পাতায়। বেশ একটা ফরফরে আওয়াজ হল। নাহ মশাই দক্ষিণ সমীরণ নয়, সে বাতাস উদার অর্থনীতির।  
২)
কোনও এক বাতাস লেগে আমাদের আদলটাই যেন বদলে গেল। সকালে উঠিয়া আর বাজারের থলি না, বরং মনে মনে বলি, সারাদিন আমি যেন টাইয়ের নট না খুলি। আসলে তো মালটা স্যামবাজারের সসিবাবু কিংবা এঁড়েদার ঘোষাল...তার ওপর চাপিয়ে দেওয়া যাক স্ট্রাইপ দেওয়া ফর্ম্যাল। যতক্ষণ দেহে আছে ধরাচূড়া, বস যতই মাথায় টুপি পরাক, আর কলিগ কাঠি করুক, মুখ থেকে সাত চড়েও ‘শুয়োরের বাচ্চা’ বেরোবা না। বড়জোড় মিন মিন করে “সান অফ আ বিচ’ কিংবা নিদেন একটা ফেসবুকে স্ট্যাটাস তাও কাস্টোমাইজ করে। কিন্তু পাড়ার রিক্সাওলা যখন দেখবে তখন ঘুণাক্ষরেও ছোটলোকটাকে টের পাবে না। কিং সাইজ থেকে ছেড়ে দেওয়া ধোঁয়ার দিকে তাকিয়ে সে যে বলে-বাবু, কোনদিকে যাব? এই না হলে কী ইয়ে থাকে? এবং ইয়ে টা থাকল ওই মোড়কের জোরেই। অতঃপর ঘরে ফিরলে দেখা যাবে প্রাণে খুশির তুফান উঠেছে। টিভির দিকে তাকিয়ে গোটা পরিবার হাসছে। যত না হাসি, তার থেকেও বেশি হাততালির জোর নেপথ্যে। সেই কাতুকুতুতে হাসি না পেলেও হাসতে হবে। কী খুশি, কী খুশি! এরপর সপ্তাহ শেষে ছুটির দিনকে পাঠানো হবে রেস্টুরেন্টে কিংবা নলবনে। প্রেম ঘুরে বেড়াবে রবীন্দ্রতীর্থে কিংবা ইকো ট্যুরিজম পার্কে। কিন্তু ধরা যাক আজ রোববার ভেবে একটা ছুটির দিন কি দেরি করে ওঠা থেকে বাড়িতে বসে আড্ড দিয়ে কাটানো যায় না? বা নেহাতই জানালার ধারে দাঁড়িয়ে শেষ বিকেলের আলো প্রেমের চোখে এঁকে দেওয়া যায় না? যায় তো। কিন্তু তাতে যে বড় মধ্যবিত্ত টাইপ লাগে নিজেদের। আর আগের গুলো করলে বেশ উচ্চ উচ্চ ভাব। এদিকে ছিপ নিয়ে গেল কোলাব্যাঙে আর স্যালারির অর্ধেক নিয়ে গেল ইএমআই-এ। কিন্তু তাতে কী, এই যে পাড়া প্রতিবেশী, অমন হামলে পড়া চোখে যারা তাকিয়ে দেখে, তারা কি আর জানছে আসল অবস্থাখানা। দেখছে তো বাইরেটা। সুতরাং জয় বাবা মোড়কনাথ।
৩)
এরকম করতে করতে একদিন আমরা ভুলেই গেলাম আমরা আসলে কী! কীসে আমাদের খুশি, কীসে দুঃখ। কীসে প্রেম, কীসে বিরহ। কীসে আনন্দ, কীসে যাতনা। আমরা খুশি হতে ভুলে গিয়ে কেবল হাসতে থাকি। আর আমাদের মেকি হাসি ছড়িয়ে পড়ে ফেসবুকের দেওয়ালে দেওয়ালে। গম্ভীর মুখে আমরা শুধু হাসিমুখ ছবির লাইক গুনি। একদা আমাদেরও নাকি জীবন বাঁধা ছিল পাড়ার রকের কে তুমি নন্দিনি মার্কা নির্ভেজাল যাপনে। ইস রবি ঘোষের সেই নাচটাকে ভুলে গিয়ে কেন যে আমরা চ্যাটে ফ্লার্টিংটা শিখে ফেললাম। আজ আমাদের আনুরাগের তীব্রতা মাপা হয় কেবিপিএস-এর ওঠানামায় আর আমাদের বিচ্ছেদের ভিতর যোজন যোজন ভারচুয়াল দূরত্ব। আমাদের আজ আর সেই মেসমালিক তুলসি চক্রবর্তীও নেই, আর বসন্তবিলাপের সিংহবাহিনীও নেই। নেই নেই এর তালিকা যে কোথায় শেষ হবে কে জানে। কিন্তু এরকম পাতার পোশাক পরা অবস্থায় ধরা পড়ে গেলে তো চলবে না। হাড় পাঁজর সব দেখা যাবে যে। সুতরাং এর ওপর মোড়ক চাই। কফি হাউস আর তত উৎপাদনশীল না হোক, প্রতি শনিবার ঘটা করে সেখানে না গেলে যেমন কোনও কোনও বাঙালি কবি হয়ে উঠতে পারেন না, তেমনই জীবনের ওপর একটা মোড়ক না লাগালে কিছুতেই যেন আমরা নিজেদের পরিচয় দিয়ে উঠতে পারি না। আসলে কবে যে আমরা না ঘরকা, না ঘটকা হয়ে গেছি, সে খেয়াল করিনি। যখন সম্বিত ফিরেছে দেখেছি এক শিশু আমাদের দিকে আঙ্গুল তুলে জানতে চাইছে- তোর কাপড় কোথায়? খোলা হাওয়ায় কাপড় যে কোথায় উড়ে গেছে, তার খোঁজ করা দূরে থাক, তাড়াতাড়ি লজ্জা ঢাকতে আমরা শরীরের ওপর একটা মোড়ক চাপিয়ে নিয়েছি। কালে কালে আমাদের সেই আসল কাপড়টা কোথায় রোদে জলে ঝড়ে জীর্ণ হচ্ছে কে জানে। এখন এই মোড়কটাই হয়ে উঠেছে সত্যি। কোনওদিন যদি হঠাৎ সেই কাপড়টা আমরা খুঁজেও পাই, আর হয়ত নিজেদের বলে চিনতে পারব না। কেননা এতদিনে যে আমার আগামীতেও ছড়িয়ে পড়েছে এই বার্তা-সবার উপরে মোড়ক সত্য, তাহার উপরে নাই।
সত্যিই কি নাই!  

