Dolchhut Printed 4th Edition - story
গল্প
এজ পিরামিড-দেবাশিস কুন্ডু
১
কিছু একটা হয়েছে। সকাল থেকে TV তে খুব হইহই। সিতারা channel কিছু বিক্ষিপ্ত বিক্ষোভ broadcast করতে চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না। বারবার TV camera-য় কিছু একটা ধরার চেষ্টা, কিন্তু কিছুতেই পেরে উঠছে না। আর্মি-র লোকেরা সরিয়ে দিছে, মারছে, কয়েকবার স্ক্রীন ঝিরঝিরে snow-এ ভরে যেতেও দেখলেন অমলেন্দু বাবু। হয়ত লেন্সটা ভেঙ্গে দেওয়া হলো। ২০৩৮-এ বসেও যদি এসব জিনিসের live coverage না দেখা যায়, তাহলে তো আর কিছু বলার নেই সত্যি! দেশ’টা আর উন্নতি করে উঠতে পারল না। ভীষণ হতাশ হয়ে TV-টা বন্ধ করে আবার কাগজের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন আশি বছরের অধ্যাপক। সরকার নতুন একটা কিছু বিল আনতে চেষ্টা করছে, কি সেটা নাকি গোপন রাখা হয়েছে, মানে রাজ্যসভা পেরিয়ে লোকসভাতে এখনো পেশ হয়নি। এই ব্যাপারগুলো অমলেন্দু বাবুর কাছে কোনদিন-ই খুব একটা পরিষ্কার হয় নি, সারাজীবন ecology-ই ধ্যানজ্ঞান ছিল। প্রকৃতিকে ভালোবেসে এসেছেন চিরটাকাল, গাছপালা, মাঠঘাট, জন্তু জানোয়ার। আর তাদের নিজেদের মধ্যে সুষম সম্পর্ক। রাজনৈতিক দলাদলি, কূটকচালি, আইনকানুনের সূক্ষ্ম চুলচেরা বিচারের দিকে তাকানোর দুর্ভাগ্য? নাহ, সে আর হয়ে উঠলো না এ জীবনে। তবু মনের মধ্যে একটু খুঁত খুঁত, কি এমন জিনিস যা সরকার দেখাতে দিচ্ছে না? তবে কি ওই বিল নিয়েই কোনো বিরোধ? pension নিয়ে আবার টানাটানি করবে না তো? সেবার retirement age কমিয়ে ৫৫ করে দেওয়ার আগেও এরকম একটা গন্ডগোল হয়েছিল।
চমক-টা ভাঙ্গলো কানের সামনে একটা চিৎকার শুনে! অর্ধাঙ্গিনী! অমৃতা, আদরের আমিত্তি। “ তোমার কি কোনদিন বুদ্ধি হবে না? departmental store থেকে মাছ এনেও, কি করে পচা বেরয়? একটু গন্ধ শুঁকে আনতে পার না? মরা ঘেঁটে জীবন কাটালে, আর এখন পচা মাছ চিনতে শিখলে না, হাহ! ” অদ্ভুত ধারণা অমলেন্দু বাবুর গিন্নির, biology, ডাক্তারি, ভেটেরিনারি সবই নাকি মরা ঘাঁটা। সারাজীবন ইংলিশ পড়িয়ে এসেছে, তাই রাগ হলেও ক্ষমা ঘেন্না করে দেওয়া হয়। আর এই বাজার গুলোর-ও বলিহারি, সব যেন অপদস্থ করার জন্য-ই বসে রয়েছে, একটু নজর শিথিল করলেই ঠকে যাবে।
আসলে আজ অমলেন্দু বাবুর ছেলে আসছে, Delhi থেকে। স্নেহেন্দুর জন্যই আজ মাছ আনা বাজার থেকে, নাহলে বুড়োবুড়ি নিরামিষের উপরেই বেঁচে। আমিত্তি দেবীর মেজাজ তাই আজ খুব খাট্টা। স্নেহেন্দু Central Board Of Excise & Customs -এ চাকরি করে। মোটা টাকার সরকারী চাকরি, বাড়িতে সেজন্য অভাব বলে কিছু নেই। ওকে জিজ্ঞাসা করলেই বিল-এর ব্যাপারে সব জেনে যাওয়া যাবে। TV তে দেখা দৃশ্যগুলো অমলেন্দু বাবুর মন থেকে তখনো মোছেনি।
২
মুখ চোখ অদ্ভুত শুকনো স্নেহেন্দুর, চার ঘন্টা হয়ে গ্যাছে বাড়ি আসার, কিন্তু এখনো কোনো কথা নেই। মা বাবার কথাগুলোর উত্তর যে কত সংক্ষিপ্ত ভাবে দেওয়া যায় আজ যেন তার পরীক্ষা দিচ্ছে ৫৩ বছরের সোনা। এখনো জামা কাপড় ছাড়ে নি, এখনো ফ্রেশ হয়নি। নিশ্চয় বৌ-এর সাথে ঝগড়া, অমলেন্দু বাবু নিজের ছেলের মন খারাপের লক্ষণগুলো চেনেন। ৫৫ বছর আগে অমৃতা কে বিয়ে করার পরে যখনি ঝগড়া হত, তখনি অমলেন্দু বাবুর ভীষণ মন খারাপ হয়ে যেত, সারাদিন চুপচাপ বসে থাকা, office এর কাজে মন না দিতে পারা তো আছেই, মাঝে মাঝে লুকিয়ে লুকিয়ে চোখের জল-ও। বৌটার মনটা ভারী নরম, ছেলে অন্ত প্রাণ একেবারে! প্রায় প্রৌড় ছেলের মধ্য দিয়ে যেন উনি নিজের যৌবনে ফিরে যাচ্ছিলেন আবার। একটা মুচকি হাসি হাসছিল মন টা, কিন্তু তাকে শাসন করেই ছেলে কে এতক্ষণ চেপে রাখা প্রশ্ন টা করে ফেললেন, “ আচ্ছা? সরকার কিসের বিল আনছে রে?”
কোনো কোনো প্রশ্নে কি বিদ্যুত থাকে? থাকতে পারে। সেরকমই কোনো কিছুর সংস্পর্শে স্নেহেন্দু যেন প্রাণ ফিরে পেল, “ ন-ন-নাহ, না তো! মানে এখনো কিছু জানি না তো! ক-ক-কোন বিল? ! ” তীক্ষ্ণ চোখে বাবাকে জরিপ ছেলের। অমলেন্দু বাবু এরকম উত্তর আশা করেন নি, সরকারের প্রধান দফতরের কর্মী হয়েও সোনা সত্যি সত্যি-ই জানে না? নাকি কিছু চেপে যাচ্ছে? নাকি সরকার থেকে কোনো
boundary দেওয়া আছে, যে কাউকে বলা যাবে না? সোনা ওরকম চমকে উঠলো কেন? কিসের বিল? সোনা আজ এত disturbed কেন? একসাথে হাজার খানেক প্রশ্ন যখন অমলেন্দু বাবুর কপালে ভাঁজ এর গভীরতা বাড়িয়ে দিচ্ছে, আমিত্তি দেবির চোখ তখন সোনার চোখে আটকে, সোনার চোখে কি? জল? !
