Dolchhut Printed 5th Edition - Story



গদ্য

অনিমেষকে খোলা চিঠি…। - ঋত্বিকা ভট্টাচার্য

তুমি তা জানো না কিছু, না জানিলে
  আমার সকল গান তবুও তোমারে লক্ষ্য করে

এই চিঠির মুখবন্ধে আমি কে এবং কেন জানান দিলে ভাল হত । কিন্তু তখন হয়ত প্রার্থিত এবং মার্জিত শব্দের ভীড়ে কথারা হারিয়ে যেত ।
তোমার নাম আমাকে ভাঙে । প্রতিনিয়ত । রিখটার স্কেলের সহনসীমা ছাড়িয়ে আমার শিখর, উপত্যকা, অরণ্যভূমি আভূমি চরাচর কেঁপে ওঠে তোমার নামে । যে মুহূর্তে তুমি ফেস্টুনে বাঁধছো রক্তের দাগ, যে মুহূর্তে লিখছো বন্দুকের নলই ক্ষমতার উৎস, সেই মুহূর্তে বুর্জোয়া আমি, মাল্টিপ্লেক্সের আলো আঁধারি কক্ষে সাগ্নিকের দুই হাতের মুঠোয় পায়রা সোহাগী আমি খান খান হয়ে যেতে থাকি । সাগ্নিক! নামটার মধ্যে যতই বারুদ ভরা থাক, আমি ওকে খুঁড়ে শুধু বালিই বালি পেয়েছি । চোরাবালি । ইদানীং শরীরী খেলা আর টানেনা । ওর চেয়ে বরং সংগ্রামের চোখদুটো দেখলে ইদানীং তোমার কথা মনে হয় ।
অমিত স্যারের ক্লাসে নোট নেওয়ার বদলে ওনার গলার আওয়াজ অবশ করে দেয়-আর কি আশ্চর্য এই প্রতিবারেই মানে কারো চোখ, কারো physique, কারো গলার আওয়াজ সবজায়গাতেই যেন একটুকরো করে তোমায় খুঁজে পাই আমি ।

মাধবীলতা সুন্দরী ।  তাঁকে অস্বীকার করিনা আমি । কিন্তু বলত, মাধবীলতাকে অতিক্রম করে কোন সুন্দরী কখনো কি তোমার চোখে পড়েনি অনিমেষ? মাইলো গমের রুটি খাবার জন্য, কমিউনে শস্তার তাঁতের শাড়ি পরার জন্য, এঁটোকাঁটা থেকে শুরু করে শৌচাগার পর্যন্ত জীবনে কোথাও ব্যক্তিগত তকমা না আঁটা জলপাই রং এই মেয়েটিই তোমার জীবনে নিঃশব্দ বিপ্লব, নিঃশর্ত বিপ্লব, তোমার দ্বিতীয় প্রেম ।

নাঃ তোমার কাছে আমার কোন অস্তিত্ব নেই । আমার, সাগ্নিক, সংগ্রাম .। আমাদের মত অজস্র মানুষের জন্য তোমার রয়েছে ঘৃণা । আমাদের জন্য শ্রেণীশত্রু তকমা ।সুবিধাবাদের দর্শন আমাদের মজ্জায় মজ্জায়।
কে যেন লিখেছিলেন মন বহুগামী। আমি তা বিশ্বাস করিনা। শারীরিকভাবে বহুগামিতা নিয়ে কখনই ছুৎমার্গ ছিলনা আমার, rather I enjoyed it..আশ্চর্যজনকভাবে আমার আসঙ্গপ্রাপ্ত সকল পুরুষের মধ্যেই যেন একটু করে তুমি রয়ে গেছিলে । বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য বোধ হয় একেই বলে অনিমেষ! হা হাএরা সবাই আমাকে পেয়ে ধন্য হয়ে গেছে । আমি টুকরো য়ে গেছি তোমার ঘৃণা অথবা তীব্র উদাসীনতায় .।      
        কুড়ি বছরের ওপর হয়ে গেছে, তোমার সেই উজ্জ্বল চোখদুটোর ধার কমেনি এখনো । এই দেখোনা  অনিমিখ সেন কিভাবে ঝাড়খন্ডের মত একটুকরো ভূমির সাধারণ মানুষগুলোর অধিকার নিয়ে লড়াই করে যাচ্ছেন । অনিমিখ সেন? কেমন তিনি? আর একজন অনিমেষ? কাকে ভাল বলব অনিমেষ? ভীড়ের মধ্যে একজন হতে পারা না রক্তের বিনিময়ে স্বায়ত্তশাসন?
        আগুনপাখি হতে পারিনি অনিমেষ ..কিন্তু বুকের মধ্যে সযত্নে লালিত হওয়া একটুকরো তুমি কখনো আমায় শান্তি দেয়নি.। শান্তি দেবেনা..


 “ ডক্টরসাব..জলদি আইয়ে..ভিকটিম কুছ বোলনা চাহ রহি হ্যয়..police record জরুরি হোগা । কামাল হ্যয়..এনকাউন্টার মে তো ইসকা বাকী দোস্তোকা ইন্তেকাম হো গয়া থা । ইয়ে ভী তো লগী একদম গয়ী । সির্ফ কুছ statement কে লিয়ে লাইফ সাপোর্ট….”

রাস্তা জুড়ে ফুটে আছে থোলো থোলো রক্তকরবী..বিগত কুড়ি বছরের স্মৃতির সরণি বেয়ে কোয়ান্টাম মুহূর্তগুলো ছুঁয়ে যে প্রবাহ ছুটে চলেছে তার নাম অনিমেষ.। তার নাম অনিমিখ..নামে কি আসে যায়?
শুধু গোপন চিঠিরাও অপেক্ষায় থাকে ..কোনদিন রাজপথে হাঁটবে বলে .।   

-o-


তারপর থেকে  মালতীকে আর কেউ দেখেনি - দেবাশিস কুন্ডু


||মালতীর বাড়ি||

        এটা একটা ভাড়া বাড়ি, দোতলাকোনকালে বাইরের দেওয়ালের রং সাদা ছিল এখন কী রং বলা কঠিন, তবে সাদা কালোর মাঝা মাঝি কিছু একটা হবে কিম্বা সাদাও আছে, কালোও আছে বাড়িটার একতলাটা যেরকম দোতলাটাও সেরকম, একদম একএকটা ঘর, একটা রান্নাঘর, একটা কলঘর দোতলা আর একতলার যোগ রেখেছে একখানা সিঁড়ি, অন্ধকার আর সরু
        বাড়ির একতলায় থাকে বাড়ির মালিক মালিক বললে বোধয় ছেলে বোঝায়, ছেলে নয়, একটা মেয়ে, মালতী বাপ-মা নেই, বয়স এই পঁচিশ-ছাব্বিশের আশেপাশে বাড়ির সবার রান্নাবান্না ওর রান্নাঘরেই হয়
        বাড়ির সবাই মানে মালতী বাদে অনয় প্রামানিক আর নিলয় চ্যাটার্জী এবাড়ির দোতলার ভাড়াটে নামমাত্র ভাড়া, অবশ্য  এই নিয়ে  মালতীর কোনো অভিযোগ নেই

||দুই ভাড়াটে||

        নিলয় চ্যাটার্জীঅনয় প্রামানিকের সাথে একই অফিসে  কাজ করেন, ব্যাংকের ক্লার্ক। ক্লার্ক বললেই যেমন মনে হয়, এরাও বাইরের থেকে ওই রকমই। রুক্ষ, কম কথা বলে, মুখ গুঁজে টাকা গোনে, চেক সই করে, এই আর কি! কিন্তু সে তো গেল বাইরের কথা, আদতে এরা আলাদা
        অনয় প্রামানিক যেমন, খোঁজখবর করতে ভালবাসেন , ভালো ভাষায় যাকে বলে "অনুসন্ধিৎসু" কার বাড়ি হলো, কে গাড়ি কিনলো, কে মেয়ের বিয়েতে কুড়ি ভরি সোনা যৌতুক দিল, কার মাথায় টিউমার  ধরা পড়ল, এমন ধরনের হাজার খবর অনয়বাবুর কাছে থাকে খবর যোগাড় করতে মাথাও কম খাটান না ভদ্রলোক কথা দিয়ে কথা কি করে বার করতে হয় তা এনার কাছ থেকে শেখার
        নিলয় চ্যাটার্জীর  সাথে  ফারাকটা এখানেই চোখে পড়ে যায় লোকটার আপাতদৃষ্টিতে কোনো দোষ নেই নিতান্তই গোবেচারা এক মানুষ, কারও সাতে-পাঁচে নেই, একটাও খারাপ কথা নেই মুখে মনে হয় যেন কোনো অবতার নেমে এসেছে পৃথিবীর  বুকে এটাই অস্বাভাবিক ঠেকে অনয় প্রামানিকের কাছে, আজকালকার দিনে কোনো মানুষ এত ভালো হতে পারে কি?
        নিলয়বাবুর সম্পর্কে খোঁজখবর অনেক করেছিল ওনার ঘরের আরেক বাসিন্দা বিশেষ কিছুই জানতে পারেনি, কয়েকটা  কথাই বারবার ঘুরে ফিরে আসে সবার মুখ থেকে নিলয় বাবুর আদিবাড়ি নদীয়ার কোথাও আর নাকি ভারী ভালোমানুষ অবশ্য দ্বিতীয় কথাটায় কান দেওয়ার কোনো কারণ খুঁজে পাওয়া যায়নি নিজের বলতে একখানা ট্রাঙ্ক, সেটার ভেতরে কি আছে তাও অজানা নয় অনয়বাবুর কিছু বইপত্তর, একটা ছেঁড়া গীতা, কিছু আধময়লা জামাকাপড়, একজোড়া ধোয়া পাজামা পাঞ্জাবী, আর একটা চাকা, মেশিনে যেরকম  লাগানো থাকে তেমন দাঁতওয়ালা চাকা নিশ্চয় কোথাও থেকে চুরি করেছে, সন্দেহ আরো ঘনিয়ে ওঠে