মোড়ক একাদশ

অভীক দত্ত

মোড়ক-০

“আলোকে মোর চক্ষুদুটি মুগ্ধ হয়ে উঠল ফুটি”
মানে কি? এই লাইনটার মানেটা কি? আলো তবে দায়ী না একটা ঘ্যাম টাইপ আলো এসে চোখ টোক ধাধিয়ে দিল। যাই বলুন কবিগুরু চোখ আমাদের কিন্তু একটা অদ্ভুত ব্যাপার। জ্ঞানচক্ষু বলুন আর যাই বলুন চোখটোখ না খুললে কিন্তু দেখা যায় না। মোড়কের শুরু কি তবে চোখ থেকে? কে জানে।
মোড়ক-১
হিন্দি সিনেমায় একটা সিন দেখে আমরা দীর্ঘশ্বাস ফেলি। কোন আমির বাপ তার মেয়ের জন্য একটা গাড়ি বিরাট মোড়কে করে হাজির করল। দেখেই মনে হয় ঈশ। কেউ যদি আমাকেও দিত এরকম। দেবে না যে সেটা এক্কেবারে সত্যি তবু আশায় বাঁচে চাষা। কি আর করবেন দাদা বলুন। আর বিশ্বাস করুন, মোড়কের কথা বললে প্রথমে আমার এই গাড়ির কথাই মনে হয়।
মোড়ক-২
 লজেন্স। ছোটবেলায় বাঙালপাড়ায় থাকার সুবাদে যাকে নজেন,লজেন ইত্যাদি ইত্যাদি বলতাম। সেই সময় পাঁচ পয়সা থেকে শুরু হত। এখন বললে অনেকে বিশ্বাস করবে না। কিন্তু ’৯৪-’৯৫ সালেও পাঁচ দশ পয়সায় পাড়ার মুদির দোকানে অনেক লোভনীয় জিনিসপত্র পাওয়া যেত। এক ধরণের বিস্কুট পাওয়া যেত যেটা এক পিস পাওয়া যেত। টিকটিকি লজেন্স পাওয়া যেত(এটা এখনও পাওয়া যায়), দশ পয়সায় এক ধরণের চুইয়িং গাম পাওয়া যেত যার মোড়ক ছিল সাদা রঙের। আমাদের শৈশবটা এরকম একটা সাদা রঙের মোড়কের ভেতর ছিল। যত বয়স বাড়ছে কে যেন মোড়কটা খুলে চিইউং গামের মত চিবিয়ে খাচ্ছে আমাদের। ধীরে ধীরে নীরস হয়ে যাচ্ছি চিইউং গামের মতোই। কেউ কিছু বললে মাথা গরম হয়ে যায়। মনে হয় দিয়ে দিই এক ঘা। বড় বিচ্ছিরি ব্যাপার এক্কেবারে।
মোড়ক-৩
পেন ড্রাইভ। ওই এট্টু বস্তু কত্ত কিছু কমিয়ে দিল। ক্লাস ইলেভেন থেকে দেখতে পাচ্ছি এক পেন ড্রাইভে সবিতাভাবির নাইটি থেকে নিড ফর স্পিডের ফুল ভারসান সবই লুকানো যায়। মনে আছে একবার কলেজের এক দাদার পেন ড্রাইভ খুলে কেট উইন্সলেটকে প্রথম নগ্ন অবস্থায় দেখতে পাই। উফফ। ভাবাই যায় না সে উত্তেজনা। হতচ্ছাড়া ভারতীয় সেন্সর বোর্ড কত কিছু দেখতে দেয় না। ভাগ্যিস ইন্টারনেট ছিল। আর ফাইলগুলি ছোট করার জন্য উইনজিপ। বেঁচে থাক বাপ। বেঁচে থাক।
মোড়ক-৪