৩
সকাল থেকে দুপুর টা আজ ভীষণ অদ্ভুত। আর্মি-র লোকেরা এসে বলল, “ দরজা খুলুন, evacuation চলছে, গাড়িতে উঠে বসুন” । তাড়াতাড়ি দরজা খুলে বেরোতেই বুড়ো বুড়ির চোখ কপালে! দেশে যেন যুদ্ধ লেগেছে। রাস্তায় শত শত আর্মি-র গাড়ি, police -এর গাড়ি দাঁড়িয়ে, আর তাতে দলে দলে লোককে ঠেসে ঠেসে ভরা হচ্ছে। এই pensioner 's কলোনি-র জন্যই বোধয় প্রায় দেড়শ দুশ গাড়ি সেছে! চিৎকার, হাঁকডাক, আর্মি-র command, police এর গালিগালাজ সব মিলে ভয়াবহ এক হুলুস্থুল। অমলেন্দু বাবু বউ এর হাত ধরে একটা আর্মি -র গাড়ি তে এসে উঠলেন, এই গাড়ি গুলো তুলনায় বড়, বেশি লোক আঁটে, তবে উচু। সে যাই হোক, সহৃদয় army man রা প্রায় কোলে করেই ওনাদের তুলে দিয়েছে। গাড়ি ভর্তি প্রায় সমবয়সী লোকজন, প্রায় সবারই মুখচেনা, এই pensioner 's কলোনিরই বাসিন্দা, কিন্তু কারোরই মুখে কথা নেই, অজানার ভয় সবার মুখে; গাড়ির মেঝে তে বসে একটু চোখ ঘোরাতেই অরিজিতের উপর চোখ পড়ল। ও মা! এর বাড়িতে না এর নাতি এসেছে বেড়াতে! সে কোথায় গেল? ! তাকে ছেড়ে বর বউ গাড়ি তে উঠে পড়েছে? সব পাবলিক! জানতে একবার ইচ্ছা হচ্ছিল, কিন্তু একটা চরম বিতৃষ্ণা ভেতর থেকে বারণ করলো। আমিত্তি যে সেই পরশুর আগের দিন রাত কে চুপ করেছে, আর কোনো কথা নেই মুখে। এবারই প্ৰথম ছেলে যাওয়ার পরেও চোখের জল ফেলে নি ও।
গাড়ি টা কখন চলতে শুরু করেছে খেয়াল-ই হয় নি। খেয়াল হলো, একটু পেছনের দিকে হেলে যেতে। পুবের পাহাড় এর দিকে যাচ্ছে, প্রায় বিকেল হতে যায়, গাড়ির গতি-ও কমে এসেছে। কিন্তু নিয়ে যাচ্ছে কোথায়? এদিকে তো bunker আছে বলে জানা নেই। আসলে শহরের এদিক টা অমলেন্দু বাবুর হাতের তালুর মতো চেনা, ecology নিয়ে প্রচুর কাজ করেছেন এখানে, microecosystem নিয়ে সেই paper টা, যেটা নিয়ে mexico গেছিলেন সেমিনার দিতে, সেই কাজ টা এখানেই করা। কিন্তু তাবলে যুদ্ধের মতো পরিস্থিতি তে এই লকায় ঘোরা তো একদমই নিরাপদ নয়। অমিত্তির দিকে আড়চোখে তাকাতে দেখলেন ও-ও ঘুমোয় নি, তাকিয়ে আছে। বোধয় ছেলের কথা ভাবছে, কথা বলে বিরক্ত করা টা ঠিক হবে না।
৪
কখন ঘুম এসে গেছিল ঠিক খেয়াল নেই, গাড়িটা ঝাকুনি মেরে থামাতে অমলেন্দু বাবুর চোখ টা খুলে গেল। একটা উচু হলুদ পাচিলের পাশে গাড়ি টা দাঁড়ানো। ভীষণ চেনা জায়গা, অনেক অনেক সুখস্মৃতি জড়িয়ে আছে এই জায়গা টার সাথে। Gyps benghalensis, মানে ভারতীয় শকুন একবার অবলুপ্তির পথে চলে গেছিল, গুটি কয় টিকে ছিল। তখন উনি নিজে ZSI এর কিছু বন্ধুবান্ধবের সহায়তায় মধ্য কর্নাটকের এই এলাকায় একটা বড় প্রান্তর সরকারকে বলে পাচিল দিয়ে ঘিরিয়েছিলেন, আর আশেপাশের যত গ্রাম গঞ্জের মরা পচা গবাদি পশুর ভাগার হিসাবে এই এলাকা টাকে চিন্হিত করে দিয়েছিলেন। আস্তে আস্তে শকুন এর পাল আবার ফিরে এলো, আর শেয়াল শকুনের ecology নিয়ে যুগান্তকারী কাজের জন্য অমলেন্দু বাবু পেলেন দেশ বিদেশের অসংখ্য সম্মান। এই তো এক বছর আগেই Ohio তে একটা সেমিনার ছিল এই বিষয়ের উপরে, চোখে ভাসছিল সেদিন এই জায়গা টা। আপাত শান্ত পচা মাংসের কটু গন্ধে ভরা এই জায়গা টাকে dias ই দাড়িয়ে অনুভব করতে পারছিলেন। কিন্তু আজ যেন কিরকম অন্য রকম লাগছে, ঠিক পরিস্কার শুনতে না পেলেও একটা যেন ভীষণ চিৎকার, আর গুলির শব্দ ভেসে আসছে কোথাও থেকে। আর্মি-র লোকেদের দৌড়াদৌড়ি চোখে পরার মতো! যুদ্ধ কি এখানে হচ্ছে? ! কিন্তু তাই যদি হয় তাহলে ওনারা এখানে কি রছেন? আমিত্তি এখনো শুন্য চোখে তাকিয়ে আছে, আর গাড়ির বাকীরা যেন কোনো নিয়তির অভিশাপে বোবা। হঠাত কোথা থেকে মাটি ফুঁড়ে চলে এলো আর্মির লোকেরা, কর্ডন করে গাড়ির চারপাশে জলপাই উর্দি। “ একে একে নেমে আসুন, লাইন করে রাস্তা ধরে এগিয়ে চলুন”, ভীষণ স্পষ্ট গলায় করা নির্দেশ টার মধ্যে কোথাও যেন যান্ত্রিকতা লুকিয়ে ছিল, ঠিক ঘড়ির সময়ের মতো, যাকে অবজ্ঞা করা যায় না। গাড়ী ঘুরে line টা যখন হাইরোড ই এলো একটা অদ্ভুত দৃশ্য দেখলেন অমলেন্দু বাবু রা। শয়ে শয়ে এরকম micro লাইন এগিয়ে চলেছে high road এর সামনের বাঁকের দিকে। একই বয়সী বয়স্ক মানুষ দের ছোট ছোট লাইন, জলপাই উর্দি রা তাদের সামনে পেছনে। ঠিক কেউ যেন একটা ফিতে কে টুকরো টুকরো করে কেটে পিপড়ে দের দিয়ে বয়াচ্ছে। কিন্তু অন্য একটা দৃশ্য টেনে রেখেছিল এই পোরখাওয়া ecologist এর চোখ। হলুদ ঘেরা জায়গা টার ঠিক উপরের আকাশ টা শকুনে শকুনে কালো। অন্তত একশ carcass । মনে মনেই হিসাব হয়ে গেল। গুলির শব্দ আর চিৎকার তখন ভীষণ স্পষ্ট, একদম কাছেই শোনা যাচ্ছে, আর পরের বাঁক টাও চলে এসেছে সামনে । “ থামুন”-যান্ত্রিক নির্দেশে লাইন নিশ্চল। এখন আর কেউ আগের মতো শান্ত নেই, অদ্ভুত ভয়ার্ত গলায় নানারকম জল্পনা কানে আসছে। একটা করে লাইন ভেতরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে পরের লাইন কে অপেক্ষায় রেখে। আর্মি-র লোকেরা machine -এর মতো কাজ করে যাচ্ছে, ঠিক conveyer belt এর মতো। অমলেন্দু বাবু ভীষণ আস্তে ঘুরে অমৃতার দিকে তাকিয়ে ততোধিক ধীর গলায় বললেন, “ ওরা আমাদের মেরে ফেলতে এনেছে।” যেন কোনো খবর দিলেন। আমিত্তি তখনো অবিচল। এক অদ্ভুত নিস্পৃহা যেন গ্রাস করেছে পঞ্চান্ন বছরের পুরনো হয়ে যাওয়া বউটাকে।
“ ওরা টাকা পাবে”-যান্ত্রিকতায় বোধয় আর্মি-র commander কেও হার মানিয়ে গেল অমিত্তির উত্তর। “ কারা? ! ”-হিসাব মেলাতে পারার অবাক অবসাদএর ছাপ অমলেন্দু বাবুর গলায়, একটু উত্তেজিত কী? । আমিত্তি আবার নির্বাক। হঠাত করে না জানা বিল এর রহস্য টা পরিস্কার হয়ে এলো বৃদ্ধের কাছে। চুপ হয়ে গেলেন উনিও, এখন শুধু দৃশ্য বদলের অপেক্ষা।
৫
আকাশ শেষ বিকেলের আলোয় লালাভো, আর অমলেন্দু বাবুদের সামনের প্রান্তর টা ধুসর, আকাশ জুড়ে কালো মেঘের মতো ঝাঁকে ঝাঁকে শকুন, অবলুপ্তির পথ থেকে ফিরিয়ে আনা অমলেন্দু বাবুর সাধের শকুন। একজন ফটোগ্রাফার এর চোখ বোধয় এমন একটা দৃশ্যের জন্য হাজার বছর অপেক্ষা করতে পারে। তবে ফটো তে শব্দ কে বন্দী করা যায় না, তা যদি সম্ভব হত, তাহল্লে শকুন আর শেয়ালের মিলিত চিৎকারে রচিত একটা কর্কশ chorus বোধয় ছবি টাকে নষ্ট করে দিত। অপেক্ষা করছিল অমলেন্দু বাবুদের লাইন টাও, পরবর্তী নির্দেশের। যদিও সেটা কি হবে তা নিয়ে কারো মনে কোনো সন্দেহ ছিল না, সারি সারি বন্দুকের উচু হয়ে থাকা নল গুলো-ই নিরবে সব জানান দিয়ে দিচ্ছিল। “ মাঠের দিকে এগিয়ে যান”, সবাই একসাথে হাঁটা শুরু করলো, যদিও অনেক গুলো চোখ-ই বন্দুকের দিকে। অমলেন্দু বাবু অমৃতা দেবির পিঠে হাত দিয়ে হাটছিলেন, শেষ হাঁটা টা দুজনের একসাথে হাঁটতে পারাটা ভীষণ ভাগ্যের ব্যাপার, ওনাদের দুজনের মাঝে কোনো কথা হচ্ছিল না, তবুও নীরবতাই হাজার হাজার মিষ্টি শব্দ হয়ে মিশে যাচ্ছিল, লম্বা ঘাস ঠেলে এগোনোর শব্দে। মনে হচ্ছিল সেই গান টা,” এই পথ যদি না শেষ হয়।”
কিন্তু হলো, firing এর শব্দ শুরু হতেই নিশ্চেষ্ট পদচারণার শব্দ গুলো বদলে গেল দৌড়াদৌড়ির শব্দে, আর সেই শব্দে ঢাকা পরে যাচ্ছিল, ধুপ ধাপ করে পরে যাওয়ার আওয়াজ। অমলেন্দু বাবুর হার্ট বিট বোধয় দুশ পেরিয়ে গাছে। আমিত্তি তখনো চুপচাপ। মৃত্যুর অপেক্ষা করা আর মৃত্যু কে স্পর্শ করা বোধয় এক নয়, না হলে জেনে যাওয়া পরিণতির জন্য এই উত্কন্ঠা টা কিসের? এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে পা থেমে গাছে দুজনের খেয়াল হয় নি, আমিত্তি একটা গুলির আঘাতে পরে যেতে বোধয় অনন্তের ভঙ্গ হলো। দাঁড়িয়ে থেকেই আধো অন্ধকারে অমলেন্দু বাবু স্পষ্ট দেখলেন আমিত্তি অল্প হেসে মরে গেল। তাহলে আমিত্তি আগে থেকেই সব জানত, ও আজ সারাদিন শুধু অপেক্ষা করছিল এই মুহূর্ত টার ? কিন্তু ওনারা মরে গিয়ে কারা টাকা পেল? ওই soldier রা, নাকি ভারত সরকার? নাকি ওনার ছেলে বউ? শিঁরদারার কাছে একটা মোক্ষম আঘাত চিন্তার শক্তি কেড়ে নিল, অমলেন্দু বাবু আকাশের দিকে মুখ করে ঘাসের উপর আছড়ে পড়লেন। আকাশে তখন তারা উঠেছে অনেক গুলো।
