Artist Anita Roy Choudhury - Interview
আলাপ – শিল্পী
অনিতা রায়চৌধুরী
ছোটবেলায় ভাবতাম-ই না বড় হয়ে কি হব! কখনো
খুব দুরন্তপনা আবার হঠাৎ করেই চুপ করে
যাওয়া...- যেন নিজেকেই ঠিক বুঝতাম না।
অনেকেই চাইতেন আমি তাদের কাছে গান, সেতার বা অন্য কিছু শিখি। বলতেন
-"তোমায় বিখ্যাত করব।" কিন্তু আমি কি হব ?
পায়রা মেঘে আকাশ
দেব পাড়ি
হাতের সামনে
উল্টানো ঘর বাড়ি
ওল্টানো বই
চড়ুই স্নানে মেলা
ছাদের পিঠে একলা
সন্ধেবেলা
ছাতিম গন্ধ ঘুম
আসে না কেন
কত- দিনের-
কথা ...?
না তো
এই তো ঘটল
যেন!
আমাদের পরিবার ছিল বেশ বড়। ছয় ভাই ছয় বোন। বড়দা খুব ভালো এসরাজ বাজাতেন। সেই সূত্রে অনেক নামকরা
ব্যক্তিরা আমাদের বাড়িতে আসতেন।
পরিবারের প্রায় সবার মধ্যেই আঁকার চল ছিল। আমার
ভাইবোনেরা এবং পরিবারের আমার সমবয়সীরা খুবই একাত্ম হওয়ায় আমাদের বাইরের বন্ধুর
প্রয়োজন ছিলনা। বাড়িতে বেশ কড়া শাসন ছিল। সন্ধের আগে বাড়ি ফিরতে হত।
বাড়ির বাগানে একটা ময়ূর ছিল। প্রচুর গাছপালা। কোন কোন
সময় ময়ূরটা আমাকে দেখলেই পেখম তুলে নাচত। আমার রঙ চাপা হওয়ায় দাদারা ঠাট্টা করে
বলত তোকে দেখে মেঘ ঘনিয়েছে ভেবেই এই নাচ।
মেঘ ঘনালে বাড়ির
কাছাকাছি
বলত ডেকে - ঘরের
ভিতর আছি ?
"আয় কুড়বি বৃষ্টি পলাশ ফুল ?"
কোমর ছুঁয়ে
এলিয়ে পরা চুল
জানতে চাইত
"সওয়ার হবি আয়
অগোছালো দিনের
এই হাওয়ায় ?"
আমি তখন রঙ
ছুঁড়েছি
আকাশ কালো করে
আমি তখন মেঘ
পুড়েছি
সবাই যেমন পোড়ে ?
না! হয়তো তেমনটা
নয়
একটু অন্যরকম
পায়রা যেমন
একটানা সয়
সখ ও বকম বকম!
আমার অনেকটা সময়ই কেটে যেত পাখির স্নান দেখে কিংবা
রাতের আকাশের নক্ষত্র দেখে অথবা ফুলে ফুলে ভরে থাকা বাগানের গাছগুলির সৌন্দর্য
দেখে। রাতের অন্ধকারেও গাছের তলায় দাড়িয়ে লক্ষ্য করতাম
পাতায় বৃষ্টি পড়া বা তার পাতা নাড়া। কেউ বারণ করলে বলতাম,
যে গাছকে দিনের আলোয় ভালোবাসি তাকে রাতে ভালোবাসতে পারব না?
রাতের
ভিতর রং মেখেছি নীলের
আর
তারাদের কি রং বলো দিলে'
চোখের
ভিতর নামতে পারে ছায়া
আর
বেহায়া
বৃষ্টি ভেজাক ছবি
এঁকেছি ভৈরবী।
স্কুলে পড়াকালীনই কিটস্
পড়েছি । কবিতাকে ছুঁতে চাওয়ার ইচ্ছে বোধয় তখন থেকেই। অস্কার ওয়াইল্ড পড়েছি আর ভেবেছি
আমিও তো চাই অন্তত একবার একটা ভুতের সঙ্গে দেখা করতে আর প্রশ্ন করতে কিসের এতো
কষ্ট তোমার?