||নিলয় চ্যাটার্জীর অস্বাভাবিকত্ব||

         লোডশেডিং এখানে প্রায়ই হয় অন্ধকারে হারিকেনই ভরসা একরাত্রে রাতের খাবার দিতে মালতী এসেছিল দোতলায়, অন্ধকারে ছায়াও ঠিক মতো দেখা যাচ্ছে না, হারিকেনের আলোয় বোধয় অন্ধকারটাই আরো স্পষ্ট অবিবাহিত পুরুষদের যেমন হয় আর কি, মেয়েদের রাত্রে দেখলে মনটা একটু কেমন কেমন করে অনয় প্রামানিক  সেদিন মালতীর সাথে একটু বোধয় বেশি কথা বলে ফেলেছিলেন। ঘরের মধ্যে অন্য একটা গলা হঠা বলে উঠলো, "আমাদের আর কিছু লাগবে না, তুমি যাও" মেনে নেওয়া গেল এটা  মানুষ কোনো কারণ ছাড়াই বলে থাকতে পারে, কিন্তু  মুখের হালকা হাসিটাই বলে দিছিল, সামনের মানুষটার মন বুঝে ফেলেছেন  নিলয় চ্যাটার্জী প্রতিশোধ নেওয়ার ইচ্ছে তখন থেকেই কেমন একটা জিদ চেপে গেছিল, কিছু একটা করে নিলয় বাবুকে অপদস্থ করতেই হবে 
        অনয়বাবুর হাতঘড়িটা হঠাত করেই চুরি গেল ঘরের থেকে দিন দুপুরে! সবচেয়ে অবাক হলো মালতী, এখানে তো কখনো চুরি হয়না! অন্তত ও তো কিছু মনে করতে পারছে না অনয়বাবুও ঘন্টা খানেক মাথা গরম করে চুপ করে গেলেন দিন কয়েক পরে ধোপা এলো ময়লা জামাকাপড় নিতে, সুযোগ ছাড়লেন না অনযবাবু  কাপড় দেওয়ার নাম করে হাতঘড়িটা  আস্তে করে চালান করে দিলেন নিলয় চ্যাটার্জীর পাঞ্জাবীর পকেটে ধোপা ভারী বিশ্বাসী, ঘড়ি ঠিকই ফেরত আসবে, কোথা থেকে পাওয়া গেল সে খবরও  নিশ্চয় আনবে আর খবর এলেই জমবে নাটক, কি কি করবেন  সেই ভাবনায় মশগুল অনয়বাবুর সকাল যে কোথা দিয়ে কেটে গেল কেউ টেরই পেল না, অফিস  যাওয়ার সময় এসে গেল বাড়ি থেকে ঠিক পা টা বাড়াতে না বাড়াতেই পিছু ডাক, "দাদা, 'টা  বাজে?"
- "নটা চল্লিশ"- উত্তরটা এক মুহূর্তে মুখ দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে  চারদিকে পৃথিবীটা যেন দুলতে লাগলো, সকালের রোদ কেমন যেন বেগুনী হয়ে এলো, মাথা চেপে রাস্তার একধারে বসে পড়লেন অনয় বাবু...। ওনার বা হাতের কব্জিতে এইচ.এম.টি রোজকার মতই চকচক করছে এক মুহূর্তের জন্য সেই  মুখটা মনে হ’ল, সে নিশ্চয় এখনো ওরকম মুচকি হাসছে
        সেই থেকে অনেক ঘটনাই চোখে পড়েছে, নিলয়বাবু  পৈতে থাকা সত্ত্বেও গন্ডুষ করেন না, রাত্রে গীতা পাঠ নিয়ম করে, ওদিকে রান্নার লোক না এলে অন্য লোক যেচে রান্না করে দিয়ে যায়, বিড়ালে মাছ নিয়ে গেলেও মাছ কম পড়ে না, মালতী অন্যের মাছ ভেবে শান্তি পায় মালতীর কাছে এগুলো মনের ভুল হলেও অনয় প্রামানিকের দৃঢ় বিশ্বাস নিলয় চ্যাটার্জী লোকটা যাদু জানে।
    

||মালতীর দিনলিপি এবং হরিহর||

         একতলার একটাই মাত্র ঘরে থেকে, একটাই কলঘর ব্যবহার করে, রোজই একই দেওয়াল, একই ছাদ দেখে মালতীর আর দিন কাটে না, বাবা-মা মারা গেছে সেই কোন কালে, দশ বারো বছর হয়ে গেল মনে হয় একা একা থাকতে ভয়ই করত দুঃসম্পর্কের মামারা দেখাশোনা করে উপরতলায় ভাড়া বসিয়ে গেছেন ব্যাংকে কাজ করে লোকদুটো দিব্যি ভালো, একটার তো সারাদিনে কোনো কথাই নেই, আরেকটা তাও গায়ে পড়ে দু একটা কথা-টথা  বলে মন্দ লাগে না বাড়িতে পুরুষমানুষ আছে এটাই স্বস্তি কিন্তু একা লাগা কি আর এভাবে কাটানো যায়
         "দিদি..। দুটো মিনিট সময় দেবেন?"- ভর দুপুরে হরিহরের প্রথম আগমন এবাড়িতে গ্রামের দিকে সাবানের কারখানা বানিয়েছে, শহরে মাল এনে রাখার জায়গা পাওয়া যাচ্ছে না গুদাম ভাড়া নেবার পয়সা নেই, মালতীর বাড়ীর সামনের ফাঁকা জায়গাটা ঘিরে  মাল রাখতে চায় আলাপটা সেখান থেকেই শুরু সেখান থেকে আসা যাওয়া, চা, আড্ডা দুপুর বেলায় একটা ছেলের সাথে একটা মেয়ের আড্ডার অবশ্যম্ভাবী পরিতি আসতে সময় লেগেছিল মাত্র সপ্তাহ দুয়েক
          হরিহর প্রতি সপ্তাহেই শনি-রবি বাদ দিয়ে দু-তিনদিন করে আসে মালতীর এখন আর অতটা একা লাগে না মাঝে মাঝে ও  দোতলায়ও ঘুরে আসে হরিহরকে নিয়ে, এটা ওটা ঘাঁটে নিলয় চ্যাটার্জীর ট্রাঙ্কও খুলেছিল একদিন একটা গীতা, জামাকাপড়, বইপত্তরের  তলায়  একটা জং ধরা চাকা, কোনকালে কোনো মেশিনে লাগানো ছিল হরিহর ওসব দেখেশুনে ফের হাত দিতে বারণ করেছিল
            দরজার  দিকে  মুখ  করা একটা আয়না আছে দোতলার ঘরে, প্রায়  মানুষ সমান ভাড়া দেওয়ার পর সেটাকে আর একতলায় নামানো হয়নি মালতীর তাতে নিজেকে দেখতে খুব ভালো লাগে কিন্তু সমস্যা হচ্ছে ওখানে  মাঝে মাঝে অদ্ভূত গন্ধ পাওয়া যায়, ঠিক সকালের দিকে বাগানে ঘুরলে যেমন গন্ধ পাওয়া যায় কখনো তেমন গন্ধ, আবার কখনো বিশ্রী মাংস পচা গন্ধও আসে নাকে একা একা আর আসে না মালতী উপরে, ভয় লাগে

||যেদিন সন্ধেটা রাত হলো না||

         ব্যাংক ফাঁকা হতে চলল, প্রায় সন্ধ্যে হয়ে এসেছে জন্মাষ্টমীর আগের দিন এমনিই ভিড় কম ছিল নিলয় চ্যাটার্জী আজ আগে আগেই বেরিয়ে গেছেন দেখা দরকার লোকটা কোথায় গেল, কিন্তু হাতের কাজ কিছুতেই শেষ হয়ে উঠছে না অনয়বাবুর এক একটা সেকেন্ড পার হতে হতে এক এক ঘন্টা কাটিয়ে দিচ্ছে কোনো ব্যাপার আছে নিশ্চয়, নিলয়বাবু তো চট করে আগে বেরিয়ে যান না! কৌতূহল আর চাপতে পারলেন না অনয় প্রামানিক ব্যাংক থেকে প্রায় লাফিয়ে বেরিয়ে এলেন, খেয়াল হলো শেষ কাগজটা হাতেই রয়ে গেছে ও থাক গে, পরে ধৈর্য্য ধরে দেখে অফিসে নিয়ে আসা যাবে হাঁটা আর ছোটার মাঝখানে একধরনের পা চালিয়ে বাড়ির দিকে আসতে আসতে কতবার হোচট খেতে হলো তার ঠিক নেই, কিন্তু ওসব কোনো ব্যাপার না, তাড়াতাড়িতে অমন হয়েই থাকে।
         বাড়ির প্রায় কুড়ি গজ দুরের মোড় পেরোতেই একতলার হাট করে খোলা দরজাটা  চোখে পড়ে গেল। অজানা উত্তেজনা অনয় প্রামানিককে প্রায় উড়িয়ে নিয়ে এলো এটুকু রাস্তা। অন্ধকার সিঁড়িটা আজ যেন অন্যদিনের থেকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। দোতলার দরজাটা সেকেন্ডের ভগ্নাংশে কাছে চলে এলো। ঘরটায় তখন অদ্ভুত একটা নীলচে আলো আর ধুপের মিষ্টি গন্ধ ঘুরে বেড়াচ্ছে। সেই আলোর উত্স খুঁজতে গিয়েই অনয় প্রামানিকের সামনে ফুটে উঠলো সেই দৃশ্য, যেটা  ছিল ওনার অনেকদিনের সন্দেহ। দরজার দিকে পিছন ফিরে দাঁড়ানো লোকটার  পুরো অবয়বটাই আয়নায় দৃশ্যমান দরজার বাইরে থেকে। মাথার পেছনের উজ্জ্বল নীলাভও গোলকটা সারা ঘরকে একটা অপার্থিব আলোয় ভাসিয়ে দিচ্ছে। কাঁচের উপরে  পড়া প্রতিবিম্বটার মুখে ফিরে এসেছে সেই স্মিত হাসি, আয়নার ভেতর দিয়ে নিলয় চ্যাটার্জী একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন অনয় প্রামানিকের দিকে।
         হঠাত আকাশ ফাটানো একটা চিত্কারে ঘরটা যেন কেঁপে উঠলো, দুজনেই চমকে পেছনে তাকিয়ে দেখলেন সিঁড়ির ঠিক মুখে একটা মেয়ে জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়ছে; আর চোখের সামনে অন্ধকার ঘনিয়ে আসার আগে মালতী দেখতে পেল দোতলার দুই ভাড়াটের একজনের চারটে হাত এবং  আরেকজনের মাথায় শিং, পেছনে লেজ, আর হাতে ধরা একটা কাগজ যেটাকে অবিকল হরিহরের সাবান কারখানার ডেলিভারি স্লিপের মতো দেখতে।       


-o-


গল্প হলেও সত্যি নির্মাল্য সেনগুপ্ত

তুমি গল্প লেখ?”
হ্যা, কেন বলুন তো? গল্প লেখা কি অপরাধ?”
না না অপরাধ কেন হবে? আমার একটা গল্পের খুব দরকার। তোমার হাতে আছে কিছু?”
কেন থাকবেনা? গল্পকারের হাতে প্রচুর গল্প থাকে। অনেক অনেক গল্প।
বাহ। তো একটা গল্প আমাকে দিতে পারবে? খুব দরকার।
নিশ্চই। একটা কেন? চারটে দিতে পারব। বলুন কবে লাগবে?”
এখনই এখনই। লেখা আছে?”
নাহ। লেখার সময় পাচ্ছিনা। পেলেও লিখতে ইচ্ছে করছেনা। চাইলে মুখে বলে দিতে পারি। চলবে?”
হ্যা হ্যা চলবে। আমি লিখে নেব। কিন্তু...
না না আমার তাতে কোনো অসুবিধে নেই। শুধু আমার নামটা একটু দেবেন। আমার গল্প তো। অন্য কারোর নাম সহ্য করতে পারিনা।
হ্যা হ্যা তোমার নামই থাকবে। বল বল।
দেখুন গল্প আসলে গল্প হয়না। গল্পের সংজ্ঞা খোঁজা ভীষণ কঠিন। মাথায় কয়েকটা কবিতার লাইন আসছে। বলব?”
হ্যা বল।
কবি বলেছেন ঘোরাও তাকে, চরকিতে
নিমেষে ধ্বংস কর, অতর্কিতে,
অথবা শানিয়ে নাও পাথর পিষে
নইলে তাহা গল্প কিসের?
এমনও কথার ছলে বইতে পারো
চরকিতে ঘোরাও তাকে, রাঙ্গাও আরো
তলোয়ার পাথর পিষে নাও শানিয়ে
নিমেষে ধ্বংস কর, কলম দিয়ে...