৬
রট আয়রন এর lampshade টার পাশে শ্নেহেন্দু আরেকটা আসবাবের মতো বসে delhi তে, সামনে TV খোলা। চ্যানেল গুলো ভীষণ উত্তেজিত হয়ে কিসব আলোচনা করছে, “ গর আয়ু ৬০-এ নামিয়ে আনা হলো”, “ জীবনমুখী পরিকল্পনা”, “ জন বিস্ফোরণ প্রতিরোধ-এ রকারের বলিষ্ঠ পদক্ষেপ”, “ ৪০ -উর্ধ দের আত্মহত্যায় পরিবার কে পাচ কোটি টাকা অনুদানের যোজনা”, “ Operation New Dawn -এ যুক্ত থাকা সৈন্য দের কীর্তি চক্র”, “ আবার ভারত একশ কোটি তে”-এরকম হাজার খানেক খবর কে পাশ কাটিয়ে সিতারা চ্যানেল ফিরে এলো, কজন সুইট পরা anchor ভীষণ গম্ভীর মুখ করে একজন তরুণ বৈজ্ঞানিক এর ব্যাখ্যা শুনছে। বিষয় হলো, age pyramid । ভারতের age pyramid হয়ে গেছিল urn- আকৃতি, মানে শিশু দের সংখ্যা কম, যুবক যুবতী দের সংখ্যা মাঝারি, আর বুড়ো বুড়ি -র সংখ্যা সর্বাধিক। গর য়ু হয়ে গেছিল ৮৫। উন্নত মানের স্বাস্থ্য পরিষেবায় এর জন্য দায়ী, কিন্তু দেশের population তো ক্রমবর্ধমান, আর urn- আকৃতির pyramid তো আসন্ন মড়ক কে চিন্হিত করে। তাহলে এই age pyramid কে stable ঘন্টাকৃতি pyramid -এ বদলে দেওয়ার উপায় কি? উপরের স্তর অর্থাত বয়স্ক দের সংখ্যা হ্রাস করা, আর এই concept থেকেই Operation New Dawn এর জন্ম। কিন্তু সরকারী খাস মহলের কর্মী হওয়ার জন্য এসবি স্নেহেন্দুর জানা, পাঁচ কোটি টাকার দু দুটো অশোকস্তম্ভে ছাপ মারা চেক যে ওর শার্টের পকেট- এ। এই টাকা টার ষণ দরকার ছিল, বুবু-র technical লাইন-এ যাওয়ার খুব ইচ্ছা, সে খরচ এই টাকা তে উঠে যাবে। আর বাবা মা-ই বা আর কদিন বাচত? আর ও নিজেই বা আর কদ্দিন? ৫৩ বছরের সোনার হাতে আর তো মাত্র ৮৪ টা মাস। তারপরেই Alozolam এর ২০ টা বড়ি, আর আবার চ কোটি টাকা।
৭
ডান দিকের ঘাসের ঝোপ টার উপর একটা হলুদ কাপড়ের টুকরো, ওটার শেষ আছে কি না বোঝা যাচ্ছে না, অমিত্তির পরনের শাড়ি টা কি ওই রঙের ছিল, অমলেন্দু বাবুর কিছুই পরিস্কার মনে পড়ছিল না।, তখন কার ছোট ছোট তারা গুলো এক হয়ে গিয়ে আরেকটা বড় তারা হয়ে গাছে, যার আলোকে সবাই রোদ বলে ডাকে, তার চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে কালো কালো ছায়া গুলো, Gyps benghalensis এর পাল। “ বেচে থাক তোরা, বংশ বৃদ্ধি কর, এই হলুদ পাচিলটার বাইরে ছড়িয়ে পড় দলে দলে, competition করে হারিয়ে দে ওই প্রাণী গুলো কে, যারা প্রকৃতির থেকে নিজেদের আবরণ দিয়ে ঢেকে রাখে, আর সেই আবরণের ভেতরের প্রকৃতি টা কাউকে জানতে দেয় না; তোরা পৃথিবীর alpha species হয়ে ওঠ”
ধীরে ধীরে বড় তারা টাও নিভে গেল।
ছ-বছর আগের এক রাতে - অতনু ব্যানার্জী
১
আমার তখন প্রথম চাকরী। প্রায় বছর ছয়েক আগের কথা। গ্যাংটকে একটা ক্লায়েন্টের কাছে যাচ্ছি কিছু কাজকম্মে। শিয়ালদায় ট্রেনে উঠে বসেছি। আমার সাথে আছে আমার এক টেকনিশিয়ান। আমাদের রিসার্ভেশন সাইড আপার ও লোয়ার। জানলার শিকেতে হাত দিয়ে মানুষের সার্কাস দেখছি। কেউ ছড়ছড় করে কল থেকে গড়িয়ে পড়া পানীয় জল বোতলবন্দী করতে ব্যস্ত, কেউ বা ছেড়ে যাবার ফিনিশিং টাচ হিসেবে কান্নায় ভেঙে পড়ছে, কেউ কেউ বা খুব ব্যস্ত কুলীর সাথে মালপত্র তোলাতুলিতে, কেউ বা ষ্টল থেকে পেপার, আনন্দলোক বা নিতান্ত চটি-পর্ণো বই কিনতে ব্যস্ত। ওরই মধ্যে দেখলাম একটা গ্যাংকে। প্রায় জনা ৭-৮ এর। ছেলে মেয়ে মিশিয়ে। হৈ-হুল্লোড়ে ব্যস্ত। কে যে যাচ্ছে তা বুঝলাম না। কে জানে, সবাই যাচ্ছে নাকি! গ্যাং এ ৩ টি মেয়ে যাদের দিকে বেশী করে চোখ পড়লো। তার মধ্যে মোটাসোটা সুন্দর মেয়েটির দিকে বেশী করে। একটু কোঁকড়ানো ধাতের লম্বা চুলের মেয়েটা গার্ডার দিয়ে বেঁধে ঝুলিয়ে রেখেছে চুল। সালোয়ার কামিজের মধ্যে স্পষ্ট মোটাসোটা মেয়েটির বাঙালী লাবন্য আর ঢলোঢলো মেয়েলীপনা। কিন্তু ওদের মধ্যে কে-ই বা যাবে আর কোন কামরাতেই বা উঠবে তা বুঝে উঠতে পারছিনা। এবার ট্রেনের হুইশেল বেজে উঠলো। লোকজন প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে ট্রেনে উঠতে আরম্ভ করলো দুড়দাড়। আমিও একটু ব্যস্ত হয়ে পড়লাম আমাদের লাগেজ সরা-নড়া নিয়ে, অন্য যাত্রীদেরও সহযোগীতা করতে আর মালপত্র ঠিকঠাক প্লেসিং করতে। ট্রেন ছেড়ে দিলো। সামনের জানলা দিয়ে প্ল্যাটফর্মটা পেছনে দৌড়তে লাগলো। যেন চলমান টিভিসেট!
লোকের আনাগোনা অনবরত চলছিলো সামনের প্যাসেজ দিয়ে। হঠাৎ দেখি আমার টেকনিশিয়ান আমায় চোখের ইশারা করছে। আমি ভ্রু কুঁচকে কি জিজ্ঞেস করতেই ও আমায় পেছনে দেখতে বললো চোখ নাড়িয়ে। আমি পেছনে তাকিয়ে দেখি আরেব্বাস ওই গ্যাং এর ২ টো মেয়ে আমাদের পাশের খোপেই ! আর জানলার ধারে বাইরের দিয়ে অবাক ভাবে চেয়ে আছে ওই মোটাসোটা মেয়েটা। আমার মনে কে যেন জলতরঙ্গ বাজাতে লাগলো। তির তির করে কাঁপছিলো আমার হৃদয়। না একেবারে ওভার রিয়্যাক্ট করে বলছিনা এসব, আসলে মন থেকে হয়তো চাইছিলাম ওই মেয়েটা যদি কাছাকাছি বসতো, একটু যদি কথা বলা যেতো বেশ হতো। আর তারপরই টেলিপ্যাথীর মতো ওর আবির্ভাবে আমি সত্যিই খুব শিহরিত হয়েছিলাম। আমার টেকনিশিয়ান সুমন রাউত দেখলাম হাঁ করে তাকিয়ে আছে ওদের দিকে। আমার খুব রাগ লাগলো। আসলে আর কিছুই নয়, পুরুষ হিসেবে নিজের জেলাস ইগো-গুলো আমি সবসময় ক্যারী করি, তাই। যেহেতু মেয়েটিকে আমি দেখছি অতএব ওকে দেখার অধিকার শুধু আমার… এমনই একটা পসেসিভ মেন্টালিটি আমার সাবকনশাসে কাজ করছিলো। সুমন বোধহয় বুঝতে পারছিলো আমার বিরক্তি। ও আমায় বলেই ফেললো” ম্যায় উও মোটি কো নেহী দেখ রাহা হু, উসকো আপহী দেখিয়ে, ষ্টেশন সে তো আপ উসপে নজর রাখ রাহে থে; ম্যায় উও দুসরি কো দেখ রাহা হু”। হালকা হাসি আর গাম্ভীর্য্যের একটা ককটেলে মুখ রক্ষা করলাম; বাব্বাঃ খানিকটা আশ্বস্ত্য হলাম যেন! আরেকজনের কথা তো এতক্ষন বলিইনি। প্রি-অকুপাইড ছিলাম একটু, আমার পছন্দের জনকে নিয়ে। আরেকজন বেশ শাওলা রঙা… ছটফটে; মানে ট্রেনে ওইটুকু সময়েই দেখলাম মালপত্র নিজেই সাইজ করে সব কিছু ম্যানেজ করে ফেললো আর বার কয়েক পায়চারীও করে ফেললো এপাশ ওপাশ। জিন্স আর কুর্তিতে মেয়েটাকে দারুন স্মার্ট লাগছিলো! ওর ফিগারটা ম্যাচ করেছিলো; কিন্তু ওই ‘স্মার্ট’ মেয়েটিকে সুমনকে হ্যান্ড-ওভার করে আমি আবার ব্যস্ত হয়ে পড়লাম ‘মোটি’ কে নিয়ে।
বেশ খানিকক্ষন কেটে গেছে। আমার অভ্যেসমতো একটা গল্পের বই নিয়ে পা মুড়ে বেশ জমিয়ে বসেছি। কান কিন্তু আছে মেয়েদুটির দিকে। আর মাঝে মাঝে চোখও। আমার টেকনিশিয়ান সুমন ঝাড়ি দিয়ে চলেছে ওই ছটফটে মেয়েটিকে। আর আমার মাথার পেছনের চোখ দিয়ে আমি বুঝতে পারছি ‘মোটি’ মাঝে মধ্যে ‘স্মার্টি’র সাথে হেসে কথা বলছে আর আবার মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে জানলার বাইরের চলমান সবুজ স্ক্রীনে। ওর নাকটা একটু চাপা, হাসলে খুব মিষ্টি দেখাচ্ছে আবার অবাক হলে যখন ভ্রু কোঁচকাচ্ছে তখনও বেশ সুইট লাগছে। এসব নানা ডিটেলস এরই মধ্যে জমিয়ে ফেলেছি আমি। কিছুক্ষনের জন্য আমি গল্পের বই-এ একটু ডুবে গেছিলাম, হঠাৎ কানে এলো রবীন্দ্রসংগীতের সুর। বেশ রেওয়াজী গলায়। আর সেই গলাটা আবার আরেকটা গলায় মিশে বেশ জোরালো কোরাস হয়ে আমার চোখদুটোকে বাধ্য করলো সেদিকে তাকাতে। ওরা গান করছে। স্মার্টি বেশ হেসে হেসে দুলে দুলে, হাততালি দিয়ে আর মোটি ধীর স্থির হয়ে, বেশ একটা ব্লিসফুল শান্তি ওর চোখে মুখে গান গাওয়ার সময়। আমি মন দিয়ে গান শুনছিলাম। এ কি লাবণ্যে পূর্ণ প্রাণ প্রাণেশ হে…!