যখন আমার বয়স নয় কিংবা দশ তখন থেকেই খেলার ছলে
মাটি দিয়ে ঠাকুরের মূর্তি গড়তে শুরু করি। মা সেই মূর্তি দিয়েই পুজো করেন সরস্বতী পূজায়।
ক্লাস নাইন
কিংবা টেন এ পড়াকালীন একসাথে দু-তিনটে মূর্তি তৈরি করতাম, নিজেদের বাড়ির, আমাদের ল্যান্ড-লেডীর
আবার পাড়ার পুজোর মূর্তিও তৈরি করে দিয়েছি । সেই পাড়ার পুজোর উন্মোচন করতে এসেছেন অনেক
নামী-দামী ব্যক্তিরা। লজ্জায় যেতে পারিনি সেখানে । তবে সবাই খুব প্রশংসা করেছেন , কেউ
আবার বলেছেন “একটা মেয়ে বানিয়েছে এই মূর্তিটা!” তখন প্রতিবাদ করে বলেছি , কেন
মেয়ে যে বানিয়েছে সেটা আলাদা করে বলতে হচ্ছে কেন? মেয়েরা কি পারেনা ?
স্কুলে একটা আয়না ছিল। আমি তার সামনে অনেক সময় ধরে
দাঁড়িয়ে থাকতাম। দিদিমণিরা বলতেন- ওভাবে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখি কেন!
তাঁদেরকে বলতে পারতাম না। আসলে নিজেকে খুঁজি।
সে
আমার অবয়ব নয়
আমার
ভিতরে এক আমি
যাকে
আমি এখনও চিনি নি
আয়নার
ওপারে অপার...
ছায়া
কিছু পড়ে আছে তার
আর
আছে মেয়েবেলা ফেরা
স্মৃতি
জুড়ে কিছু ছেঁড়া ছেঁড়া
আলো
চলাচল ঘরময়
এরপর স্কুল পেড়িয়ে গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজে ভর্তি
হলাম। বাবারই
খুব শখ ছিল তার কোন ছেলে বা মেয়ে শিল্প নিয়ে পড়াশুনা করুক। জেনারেল কলেজে পড়ার ইচ্ছে থাকলেও, আর্ট
কলেজে ভর্তির বয়স-সীমা থাকার কারণে ওখানে ভর্তি হতে পারিনি। সেই সময় সহপাঠী হিসেবে পেয়েছি যোগেন চৌধুরী,
সুনীতা বসু, সুনীল দাসদের। এরপর বঙ্গ
সংস্কৃতি সম্মেলনে আমার দেওয়া একটি ছবি দেখে সোসাইটি অফ কনটেম্পোরারি
আর্টস গ্রুপ আমায় সদস্য করে নেয়। এরপরে মেম্বার হই ক্যালকাটা পেইন্টার্স
গ্রুপের।
কলেজ শেষ করার আগে আগেই আমি গীতবিতানে ভর্তি হই। সপ্তাহে দুদিন ক্লাস
থাকত। বৃষ্টি ঝঞ্ঝা মাথায় ক’রেও ক্লাস যেতাম। তখন গীতবিতানের প্রধান ছিলেন কনক দাস। সেরকমই একটা বৃষ্টির দিনে আমি ছাড়া
আর কেউই তেমন ক্লাসে আসেনি। নীহার বিন্দু সেন আমাকে ডেকে দুটি গান শুনিয়েছিলেন।
সেটা আমার কাছে একটা পরম পাওয়া।
কলেজ পাস করার পড় বাড়িতে প্রচুর কবিতা পড়তাম। লিখেছি। কলেজ ম্যাগাজিনেও কবিতা দিয়েছি। যোগেন ভালো কবিতা লিখত। ও খুব
উৎসাহ দিতো। স্কুল ছাড়ার সময় ‘তারা’ নামে
একটা কবিতা লিখেছিলাম। তারা, যাদের ছেড়ে চলে যেতে হচ্ছে।
ছোটবেলা থেকেই আমার এক বিচিত্র নিরীক্ষণ শক্তি আছে। যাবতীয় সুন্দরতা
আমার আশেপাশে। সেগুলো কিছুই আমার চোখ এড়ায় না।
আড়াই বছর বয়সেও মায়ের জল গরম করার জন্য জ্বালানো কাগজ পোড়া দিয়ে আঁকিবুঁকি কেটেছি ঘরময়।
ঘরময় সেইসব
আলাপন থেকে
মায়ের বকুনি
ছিল, মুখে কালিঝুলি
শুকনো রঙেতে জল গোলা রঙ-তুলি
আজকে যদিবা বলি
তাদেরকে ডেকে
কোথায় লুকিয়ে
পড়ে খাটের তলার
তিনটি মেয়েতে
চলে বলা না বলার
ব্যাঙ্গমা আর
ছিল এক ব্যাঙ্গমী
মেঝেময় রূপকথা
এঁকে গেছি আমি...