হুমম ভালো। তা গল্পটা...
ব্যস্ত হবেননা। গল্প তো বলবই। আসলে চারটেই বলতে হবে। ধৈর্য্য থাকবে?”
চেষ্টা করব। কথা দিতে পারছিনা।
নাহ কথা দেওয়ার দায়িত্ব আমার। গল্পটা চারজনের। এক এক করে বলি?”
হ্যা বল।
প্রথম গল্পটা হরিপদ ঘোষদস্তিদারের। হরিপদবাবু খুব সাদামাটা লোক ছিলেন। ওই গানটার মতন। রোজ সকালে বউএর কথামত বাজারে যেতেন। বউ যা যা বলে দিত তার বাইরে কিচ্ছুটি কিনতেননা। কড়া আদেশ ছিল ফর্দতে যা লেখা থাকবে তাই আনতে হবে। তিনি প্রতিদিন তেমনই বাজার করে আনতেন। খুব শান্তিতে ছিলেন তিনি।
তারপর?”
বলছি। বাজারের সবাই জানত তিনি বউ এর দেওয়া ফর্দের বাইরে কিচ্ছু কিনবেননা। একদিন এক সবজীওয়ালা একটা মজা করে বসল। ইংরেজীতে যাকে বলে প্র্যাঙ্ক।
কি? কি?”
সবজীওয়ালা ফর্দমত একটা শালগম আর একফালি কুমড়ো থলিতে ভরতে ভরতে হাসিমুখে বলে উঠল জানেন হরিবাবু এই যে শাকটা দেখছেন এটা সাধারন শাক নয়, এটা খেলে শরীর তিনগুন বেড়ে ওঠে, হাতের গুলি এইসা ফুলে যায়, একহাতে একটা পাঁচশ কিলোর গাড়ি চাগিয়ে তোলা যায়। বলুন তো দিই। তবে ফর্দতে লেখা নেই কিন্তু।
এক মিনিট। একটা অশিক্ষিত সবজীওয়ালার মাথায় এতো বুদ্ধি এল কিভাবে?”
সবজীওয়ালা মোটেও অশিক্ষিত নয়। মতিঝিল কলেজ থেকে বি.এস.সি। পাশ। কাজ না পেয়ে সবজী বেচছে। রঙচং মাখিয়ে সবজী বেচে এখন তার টুপাইস হয়েছে। তার মোবাইল ফোন আছে,কালার টিভি আছেসেই টিভিতে তার ইস্কুল পড়ুয়া ছেলে পপাই দ্য সেলারনামের একটা কার্টুন দ্যাখে। মাঝেমাঝে সেও দ্যাখে। সেই কার্টুন থেকেই এই ব্যাপারটা জেনে সে বুদ্ধি বের করেছে।
পপাই মানে সেই পাইপ মুখে টিংটিঙ্গে লোকটাতো যে পালংশাক খেয়ে চেহারা বানিয়ে ব্রুনো নামের দৈত্যটাকে মেরে প্রেমিকাকে বাঁচায়? আমার ছেলেও দ্যাখে। বেড়ে হয়।
হ্যা একদম সেটাই।
অ। তা হরিপদবাবু নিশ্চই সবজীওয়ালার ঢপে বিশ্বাস করলেননা?”
উহু, করলেন। ভীষণভাবে করলেন।
সেকি! উনি কি তবে শিক্ষিত নন?”
কে বলেছে? উনি বাংলায় এম.এ,পলাশপুকুর গভার্নমেন্ট কলেজে বাংলা পাস পড়ান। আসলে বউ এর কথায় উঠে বসে ওনার সাধারন বুদ্ধিতে একেবারে মর্চে পড়ে গেছে।
আচ্ছা বুঝলাম। তারপর?”
তারপর ইচ্ছাসত্ত্বেও শাকটা না কিনতে পেরে তিনি হতাশ হয়ে বাড়ি ফিরলেন। হরিপদবাবু বেঁটেখাঁটো রোগা মানুষ। সেই গানটার মতন। শক্তিশালী হওয়ার ইচ্ছা বহুদিনের। যৌবনে ব্যায়াম করার প্রচেষ্টা করে অসফল হয়েছেন লোহাগুলি ভীষণ ভারী হওয়ায়। এখন এমন দুর্দান্ত একটা সুযোগ পেয়েও হাতছাড়া হওয়ায় তিনি ভীষণ মুষড়ে পড়লেন। ওনার ঘুম উড়ে গেল। সারাদিন একই কথা ভাবতে থাকলেন। ঠিকমত খেলেননা। কলেজে পড়ানোর সময় চ্যাপটার স্কিপ করলেন। হিসি করতে ভুলে গেলেন।
তারপর?”
তারপর ধৈর্য্যের বাঁধ ভাংল। হাজার হোক মানুষ তো।
মানে শাকটা কিনলেন?”
আলবাত। এদিকে হয়েছে কি, ওনার গিন্নীর আবার শাকে অ্যালার্জী। মানে খেলেই গায়ে লাল চাকা চাকা দাগ ওঠে। শাক দেখেই তো তিনি চোখ দ্বিগুন করে চেঁচিয়ে উঠলেন। হরিপদবাবুকে এই মারেন তো সেই মারেন।
এতো ভয়ানক। তারপর কি হল?”
অগত্যা তখন তো শাক খাওয়া হলনা। কিন্তু খেতে তো হবেই। শরীর খারাপের বাহানায় তিনি সেদিন কলেজ গেলেননা। দুপুরে গিন্নীমা যেই একটু গড়িয়েছেন ওমনি হরিপদবাবু রান্নাঘরে গিয়ে শাকটা রেঁধে ফেললেন। তিনি একটু আধটু রান্নাবান্না জানতেন। তারপর সেই শাকটা একথালা ভাতের সাথে মেখে খেয়ে নিলেন।
তারপর? যখন কিছু হলনা তিনি কি করলেন?”
কে বলেছে কিছু হলনা?”
মানে?”
শাকটা খাওয়ার সাথে সাথে হরিপদবাবুর শরীরে দশটা হাতির শক্তি এল। পরীক্ষা করতে তিনি দুহাতে ভাতের থালাটা বেঁকিয়ে দিলেন। তারপর গেলেন স্ত্রীর ঘরে। শায়িত ঘুমন্ত স্ত্রীর খাটটা হাতে তুলে প্রবলভাবে ঝাঁকাতে লাগলেন। গিন্নীমা ভয় পেয়ে লাফিয়ে উঠতেই তার চোখের দিকে তাকিয়ে রইলেন হরিপদবাবু। সেই শান্ত চোখে এক বিশাল ঝড়ের আভাস।তারপর থেকে আর কোনোদিন তার জীবনে কোনো অশান্তি আসেনি। ভয়ানক শক্তিশালী হরিপদবাবু রাজার মতন বেঁচে আছেন।
মানে মানে এটা কিভাবে সম্ভব হল?! শাকটাতে সত্যিই কিছু ছিল? স্টেরয়েড বা মলিকুলার চেঞ্জ ? বা কেমিক্যাল  রিঅ্যাকশনস?”
একেবারেই না।
তাহলে কি?”
এর নাম ডাক্তারী ভাষায় ক্সিজোফ্রেনিক আনন্যচারাল বডিপাওয়ার গেইনসাইকোলজিকালি মানুষের মধ্যে একটা সুপার কনফিডেন্স এসে যায় যখন মানুষ নিজেকে কোনো সুপারন্যচারাল ক্যারেকটার ভেবে ফ্যালে। তখন এই শক্তিটা আসে।
মানে আমি যদি নিজেকে মহাশক্তিমান ভাবতে থাকি তবে অমন শক্তি পাব? তার মানে স্পাইডারম্যান,ব্যাটম্যান,শক্তিমান এগুলো সবই সত্যি শুধুমাত্র কল্পনাশক্তি প্রয়োগের ফলে?”
ওনাদের কথা বা আপনার কথা জানিনা। তবে হরিপদবাবুর ক্ষেত্রে হয়েছিল।
ধুত এমন হয় নাকি? সব গাঁজা।
যা ভাববেন।
আর গল্প আছে?”
নিশ্চই। আরোও তিনটে।
বল, শুনি।
আচ্ছা আপনার কি মনে হয় সব গল্পই মিথ্যে হয়?”
বেশিরভাগই। তাইতো তাকে গল্প বলে।
হয়তো তাই। গল্প মিথ্যে হয়। কবিতাও মিথ্যে হয়। একটা কবিতা আবার মাথার চারিদিকে ঘোরাফেরা করছে।
তবে কবিতাটাই আগে শোনাও।
শুনবেন?”
হুমম।
হে পাষান, মেখেছ ধুলিকণা
মেঘের উৎসকালে
যেভাবে বজ্র সহকারে
ভোরের গাত্র পোড়ালে
ফুরায়ে গেছে সে পাহাড়
অন্তিমে সাদা ধবধবে
এতো চাদর নয়, মায়ার ঘনজাল
পৌছলে নীরবে পথিক
তিষ্টক্ষণকাল
সেথায় মাটির প্রলেপ
পরেনি কখনও
প্রতিমা সাজেনি কখনও
দেখেছ কি অধরা চিত্তে
অন্ধকার কেহ
আকাশপানেতে হেঁটে চলে
আমার মৃতদেহ...
এবারের গল্পটা কি মৃত্যু নিয়ে?”
এক্সাক্টলি। কিভাবে বুঝলেন?”
ওই একভাবে। এবার গল্পটা শোনালে ভালো হয়।
হ্যা হ্যা নিশ্চই। এই গল্পটা অলোকের। অলোক ব্যাঙ্কে কাজ করে। খুব সৎ মানুষ। চারিদিকে হাজার হাজার টাকা। সে সবই তার তাচ্ছিল্যের বস্তু। কোনোদিন একটু ঘেঁটে দেখারও ইচ্ছে হয়নি তার।  অলোকের বউ সোমা। তাদের প্রেম করে বিয়ে। তারা খুব সুখী। একে অপরকে ভয়ানক ভালোবাসে। সপ্তাহান্তে রেস্টুর্যাঅন্টে খেতে যায়। রাতে তুমুল সেক্স করে। টাকাপয়সারও কোনো অভাব নেই।
বুঝলাম। গল্পটা কি?”
মুশকিল শুধু একটা জায়গাতেই। সে হচ্ছে অশোক।
কে অশোক? সোমার কোনো অ্যাডমায়ারার?”
উহু।
অলোকের ভাই বা বন্ধু?”
নাহ।
তবে কে?”
অলোক নিজেই।
মানে অলোকের ব্যাপারটা ভীষণই আলাদা। আর পাঁচটা মানুষের মতন নয়। দেখুন, আমাদের দেহে একটাই প্রাণ থাকে। দেহ সেটাই বহন করে বেড়ায়। জীবনের শেষে সেটা বেড়িয়ে যায়। আর আমরা মরে যাই। কিন্তু অলোকের ঘটনাটা একটু আলাদা। তার দেহে দুটো প্রাণ। অলোক এবং অশোক।
সে আবার হয় নাকি? এতো মানসিক রোগীর হয়। মানে স্পলিট পার্সোনালিটি।
একটু ভুল করছেন। সেক্ষেত্রে একজন মানুষ নিজেকেই আরেকটা চরিত্র ভেবে বসে। অবচেতন মন সেটা মেনে নেয়। এটা অশুখ। কিন্তু অলকেরা সম্পুর্ন আলাদা দুজন মানুষ। শুধু দেহটা দুর্ভাগ্যক্রমে একই পেয়ে গেছে। আপনি ভুডুকথাটা শুনেছেন?”
শোনা শোনা লাগছে।
এটা আফ্রিকান আমেরিকান ফোক ম্যাজিক। এতে দুটি দেহের প্রাণ অদলাবদলি হয়ে যায়। কিন্তু ভুডু বিশ্বাস ছাড়া হয়না। মানে ব্যাপারটাতে বিশ্বাস করতে হয়। তবেই ফলপ্রসু হয়। এই ভুডু অনেক সময় মাঝপথে কোনো কারণে আটকে যায়। সেক্ষেত্রে একটি দেহেই দুটি প্রাণ থেকে যায়। এবং অন্যটি মৃতদেহ বনে যায়। এমনই কিছু বোধহয় অলোক,অশোকদের ক্ষেত্রে ঘটেছে। কিন্তু সেটা ঠিক জানা যায়নি। আপনি ব্যাপারটাকে বিশ্বাস করছেন?”
না না একেবারেই না।
ভালো। ভুলেও করবেননা। হ্যা যা বলছিলাম। তো অলোক ভীষণই ভালো মানুষ। কিন্তু অশোকের চারিত্রিক দোষ ছিল।
যেমন?”
যেমন অশোক প্রচন্ড লোভী। তার সব মেয়েদের শরীরের প্রতি দুর্বার আকর্ষণ। খিটখিটে মেজাজ ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু মুশকিল একটাই। সেটা হল অশোকের থেকে অলোকের মনের জোর বেশি। ফলে সে না চাইলে অশোক কিছুতেই দেহটাকে ব্যবহার করতে পারেনা খুশিমতন। তাই সমাজে তাদের দেহটা অলোক নামেই পরিচিত। অশোকের কথা কেউ জানেনা, সোমাও নয়।
থেমোনা। তারপর?”
তো এইভাবেই নির্বিঘ্নে দিন চলে যাচ্ছিল। কিন্তু বিপত্তিটা ঘটল একদিন। অফিসটাইমে ব্যাঙ্কে ডাকাত পড়ল।
সর্বনাশ!
সর্বনাশ বলে সর্বনাশ! ডাকাতরা মুখে কালো কাপড় দিয়ে এসে বন্দুক বাগিয়ে ধরল ক্যাশিয়ারের দিকে। দুইজন সব গ্রাহকদের ভয় দেখাতে থাকল, আর দুজন কর্মচারীদের। ব্যাঙ্কে দুটো সেফটি অ্যালার্ম ছিল। একটা ম্যানেজারের ডেস্কের নিচে। যেটা কাজে লাগানো অসম্ভব। কারণ সেটার সামনে একজন বন্দুকধারী ডাকাত দাঁড়িয়ে আছে। আরেকটা ছিল অলোকের টেবিলের ডানদিকের দেওয়ালে। যেটা টেবিল থেকে হাত পাঁচেক দূরে।
তারপর তারপর?”
সেটা দৌড়ে গিয়ে টেপা যায়। কিন্তু কিছু দূড়েই একজন ডাকাত বন্দুক ঘাড়ে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। প্রচন্ড রিস্ক। শুরু হল ঝগড়া। অলোক আর অশোকের মধ্যে। অলোক চায় বোতামটা টিপতে, কিন্তু অশোক যেতে দেবেনা। শুরু হল ধস্তাধস্তি। দেহের ভিতর। বাইরের কেউ বুঝলনা।
তারপর কে জিতল?”
ওই যে বল্লুম অলোকের জোর বেশি। অলোকই জিতল। হটাৎ টেবিল থেকে বেড়িয়ে দৌড়তে শুরু করল বোতামটার দিকে। পৌছে গেল।বোতামটা টিপেও দিল। কিন্ত তখনই...
কি তখনই কি?”
ডাকাতটা দেখে নিল অলোককে। সোজা বন্দুক তুলে ধরল তার কপালের দিকে। একটা আওয়াজ। অলোকের রক্তাক্ত দেহ ছিটকে পড়ল মেঝেতে। সবাই ভয়ে চিৎকার করে উঠল। ঘন্টা দুয়েক পর অ্যাম্বুলেন্স এল। কিন্তু ততক্ষণে সব শেষ।
যাহ মরেই গেল? আর ডাকাতরা?”