কিছুক্ষন পরে আর থাকতে পারলাম না। কতগুলো জিনিষে আমার নিজের ওপর কন্ট্রোল কোনোদিনই নেই। ভালো গান আমাকে চিরদিনই কাঁদায়। সিট থেকে উঠে চলে গেলাম ওদের সিটের দিকে।
“আপনাদের গানে কি পাসওয়ার্ড দেওয়া আছে?”
আমার প্রশ্নে মেয়েদুটো প্রাথমিক বিহ্বলতা কাটিয়ে “এমা না না কোনো পাসওয়ার্ড নেই চলে আসুন” বলে ওয়েলকাম করলো।
প্রাথমিক আলাপের বাড়াবাড়িতে না গিয়ে শুধু নাম বিনিময় করেই আবার গান শুরু হয়ে গেলো। তারপর শুরু হলো এক নতুন জার্নি। শুধু গান আর মাঝে মাঝে আড্ডা। আড্ডা আর গান। জেনে ফেললাম…ওরা এঞ্জিনিয়ারিং পড়ে। শিলিগুড়িতে। ছুটিতে কোলকাতা এসেছিলো। ওদের বাড়ী নর্থ বেঙ্গলেই। কোলকাতায় রিলেটিভের বাড়ীতে থেকে বেশ কয়েকদিন কোলকাতা ঘুরে, পরিচিতদের সাথে আড্ডা-টাড্ডা মেরে ফিরে যাচ্ছে আবার ওদের শহরে। মোটির নাম অদিতি আর স্মার্টির নাম শেলী। অদিতিকে মনে হলো বেশ রিজার্ভড। খুব মেপে কথা বলে। বা আগে হয়তো আমাকেই মেপে নিচ্ছে। মোটের ওপর ক্যারেড-অ্যাওয়ে টাইপের আবেগ-স্বর্বস্য নয়। অ্যাটলিষ্ট আমার মনে হলো। অবশ্য আমার মনে হওয়াটা আমার কাছে ভীষন কনফিউসিং! মানুষ ঠিক কি রকমের সেটা পুরোপুরি কখনোই জানা যায় না। আমি সাইকোলজিষ্ট নই। কিন্তু জীবন থেকে বলছি, আমরা কতগুলো ঘটনায় মানুষের আচরণ দেখে গড়পড়তা একটা চরিত্র নিজেদের মতো করে বসিয়ে দিয়ে নিজেদের খুব স্মার্ট মনে করি, আর মনে মনে বা প্রকাশ্যে এটা বলতেও ছাড়ি না” হুঁ হুঁ বাবা, আমার সাথে পেঁয়াজী, আমি তোমার সব ধরে ফেলেছি” । আসলে কেউ কাউকে পুরোপুরি ধরতে পারেই না। সেটাই তো সম্পর্কের মজা! না হলে সম্পর্ক একটা বস্তাপচা রদ্দিমার্কা ভালো ভালো ব্যাপার স্যাপার হয়ে যেতো। কিন্তু সম্পর্কের এই জটিলতা, অলিতে গলিতে হারিয়ে যাওয়া, কখনো রোদ, কখনো মেঘলা আকাশ এসবই তো সম্পর্কের মজা। যাই হোক গল্পে ফিরে যাই আবার। অদিতিকে রিজার্ভ লাগলেও শেলী দেখলাম ভীষন ছটফটে। যাকে বলে পায়ের নীচে চাকাওয়ালী। একফোঁটা চুপচাপ বসে থাকতে পারে না। খুব হুল্লোড়ে। বেশ খানিকক্ষন আড্ডায় আমাদের মধ্যে যখন বেশ একটা বন্ধুত্ব দানা বেঁধেছে আর আপনি কখন তুমি আর তুই এর হাতে আড্ডাকে হ্যান্ড-ওভার দিয়ে কেটে পড়েছে আমাদের ছেড়ে, শেলী আমাকে বললো ‘জানোতো তুমি যদি আমাদের এখানে না আসতে আমি তোমাকে ঝাড়ি মারা শুরু করতাম, ট্রেনে একা একা যেতে আমার ভীষন বোর লাগে! অদিতি তো জানলা দেখবে আর ঘটের মতো নড়বেনা আর আমি কি করতাম বলো’ বলে খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসতে লাগলো। সেই মুহুর্তে জানতেও পারিনি সেই রাতের পর শেলীর সাথে দেখা হবে না বহুদিন আর যোগাযোগও রাখতে চাইবে না কোন অজানা কারনে; আবার দেখা হবে বছর ছয়েক পরে সেক্টর ফাইভে আমাদের এক ক্লায়েন্ট অফিসের সামনে!
২
ট্রেন চলছিলো ঝমঝমিয়ে, সন্ধ্যা গড়িয়ে রাতের কালো অন্ধকার ফুঁড়ে। কথায় কথায় বেরিয়ে এলো অদিতির বাবা অধ্যাপনার পাশাপাশি নাটকের দল চালান আর অদিতি সে দলে শিশুবেলায় অভিনয়ও করেছে। ও ভালো নাচেও আর গায় যে ভালো সেতো আমি শুনছিই। শেলী সাহিত্যের পোকা আর খুব আড্ডাবাজ আর স্বপ্ন দেখে একদিন ও একটা রোবট বানাবে। আমার স্বপ্ন লেখক হওয়ার শুনে ওরা বেশ উচ্ছসিত হলো। বাঙালী মেয়েরা কবি বা গদ্য লেখকদের ভেবে এখনো উচ্ছাস প্রকাশ করে দেখেছি। এই ব্যাপারটা বাংলার বাইরে ভীষন মিস করি! আমার টেকনিশিয়ান সুমনকে দেখে আমার মায়া হচ্ছিলো। একে তো সে বেচারা বাংলা বোঝে না তার ওপর ও শেলীকে যে টাইপ ভেবেছিলো তা একেবারেই নয় এটা বুঝে আর এ পথ মাড়ায়নি ও। চুপচাপ নিজের জায়গাতেই বসে ছিল। আমাদের আড্ডাতে আর আসে নি। এর মধ্যে আমাদের ডিনার থালি চলে এলো। তখন রেলে থালি আসতো। এখন দেখি প্যাকেট সিস্টেম চালু হয়েছে। আমার থালির-খাবার দারুন লাগতো। রুটি, তেলতেলে মুরগীর ঝোল, টোকো আচার, পেঁয়াজ আর কাঁচালঙ্কা। আর পাউচ প্যাকেটে জল। এই ছিলো আমার সে-রাতের মেনু। অদিতি আর শেলী বাড়ী থেকে খাবার নিয়ে এসেছিলো। ওদেরটাও একটু টেষ্ট করলাম আমি। খাওয়া দাওয়া শেষ করে আবার আড্ডা শুরু হলো। ওদের সিটের অন্যদিকে একজন নার্স ছিলেন; উনি একবার কথায় কথায় জিজ্ঞেস করলেন আমরা লাইট কখন নেভাবো। আমরা তো বিনদাস্! লাইট নিভিয়ে আবার গান ধরলাম আস্তে আস্তে গলায়। এবার অন্ত্যক্ষরী। আর গানের ফাঁকে ফাঁকে কত কথা! সত্যি এখন ভাবতেও অবাক লাগে মাত্র ৮-৯ ঘন্টার মধ্যে আমরা কি ভীষন বন্ধু হয়ে গেছিলাম।
সেদিন মনেই হচ্ছিলো না আমরা অপরিচিত ছিলাম! কিছুক্ষন আগে আর রাত ১টার সময় অন্ধকার সিটে আমরা একে অপরের গায়ে হেলান দিয়ে গান গেয়ে যাচ্ছি, আড্ডা মেরে যাচ্ছি আর শেয়ার করে যাচ্ছি কত না বলা মনের কথা তিন ভীষন ঘনিষ্ঠ বন্ধুর মতো। এটাই বোধহয় সম্পর্কের রহস্য আর মজাও। রাতে আমাদের কারোরই ঘুমোতে ইচ্ছে করছিলো না। মনে হচ্ছিলো এই সময়টাকে ধরে রাখি। একে যেন হারিয়ে যেতে না দিই। প্রেম এলো তার সময়মতোই। জানলাম অদিতির এই-মুহুর্তের প্রেমিক থাকে ব্যাঙ্গালোরে, এঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে আর শেলীর ষ্টেডী প্রেমিক শিলিগুড়িতেই কমার্স নিয়ে পড়ে আর ভালো লেখে। প্রথমে অদিতির লাবণ্যমাখা চেহারায় মুগ্ধ হলেও শেলীকেও আমার বেশ ভালো লাগছিলো। ওদের সম্পর্কে জানতে আরো বেশী ভালো লাগছিলো। ওদের ছোট ছোট খুনসুটি, দুষ্টুমি আমার বেশ মজাই লাগছিলো। একদিকে ওদের যেমন সিনিয়র হিসেবে জ্ঞান দিচ্ছিলাম আবার বন্ধু হয়ে কাঁধও দিচ্ছিলাম সে রাত্রে। ওদের হোষ্টেলের নানা দুষ্টুমী, ওদের বয়ফ্রেন্ডদের নিয়ে চুটিয়ে প্রেম এসবের ফাঁকে ওরা আমাকে জিজ্ঞেস করে বসলো আমার ভালোবাসার মানুষটার কথা। ঠিক এই ভয়টাই পাচ্ছিলাম। আসলে আমার একদম ভালো লাগছিলো না মিতার কথা বলতে ওদের। মিতার সাথে আমার তখন সদ্য ব্রেক-আপ হয়েছে। একটা বেশী শক্ত ডালে ও উড়ে গেছে তখন। আসলে ও আমার চেয়ে জীবনের অঙ্কে অনেক বেশী ভালো ছিলো। তাই হিসেবের ব্যপারে ও আপোষ করেনি। ওকে আমি আজো মিস্ করি। হাজারো দুঃখ থাকলেও। রাগও ছিলো আগে আগে সময়ের সাথে সাথে রাগটা কমে এসেছে। এমন কথাও মনে হয় এখন হয়তো ও আমাকে যোগ্যই মনে করেনি ওর; তাই ওপর ওপর দিয়ে মিতা এপিসোড বিদায় দিলাম। শেলী আমার গুমোট ভাবটা বুঝে একটা গান ধরলোএমনি করেই যাই যদি দিন যাক নাআমার কালো মেঘগুলো সরে আবার রোদ এলো অন্ধকার কামরায়।