ক্লাস টুয়েলভ। অঙ্ক ব্যাচের তানিয়া বাড়ির ল্যান্ড লাইনে ফোন করে বলল কি কথা আছে। বাজারে দেখা করতে গেলাম। একটা হলুদ গোলাপ দিল আর একটা মোড়কে একটা পেন। হলুদ গোলাপটা গেছে কিন্তু পেনের মোড়কটা রেখে দিয়েছি। বর্তমান প্রেমিকা এখনও জানে না জিনিসটার ব্যাপারে। ওই মোড়কটা থাকবে এখনও। কিছু কিছু মোড়ক হারাতে ভাল লাগে না। কে বলেছিল হলুদ গোলাপ বন্ধুত্বের প্রতীক। তানিয়ার এখন বিয়ে থা হয়ে একটা ছেলে হয়েছে। বন্ধুত্ব যে এককালে প্রেম ছিল সেই গোপন কথাটা সুদৃশ্য মোড়কের ভেতরেই থাক বরং।
মোড়ক-৫
এক বন্ধুর বিয়েতে কিনে দিলাম। একটা মোড়ক। তা নাকি নিয়ন্ত্রন করে জনসংখ্যা। আমরা কিনেছিলাম অবশ্য ইয়ার্কি মারতে। বন্ধুটা পেয়ে বেশ খানিকটা গাল দিল। পরে ভেবে দেখলাম ওইটুকু জিনিসের কি ক্ষমতা মাইরি। আজকাল আবার কোটি কোটি টাকা খরচ করে তৈরি হচ্ছে অ্যাড। তাতে অভিনয় করছে বিশ্বের সেরা পর্ণস্টার। তার আবার ফ্লেবারও বেরিয়ে গেছে। নিন্দুকেরা বলে অবশ্য এই ফ্লেবার ব্যাপারটা জাঙ্গিয়ার বুক পকেটের মতোই। কিন্তু সে যাই বলুক, আদতে কাজ তো হয়! কেউ কেউ গালাগাল করতেও আজকাল এর ব্যবহার করে। কেউ বেশি কিছু বললে বলে দেয় তুই তো ইয়ে ফাটা প্রোডাক্ট, চুপ থাক!
মোড়ক-৬
আমাদের মুখের হাসি। এই মাগ্যিগণ্ডার বাজারেও বেঁচে আছে।
মোড়ক-৭
জন্মদিন। ছোটবেলায় বাবা জন্মদিনে আনত কেক। তার কি মজা। আর কর্পোরেটে এখন জন্মদিনে সুদৃশ্য মোড়কে থাকে ক্রিম কেক। কেউ নাকে মাখাচ্ছে, কেউ চুলে। জিনিসটা খাবার না মাখার বোঝা যায় না। তবু জন্মদিন একটা বিশেষ দিন বলে এই আদিখ্যেতা চলছে চলবে! এক্ষেত্রে কিন্তু কেক আনার মোড়কটা না, আমাদের হিরো সেই জন্মদিনই। কারও জন্মদিন হয় কারও নয়। কেউ হয়ত জানেও না তার জন্মদিন কবে। তবুও জন্মদিনের মাহাত্ম্য শেষ হয়েও হইল না শেষ।
মোড়ক-৮
আমাদের চারপাশের লোকেরা পড়ে থাকে সব সময়। মুখোশ। খুব ভাল করে বুঝতে পারি টার্গেটটা আমিই। তবু কিছু করার থাকে না। ওই ৬ নম্বর মোড়ক মুখে ঝুলিয়ে রেখে ৮ নম্বর মোড়কের মুখোমুখি হই!
মোড়ক-৯
পৃথিবীর সব থেকে দামী মোড়ক। ওই ৯মাসে সিনেমা তৈরি হয়। আশা আকাঙ্খা সারা জীবনের জন্য।
মাতৃগর্ভ। সাধে কি কবি বলেছেন “মা তুঝে সালাম”।
মোড়ক-১০
চামড়া। এর রঙের উপর নির্ভর করে পৃথিবী চলছে। শুধু মাঝে মাঝে মনে পরে, এখনও ভারতে কালো মেয়ে জন্মালে বাবার ভুরু কুঁচকে ওঠে...