অলোকের সাহসিকতা বেকার যায়নি। বোতামটা টেপায় পুলিশ খবর পেয়ে যায়। সবাইকে ধরে ফ্যালে। ব্যাঙ্কের কিছুই খোয়া যায়নি।
যাক তাও ভালো। কিন্তু সোমার কি হল?”
ভালোই আছে। সুখে ঘর করছে।
মানে? আবার বিয়ে করেছে?”
নাহ। আবার বিয়ে করবে কেন? যেমন ছিল তেমনই আছে।
মানে বুঝলামনা। অলোক তো মরে গেল। তাহলে আবার বিয়ে না করলে?”
অলোকই যে মরেছে সেটা তো শিওর নয়।
সে আবার কি?”
সেটাই তো । মরেছিল সেদিন একজন, সেতো ঠিকই। কিন্তু অলোক মরেছে না অশোক সেটাতো কেউ জানেনা। একটা প্রাণ গেছে। আরেকটা যে থেকে গেছে। অলোক এখনও ব্যাঙ্কে যায়। তার প্রোমোশন হয়েছে। সোমাও খুব খুশি। সুখে সংসার করছে। শুধু একটাই প্রবলেম।
কি?”
লোকটা কে? অলোক না অশোক???”
বাহ বেশ গল্প। ভাল লাগল।
আপনার কি মনে হয় এটা সত্যি গল্প?”
কি জানি, হতেও পারে।
তার মানে আপনি ভুডুতে বিশ্বাস রাখেন?”
না না তাতো বলিনি।
রাখেন রাখেন। আমি জানি। সে ছাড়ুন। পরের গল্পটা শুনবেন?”
হ্যা হ্যা বল,পরের গল্প।
দাড়ান একটা সিগারেট ধরাই। আপনি খাবেন?”
হ্যা দাও।
হুমম তো পরের গল্প একটা চোদ্দ বছরের ছেলের। নাম পদ্মলোচন। রোগা,শ্যামবর্ণ,পড়াশুনা শেখেনি, বাড়িতে বাবা আর সৎমা, বাবা মিস্তিরি, মা ঝি এর কাজ করে। পদ্মলোচন চায়ের একটা ফাস্টফুডের দোকানে বেয়ারার কাজ করে। সারাদিন বেশ খাটুনী। আগে দোকানেই শুত। কিন্তু খুব আরশোলার উপদ্রব থাকায় মালিক দুর্গাবাবু তাকে নিজের তিনতলা বাড়ির সিড়ির নিচে শোওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন দয়া করে। কাজ শেষ হলে পদ্ম মালিকের সাথেই বাড়িতে ফিরে শুয়ে পড়ে। সবই ভালো,কিন্তু একটাই প্রবলেম...
কি? ওর ভেতরেও কি অন্য কেউ আছে নাকি?”
না না। সেসব না। মুশকিলটা হল দুর্গাবাবু প্রতি শনিবার মদ খান। রবিবার দোকান থাকেনা বলে। এইসময় পদ্মকে তার ফাইফরমাস খাটতে হয়। পান থেকে চুন খসলেই মারধর করেন। একদিন হয়েছে কি, পদ্ম মদে জল একটু বেশি মিশিয়ে ফেলেছে, দুর্গাবাবু ঢোক দিতে তার মুখ বিচ্ছিরি হয়ে যায়, রাগে হাতের সামনে রাখা আলমারীর লোহার চাবি ছুড়ে মারেন পদ্মকে। চাবির তীক্ষ্ণ ডগাটা ঢুকে যায় পদ্মর ডান চোখের মনিতে। সঙ্গে সঙ্গে ফিনকি দিয়ে রক্ত।  অ্যাম্বুলেন্স, হাসপাতাল।
তারপর?”
দু হপ্তা বাদে ফেরে পদ্মলোচন।  কিন্তু ডান চোখটা নষ্ট হয়ে যায়। ডাক্তাররা সেখানে পাথর বসিয়ে দেয়। পদ্মলোচন কানা হয়ে যায়।
এটা একটা প্রবাদবাক্য আছে না?”
হবে হয়তো।
আচ্ছা তারপর?”
তারপর আবার সাধারণ জীবন চলতে থাকে পদ্মর। চোখের ব্যথা আস্তে আস্তে সেরে আসে। শুকোনোর সময় ভীষণ চুলকোত। কিন্তু চোখের ভেতরে তো আর চুলকানো যায়না, সেখানে পাথর বসানো, অতএব পদ্ম নিরুপায় হয়ে কপালের মাঝখানে চুলকোতে থাকল। কিছুদিনের মধ্যেই সেখানটাতে একটা ডিম্বাকার দাগ হয়ে গেল।
ইসস বেচারা।
সত্যি খুব কষ্টকর। এদিকে একচোখ না থাকাটা খুব অসুবিধের। ফোকাসটা ঠিকমতো হয়না, মানে অবজেক্টের পোজিশন ঠিকঠাক মেজার করা যায়না। দূরের জিনিস দেখতে খুব কষ্ট হয়। লোকের সাথে ধাক্কা খায়। এইসব। দুদিন অন্তর অন্তর পদ্ম দোকানের কাস্টোমারদের কাছে খিস্তি খেতে থাকল। দুর্গাবাবু বুঝলেন একে বিদায় করা ছাড়া উপায় নেই। এদিকে তিনিই ওকে কানা করেছেন। এরপর সেই কারণেই ছাড়িয়ে দিলে লোকে হাজারটা কথা বলবে। কাস্টোমারও কমে যেতে পারে। তিনি একটা প্ল্যান বানালেন। পদ্মকে ডাকলেন। পদ্ম কপাল চুলকোতে চুলকোতে এল। তিনি বললেন আজ তুই একটু দোকানেই শুস। বাড়িতে আজ ঝামেলা হতে পারে। আজ ক্যাশ বাড়ি নিয়ে যাবনা। দোকানেই থাকবে। পাহারা তো দিতে হবে কাউকে। বুঝেছিস? পদ্ম ঘাড় নাড়ালো। সে কপাল চুলকেই যাচ্ছে। দুর্গাবাবু ওর কপালটার দিকে তাকালেন। মধ্যিখানটা কেমন ফুলে গেছে নখের খোঁচায়। অদ্ভুত ব্যাপার হল গোল জায়গাটার একদিকে খোঁচা খোঁচা চুলের মত উঠেছে। কপালে চুল! দুর্গাবাবুর গা ঘিনঘিন করে উঠল। উফ একে ভাগাতে পারলে হয়।
কিন্তু দুর্গাবাবুর প্ল্যানটা কি ছিল?”
বলছি। প্ল্যানটা ছিল সেদিন রাতে ক্যাশবাক্সে টাকা রেখে পদ্মকে পাহারায় রেখে যাওয়া। এমনিতেই বেচারা দেখতে পারেনা। সেই সুযোগে মাঝরাতে দোকানে এসে টাকাটা তিনি ঝেড়ে দেবেন, আর পরদিন সকালে চুরির বদনাম দিয়ে পদ্মকে তাড়াবেন। বেশ বুদ্ধিসম্পন্ন ছক।
কি ঘোড়েল লোক। তারপর? প্ল্যানটা খাটল?”
রাত তখন তিনটে। একটা ১০০ পাওয়ারের টর্চ নিয়ে দোকানে পৌছলেন দুর্গাবাবু। পেছনের দরজা দিয়ে ঢুকলেন। ঘুটঘুটে অন্ধকার ভিতরটা। পায়ের ওপর দিয়ে আরশোলা ঘোরাফেরা করছে। টর্চের আলোয় ঘুমন্ত পদ্মকে দেখলেন দুর্গাবাবু। নিঃসাড়ে ঘুমোচ্ছে। ক্যাশবাক্সের দিকে এগোলেন তিনি। ড্রয়ারের চাবিটা খুললেন। হটাৎ...
কি হটাৎ কি?”
পিছন দিয়ে একটা ফ্যাসফ্যাসে আওয়াজ শুনলেন দুর্গাবাবু। পদ্মর গলার আওয়াজ।
: রাতেই টাকাটার দরকার হল বাবু?
চমকে পেছনে ফিরলেন দুর্গাবাবু। টর্চের আলো ফেললেন পদ্মর মুখের ওপর। ডান চোখের মনির জায়গায় লাগানো ধুসর রঙের পাথরটা টর্চের আলোয় ঝকঝক করছে। পদ্মর মুখে একগাল হাসি সবকটা দাঁতকে নির্লজ্জের মত দেখাচ্ছে। কিন্তু একি...
কি? কি?”
দুর্গাবাবু সবিষ্ময়ে দেখলেন পদ্মর কপালের মাঝে ঘা টা আর আগের মতন নেই। চুলগুলো পরিপাটিভাবে একটা রেখা উৎপন্ন করেছে। আর তার নিচে...
তার নিচে?”
তার নিচে একটা উলম্বভাবে থাকা চোখ। যেমন মা দুর্গার হয়। সাদা অংশটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। তার মাঝে একটা নিকশ কালো মনি। ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে তার দিকে । আর কিছু মনে নেই দুর্গাবাবুর।
মাই গড থার্ড আই!
হ্যা।
তারপর কি হল?”
ঠিক জানিনা। পদ্মর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। দুর্গাবাবু দোকান চালাচ্ছেন। তবে মদ খাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন পুরোপুরি।
হুমম, এটাও ভালো। একটু জল হবে?
নিশ্চই। এই নিন।
ধন্যবাদ। আজ তবে চলি। গল্পগুলো ভেবে দেখছি। কাজে লাগাতে পারলে জানাব।
আরে দাড়ান। চার নম্বর গল্পটা শুনে যান।
থাক অন্য কোনোদিন। এই তিনটেই বেশ ছিল।
কিন্তু চারনম্বরটা বাদে যে বাকি তিনটের মানেই থাকেনা কোনো।
তাই নাকি?”
আজ্ঞে হ্যা।
তাহলে আর কি। বসি। বল।
হ্যা এবারের গল্পটা বোধহয় নিছক গল্প নয়। কি জানি। আমি নিজেও ঠিক জানিনা।
একটু জলদি করবে? অনেক রাত হল। বারটা বাজে।
হ্যা হ্যা নিশ্চই। আরেকটু ধৈর্য্য রাখুন। শেষ হয়ে এসছে।
আচ্ছা।
হুমম এই গল্পটার চরিত্রের কোনো নাম নেই। সে অনামা। মানে কেউ কোনোদিন তাকে নাম দিতে চায়নি। লোকটা একজন লেখক। খুব একটা খারাপ সে লেখেনা। কিন্তু ওই যে, তার নাম নেই। এককালে ছিল, কিন্তু কে জানি ঝেড়ে দিয়েছে। নাম ছাড়া কি আর লেখক হওয়া যায় আপনিই বলুন। তাই সে এক রাতে ঠিক করল এই নামহীনভাবে বাঁচার কোনো মানে হয়না। তাই এবার একটাই পথ।
কি পথ?”
আর কি। সুইসাইড, আত্মহত্যা।
স্ট্রেইঞ্জ।
হ্যা তো সে ভাবতে থাকল কিভাবে মরবে। গলায় দড়ি দিয়ে মরাটা খুব কষ্টের। স্পাইনাল কর্ডটা কড়মড় করে ভাঙ্গে। বিস্কুটের মতন। শুনেছেন কখনও?”
ক্ষেপেছ নাকি?”
একবার সুযোগ পেলে শুনে দেখবেন। পৃথিবীতে এমন শব্দ আর কিচ্ছুতে হয়না। কোনো যন্ত্রের দ্বারাও সম্ভব নয়। হ্যা যেটা বলছিলাম, এছাড়া আছে বিষ। শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিষ মিশে নীল হয়ে যায়। ভগবান মহাদেবের মতন। নিজের শরীরটাকে তখন দেবতা লাগে। দেবতার মৃত্যু দেখাটা মহাপাপ কিনা বলুন?”
তা ঠিক।
এছাড়া আছে হাতের শিরা কাটা। সেটা খুব একটা কঠিন নয়, কিন্তু মুশকিল হচ্ছে ঘরে একটাও ব্লেড নেই, অগত্যা...
অগত্যা কি?”
একটা প্রবাদবাক্য আছে না কলম তলোয়ারের থেকেও বেশি ধারালো’...”
হ্যা হ্যা।
তো সে ভাবল তাই করবে। লেখকের সবথেকে বড় অস্ত্র হল কলম। সে সেটাই ব্যবহার করবে। কলমের তীক্ষ্ণ দিকটা সজোরে বসিয়ে দেবে হৃদপিণ্ডের ওপর। খুব অভিনব। কিন্তু...
কিন্তু?”
ওই যে, লেখক কলম ধরলে গল্প তো আসবেই, সে তার নাম থাক কি না থাক, তার জন্য থাকে পাঠক। কিন্তু এখানেও তার দুর্ভাগ্য। সে পেল এক শ্রোতা।
অ্যা মানে?”
শুনুন। বসুন ওখানে। তো সেই অনামা লেখক ভাবল মৃত্যুর আগে আরেকটা গল্প হোক। একটা কেন চারটে হোক। তার মধ্যে তিনটে হবে বানানো, একটা হবে সত্যি।
কিভাবে?”
দেখুন গল্প হলে তার ক্লাইম্যাক্স তো থাকতেই হবে। নইলে গল্প তো ফ্লপ। তাই সে ঠিক করল তার নামের মতন তার গল্পও শেষ হয়ে যাক তার সাথে। কিন্তু এই শ্রোতা। সে থাকলে গল্প বেঁচে থাকবে, যার লেখকের নাম অস্তিত্ব কিচ্ছু নেই, সে বড় কষ্টের বাঁচা। বউ এর পোষ্য হয়ে থাকার চেয়েও বেশি কষ্ট, শরীর শেয়ার করার চেয়েও বেশি কষ্ট, কানা হওয়ার চেয়েও বেশি...
তো কি হবে?”
তাই শ্রোতাকেও মরতে হবে গল্পের সাথে। গল্প সত্যি হয়না যে। গল্পই থেকে যায়। তাই গল্প জানুক মানুষে। সত্যি নয়, সত্যি মরে যাক, শুধু গল্প বেঁচে থাক, যার নাম আছে, অস্তিত্ব আছে, শব্দ আছে, কবিতা আছে, একটা কবিতা আসছে মাথায়। শুনবেন? না শুনলেও আমার খুব বলতে ইচ্ছে করছে। শুনুন তবে...
শরীর তবু নশ্বর
দেহের মাঝে প্রাণ
গল্প হোকনা সত্যি
তবু মিথ্যের জলযান
মিথ্যের মধ্যে বাঁচা
যত ঝলমল কবিতায়
এইবারে জ্বলবে দেহ
জ্বলে উঠবে লক্ষ চিতা
আগুন তবু নশ্বর
কিছু বৃহৎ কিছু স্বল্প
জীবন গল্প হলেও সত্যি
আর সত্যি হলেও গল্প
জীবন সত্যি হলেও গল্প
এসব সত্যি হলেও গল্প...