কি একটা ষ্টেশনে গাড়ী থেমেছে তখন। শুনলাম অনেকক্ষন থেমে থাকবে। অদিতি আবদার করলো কোল্ড-ড্রিঙ্কস খাবে। চললাম সব্বাই মিলে দরজার দিকে। প্লাটফর্মে নেমে পড়লাম। হাতঘড়িতে তখন রাত আড়াইটা। সারা ষ্টেশনে কটা মানুষ আঙুলের পাব গুনে বলে ফেলা যায়। সামনের দোকানটায় লাইট জ্বলছে। একটা বড় কোকের বোতল কিনে চুমুক দিলাম একটু করে সবাই মিলে। অদিতি একটা চুমুকে গাল ভর্তি করে কোক পুরতেই আমি গাল দুটোকে টিপে দিলাম আর পুচুৎ করে কোকটা সামনে ছিটকে পড়লো। শেলী হাসতে লাগলো। আর অদিতি তো রেগে কাঁই। ট্রেনে উঠে পড়লাম আবার। ঘুম পাচ্ছিলো আমাদের এবার। ওরা নামবে ভোর ছটায়। আমি আরো পরে। ঘড়িতে অ্যালার্ম দিয়ে ওরা নিজের নিজের সিটে শুয়ে পড়লো আর আমিও আমার সাইড আপারের বিছানায় বেড-সীট গায়ে দিয়ে শুয়ে পড়লাম স্বপ্ন দেখছিলাম ঘুমের মধ্যেই আমি, শেলী আর অদিতি কোন একটা উঁচু পাহাড়ের ওপর বসে গান করছি আর মিতা ওদের দেখে ভীষন রেগে গেছে। আমার আবার ভীষন আনন্দ হচ্ছিলো মিতার হিংসে দেখে। কি না জানি কি ভাবছে ও আমাদের নিয়ে! কিন্তু ও কি করে জানলো আমরা পাহাড়ে এসেছি! হঠাৎ কে ঠেলা দিলো আমায়! কিছু বোঝার আগে চোখ খুলে ফেলেই দেখি অদিতি গুড-মর্নিং জানাচ্ছে। কি মিষ্টিই না লাগছে ওকে দেখে! ও বললো ছ-টা বাজতে চললো; আর কিছুক্ষনের মধ্যেই ষ্টেশনে ঢুকছে ট্রেন। ওরা এখানেই নেমে যাবে। তারপর কি একটা ট্রেন ধরে কুচবিহার যাবে। ট্রেনের গতি কমে আসছে আর আমি ভাবছি আমাদের কি আবার দেখা হওয়া সম্ভব! ওরা থাকে নর্থে। আমি কোলকাতায়। কালেভদ্রে গ্যাংটক গেলেও শিলিগুড়িতে থেকে যাওয়া অসম্ভব। ওদের হোষ্টেল আবার শহর থেকে অনেক দূরে। অবশ্য ওরা রাজী থাকলে দেখা হতেই পারে পরে। কিন্তু জীবন কি এত কিছু মনে রাখে? ওদের সাথে আমিও নামলাম ট্রেন থেকে। শেলী আর অদিতির মুখে একটা অদ্ভুত বিষাদ। মুখে কিছু না বললেও চিলতে বিষাদী হাসি ঠোঁটের আগায় ওদের। আমি তখন আকাশ পাথাল ভাবছি। কি অদ্ভুত আমাদের জীবন! এক রাতের বন্ধুত্ব, বিশ্বাস, আনন্দ। এই তো আসল জীবন যেখানে কোনো প্রত্যাশা নেই। আছে শুধু আনন্দ আর আনন্দ। বিশ্বাস সত্যতা সততা। এর থেকে জীবনের কাছে আমি কি বা বেশী চাইতে পারতাম কালকের রাত্রে। আমায় অনেক দিলো জীবনের এই রাত্রিটা। আবার দেখা হওয়ার প্রতিশ্রুতি নিয়ে ওরা চলে গেলো। আমার ট্রেনেরও হুইশেল বেজে উঠলো। প্ল্যাটফর্ম থেকে ট্রেনটা ছেড়ে যাওয়া অব্দি আমি দরজায় দাঁড়িয়ে ছিলাম আর ওরা আমায় হাত নাড়ছিলো।
৩
নানা কারনে মাঝে ৫-৬ বছর আমাদের সম্পর্কের সূতো ক্ষীন হয়ে গেলো। দেখা আর হোলো না। শুধু মাঝে মাঝে মেল আর কালে ভদ্রে ফোন। ব্যস্ত জীবনের ফাঁকে যা হয়। তাও আবার যোগাযোগের অভাবে ফোন নাম্বারও ডাষ্টবিনে চলে গেলো। এই সেদিন আমি সেক্টর ফাইভের একটা বিল্ডিং-এ গেছি ক্লায়েন্ট সাইটে কিছু কাজ-কম্মো চলছিলো ওখানে; দেখলাম আমাদের কোম্পানীর কিছু বাচ্চা বাচ্চা ছেলে মেয়ে ওখানে বসেই ক্লায়েন্টকে সাপোর্ট দিচ্ছে। একটা মেয়ে দেখলাম ফুল শার্ট আর সাদা গেঞ্জী পরা, চুলটা কর্পোরেটের বিপাশার ষ্টাইলে জড়ো করা পেছনে মন দিয়ে ওর কম্পিউটারের স্ক্রীনের দিকে তাকিয়ে। কাজের ফাঁকে ফাঁকে মেয়েটিকে আমিও দেখছিলাম, মানে দেখার চেষ্টায় ছিলাম। মুখটা দেখতে পাচ্ছিলাম না। এর মধ্যে আমাদের কাজকম্মের মধ্যে আমি ডুবে গেছি, মেয়ে-ফেয়ে মাথায় উঠেছে একটু পরে, যখন চাপ রিলিজ করার জন্য একটু উঠে দাঁড়িয়েছি কফিবমেশিনে গিয়ে একটু কফি দোয়াবো বলে, এমন সময় মেয়েটাও চেয়ার থেকে উঠে ঘুরে দাঁড়ালো।
‘একি অদিতি তুই? ’
‘আরে তুমি! এখানে কি করছো? ’
‘আমারও প্রশ্নটা সেম্’
দুজনেই হেসে ফেললাম।
ক্লায়েন্ট সাইটে আবেগের ব্যারেজ না ভাসিয়ে অফিস থেকে বিল্ডিং করিডরে বেরিয়ে এলাম দুজনে। কবে কোথায় এসব পালা চুকিয়ে আমি জিজ্ঞেস করলাম
‘গান করিস তো এখনো? ’
ঝলমলিয়ে তাকিয়ে বললো” হ্যাঁ এখনো ছাড়িনি। আর এটা বুঝে গেছি ছাড়লে আমি মরে যাবো…”
‘ভেরী গুড এইটা অনেকেই বোঝে না রে, দৌড়য় শুধু কেরিয়ারের পেছনে। ওটাও ভীষন ইম্পর্টেন্ট কিন্তু নিজেকে বাদ দিয়ে তো নয়’
‘ঠিক; আমি দক্ষিনীতে ভর্তি হয়েছিলাম; কিন্তু চাকরীর জন্য ডেটে প্রবলেম হচ্ছে। তাই দক্ষিনী ছেড়েছি। কিন্তু রেগুলার একবার না একবার হারমোনিয়াম নিয়ে বসছি। আমি এখন গুরু খুঁজছি, যে আমায় আমার সময়মতো বাড়ীতে এসে গান শেখাতে পারবে’।
‘বুঝছি তোর সিচুয়েশন। কিন্তু তুই যে এতো চাপের মধ্যেও ধরে রেখেছিস রবিঠাকুরের গানকে সিরিয়াসলী এটা দারুন লাগলো আমার’।
হাসলো ও। সেদিনের মতোই সুন্দর লাগলো ওর হাসিটা। ‘দেখি কোথায় যাই শেষ অব্ধি’; কথা প্রসঙ্গে আরো নানা কথা উঠে এলো। ওর মাও নাকি আজকাল ওর বাবার নাটকের গ্রুপে ষ্টেজে অভিনয় করছে। আর ওর মাসতুতো দিদির পুচকে মেয়েটা এখন নাকি ক্লাস ওয়ানে পড়ে! যার কথা সেই রাতে খুব শুনছিলাম ওদের কাছে, তখন বোধহয় ১-২ মাস বয়স ছিলো; ফটোও দেখিয়েছিলো অদিতি আমায় পুচকির।
‘শেলীকে মনে আছে? ’ অদিতি এবার আমাকে জিজ্ঞেস করলো।
‘বাঃ, তো থাকবে না? সে গেছো কোথায়? ’
‘ও তো ওই অফিসে’ বলে সামনের বিল্ডিংটা দেখালো।
‘তাই নাকি? ডাক ওব্যাটাকে’।
‘না না আজ নয়, ওকে সারপ্রাইজ দেবো দাঁড়াও’। বাড়ী ফিরে আমার স্ত্রীকে বললাম ওদের কথা। ওদের কথা অবশ্য আগেই বলেছিলাম; ওদের সাথে দেখা হওয়ার কথা জানালাম। ও হেসে বললো ‘যাক তোমার অফিস তাহলে তো বেশ কালারফুল হলো’। কি বলবো আমি!