সবশেষেঃ
মোড়কের শেষ থাকে না। থাকার কথাও নয়। কাগজ প্লাস্টিক মানুষ বায়ুমণ্ডল নেতা নেত্রী বাস ট্রাম ল্যাপটপ মোবাইল মেয়ে ছেলে- সবই আসলে মোড়ক। কোনটা সুদৃশ্য কোনটা কুশ্রী। কিন্তু এই মোড়কগুলি না থাকলে বেঁচে থাকাটা কঠিনতর হয়ে উঠত। সুতরাং মাধ্যমিকে বাংলা রচনায় লেখা উপসংহারের মত লিখতেই পারি “মানবজীবনে মোড়কের ভূমিকা অনস্বীকার্য”।
বাকিটা পাঠক বিচার করুন।


জলজিরা নিয়ে সুমাহানের একটু স্বভাব সিদ্ধ টান ছিলো।

পাতাউর জামান



বি-দূষকম্‌ মূড়োকাবচনম্‌

উল্কা


ঘুম থেকে উঠে সূর্যের চাকতিপানা মুখের থেকে কিলো দেড়েক ধুমসো মেঘ কে ঠেলে সরিয়ে উবু হয়ে বসলেন রাজা বর্ষাপ্রসন্ন।দেশের নাম বর্ষাতি যদিও এখানে লোকে কখনো বর্ষাতি দেখেনি।বর্ষাতি না দেখল তো না দেখল, বয়েই গেল।এদেশে কলা গাছে কলা, আপেল গাছে আপে্‌ সুপুরি গাছে সুপুরি, ধান গাছে ধান, তুলসি গাছে তুলসি, বেল গাছে বেল, গরু গাছে বাছুর ভালই ফলছে। এদেশের নদী নীরবতী, এদেশের মাটি ফলবতী, এদেশের বাতাস বলবতী কিন্তু দেশের স্ত্রীলোকেরা সময়ে অসময়ে গর্ভবতী হয়ে পড়ছে এটা সত্যি চিন্তার বিষয়।রাজার বারো রানি তাদের নয় কন্যা তিন পুত্র।গণৎকার বলেছে বর্ষাতি ঘোর দুর্যোগের সম্মুখিন। এমন দিন আসতে চলেছে যখন দেশের প্রতি হাজার বর্গক্ষেত্রে বারোটি নয় বারো জোড়া স্ত্রী গর্ভবতী হয়ে উঠবে!আর এর নির্দিষ্ট কোনো সময় তারিখ নেই।কোন একদিন ঘুম থেকে উঠে রাজা দেখবেন বর্ষাতির সমস্ত স্ত্রীর গর্ভে ইগলু বানিয়ে বসত গেড়েছে বেশ কিছু এস্কিমো।“গ্লোবাল ওয়ার্মিং বুঝলেন মহারাজ...গ্লোবাল ওয়ার্মিং। মেরু ছেড়ে সব সাদা সাদা মানুষ গুলো লম্বা দাড়ি নিয়ে গলে যাওয়া হিমশৈলের সাথে ভাসতে ভাসতে...” না মহারাজ আর শুনতে পারেননি এই ভবিষ্যদ্বাণী। সেই থেকে রোজ সকালে নিজে হাতে করে সূর্য থেকে মেঘ সরান আবার সময় মত ঢেকে দেন যাতে মেরু গলে গোলমাল না বাঁধে।এর সাথে উবু হয়ে বসে তিনি এই সমস্যা দূর করার সুরাহা খোঁজেন।উবু হয়ে বসার যদিও বিশেষ কোন কারণ নেই আর থাকলেও সেটা জামা কাপড়ের বাইরে থেকে কেও কোনোদিন বুঝতে পারেনি।রাজবাড়ির চাকরবাকরদের কাওকে তিনি বলেছেন ওই সময় উবু হয়ে ধ্যান করেন আবার কাওকে নতুন ধর্মের প্রার্থনা পদ্ধতি।এইভাবে প্রার্থনা করলে হজম ভাল হয়।কাছের ভৃত্যদের বলেছেন রাতের স্বপ্নদোষগুণ সূর্যের রোদের সাথে বিক্রিয়া করানোর জন্য তিনি উবু হয়ে বসেন। এতে শরীরে সিংহের শক্তি আসে ও বুদ্ধি শেয়ালের মত প্রখর হয়।এসব গালগল্প সাজালেও বর্ষাপ্রসন্ন বিগত তিন বছরেও মূল সমস্যার কোনো সমাধান পাননি।সূর্য নিয়ন্ত্রণের কাজে সারাদিন ব্যস্ত থাকেন অতএব এল নাওয়া খাওয়ায় বিরতি, অনিয়মিত ঘুমম চিন্তার উঁইপোকাতে ঢিপি বানাল মগজে, ছিটকিনিতে পড়ল জং, জীবনের স্বাদ গিয়ে ঠেকল ল্যাংচা থেকে মিহি দানায়।
বর্ষাপ্রসন্নের রাজসভায় সমাধান বাতলানোর জন্য নিয়োজিত আছেন মিত্তির মশাই।তিনি সারাদিন বসে বসে বিরবির করে সমাধান ভাবে। ওনার সামনে থাকে একটা মস্ত বাঁধানো খাতা তার মধ্যে হরেক কিসিমের সমস্যার ফিরিস্তি। মাথার উপর ঝোলানো থাকে একশো, ষাট ও চল্লিশ ওয়াটের বাল্ব।মাথায় কোন রকম সমাধান এলেই উনি এই তিনটি আলোর মধ্যে যেকোনো একটি জ্বালান।জোড়াল সামাধান একশো ওয়াট।এই সমাধান ফেল করে না।ষাট ওয়াটে নব্বই শতাংশ ঠিকঠাক যায়।আর চল্লিশে পয়ত্রিশ শতাংশ।যার যেরকম সমাধান দরকার দামি থেকে কমদামি হিট থেকে ফ্লপ সব ধরনের আছে। গণৎকারের কড়া নির্দেশ এখবর যেন বর্ষাতির আর কেও জানতে না পারে তাহলেই ঘোর অনর্থ।তাই কোনোভাবেই এর সমাধান মিত্তির মশায়ের মগজে শানানো যাবেনা।সমস্যা সমাধান না হলেও বেড়ে তালগাছ হয়নি কিন্তু এভাবে চলতে থাকলে আর কিছু হোক না হোক বর্ষাপ্রসন্ন পটল তুলবেন আর রাজ্যপাট লাটে উঠবে।নিমাইদের বাড়ির মোরগটা এইমাত্র কোঁকোঁর কোঁ করে উঠল।ব্যাটা রোজ রাজবাড়ির কার্নিশে বসে অপেক্ষা করে কখন রাজামশাই মেঘ সরাবেন। আজ বোধয় অপেক্ষা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছিল।পালঙ্ক থেকে নেমে জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন বর্ষাপ্রসন্ন।ইলশেগুঁড়ির মাঠে প্রজারা রঙিন পতাকা গেঁথেছে।মেলা বসবে পাশের রাজ্য থেকেও লোকে আসবে মেলায়।নানা রকম খেলা বাজি তামাশা চলবে দিনভর।একটা মূর্তি বানানো হয়েছে বর্ষাপ্রসন্নের।সেই মূর্তির আবরণ উন্মোচন করবেন তিনি।এত আনন্দ আহ্লাদ কিন্তু বর্ষাতিকে বিপদ মুক্ত কি করে করবেন তিনি।কপাল থেকে ঘামের কণা সরিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন মহারাজ।
“মোড়ক নেবে গো মোড়ক
এ আমার ছোট্ট ঝুড়ি এতে ভাল মোড়ক আছে
এস গো দেখবে সবাই
এ মোড়ক কেমন কাজের
মোড়ক নেবে গো মোড়ক...”