-o-

স্যরি সায়ন্তন ভট্টাচার্য

কিছু কিছু জিনিস ভাঙ্গার জন্যই তৈরী হয়।আমার কলেজের প্রেম,লিটল ম্যাগাজিন,রক ব্যান্ড,সেনের বাগান,অনির্বান দা...

আমি তখন কলেজে পড়ি।রোজ রাত জাগতাম।প্রথম ঘণ্টা দু-এক ফোনে প্রেম,তারপর পড়াশোনা;ভোর তিনটে,চারটে,পাঁচটা-যতক্ষন না আজান শোনা যাচ্ছে।সেদিন শীতকাল ছিল।পড়া শেষ হয়ে গ্যাছে,আজান হচ্ছে,আমাদের বাড়ির সামনের ধানক্ষেতটার ওপরে এক পলেস্তারা কুয়াশা।ঘুম আসছিল না,তাই গায়ে একটা শাল পেঁচিয়ে সাইকেলটা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম সেনের বাগানের দিকে।অনির্বান দা সবসময় বলত,"এটা খুব খারাপ যায়গা।কক্ষোনো একা আসবি না,মন খারাপ হয়ে যাবে।"

অশোকনগর শ্মশানে ইলেক্ট্রিক চুল্লী নেই,এখানে কাঠ দিয়ে ম্যানুয়ালি মানুষ পোড়ানো হয়।অনিল দা পোড়ায়-অনিল ডোম।শ্মশানের থেকে ডান দিকে একটা সুরকির রাস্তা সোজা সেনের বাগানে চলে গ্যাছে।এই রাস্তাটা ৩৬৫ দিন কাদা কাদা হয়ে থাকে,কেন কেজানে!সাইকেলে কাদা লেগে যাচ্ছে,গায়ের শালটা সামলাতে পারছি না।খুব শীত!