পরদিন বিকেলে অদিতি আমার কাছে এসে বললো ‘একটু বাইরে চলোতো, কথা আছে’
আশেপাশের লোকজন দেখি তাকাচ্ছে; হয়তো ভাবছিলো এ আবার কি? একটা জুনিয়ার মেয়ে এসে কেমন হিড় হিড় করে সিনিয়ারকে নিয়ে যাচ্ছে দেখো! ওরা তো আর ভেতরের খবর জানে না; জানলে ভিমড়ি খেতো। বাইরে এসে দেখি শেলী কেমন একটা” ওয়্য্য্য্য্য্যাও” মার্কা মুখ করে এগিয়ে আসছে। আশ্চর্য্য ব্যাপার ওরা কিন্তু দেখতে কিচ্ছু আলাদা হয়নি। কিছুক্ষনের মধ্যে আমরা হারিয়ে গেলাম ছ বছর আগের সেই রাতে, স্মৃতিগুলো শুয়োপোকার মতো বেরিয়ে এলো অন্ধকার অতীতের গর্ত ফুঁড়ে; আর কত কথাও ! শেলী তো আদতেই প্রানখোলা, আর হৈ-হুল্লোড়েকোনো চেঞ্জ দেখলাম না ওর। সেদিন রাতে শেলীকে দেখে মনে হয়েছিলো শ্রীনিকেতনের রাস্তায় উদাস বাউলের মতো উচ্ছল উত্তেজনায় ভরপুর আজো একই আছে। একটু পরে অদিতি চলে গেলো ওর কাজে, কি একটা ডকুমেন্টেশন আছে বলছিলো; বেচারী একটু চাপেই আছে। আমি আর শেলী দাঁড়ালাম মুখোমুখি। সেই রাতে শেলীর মধ্যেও আমি খুব সুন্দর একটা মন পেয়েছিলাম যে ভীষন সুন্দর করে ভাবতে জানে। সেরাতে শেলী জানলার ধারে উদাস হয়ে বলেছিলো ‘জানো আমি নিজেই বুঝতে পারি না আমি কে ? আমি কি? আমি কেন? ’
‘এটা তো খুব জটিল প্রশ্ন রেআর এর উত্তর তাত্ত্বিক ভাষায় নয়, হাতে কলমে করে দেখে খুঁজতে হয়’। একথা ওকথায় হারিয়ে গিয়েছিলো ওই কথাগুলো।
শেলী আজ একটা কচি কলাপাতার টপ আর জিন্স পরেছিলো আর সেরাতের থেকে ওকে অনেক বেশী স্মার্ট আর ঝকঝকে লাগছিলো আজ। আমি জিজ্ঞেস করলাম ‘শেলী খুঁজে পেলি কি? নিজেকে? ’ আমার দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললো ও। ‘নাঃ পাইনি। খোঁজার সময়ই পাচ্ছিনা। অকারন হাবিজাবি কাজ করতে করতে মাথা এতো ব্যস্ত যে ভালো কিছু ভাবার সময়ই পাচ্ছে না। ভালো লাগছে না আমার জানো। কিচ্ছু ভালো লাগছে না। কলেজে যখন ছিলাম ভাবতাম ক্যাম্পাসে যদি লেগে যায় জীবন ধন্য হয়ে যাবে। কিন্তু এখন? সেই চাকরী তো ছ মাস হয়ে গেলো সেই আনন্দ তো পেলামই না। সারা দিন তো সফিসষ্টিকেটেড কেরানীর কাজ করি। খালি কন্ট্রোল ভি আর কন্ট্রোল সি! নিজের ভাবনাকে তো ব্যবহারের সুযোগ পাইই না’।
আমি বললাম ‘জানিস শেলী আমার মনে হয় তুই জার্ণালিষ্ট হলে পারতিস। এতো স্মার্ট এত সুন্দর কথা বলিস এতো ঝকঝকে তুই। এতো শেডস্ তোর’ কিছুক্ষন চুপ করে রইলো ও। ‘মানে বলছো আমি কর্পোরেটে মিসফিট্ তাই তো? ’
‘এক্কেবারেই না শেলী; কর্পোরেটে খুব বেশী স্ফিয়ারের দরকার হয় না। এখানে রিয়েলিটি নিয়ে বেশী কাজ তো তাই রুড রিয়েলিটির একঘেয়েমিকে অ্যাক্সেপ্ট করে মনের জোরের সাথে চলার জার্নিতে যারা অনাবিল দৌড়তে পারে তারাই সো কলড সারভাইবার। কিন্তু সেটা চাপের হলেও কঠিন নয়, টেনশনের হলেও সূক্ষ্ম নয়। কিন্তু তুই তো অনেক আলাদা মেয়ে আমি জানি সেটা। তুই আরো অনেক কিছু করতে পারতিস’। ও আমার দিকে তাকালোতারপর বললো ‘আমি ছোটবেলায় বড়মামার কাছে একটা রোবট দেখেছিলাম। জিজ্ঞেস করেছিলাম এটা কে তৈরী করেছে? বড়মামা বলেছিলো এটা কোনো ইলেকট্রনিক্স এঞ্জিনিয়ার তৈরী করেছে। আমার মাথায় ঢুকে গেলো সেই রোবটের কথা। আমি ঠিক করে ফেললাম ইলেক্ট্রনিক্স এঞ্জিনিয়ারিং-ই পড়বো। এতো দিন হয়ে গেলো, এতো কিছু পড়ে ফেললাম চাকরীতে ঢুকে গেলাম কিন্তু সেই রোবোট বানানো আমার আর হলো না’।
‘তা কেনো শেলী চাকরী তো করতেই হবে। আর চাকরী তো তোর মনের মত কখনো হবে না কিন্তু ওর ভেতরেই তোকে নিজেকে খুঁজতে হবে; নিজের স্পেশালিটিকে অ্যাড কোরতে হবে; এই আলাদা হওয়াটা তোর বন্ধুরা বুঝবেনা, তোর বস্ও হয়তো বুঝবে না …হয়তো তোকে ভুলও বুঝবে কখনো কিন্তু তুই যে আলাদা হয়ে একই কাজকে অন্য একটা আদলে ঢালছিস… গতানুগতিকতার পৌনপুনিকতায় নিজেকে না আটকে জানলা খুলে দক্ষিনের বাতাস ভরিয়ে দিচ্ছিস তোর কিউবিকলে এটা ভেবে তুই আনন্দ পাবি’। শেলী একটু উদাস হয়েই বললো ‘কিন্তু আমি এভাবে ভাবতে পারি না গো…আমি সময়ই পাই না। দেখো চারিদিকে …কেমন একটা সুখী সুখী ভাব। সবাই কেমন নিপাট ঠিক্ ঠাক। সুন্দর এর পাশে সুন্দরী্, ঝকঝকের পাশে ঝকঝকি। কি ঠিক ঠাক সহাবস্থান! কিন্তু তুমি ওদের ভেতরটা খোঁড়ো দেখবে কত পুঁজ রক্ত বাসী পচা কান্না প্লাষ্টিকে প্যাকেটে মোড়া আছে। ফেলতে না পেরে পচা গন্ধ বেরোচ্ছে । সেন্ট মেখে চলে আসছে সেই পচা গন্ধে… মুখ ভর্তি হাসি নিয়ে’। আমি বললাম ‘সেটা তো আমরা সবাই। বাঁচার মুখোস আমাদের সবাইকে পরতেই হয়। কারন সোসাইটি ‘সবাই’ কে দেখতে চায় ‘নরমালাইজ’ করে। সোসাইটি কোনো ‘ইন্ডিভিজুয়্যাল’কে দেখতেই তো চায়না। বরং কারো মধ্যে ইন্ডিভিজুয়্যালিটি পেলে বুঝিয়ে সুঝিয়ে বা পরে মেরে ধোরে সবকিছুর মধ্যে ইক্যুইলিব্রিয়াম আনার আপ্রান চেষ্টা করে যায়! এখানেই তো আমাদের লড়াই। আমরা কি এত সহজে এই ফাঁদে পা দেবো নাকি আমরা জীবন ভোর লড়াই করে যাবো ‘ইন্ডিভিজুয়্যাল’ হবার জন্য… এ সিদ্ধান্ত কিন্তু আমাদের; হাজার কাজের চাপ, ফ্যামিলির চাপের মধ্যেও এই সিদ্ধান্ত আমাদের নিতে হয় আর লড়াইও চালাতে হয়। এভাবেই বেঁচে থাকা যায় সেটা প্রুভ করতে হয় শেলী’। ও এবার ঘড়ি দেখলো। ঘড়ির কাঁটা বললো সাড়ে ছ টা। ‘এবার আমি যাই… যাদবপুর পৌঁছতে দেরী হবে। ও চিন্তা করবে’… শেলী মুখ তুলে বললো।
‘ও কি আগেরটাই? ’
‘তাছাড়া আবার কি হবে! ’
‘এবার বিয়েটা কর’
‘দাঁড়াও ও আগে একটু ষ্টেবল্ হোক’
আমি বললাম ‘আমাকে বিয়েতে বলবি তো? ’
ও জোরালো চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বললো ‘ তুমি কেন এতোদিন হারিয়ে গিয়েছিলে? ’ আমি হাসলাম, বললাম ‘তুই খুঁজেছিলি? ’
‘নাঃ সত্যিই খুঁজিনি। তুমিও তো খুঁজতে পারতে! ’