বেঁটে কালো মত লুঙ্গি পরা একটা লোক মাথায় ঝুড়ি নিয়ে এসে দাঁড়াল ইলশেগুঁড়ির মাঠে।এই হুল্লোড়ে তার এই ফেরি গান কারোর কানে পৌঁছচ্ছে না। আজ মহারাজ বর্ষাপ্রসন্নের জন্মদিন তাই সারা রাজ্য মেতে উঠেছে।লাল নীল সবুজ হলুদ আবীরে ছয়লাপ বর্ষাতি।আকাশে উড়ছে রকমারি রংবাহারি ঘুড়ি।মাঠের মধ্যে বাঁধা ফুলের প্যান্ডেলে চাঁদোয়ার নিচে বসে আছেন বর্ষাপ্রসন্ন।সঙ্গে এসেছেন গণৎকার,মিত্তির মশাই, মন্ত্রীমশাই, রাজপুরোহিত। মিত্তির মশাই এখানেও নিয়ে বসেছেন সমাধান কার্যালয়।রাজা মশায়ের জন্মদিন উপলক্ষে আজ একশো ওয়াটের সমাধান পাওয়া যাবে চল্লিশ ওয়াটের দামে।বিশাল লাইন পড়েছে তার টেবিলের সামনে।নাগরদোলার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছেন গণৎকার মশাই।প্রতি এক পাক ঘুরতেই চেঁচিয়ে উঠছেন “চক্রবান দৌহিত্র কাকব্যঙ্গ কেতু...ঘুর ঘুর ঘুর ঘুর...” নাগরদোলায় ঘুরন্ত ছেলেমেয়ের দল খিল খিল করে হেসে উঠছে।মাঠের একপাশে রাজবাড়ির মাহুত পাহারা দিচ্ছে গজেশ্বরকে।সেজো রানিমার প্রিয় হাতি গজেশ্বর।প্রতিবছর জন্মদিনে বর্ষাপ্রসন্ন কোন একজন রানিমার প্রিয় প্রাণীটির পিঠে চেপে আসেন ইলশেগুঁড়ির মাঠে।গত বছর মেজরানিমার প্রিয় কাজলের পিঠে চেপে এসেছিলেন রাজা মশাই।কাজল রানিমার দুধেল গাই।বর্ষাপ্রসন্ন প্রথমে রাজি হননি কিন্তু মেজরানিমা আত্মহত্যা করবেন বলাতে হাসি মুখে কাজলের পিঠে চাপতে হয়েছিল তাকে।সে যাই হোক গজেশ্বর আসায় আজ বেশ খুশি হয়েছে ছোটছোট ছেলে মেয়েরা।গজেশ্বরের শুঁড়ে হাত বুলিয়ে চিনে বাদাম ছুঁড়ে দিচ্ছে আর সেও শুঁড় উঁচিয়ে মহানন্দে আহ্লাদি বৃংহণ ধ্বনি তুলছে।বর্ষাপ্রসন্নকে ঘিরে রয়েছে তার বারো রানি।পরমা সুন্দরী প্রত্যেকে।ঝলমল করছে দামিদামি পাথর আর সোনার অলঙ্কারে।ভৃত্যরা সামলাচ্ছে নয় রাজকন্যা ও তিন রাজপুত্রকে।রাজকন্যা রাজপুত্রের সংখ্যা আর বাড়েনি। গণৎকারের নির্দেশানুসারে বর্ষাপ্রসন্ন রানিদের সাথে একলা সময় কাটান না এবং সূর্য আড়াল হওয়ার সাথে সাথে কোন রানি দাসী বর্ষাপ্রসন্নের শয়নকক্ষে প্রবেশ করতে পারবেন না এমন নির্দেশ।সেই সময়ে শয়নকক্ষের সামনে মোতায়ন থাকে চারজন সশস্ত্র প্রহরী।রানিমাদের মনে দুঃখ কিন্তু আজ সব ভুলে চলে এসেছেন ইলশেগুঁড়ির মাঠে।ষোলকলা পূর্ণ কিন্তু বর্ষাপ্রসন্ন ডুবে আছেন সমস্যার চোরাবালিতে।মন মরা ঠোঁটে হাসি মনে খুশি নেই।
ফেরি গান থামিয়ে মাঠের মধ্যে দাঁড়িয়ে অবাক নজরে লোকটা সব দেখছিল।একটা লোক আগুনের বল নিয়ে জাগ্লিং করছে মহারাজার সামনে।হাততালি দিচ্ছেন রানিমারা।
“একটা গরু চিত হয়ে শুয়ে ছিল তার চারটে পা মাথায় দুটা কান একখান লেজ।একজন অন্ধ লোক দুধ দুইতে গেল কিন্তু দু ফোঁটার বেশি দুধ পেল না...” বড়চোঙা ওলা মাইকে এতক্ষণ নানারকম মজার কথা বলে নিজেই হেসে কুটিপাটি যাচ্ছিলেন বিদূষক।মন্ত্রীমশাইয়ের খোঁচা খেয়ে সেই মজার কথার মাঝেই বলে উঠলেন “মহারাজ বর্ষাপ্রসন্ন এবার মূর্তির আবরণ উন্মোচন করবেন।” এটিকেও মজার কথা ভেবে অনেকে হেসে হাততালি দিয়ে উঠল।