সেনের বাগান আসলে বাগান নয়,একটা বড়ো মাঠ,মাঠটার বাঁ পাশে একটা ঝিল আর ডান পাশে ক্ষেত।এখানে আসার প্রথম অভিজ্ঞতা আমি কোনোদিন ভুলবো না!কত ভালো ছিলাম তখন!পাশের বাড়ির কাকিমা বলেছিল শ্মশানের পাশে একটা পিকনিক স্পট আছে-প্রফুল্ল সেনের বাগান।প্রথম যেদিন গেলাম,ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়ছে।আমি মাঠের ঠিক মাঝখানে ছেঁড়া হাওয়াই চটি হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি।দেখলাম,দুর থেকে একটা লোক আমার দিকে এগিয়ে আসছে-খালি গা,লুঙ্গি পড়া,হাতে কাস্তে।আমি হঠাৎ বললাম-

"কাকু,একটু স্ট্র্যাপটা লাগিয়ে দেবে?হাঁটতে পারছি না।"

এখন ভাবি,কেন অত স্পর্ধা দেখিয়েছিলাম?লোকটা কিন্তু কিচ্ছু বলেনি,আমার চটিটা হাতে নিয়ে ঠিক করে ফেরত দিয়েছিল,আর হেসে বলেছিল,

"বাড়ি যাও,বৃষ্টি ভিজলে ঠান্ডা লাগবে।"
যাই হোক,এটা শীতকাল।পুরো ঘাস কুয়াশায় ভিজে আছে।ঝিলের জল শুকিয়ে ডোবা,চারপাশে কেউ নেই।আমি সাইকেলটা একটা গাছের সাথে ঠেঁস দিয়ে রাখলাম।তারপর ক্ষেতের দিকে হাঁটা লাগালাম।এখন সবাই আখ চাষ করছে।তোমরা কেউ আখের ক্ষেত দেখেছো?একদম ভুলভুলাইয়া'র মতো লাগে!প্রায় দেড় মানুষ লম্বা গাছ,বিরাট বিরাট পাতা আর পাতার সাইডগুলো ধারালো।আমি ক্ষেতের মধ্য দিয়ে হাঁটছিলাম আর গাছগুলোকে বাড়ি মারছিলাম-টুপ-টাপ করে শিশির পড়ছে আমার গায়ে!কি ঠান্ডা!

চশমা পড়া লোকেদের বর্ষাকালে আর শীতকালে খুব চাপ হয়!

মানে ধরো তুমি বৃষ্টি ভিজলে,চশমার কাঁচ ভিজে একসা-অথচ মুছতে পারবে না,সব কিছু ভিজে গ্যাছে যে!এটা আজো হয় আমার।আবার শীতকালে,ভোরবেলা আমি যখন পড়তে যেতাম,কান ঢাকা টুপি পড়তাম,একটা মাফলার দিয়ে নাক অবধি ঢেকে দিতাম আর তারপর সাইকেল চালাতাম।যতবার নিঃশ্বাস নিচ্ছি,কাঁচে ভেপার জমে আবছা হয়ে যাচ্ছে।হাতে গ্লাভস,সেটাও কুয়াশায় ভেজা,তাই মোছা যেত না...সরি,আখের ক্ষেতে ছিলাম।তো,আমার চশমাও পুরো ঝাপসা হয়ে গেছিল!অনেকক্ষন ধরে হুটোপুটি করার পর যখন ক্ষেত থেকে বেরোলাম,দেখলাম একটা চাষী কাকু আমার দিকে রাগী রাগী চখে দাঁড়িয়ে আছে-

"আখের ক্ষেতে কত সাপ থাকে জানো!আর কোনোদিন ঢুকবে না!"

কিছু কিছু অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে নেই,শুধু লিখে,ফেলে দিতে হয়।আমি যখন ছোটো ছিলাম,প্রচুর গল্প,কবিতা লিখতাম।তারপর গোল্ডিকে (আমার পোষা কুকুর) পড়িয়ে কাগজটাকে নৌকো বানিয়ে ভাসিয়ে দিতাম-এমনিই।ঠিক করতাম।এখন করি না।বড়ো হয়ে গেছি যে!এই যে এখন আমি সিগারেট খেতে খেতে এটা লিছি আর ভাবছি ফেলে দেবো...ফেলবো না, জানি। দলছুটে পাঠিয়ে দেব। ছোটো বেলায় মানুষের প্রসংসার লোভ থাকে না।বাকিটুকু একটু পরে লিখছি।এখন পিঙ্ক ফ্লয়েড শুনবো।

কিছু কিছু লেখার কোনো স্ট্রাকচার থাকে না,মানে থাকে না,উদ্দেশ্য থাকে না-লেখাটা ধীরে ধীরে তোমায় কবজা করে নেবে।আমি যেমন দেখতে পাচ্ছি ওপরের স্ট্যানজার শব্দগুলো আমার আঙ্গুল চেপে ধরে এসব লিখিয়ে নিচ্ছে।কোনোদিন এমন গল্প পেলাম না যেটা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেবে।একটা ঘুম পাড়ানি গন্ধ আসবে...আমার এলোমেলো চুল আরো এলোমেলো হয়ে যাবে,তারপর লেখাটা সেনের বাগান পেরিয়ে,ধানকল পেরিয়ে,শুভাষীশ দা'র ব্যাচ পেরিয়ে গোল্ডির কবরের ওপর এসে দাঁড়াবে।ওখানে একটা গন্ধরাজ গাছ আছে।অনেক অনেক ফুল ধরত এক কালে-মানে বছর চারেক আগে।গল্পটা গন্ধরাজ ফুল হয়ে গেল।গোল্ডি-আমার পোষা কুকুর,তুই কেন মরে গেলি?কান্না পাচ্ছে।এটা লিখবো না।আর লিখবো না।

shut up, shut up!

অনির্বান দা বলত,"ভদকার সাথে মিরিন্ডা দারুন জমে!একদিন তুই আর আমি খাবো।"
হাসতাম,আমি তখোনো মদ খেতাম না।
অনির্বান দার সাথে প্রথম আলাপ হয়েছিল অহর্ণিশের একটা মিটিং-এ।সবাই বুদ্ধদেব বসু সংখ্যা বে করবে বলে গভীর আলোচনায় ব্যাস্ত।হঠাৎ অনির্বান দা আমার কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলল,"সাহিত্য-সাফোকেশন হইতাসে,চল বাইরে থেকে একটা সিগারেট খেয়ে আসি।"

"ভালোবাসলেই জানে সক্কলে দীর্ঘশ্বাস নামে
রাত থেকে ভোর-ভোর থেকে রাত
নিত্য,অহর্ণিশ।
একটিই চিঠি আরো একবার ছিঁড়বার আগে লেখে
ভালো থাকা যায় কেমন করে রে?
বলে দিস...বলে দিস..."

এটা কার লেখা মনে নেই,অনির্বান দা পড়ে শুনিয়েছিল।

অনির্বান দা বিয়ে করেনি।সবাই বলত কি একটা ইতিহাস আছে।জানতে চাইনি কোনোদিন।একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম,

"অনি দা,তুমি বিয়ে করবে কবে?" অনি দা বলেছিল,

"B.A! আমি তো M.A রে! মা হওয়ার পরে কি আর বিয়ে করা যায়?"

এই লোকটা অদ্ভুত ছিল!জীবনের বেশিরভাগ সময় শ্মশানে পড়ে থাকত,অনিল দার সাথে আড্ডা মারত আর কবিতা লিখত।যেদিন অনি দা কে প্রথম সেনের বাগানে নিয়ে গেলাম,ও আমায় ওর লেখা একটা কবিতার বই গিফট করেছিল।"এসো" নাম।প্রথম পাতায় লেখা ছিল,"আমার শ্মশানকে নিজের মতো করে চিনেছে যে,সেই সায়ন কে।" কি ভালো কবিতা লেখে অনির্বান দা!

ব্লেড

"একটি ধারে প্রেম থাকে,একটি ধারে ঘৃণা
ভাছি শুধু এই আঁধারে চিনতে পারবে কি না..."

অনির্বান দার বাড়ি যেদিন প্রথম গেলাম,সেদিনই আমার হাতে "ঢোঁড়াই চরিত মানস" ধরিয়ে দিয়ে বলল,"এটা পড়বি।"
পড়েছিলাম।তারপর ধীরে ধীরে পার্থিব পড়লাম,রানু ও ভানু পড়লাম,মানবজমিন পড়লাম...এই অনির্বান দার হাত ধরেই আমার কবিতার শুরু।একদিন ওকে কি যেন একটা sms করেছি,হঠাৎ দেখি অনির্বান দার রিপ্লাই-"তুই এইমাত্র আমায় যে smsটা পাঠালি,সেটা একটা দুর্ধষ কবিতা!"
কয়েক মাস পরে দেখি smsটা অহর্ণিশে ছাপা!আমি কিছু জানতামই না...

"আবীর সিংহ পড়েছিস? পিয়াল ভট্টাচার্য? নির্মল হালদার?"
"নাহ।"
"রনজিৎ দাশ পড়েছিস?"
"আমি কবিতা বুঝি না গো!"
"তুই কুকুর খুব ভালোবাসিস না রে? এটা শোন, রনজিৎ দাশের লেখা-"

একটা কুকুর শুধু
এটুকুই ভাবতে পারে
'আমার প্রভু রোজকার মতো,
আজ বিকেলে বাড়ি ফিরবে।'

কিন্তু একটা কুকুর কখনও
ভাবতে পারে না এমন জটিল কথা, যে
'আমার প্রভু দিল্লী গেছে,
পরশু বিকেলে ফিরবে।'

কুকুরের প্রতিটি বিকেল
প্রভুর ফিরে আসার বিকেল।

সেদিনও বর্ষাকাল।আমি আর অনির্বান দা ওর ঘরে চুপ করে বসে রবীন্দ্রসংগীত শুনছি। বাইরে খুব বৃষ্টি পড়ছে! আমি সাহসে ভর করে বললাম,

"দাদা,কাউকে কোনোদিন প্রচন্ড ভালোবেসেছো?"

"বেসেছি। বুলাই। একটা ছোট্ট বাবুই পাখি।গাছ থেকে বাসাটা ভেঙ্গে মাটিতে পড়ে ছিল।ওর বাঁ দিকের ডানাটা কমজোর হয়ে গেছিল তখনই।প্ররথমে তো মা কিছুতেই রাখতে দেবে না!তারপর না...সবার কেমন মায়া পড়ে গেল ওর ওপর।বুলাই সারাদিন আমার ঘাড়ে চেপে ঘুরে বেড়াত,বাবার দাড়ি ধরে টানত,আমার সিগারেট নিয়ে পালাতো,খুব মজা করত!তিন-চার মাস বাদে,একদিন ফ্যানের ব্লেডে বাড়ি খেয়ে মরে গেল।"

আমি চুপ।কিছুক্ষন পরে অনির্বান দা বলল,

"প্রচুর লিখেছি...প্রচুর...কিন্তু জানিস তো সায়ন্তন,কোনোদিন বুলাই কে চিঠি লিখতে পারি নি।"

পাখি আমিও পুষেছিলাম।সেনের বাগানে একটা গাছের নিচে পড়ে ছিল পাখিটা।খুব অসুস্থ!ঘাড়ের কাছে ঘা হয়ে আছে।পাখিটার নাম দিয়েছিলাম "ডোডো"।কি জাত জানিনা,মাথাটা নীল ছিল।ডোডোও বাঁচেনি।
সায়ন্তন,এটা কি করছিস!অন্যদের ভালো লাগানোর জন্য এভাবে নিজের খারাপ লাগাগুলো পাবলিশ করে দিচ্ছিস!ভুলে যাস না,এটা যতক্ষন তোর কাছে,ততক্ষন ইমোশন,এরপরে পণ্য।ছিঁড়ে ফেল সব-এক্ষুনি ছিঁড়ে ফেল!