‘তা পারতাম। যাই হোক আবার কিন্তু আমরা হারিয়ে যেতে পারি শেলী। এটাই জীবন। কোনোকিছু কনষ্ট্যান্ট নয়। কিন্তু সেদিন রাত …আজকের এই কিছুক্ষনকে নিয়েই তো বুকের মাঝে একটা স্মৃতির কেবিন গড়ে ওঠে তাই না? আর মাঝে মাঝে মন খারাপ করা কোনো দুপুরে কফি হাতে সেই কেবিনে ঢুকলেই মনে পড়বে সেসব স্মৃতি, তখন দেখবি মনটা ঝলমলিয়ে উঠলো’। আব্দারি গলায় ও বললো ‘তুমি লেখা ছাড়বেনা কিন্তু। তুমি লিখলে আমি পড়বো তোমার লেখা আর তোমার কাছাকাছি থাকবো’। আমি হেসে বললাম ‘লেখা আমি ছাড়তে পারবনা রে। কিন্তু পাবলিশার বা সম্পাদক কতটা সহায় হবেন বা পাঠক কতটা খুশী হবেন সেটা তো আমার হাতেই নেই রে। আমি লেখাটা ভালোবাসি তাই লিখি। আর ভালোবাসার কিছু কেউ ছেড়ে যেতে পারে যদি কেউ স্বীকৃতি নাও দেয়? এতো আমার নিজের ভেতরের জিনিষ। স্বীকৃতি দিলে ভালো না দিলেও এ শুধু আমার-ই’। শেলী এবার নেমে গেলো সিঁড়ি দিয়ে পাশে আমি। ওকে এগিয়ে দিতে এলাম গেট পর্যন্ত। গেটে পৌঁছে ওকে হাত তুলে ‘বাই’ জানিয়ে পেছন ফিরতেই দেখলাম ওই দূরে অদিতি দাঁড়িয়ে আছে । আমি এগিয়ে গেলাম অদিতির দিকে। ও হাসলো। ওকে কিন্তু সেই রাতে ট্রেনের বাল্বের আলোয় দেখা ‘মোটি’র মতোই সুন্দর লাগছিলো। কিন্তু আমার মনে জলতরঙ্গটা বেজে উঠলো না আর। সেরাতের মতো। আসলে জীবনের কোনো কিছু হয়তো ঠিক কোনকিছুর ‘মতো’ হয় না। কারন জীবন সত্যিই রক্ত মাংসের বাস্তবতা ভরা নিপাট জার্ণি ছাড়া আর কিছু কি! আর কোনো ভাবনা মাথায় এলো না আমার ।
আমি রাঁচি পলাতক-সায়ন্তনী পূততুন্ড
যখন হুস্কুলের (সমাস—হুল্লোড় যুক্ত স্কুল) চৌকাঠ পেরিয়ে কলেজে ঢুকলুম তখন হঠাৎ ধারণা হল যে
‘দেখ আমি বাড়ছি মাম্মি’!
যদিও বাড়িতে সবার চেয়ে বয়সে ছোট ছিলুম বলে এই বড় বড় ভাবটা ফলানোর জায়গা বিশেষ পেতুম না। আমার কনিষ্ঠতমা দিদির সাথে বয়েসের পার্থক্য ছিল মাত্তর দশ বছর! আর কাজিন ব্রাদার—তথা বংশের সবচেয়ে বড় দাদাকে কাকু বলে ডাকলেও বিশেষ অসুবিধে কিছু হয় না! একবার তার পেছনে খুব লেগেছিলুম। উত্তরে তার গম্ভীর প্রতিক্রিয়া
—‘ফাজলামি করিস না, আমি তোর বাপের বয়েসি! ’
দাদারা যদি এই ডায়লগ মারে তাহলে সহ্য হয়? কি জ্বালা! দাদার সাথে ইয়ার্কি মারবো না তো কি ও পাড়ার পদীর ভাইপোর সাথে মারবো! অন্যায় নয়?
যাই হোক, তখন বাড়ির সবার দাদাগিরি, দিদিগিরি পেরিয়ে কলেজে ঢুকে বেশ আত্মস্ফীতি অনুভব করছি। (যদিও এমনিতে আমি যে বেশ স্ফীত তা ছবি দেখে যে কেউ বুঝতে পারবে! আমার একটাই দুঃখু, অনন্তকাল অনাহারে থাকলেও স্ফীতি কিছুতেই কমে না! )ভাষাতত্ব, ছন্দ আর অলঙ্কারের হেভি ডোজের পাঞ্চ পাকিয়ে ঘুরছি। ‘কাকে দিইকাকে দিই’ ভাব! এখন কেউ আমায় ‘ছোত্ত’ বলতে আসুক—ব্যাটাকে সোজা অক্ষরবৃত্ত, দলবৃত্ত, অনুপ্রাস, ব্যজস্তুতি, নাসিক্যবর্ণ আর প্লুতস্বরের গোঁত্তা মেরে আপ্লুত করে দেবো!
‘ছোত্ত’ বলা! দাঁড়াও!
ঠিক এমন একটা পজিশনেই আধখ্যাপা বঙ্গাল আইনস্টাইনের সাথে এক্কেবারে যাকে বলে মুখোমুখি সংঘাত হয়ে গেলো!
ঘটনাটা কিছুই নয় নিতান্তই সামান্য ব্যাপার!
আমাদের থেকে একবছরের বড় অনির্বাণদা অসম্ভব গানপাগল মানুষ ছিল। যদিও তার নিজের গলার গান শুনলেই মন ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে! মনে হয় দুনিয়ায় খালি দুঃখ ছাড়া আর কিছুই নেই!
কারণ সে যাই গাক না কেন, সে জ্যাজই হোক কি শ্যামাসঙ্গীত, বিয়েশাদীর গান কি আইটেম সং- আল্টিমেটলি সেটা স্যাড সঙেই পরিণত হত! নিন্দুকেরা বলে, সে নাকি একবার করিডোরে বসে গাইছিল—‘প্রাণ ভরিয়ে তৃষা হরিয়ে মোরে আরো আরো আরো দাও প্রাণ! ’ সে গান শুনে প্রেসিডেন্সি কলেজের বাইরে তিনটে বিড়াল কেঁদেকেটে যাচ্ছেতাই করেছিল। দারোয়ান মোহনদা এমন বিষম খেয়েছিল যে তাকে মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি করতে হয়েছিলএবং আমাদের হেড অফ দ্য ডিপার্টমেন্ট বীরেন মুখার্জী ‘কে কাঁদছেকে কাঁদছে’ বলতে বলতে উর্দ্ধশ্বাসে ছুটে এসেছিলেন!
বলাই বাহুল্য ‘আরও আরও আরও দাও প্রাণ’-এর চোটে গোটা কলেজের প্রাণ যেতে বসেছিল। মোহনদা কোনমতে সুস্থ হয়ে তাকে রীতিমতো হুমকি দিয়েছিল—‘ ফিরসে যদি তোমি গান গেয়েছে, তো হোয় হাম খুদখুশি করবে নয়তো তুমায় মার্ডার’।
অনির্বাণদার উৎসাহ এমন ভয়াবহ হুমকির পরেও কমেনি। এবং সে যথারীতি তার কলা প্রদর্শনে পিছ পা নয়। তার গানশুনে মোটামুটি গানজানা মানুষেরা ‘আগে কে বা প্রাণ করিবেক দান’ বলে দোতলার জানলা দিয়ে লাফিয়ে পড়তেন। কিন্তু তাতেও সে অবিচল।
কিন্তু কে ভেবেছিল যে নীচের তলার সোশিওলজির প্রোফেসর অখিল রঞ্জন পন্ডিতের সাথে তার এই সূত্রেই রীতিমত পাঙ্গা হয়ে যাবে!
অখিল রঞ্জন পন্ডিতের সংক্ষিপ্ত নাম—‘এ আর পি’! ওঁর পুরো নাম না বলে ইনিশিয়ালই ব্যবহার করব।
একদিন বেশ সকাল সকাল অনির্বাণদা বেশ খুশি খুশি মেজাজে গান ধরেছে—‘যে তোরে পাগল বলে, তারে তুই বলিসনে কিছু’।
আমরা টিচার্স রুমে ছুটেছি তুলোর খোঁজে, বীরেনবাবু দরজা জানলা বন্ধ করে সম্ভবত মাথায় আইসব্যাগ চাপানোর তাল করছেন, প্রোফেসর অলোক শূর অগ্নিদৃষ্টিতে অনির্বাণদাকে দেখছেন কিন্তু কিছু করতে না পারার আফসোস তার চোখে মুখে ফুটে উঠেছে! নাটকের স্যার সৌমিত্র রায় চৌধুরী ওরফে সৌ রা চৌ (ইনিশিয়াল) ক্রমাগত নাটকীয় ভঙ্গীতে নিজেকেই নিজেকে বলে যাচ্ছেন—‘গুরুদেবকন্ট্রোলকন্ট্রোল’
ঠিক এমন সময়েই ড্রামাটিক টেম্পোয় একজনের প্রবেশ।
এবং এসেই খ্যারখ্যারে বিউগলি গলায় চেঁচিয়ে উঠলেন—‘হ-ত-ভা-গা-! পাগল বলছিস কাকে! অ্যাঁ! সাতসকালে পাগল পাগল করছিস হতচ্ছাড়া হ-নু-মা-ন! ’
সেই প্রথম লোকটাকে দেখেছিলুম! আর দেখেই কথা নেই বার্তা নেই, একটা অট্টহাসি!