আবরণ খুলে বেরিয়ে পড়েছে বর্ষাপ্রসন্নের মূর্তি।ঠোঁটে প্রসন্ন হাসি।কিন্তু এই মূর্তি দেখে খুশি হতে পারলেন না মহারাজ।ভাস্কর্য শিল্পীদের পুরস্কৃত করলেন, প্রজাদের মিষ্টি নতুন কাপড় বিতরণ করলেন, ছোটদের জন্য নতুন পাঠশালার ছাড়পত্র দিলেন এতেও খুশি হলেন না। যত সময় যাচ্ছে ভারী হয়ে উঠছে বর্ষাপ্রসন্নের মন।এই মেলায় প্রায় যতজন প্রাপ্তবয়স্কা সক্ষম মহিলা রয়েছেন বেশিরভাগই কমবেশি গর্ভবতী নয়ত গ্যাদাবাচ্চা কোলে।স্ত্রীমৃত্যু বেড়েছে আগের চেয়ে।সত্যি অনর্থ ঘটছে রাজ্যে।আকাশের দিকে মুখ তুলে তাকালেন বর্ষাপ্রসন্ন। সন্ধ্যে গড়িয়ে আসছে,সূর্য আড়াল করতে হবে। রাজামাশাই গজেশ্বরের পিঠে চেপে রওনা দিলেন রাজমহলের দিকে।
লোকটা লক্ষ্য করছিল রাজামশাই বড্ড ভালমানুষ।অন্য রাজ্য থেকে এসেছে বলে কোন ভেদাভেদ নেই।সেও বাকি প্রজাদের মত নতুন কাপড় পেয়েছে।এত কিছু দেখতে দেখতে ভুলেই গেছিল তার রুজিরোজগারের কথা।তাই গজেশ্বরের পাশাপাশি চলতে শুরু করল রাস্তা ধরে।মাথায় ঝুড়ি বসানো ন্যাকড়া দিয়ে ঢাকা।আবার সে ধরল তার ফেরি গান-
“মোড়ক নেবে গো মোড়ক
এ আমার ছোট্ট ঝুড়ি এতে ভাল মোড়ক আছে
এস গো দেখবে সবাই
এ মোড়ক কেমন কাজের
মোড়ক নেবে গো মোড়ক...”
বেশ সুরে গায় সে।বর্ষাপ্রসন্ন ঘুরে তাকালেন লোকটার দিকে। “মোড়ক নেবেন মহারাজ হরেক রকম হরেক কাজের মোড়ক আছে।”
‘মোরগ’ অদ্ভুত তো!বর্ষাতিতে এমনভাবে কাওকে মোরগ বেচতে শোনেননি তিনি।নিশ্চয় অন্য রাজ্যের মানুষ।কি মনে হতেই মন্ত্রী মশাইকে হুকুম দিলেন লোকটাকে রাজমহলে নিয়ে আসার।
বর্ষাপ্রসন্ন সূর্য আড়াল করেই আজ দুম করে সভা ডেকে বসলেন।নতুন সমস্যা বুঝে বাল্বের সেট সাজিয়ে বসলেন মিত্তিরমশাই, মন্ত্রীমশাই সজাগ করলেন পেয়াদাদের, বিদূষক গিয়ে ভাবতে বসল সিরিয়াস জোক, গণৎকার টাকে হাত বোলাতে বোলাতে পাঁজির পা ঝেড়ে দেখে নিলেন গ্রহের দিশা দশা।লোকটা এত কাণ্ডকারখানা দেখে মাঝে মাঝে ঘাবড়ে যাচ্ছিল।সে সামান্য মোড়কওলা আর তাকে নিয়ে এমন করা হচ্ছে যেন কোন বড় আতঙ্কবাদী ধরা পড়েছে।যদিও তাকে বেঁধে রাখাও হয়নি, গারদে পোরাও হয়নি।
“তা তোমার নাম কি আসছ কথা থেকে?” লোকটাকে প্রশ্ন করলেন বর্ষাপ্রসন্ন।
“হাত জড় করে বিনীত গলায় মাথা নত করে লোকটা বলল আজ্ঞে আমার নাম কেতুশিব আসছি কিউকামরাঙা থেকে।”
নামটা শুনেই গণৎকারের হঠাৎ হেঁচকি তুলতে তুলতে সভা ছাড়ল।যেতে যেতে বলতে লাগল কাকব্যঙ্গ! কাকব্যঙ্গ।গণৎকার চলে যেতেই আবার লোকটা বলতে শুরু করল।
“আজ এখানে মেলা হয়েছিল তাই চলে এলাম কিন্তু এত চমক ঢমক দেখে স্তম্ভিত হয়ে ভুলেই গেছিলাম মোড়ক বিক্রি না হলে খাবার জুটবেনা। কিন্তু যেই না মেলা ফুরল রঙ জুড়লো মনে পড়ল আজ এক আনাও রোজগার হয়নি।”
“বাহ তবে তুমি কিউকামরাঙার লোক... তা এমন উদ্ভট জিনিস বেচলে কি করে আর রোজগার হবে বল দিকিনি।আমার প্রজা নিমাই, তারই তো খান দশেক মোরগ আছে বাড়িতে আর বর্ষাতিতে এসবের কোন অভাব নেই তাই খামোখা তোমার থেকে কেন কিনবে বল?”