এরপর আমি অশোকনগর ছেড়ে বারাসাত চলে এলাম।সেনের বাগান গেল,অহর্ণিশ গেল,সাইকেল গেল,অনির্বান দা গেল,গোল্ডির কবর গেল,ঢোঁড়াই চরিত মানস গেল-কিন্তু আমার জঙলি মনটা গেল না।একটা ঢাউস অ্যাকুয়ারিয়াম বসালাম,ফ্ল্যাটের জানলাটা ফুলগাছে ঢেকে দিলাম,খরগোশ পুশলাম,গোটা ঘরের দেওয়াল সবুজ করে দিলাম।হয় না...এভাবে সেনের বাগান বানানো যায় না।

আমার বন্ধুরা বলে আমি ওভার-সেনসিটিভ,ছিঁচকাদুনে,ন্যাকা,স্পাইনলেস-ঠিকই বলে বোধহয়।আমি একা কিছু পারিনা।সারা জীবন কখনো একটা কুকুর,কখনো একটা মানুষ,কখনো একটা বাগান,কখনো একটা কম্যুনিটিকে আঁকড়ে ধরেছি ভালো থাকার জন্য-পারিনি।এটা আর লিখবো না। ছিঁড়ে দেবো।এই লাইনটা লিখতে লিখতেও জানিনা কি করব।তবে এখন ফেলে দেওয়ার সাহস হারিয়ে গ্যাছে।

সারাদিন ভালোই ছিলাম।সিনেমা দেখলাম,গান শুনলাম,পড়াশোনা করলাম,একটু আগে আবীর সিংহের একটা কবিতা দেখে সব এলোমেলো হয়ে গেল-

"সবাই নয়,কেউ কেউ
ভালোবেসে হাত ধরলে চোখে জল আসে"

Sorry.

-o-


পশ্চিমবঙ্গের লাশ অর্নভ

একটি রাজনৈতিক পূর্বাভাসঃ

এবার পুজোয়-
মাঝে মাঝে বজ্র-বিদ্যুত সহ গুলিবর্ষন, বিকেলের দিকে সূর্য্য ডুবতে পারে তবে সকালে ওঠার চান্স কম । শেষ লগ্নে জোটপক্ষের অধিক ব্যস্ততার দরুন বাতাসে জলীয় বাস্পের পরিমান বেশি হতে পারে, তবে বৃষ্টির সম্ভাবনা নেই।
নেতা ও নেত্রীদের ততধিক খাঁই-খাঁই ও মুদ্রাস্ফীতির ফলে “সেন’’ আদের “সেক্স’’ পড়ে যেতে পারে আর তার ফলে ‘‘ম্যাও’’ দের “হালুম” করবার প্রবতা বাড়তে পারে।
পরিতিঃ মা দুর্গার লাশে আগমন এবং লাশেই গমন!


পূনঃপ্রচার :
ক্যামেরায় লাট্টুর সঙ্গে মদন সাঁপুই
   ।।সুখে-দুঃখে ২৪.৫ ঘন্টা।।

রাজনৈতিক বক্তব্য-
“যে কোনো মৃত্যুই দুঃখের, বেদনার । আমি এর তীব্র নিন্দা করছি, দোষীরা অবশ্যই শাস্তি পাবে। তবে কি জানেন যেটি প্রচারিত হচ্ছে সেটি ঠিক নয়, উনি মানে কালু ওরফে লাল্টু বসাক আমাদের দলেরই একনিষ্ঠ কর্মী ছিল, ওরা আগে এসে লাশের দখল নিয়ে আমাদের লোকেদের ভয় দেখিয়ে তাড়িয়ে নিজেরা প্রচারে আসতে চাইছে, এই ঘটনারও আমি তীব্র থেকে তীব্রতর নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি । কালু তুমি অমর রহে, বন্দেমাতরম…”



প্রত্যক্ষদর্শীর বক্তব্য–

“আহারে পরাণ যায় গলিয়া রে, সব শালারা এক আকাশের ভালচার… মরদেহ দেখলেই হলো… খুঁটে খাওয়া অবধি no নিস্তার, byte এর পর byte দিয়েই যাবে…!”

লাশের বক্তব্য –

“বঁলি ওঁ বাঁবুরা বেঁচে থাঁকতে তোঁ সুঁখ দিঁলে নাঁ… অঁন্তত মঁরে যাঁবার পঁর শাঁন্তিতে পুঁড়তে তোঁ দিঁন! আঁর কঁতো মাঁছি তাঁড়াবেন? এঁরপর তোঁ পঁচে গঁন্ধ বেঁরোলে আঁপনারাই গাঁলাগালি কঁরবেন… অঁযথা caution money কঁমিয়ে দিঁবেন । আঁমি নাঁ হঁয় মঁরেই গেঁলুম , বাঁড়ির আঁর নোঁকগুলকে তোঁ বাঁচিয়ে রাঁখুন, বাঁচতে দিঁন ।”

পাগলের প্রলাপ–

“হুঃ সব শালা এক গোয়ালের গরু, তোমাদের চোখের সামনে চোলাইয়ের ঠেঁক, দেশী মদের ঠেঁক, অলিতে-গলিতে ,আনাচে-কানাচে  বুক চিঁতিয়ে আরও কত কিছুর মৌচাক গজিয়েছে… সে সব দেখেও না দেখার ভান করে্ চলেছ তোমরা, যেহেতু ওরা সমাজবদ্ধ জীব… কিছু তো করে খেতে হবে তাই হপ্তায়ান্তে just এক বান্ডিল বাপুজী কেক… ব্যাস বাপু ভি খুস… অওর বাপুর হাত পাখারাও খুস! হামী বড় বাবু আছি তো কি! হামী ভি বাঙ্গালী আছি…! মাইরি শালাদের মজ্জায় ঢুকে গেছে চোখ/ঘুষ-বন্দী খেলাটা। আর অই দিকে যদি কেউ গন্ডি পেড়িয়ে একটু হা করেছে… ব্যাস অমনি, তোমার নামের সামনে শ্রী চন্দ্রবিন্দুয়াএ নমঃ আর যেই তুমি একবার লাশ হলে, তখন তুমি on/off দুই camera-ই famous, তোমাকে ঘিরে কত্ত জনের টানাটানি, রিলে-রেস! তুমি দাঁত কেলিয়ে পড়ে ছিলে মানে তুমি হাসতে হাসতে শহীদের মৃত্যু বরণ করেছ, মানে কিছু জনের কাছে তুমি শহীদপন্থী, আর যদি তোমার হাত মরবার সময় একটু হলেও মুঠো হয়ে থাকে তবে তুমি বামপন্থী্‌, (তবুও মানুষপন্থী নও), আর সেরকম কিছুই না হলে, first come first serve basis এ যেনারা আগে আসবেন তুমি তাদের ঘরের জামাই, যে কোনো একটা রং এর হতেই হবে তোমার মরদেহ, লাল-সাবুজ অথবা হালুদ ।           

যে ফুলে সাজাও মরদেহ…
সে ফুলের রং তো একটাই…
একটাই তার গন্ধ, তাতে নেই কোনো সন্দেহ ।।

লাইভ টেলিকাস্ট:

-      Go back… go back…
-      এই খেয়েছে আমি কি করলুম আবার! এখনো তো মাটিতে পা ফেলতেই পারলাম না্‌… তার আগেই back Go! … কিরে কেতো … এসব হচ্ছেটা কি?
-      আহা মা আপনি ঘাবড়াবেন না, আপনাকে থোড়াই Go back…বলেছে! বলেছে তো ঐ শকুন গুলোকে, কেউ মরেছে কি মরেনি অমনি তাঁকে ঘিরে ধরে ভোঁ ভোঁ শুরু করে দিয়েছে Public আর কতো সহ্য করবে বলুন, দিচ্ছে ব্যটাদের আচ্ছা করে ঠুকে…
-      ওহ! তাই বল, তা ভালো… তা ভালো…


‘মধ্য গগনে দেখা দিল এক অতীব আলো পরিস্ফুটন
ত্রি-নয়নে দিপ্ত শান্তির স্ফুলিঙ্গ
পরিপূর্ন সব দলে দলে এক গোত্রে এক বর্ণধারী
ধরার মৃত্তিকাএ সবুজের আভা…
বাসন্তী রংএ রাঙ্গাইয়াছে শরতের শুভ্রাকাশ
ওই দেখা যায়ে…
নির্মল-শান্ত-কোমল-স্নিগ্ধ… অপার সুন্দরের মুখখানি…’


পুনশ্চঃ- “পূর্বাভাস” মানেই একটি কাল্পনিক শব্দ মাত্র… সত্যের সহিত এর কোনরূপ মিল নাই ।।

-o-


কথাকলি - নীলাঞ্জন দরিপা

১.
যে কথার রক্ত দিয়ে স্বাধীনতা পেয়েছে চেতনা,
সে কথারা কবিতায় বেঁচে থাকে!

আমার মাঝে মাঝে কষ্ট হয় খুব| এই, এখন যেমন হচ্ছে| লিখতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু লিখতে পারছি না। বোবা হলে, মানুষের কি এরকমই কষ্ট হয়? কি জানি! প্রচন্ড অসংলগ্ন শব্দ ভিড় করে আসছে মাথায়, আর সেই শব্দ গুলো পাশাপাশি জড়ো হয়ে মাথার ভেতর একটা জট পাকিয়ে দিচ্ছে। কাছের থেকে দেখলে , ওটা একটা অর্থহীন জঞ্জাল বলে মনে হয়.। দূরের থেকে হয়তো কোনো মানে খুঁজে পাওয়া যাবে!ছবিতে এরকম হয়। দাদার কাছে শুনেছিলাম, এমন একটা আঁকার ধরন আছে..প্রচুর হিজিবিজি দাগ কাটা পাতার ওপর..তারই ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে একটা মানে..একটা মুখ..বা, অন্য কিছু। সেরকমটা হলেও চলত...কিন্তু, আমি লিখতে পারছি কই?