আর যে সমস্ত কথা মনে থেকে গেছে এখনও।
আমার এক খুব ভালো বন্ধু। রঞ্জন গাঙ্গুলি। যে ছিল ওস্তাদ আলী আকবর খাঁ
সাহেবের ছাত্র। অনেক সময়েই এরকম হয়েছে - ও একদিকে সেতার বাজাচ্ছে আর আমি ছবি
আঁকছি। এভাবেই একদিন ওর সেতারের কোনও এক রাগের সাথে আমি এঁকে ফেললাম এক ‘অভিসারিকা’র
ছবি। যেটা এক্সিবিশনে পাঠিয়ে খুব প্রশংসা পেলাম। আর তখনই ভেবেছিলাম আমি যদি একে
নিয়ে সাধনা করি তবে তো আরও ভাল করতে পারি।
জীবনের প্রথম পেণ্টিং বাক্সটা পাই ল্যান্ড লেডির কাছ থেকে। যেদিন
তিনি সেটা দেবেন বলেছিলেন পরম উৎসাহে সারাদিন তার পায়ে পায়ে ঘুরেছিলাম। জিনিসটা
হাতে না পাওয়া অবধি। তখন আমি খুব ছোট। এরপর মেজদা একটা পেণ্টিং-বক্স এনে দেয় যখন
আমি ক্লাস এইটে। সেদিন আমি সারারাত ঘুমতে পারিনি।
আর কলেজের থার্ড ইয়ারে যেদিন আমার হাতে একটা প্যালেট আর একটা
ক্যানভাস দিয়ে বলা হয়েছিল একটা মডেলের ছবি আঁকতে। যদিও সেটা মনোক্রম ছবি ছিল। এক
রঙে নানারকম শেড দিয়ে আঁকতে হবে। সেদিন ক্যানভাসের সামনে দাঁড়িয়ে আমার যে অনুভূতি হয়েছিল সেটা ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না।
যা আজও ভাবলে আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। পরবর্তী কালে আমার যারা প্রিয় ব্যক্তি তাদের সামনে দাঁড়িয়ে আমার যে অনুভূতি হয়, ঠিক সেই অনুভূতিই হয়েছিলো ক্যানভাসের সামনে হাতে তুলিটা ধরে, আর সেদিনই বুঝেছিলাম আমি একজন শিল্পী।
দিল্লি, মুম্বাই, মাদ্রাজ অনেক জায়গায় গিয়েছি এক্সিবিশনে। শুরুর দিক
থেকে কাগজে নাম বেরতও অনেক। যেটা নিয়ে
আমার বাড়ির লোকেরা আপ্লুত হয়েছে। একটা সময়ের পর থেকে সময় কম পড়ে গেছে আমার জন্য।
আজও বয়স বাড়ার কথা ভাবলে খারাপ লাগে, কিন্তু বয়সটাই যে আমার বাড়েনি আর বাড়বেও না।
অনুলিখন – শুভনিতা দে
কবিতা – মৃগাঙ্কশেখর গঙ্গোপাধ্যায়
Comments
Post a Comment