“মাফ করবেন মহারাজ তবে আমি যে জিনিসটা বিক্রি করি সেটি মোরগ মানে কোন পাখি নয়।এটা মোড়ক।আমার প্রপিতামহ চক্রবান প্রথম এই মোড়কের ব্যবসা শুরু করেন কিউকামরাঙাতে।সেই থেকে চারপুরুষ ধরে চলছে আমাদের মোড়ক ব্যাবসা।”
রাজসভা গুজগুজ আওয়াজে ভরে গেল।বর্ষাপ্রসন্ন হাত তুলে এদিক ওদিক তাকিয়ে সকলকে শান্ত হতে বললেন।
“আমরা আগে এমন জিনিসের কথা কখনো শুনিনি।এই মোড়কে কি হয়?”
“মহারাজ এই মোড়কের অনেক রকম ব্যবহার আছে।মনে দুঃখ বারবার আঘাত হানছে তার জন্য আমাদের কাছে আছে ফুলঝুরিকার্ডিয়াম,নিঃশ্বাস নেওয়ার সময় বিষাক্ত ধোঁয়া ধুলো ফুসফুসে ঢুকে যাচ্ছে তার জন্য রয়েছে ফুসপ্লুরা,পড়াশুনা করার পরই বাচ্ছাদের মাথা থেকে সব বেরিয়ে দুষ্টুমি ঢুকে পড়ছে বা চোরদের সংশোধনাগার থেকে ফেরার পর আবার চুরির ইচ্ছা জাগছে এগুলোর জন্য রয়েছে ঘিলুর মোড়ক সুকর্মেনিনজেস আবার যেমন যুদ্ধের সময় বর্ম পড়েন সৈনিকেরা তেমনি বহিরাঘাত থেকে বাচাতে রয়েছে এক্স-একটোর্ডাম।এগুলো সব মোড়ক কিন্তু কেউ বুঝতে পারবে না।লাস্ট যেটা বললাম সেটা নতুন এনেছি বাজারে কেটে যাবে রক্ত বেরবে না স্টাইল।আমাদের অর্ডার দিলে সাপের মোড়ক খরগোশের মোড়ক উটের মোড়ক মানে আর যা যা হয় বানিয়ে দিই।মহারাজ আরেকটা জিনিস আমরা অন্য মানুষের চেহারার মত সেম টু সেম মোড়ক বানাতে পারি।যদিও এটা আমরা সবাইকে বানিয়ে দিই না।যুদ্ধের সময় আমাদের রাজামশাইকে দু এক পিশ করে দিয়েছি শত্রুদের মোড়ক।গুপ্তচরদের সুবিধা হয়।একটাই সমস্যা...”
সমস্যা শুনেই মিত্তির মশাই নড়ে চড়ে বসলেন।
একটু হেসে লোকটা বলল, “মোড়ক গুলো সব ইউজ অ্যান্ড থ্রো।এই আর কি... আপনাকে বললাম কারণ আপনি আমাদের রাজার আপন সহদর।”
এতক্ষণ শুনতে শুনতে বর্ষাপ্রসন্নের মুখটা হাঁ হয়ে গেছিল।এত বিশাল ব্যাপার মোড়ক এত অসাধ্য সাধন করছে।কিন্তু এসবে কি হবে তার।কিছুরই সমস্যা নেই বর্ষাতিতে আর যা সমস্যা আছে তার জন্য আছেন মিত্তির মশাই।না যা ভাবছিলেন মনের ভুল।বেকার বেকার সকলকে নিয়ে টানাটানি করলেন। সভা মুলতুবি করার আগে কেতুশিবের থাকা খাওয়ার জন্য মন্ত্রীকে বলে দিলেন বর্ষাপ্রসন্ন।
“মহারাজ শুনতে পাচ্ছেন?”