আমি জানি, অনেকেই তোমরা বলবে, চেষ্টা করে লেখা যায় না , লেখা নিজের থেকে জন্মায়। কিন্তু বিশ্বাস করো, আমি দেখতে পাই.। লেখা গুলো আমার কাছে এক-একটা ছবি হয়ে আসে, আমি শুধু ছবি গুলো পড়ে যাই! সেই পড়াটা অনেকটা কবিতা পড়ার মতই। যেমন প্রতিটা আনন্দের একটা নিজস্ব বেদনা থাকে,যার প্রানেই আনন্দের আলো; ঠিক তেমনি প্রতিটা কবিতাকে জড়িয়ে একটা করে ছবি থাকে! আমি খুব ছোটবেলায় একটা স্বপ্ন দেখেছিলাম। একটা ছবি। ছবিটার মাঝখানে একটা ছোট্টোমত বাড়ি। লাল টালির ছাউনি। পাশে একটা বেড়া। বেড়ার পেছনে একটা ঝোপ, ঝোপটায় গাঢ় সবুজ, হাল্কা সবুজ আর হলুদ অদ্ভুত ভাবে মিশে আছে। এক পাশে একটা নদী বয়ে যাচ্ছে। বাড়ির ওপরে, ঝোপের ওপরে, নদীর ওপরে নীল আকাশ |তাতে কয়েক টুকরো মেঘ। সাদা মেঘ। অন্য পাশে সূর্য। একটা হলুদ গোল, আর তার চারপাশে অনেক গুলো দাগ, একটা বড়, একটা ছোট..একটা বড়..আবার একটা ছোট..আবার একটা বড়.. হঠাত দেখি ছবিটার ভেতর থেকে যেন অনেকগুলো শব্দ উঠে আসছে! যেন ছবির ওপরে ভেসে ভেসে শব্দ গুলো খেলছে! শুধুই কি খেলছে? না তো- ঐ যে সব কেমন ওলট-পালট হয়ে সাজছে..চমকে গিয়ে দেখলাম..চোখের সামনে একটা কবিতা দুলছে ছবিটার গায়ে জড়িয়ে-

আমার গাঁয়ে একটা বাড়ি,
লাল টালির চালা ;
আমার গাঁয়ে একলা আমি,
একলা দুপুরবেলা|

আমার গাঁয়ে একটা বাড়ি,
বেড়া বাড়ির পিছে;
বেড়ার পিছে হলুদ ঝোপে,
গাঢ় সবুজ নিচে|

আমার গাঁয়ে একটা নদী,
নৌকা কেন নাই?
ও মা, তোকে কেমন করে,
আনতে আমি যাই?

তখন হঠাত মেঘলা কেটে,
সূয্যি দিল হেসে;
অমনি দেখি নদীর পারে,
নৌকা এলো ভেসে!


আমি তখন নৌকা চড়ে ,
আমি তখন মাঝি;
পাশের গাঁয়ে পৌছে, তোকে
বলছি, "আমি হাজির ..."

অবাক চোখে বললি তখন,
"একাই এলি খোকা?"
আমি তখন বীর পালোয়ান,
বলছি "ওরে বোকা-

আমার গাঁয়ে একটা বাড়ি,
কেউ নেই ওর কাছে;
শিগগির চল, নদীর ঘাটে-
নৌকা বাঁধা আছে |

আমার গাঁয়ে সূয্যি একা,
একলা বেঁচে থাকে;
তাই তো আমি নিয়ে এলেম
সবার প্রিয় মা'কে |

        -ব্যাস, অমনি আমার ঘুম ভেঙ্গে গেলে। তোমরা বলবে, "মিথ্যে কথা..ছবিতে তো নৌকা ছিল না..মা ছিল না..ওসব এলো কোত্থেকে? " ওটাই তো মুশকিল! ছবিতে যা দেখি , তার প্রায় সবটাই শব্দে থাকে..কিন্তু ঐ হিজিবিজি গুলো, যার মাঝে আসল মানে টা দেখি..তার বাইরের শব্দ গুলো ছবিতে থাকে না..কোথা থেকে যেন ঢুকে পড়ে মাঝে মাঝে!আমি চেষ্টা করে দেখেছি..স্বপ্ন গুলো সবসময় মনে রাখা যায় না..আসলে চেষ্টাও করা যায় না। তবু তারই মাঝে কয়েকটা থেকে যায়..কয়েকটা কবিতায়!


২.
কিছু প্রাণে তীব্র হয়ে জন্ম নেয় ব্যথা ,
কিছু প্রাণে দুর্বলতা আস্কারা পায়, বাঁচে ;
কিশোর আঙ্গুল, ঠোঁটের মাঝে জ্বালায় নি  দেশলাই-
দু'ঠোঁট গরম; শব্দমালা উচ্চারণের আঁচে!

ছোটবেলায় যে স্বপ্ন গুলো দেখতাম, সেগুলো পাল্টে যাচ্ছিল বয়সের সাথে সাথে , যেভাবে পাল্টে যাচ্ছিল বন্ধুদের সাথে আড্ডার বিষয় আর চটির সাইজ। দাদার বন্ধু টাকার অভাবে পড়া ছেড়ে ঢুকলো কাপড়ের দোকানে। রাত্রে স্বপ্ন দেখলাম .। জুতো সেলাই করতে চেষ্টা করছি বাস-স্ট্যান্ডে বসে! পারছি না, ঘাম পড়ছে কপাল থেকে..আর ঘামে ভেজা কয়েকটা শব্দ ভেসে উঠছে আমার গায়ের চারপাশে..

বেকারত্বের একরাশ জ্বালা তুমি,
দুর্ভিক্ষ- , তুমিই অনাহার;
একশ কোটির দেশের তুমিই রাজা;
তুমিই মৃত্যুদূতের ইস্তাহার!

সময় থমকে গেছে তোমায় দেখে,
তুমিই আমার আজ,তুমিই কাল;
তুমিই আমার জীবন্ত হৃত্পিণ্ড,
তুমিই মরণোত্তর কঙ্কাল!
নবম-দশম শ্রেণী তে বন্ধুমহলে আড্ডাবাজ হিসেবে খ্যাতি ছিল..কয়েকজন বলল "লেখালিখি তে গুরুত্ব দে".। আমি মুখে বললাম "হুঁ.." ; মনে মনে বললাম, স্বপ্ন কই? আরো অনেক স্বপ্ন চাই যে.।। এর মধ্যে কিছু বন্ধু বড্ড কাছে আসে..কিছু বন্ধু দূরে চলে যায় অনেকটা..আমার চব্বিশ ঘন্টা ব্যস্ত হয়ে ওঠে ভীষণ .। বৈষম্য, চোখের সামনে পশরা সাজিয়ে বসে, মফস্বল এর অলিতে-গলিতে! মধ্যবিত্ত চোখে অর্থনৈতিক বিভেদ সবসময়ই প্রকট! তাই কলমের সুর হল একঘেঁয়ে - ভয় হল..বিষয়টাকে ব্যবহার করছি নাতো ?!.।

কিছু আধুনিক কবিতা পড়ার সুযোগ হল..তাতেও দেখলাম..অশ্লীলতা আর বৈষম্য নতুন মোড়কে বাজারে খাচ্ছে ভীষণ।  কলকাতা আর তার ছত্রছায়ায় থাকা অঞ্চল গুলোর ওপর এমনিতেই বিষিয়ে থাকে মফস্বলের কিশোর মন..তখন বিবেচনা বোধ অপরিণত বলেই বোধ হয়...আবার একদিন ভোরের দিকে দেখলাম..কোনো এক বিখ্যাত কবি কফি খেতে খেতে কিসব লিখছেন..খাতার ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো ..
তুমি দু'চোখ বুজে রবি সেতুর 'পরে,
তুমি সত্যি ভাবুক, কত গুনীর ভিড়ে |
তুমি কবির জীবন, কথা ছন্দ মাখা;
আমি আঁধার গলি, নোনা ভাতেই ঢাকা!

তুমি ঠান্ডা ঘরে বসে কলম-খাতায়
লেখ সহানুভূতি, আমি জীবন কাটাই,
এই আঁধার স্রোতের মাঝে দেখেছ মিশে ?
কোন শক্তি ফলাও পেনসিলের শিসে!

নিজের ঔদ্ধত্য ধরা পড়ল নিজের কাছেই..সময় পেরোলো বছরের খাতায় কয়েক পাতা..বুঝতে পারলাম আমি কিসসু জানি না.। কতটুকুই বা দেখেছি দুনিয়া? লিখতে পারা-না পারার আনন্দ-কষ্ট গুলো আমাকে জাপটে ধরে থাকত সবসময়..আমি বড় হতে থাকলাম..সাথে সাথে ওরাও। কখনো কখনো মনে হয় নশ্বর বলেই আমাদের আকর্ষণ বেশী..অতীত-ভবিষ্যত এক হয়ে আসে আমার আঠারোর সন্ধিকালে! ইচ্ছে করে শব্দ গুলোকে রং দিয়ে এঁকে সময়কে ডেকে দেখায়..দেখো, তুমি কাউকে হারাতে পারো না..শুধু নিজেকে পেরিয়ে চল রোজ! তুমি যাদের চাপা দিয়ে এগিয়ে চলেছ..তারা বেঁচে থাকে স্বপ্নে, পাতায়, কলমে..
                                                
তুলির ভেজানো চুলে নীলিমা মাখিয়ে ,
কাগজে নামানো হয় স্মৃতির খেয়ালে ;
পুরনো জানালা দিয়ে দেখেছি আকাশ ,
সচল সময়, থাকে ঝোলানো, দেয়ালে |

বিগত শতকে যারা হারিয়ে গিয়েছে ,
সকলে মিশেছে এসে অনুজ লিপিতে ;
যা কিছু চলেছে তাকে সময়ে জড়িয়ে ,
বয়স বাড়িয়ে 'আজ' ঘুমোবে বিবিধে |

গত কয়েক বছরে পরীক্ষা-ভবিষ্যত চিন্তা অনেক সময় কেড়ে নিয়েছে..তবু রাত্রে কখনো কখনো সবাই ঘুমিয়ে যাওয়ার পর একটা দৈত্য আসে আমার কাছে। দু হাতে টিপে ধরে আমার গলা। শ্বাস আটকে যায়, কলম সাদা পাতায় আঁচড় কাটতে চায়..সেগুলো; না হয় হিজিবিজি..না হয় সত্যিকারের গল্প। মাঝে মাঝেই একটা ফর্সা লম্বাটে মুখ এক-একটা রাতে চোখের পাতায় আসে..কিন্তু স্বপ্ন গুলো মনে থাকে না! ব্যথায় মরতে মরতে সেদিন রাতে দেখলাম, আমার ডান হাতে কলম আর বাঁ হাতে ঘিলু , ঘিলুর থেকে একটা সুর আসছে ভেসে..আর সেই সুরটা ফুটে উঠছে খাতায় ; কলমের মুখ দিয়ে..

আমার উনিশ লাইনের কবিতা, তোকে বলছি-
জানি না, কেমন ভাবে বড় হবি ..
আমার চেতনার দাগ ঢাকা তৈলচিত্র; নাকি
অবচেতনার জলছবি হয়ে গড়ে উঠবি তুই
বোধ শক্তি তোরও কিছু হলো ?
খোলা কলম, সাদা কাগজ মাথায় নিয়ে শুই ..
তোকে গড়ি একটু একটু করে!

তোকে আমি "কথা" বলেই ডাকি-
যেদিন প্রথম ধরেছিলি পুঁজিবাদের ফাঁকি! 
 সাম্যবাদে কোমর দুলিয়ে গণসংগীতে কন্ঠ ছেড়েছিলি -
ভয় পেলেও-
সেদিন থেকেই তোর সাথে , মনের কথা বলি!

তারপরে সেই কৃষ্ণগভীর চোখ ;
ভূমিকা বা উপসংহার যেথায় দেখা হোক
তুই মাতাল হয়েছিলি ভীষণ , জানি |

আজকে দারুন বুঝতে পেরেছি, গড়তে চেয়েছি যারে
ভিন্ন বাক্যে, ভিন্ন প্রেরণা ভীষণ ধাক্কা মারে!

ভেবেছিলাম, কলম বুঝি বিক্রি করবে তোকে ;
কিন্তু সে আজ পালছে তোকে, সৃষ্টি করার ঝোঁকে!
অতিরিক্ত, ভালো থাকিস, কথা ||

-o-

Comments