কেতুশিবের ফিসফিসানিতে চমকে উঠে বসলেন বর্ষাপ্রসন্ন।এখন মাঝরাত সেটা বলে দিল কেতুশিব।রাজা মশাই জিজ্ঞাসা করার আগেই সে বলে উঠল এই রাতবিরেতে এখানে আসার কারণ।
“মহারাজ যে মোরগ রোজ সকালে আপনার ঘুম ভাঙায় সেটা একটা মোড়ক পড়া কাক। আপনাদের নিমাই কাক পোষে মোরগের মোড়ক পরিয়ে আর তাদের ডাকতে শেখায়।একটু আগে একটা মোড়ক পরা কাক আমার জানলায় এসে বসেছিল। প্রফেশনাল চোখ তাই খপ করে ধরে মোড়ক ছাড়িয়ে দিলাম।এই দেখুন কাক টা আর এটা এর মোড়ক।” কেতুশিব বর্ষাপ্রসন্নের দিকে এগিয়ে ধরল কাক আর মোড়কটা।
“আপনি ভাবতেন আপনার রাজ্যে একটাও কাক নেই কিন্তু মহারাজ এখানে বেশির ভাগ পাখিই মোড়ক পড়া কাক।মোড়ক আপনার পছন্দ ধরে রাখতে পেরেছে।আপনি জানতেও পারেননি।এটাই আমাদের সার্থকতা। আপনার গণৎকার আর নিমাই গিয়ে কিনে আনত এই সব মোড়ক আজ সভায় চিনতে পারলাম গণৎকারকে।তাই ভিরকে গিয়ে কাকব্যঙ্গ বলতে বলতে পালিয়ে গেল।”
“মহারাজ যদি অভয় দেন একটা কথা বলি...”
কাঁপা কাঁপা গলায় কাক আর মোড়ক তার দিকে তাকিয়ে বর্ষাপ্রসন্ন মাথা নাড়লেন।
“এখানে এসে থেকেই দেখছি আপনি বড় মন মরা হয়ে রয়েছেন।কি হয়েছে মহারাজ?”
“আমি মহা বিপদে পড়েছি আমার রাজ্যে কলা গাছে কলা, আপেল গাছে আপেল, সুপুরি গাছে সুপুরি, ধান গাছে ধান, তুলসি গাছে তুলসি, বেল গাছে বেল, গরু গাছে বাছুর ভালই ফলছে। এদেশের নদী নীরবতী, এদেশের মাটি ফলবতী, এদেশের বাতাস বলবতী কিন্তু দেশের স্ত্রীলোকেরা সময়ে অসময়ে গর্ভবতী হয়ে পড়ছে আমি এটা কিছুতেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি না।নিজে প্রহরী দিয়ে বন্দি থাকি রাতে।রানি বা দাসীদের প্রবেশ নিষেধ।কিন্তু প্রজাদের কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করি।গণৎকার বলেছে এস্কিমো ইগলু বানাবে স্ত্রীদের গর্ভে।আজ হয়ত লক্ষ্য করেছ মাঠে নাগরদোলা চরবার জন্য বাচ্চার অভাব নেই বা খাবারের দোকানে।গর্ভবতী স্ত্রীরা ঘুরে বেড়াচ্ছে।সন্তান প্রসব করতে করতে অল্প বয়সে মারা যাচ্ছে তারা।” কষ্টে মাথা নিচু করে হাত দিয়ে মুখ ঢাকলেন।
“মহারাজ আমি বুঝতে পারছি এ সমস্যা আপনার প্রপিতামহের হয়েছিল। আপনার মত কষ্টে ছিলেন তিনি। তারাও কুড়ি ভাই ছিলেন তাই আমরা আপনার পাশের রাজ্যের বাসিন্দা হয়ে যাই।তখন আমার প্রপিতামহ শিখেছিলেন মোড়ক বানানো।পাশের রাজ্য থেকে একজন এসেছিলেন মোড়ক বেচতে।ঠিক আমি যেমন এসেছি এখানে।তখন আপনার পিতামহ তাকে জানান এই সমস্যা। মহারাজ সেই ব্যাক্তি এমন মোড়ক বানিয়ে দিয়েছিলেন যা এই সমস্যা দূর করে দিয়েছিল।এই জিনিস আমরাও এখন বানাতে পারি এর নাম মানবশক্তিশুক্ররোধকাডোম!এটা পৃথিবীর সেরা উপাদেয় মোড়ক।”
সেই রাতের পর থেকেই বর্ষাপ্রসন্নের মুখে ফুটে উঠল শতাব্দীর আনন্দ।ফিরে এল নিয়মিত নাওয়া খাওয়ায় প্রশান্তিময় ঘুম, ছিটকিনিতে পড়ল তেল, জীবনের স্বাদ বদলে গিয়ে এখন শুধুই ল্যাংচা।
প্রিয় পাঠক এই গল্প আমি শুনেছিলাম রাজসভার বিদূষকের কাছে।গল্পটা বলার পর সে নিজেই খুব হেসেছিল কিন্তু আমি এর কোন মাথা মুণ্ডু পাইনি।শুধু হৃদপিণ্ডের পেরিকার্ডিয়াম থেকে ছিটকে পড়া ধুকপুক নার্ভতন্তু বেয়ে এক্টোর্ডামের লোমে অভিকর্ষশুন্য হয়ে গেল।

মড়কের উৎস সন্ধানে

বিতান চক্রবর্তী

Comments