একটা পাঁচ ফুটি লোক, যার চুলগুলো একদম মাথার সাথে ৯০ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে খাড়া হয়ে আছে—ভয়াবহ ঝাঁটা গোঁফের নীচে একটা পুঁচকি নূর! চোখ দুটো প্রায় টর্চ মেরে দেখতে হয়! পাঞ্জাবিটা উলটো পরেছেন, এমন মানুষকে দেখে লোকে হাসবে না তো কি করবে! আমিও হেসে ফেলেছিলুম! আর তাতেই যা তা কেস!
একখানা লম্ফ মেরে আমার সামনে এসে বললেন—‘ কি ভেবেছিস? আমি পাগল? অ্যাঁ? সার্কাসের জোকার? হাসছিস কেন? গা-ধী! পাঁ-ঠী! রামছাগলী! আমি পাগল? ’
আমি লোকটার হাবভাব দেখে ঘাবড়ে গেছি! গাধী কি গাধার স্ত্রী-সংস্করণ! পাঁঠী—পাঁঠার!
সঙ্গে সঙ্গেই মনে যে চিন্তাটা প্রথমেই এলো তাহল, -লোকটা কি সত্যিই পাগল? না আঁতেল!
কোনমতে বিস্ময়টা সামলে নিয়ে বলি—‘ না কাকু, আসলে আমি ঠিক’
‘কাকু’ সম্বোধন শুনে ‘তৈলে নিক্ষিপ্ত বার্তাকুর’ মতো চিড়বিড় করতে করতে বললেন ভদ্রলোক —‘ কি! কাকু! কে কাকু! এখানে তোর কোন কাকুটা আছে! তুই আমার কোথাকার ভাইঝি! ’
সাথে সাথেই প্রায় চরম ঘোষণা—‘এই ছেলেটা আমায় দেখে পাগলপাগল বলছিল আর মেয়েটা হাসছিল, এক্ষুণি প্রিন্সিপালের কাছে কম্প্লেন না করেছি…! ’
কথাগুলো শুনে আমি এবং ফার্স্ট ইয়ারের সব নতুন সদস্যরাই ধরে নিয়েছে যে ইনি একজন বদ্ধ পাগল! সবাই তখন ভাবছে লোকটাকে কিভাবে শান্ত করবে! কাকু শুনে ক্ষেপে গেছেন দেখে ‘দাদা’ ও বলা হল! কিন্তু তাতেও চিঁড়ে ভেজে না! ক্রমাগতই লম্ফ ঝম্প করছেন –‘ আমি দেখে নেবোপ্রিন্সিপালের কাছে যাবোশেষ দেখে ছাড়বো! ’
ওদিকে হইচই শুনে প্রোফেসররাও বেরিয়ে এসেছেন। ভদ্রলোককে দেখে বীরেনবাবু পড়ি কি মরি করে ছুটে এলেন। এক কোণে টেনে নিয়ে গিয়ে কি যেন বললেন।
শেষ পর্যন্ত ওঁর হস্তক্ষেপেই সমস্যা মিটল।
আমরা তখনও বুঝতে পারিনি ভদ্রলোক অমন চটলেন কেন!
বীরেনবাবু ওঁকে বিদায় দিয়ে এসে খুব নিরীহ মুখেই জানতে চাইলেন—‘ কি বলেছিলে ওঁকে তোমরা? ’
সমস্ত কাহিনীটা ওঁকে বলা হল। শুনে উনি মিটমিট করে হাসছেন—‘স্বাভাবিক, আসলে তোমরা তো ওকে চেনো না! আজ থেকে চিনে রাখো—ওঁর নাম অখিল রঞ্জন পন্ডিত! সংক্ষেপে এ আর পি! সোশিওলজির হেড অফ দ্য ডিপার্টমেন্ট! ’
আমরা যেন মহাকাশ থেকে পড়লুম! অথবা গোটা ব্রহ্মান্ডটাই চাঁদ সূর্যসমেত হুড়মুড় করে মাথায় ভেঙে পড়ল। এবার বুঝলাম ‘কাকু’ শুনে অতো চটেছিলেন কেন! যিনি ‘স্যার’ তাকে ‘কাকু’ বললে তো চটবেনই!
-‘ ভদ্রলোকের কিঞ্চিৎ ম্যানিয়া আছে! ’ বীরেনবাবু তখনও দুষ্টু দুষ্টু হাসছেন। ওঁর হাসিটাই দুষ্টু বাচ্চা ছেলের মতো—
-‘ উনি ভাবেন যে গোটা বিশ্বই ওঁকে পাগল ভাবে! অভ্রান্ত ধারণা যে সবাই ওঁর লেগ পুলিং করার জন্য, উত্যক্ত করার জন্য তৈরি হয়ে আছে! এমন কি জাপানে ভূমিকম্প ও সাইবেরিয়ায় স্নো ফল হলেও ওঁর মনে হবে সেটাও ওঁকে টিজ করার জন্য! একেই এইরকম ভাবনা চিন্তা, তার উপর অনির্বাণও ধরেছে মোক্ষম গান! ’
কি সর্বনাশ! ’যে তোরে পাগল বলে’!
বীরেনবাবুর হাসি তখনও থামেনি। খুব ধীরে সুস্থে তেঁতুলের আচার চেখে চেখে খাওয়ার মতো বললেন—‘ওঁর ধারণা অবিশ্যি খুব ভ্রান্ত নয়। ছাত্র ছাত্রীরা ওঁর ইনিশিয়াল থেকে নতুন নামকরণ করেছে! ’
কি নাম? সেটা বলাই বাহুল্য! এ আর পি এর আর কি যোগ্যতম ফুলফর্ম হতে পারতো এর চেয়ে? অন্তত ওনার ক্ষেত্রে?
এ আর পি ফর—‘আমি রাঁচী পলাতক’!
এ আর পি’র সম্পর্কে তখন থেকেই কৌতুহলের উদ্রেক! অগত্যা সকলেই মিলে সরেজমিনে তদন্ত করতে নেমে পড়লুম।
আমার এক সহপাঠী নীরভ্র’র মতে এ আর পি এর চূড়ান্ত আমাশা আছে! সেইজন্যই অমন কুইনাইন খাওয়া মুখ করে থাকেন।
-‘আমাশার রোগীরা কবে থেকে কুইনাইন খেতে শুরু করেছেন? ’
বাধ্য হয়েই বলে ফেললাম। নীরভ্র’র বাবা গ্যাস্ট্রোএন্ট্রোলজিস্ট হতে পারেন, কিন্তু তাই বলে ও-ই সব ওষুধের নাম জানবে এমন কোন মুচলেকা মেটিরিয়া মেডিকা ওকে দেয় নি!
যাই হোক, অনেক তদন্তের পর এ আর পি সম্পর্কে বেশ কিছু তথ্য জানা গেলো। সবচেয়ে যে তথ্যটা শুনে আমরা আহ্লাদিত হয়েছিলুম তা হল—বছরখানেক আগে ভদ্রলোকের বৌ কোন এক প্রতিবেশীর সাথে ভেগে গিয়েছেন!
শুনেই দেবর্ষির কমেন্ট—‘ তাই ওরকম, বুঝলি না? ডিপ স্টেজ অব ডিপ্রেশন’।
ওর বাবা আবার সাইক্রিয়াট্রিস্ট!
মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলুম ডাক্তারের ছানাপোনাদের হাত থেকে শত হস্ত দূরে থাকবো!
শেষ অবধি আমরা অবিশ্যি সিদ্ধান্তে এসেছিলুম যে ভদ্রলোকের স্ত্রী পালিয়েছেন বলে উনি ওরকম মোটেই নন, বরং উনি ওরকম বলেই স্ত্রী বেচারি পালিয়ে বেঁচেছে!
এ আর পি দমদমে একটা ফ্ল্যাট ভাড়া করে আগে থাকতেন। পরবর্তীকালে বালিগঞ্জে চলে আসেন। ছেলে পুলে নেই। বৃদ্ধা মা এর সঙ্গে থাকেন। তবে তার জীবনের সবচেয়ে বড়ো জায়গা জুড়ে আছে এই কলেজ। বেশিরভাগ সময়টাই কাটান কলেজে। তার পাগলাটে হাবভাবের জন্য ছাত্র ছাত্রীরা তাকে এড়িয়েই চলে। আবার কেউ কেউ স্বেচ্ছায় গিয়ে একটু খেপিয়ে দিয়ে আসতো।
উনি জানতেন যে পিছনে ওকে সবাই ‘আমি রাঁচি পলাতক’ বলে ডাকে! ছাত্র-ছাত্রীরাও জানতো ওঁর দুর্বলতা কোথায়!
হয়তো কোনদিন উনি করিডোর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন এমন সময় কোন এক ছাত্র গিয়ে খুব বিনীত ভাবে জিজ্ঞাসা করল—‘কেমন আছেন স্যার? ’
স্যার খুব খুশি হয়ে বললেন-‘ভালোই আছি, তুই? ’
-‘আমি দারুণ। এই তো কালই রাঁচি থেকে ফিরলাম’।
বলেই ভোঁ ভাঁ দৌড়! আর স্যার! ওখানেই জাস্ট জ্বলে গেলেন! আর হাতের কাছে যাকে পেলেন তাকেই জ্বালিয়ে দিলেন।
‘আমি রাঁচি পলাতক’ তথা এ আর পি এর আরও একটি অদ্ভুত গুণ ছিল। সারাদিনে অন্তত একবার প্রিন্সি’র মুখ না দেখলে তাঁর ভাত হজম হতো না! যে কোনও প্রকারেই হোক, যেভাবেই হোক, প্রিন্সির মুখ তাঁর দেখাই চাই। কথায় কথায় প্রিন্সির কাছে কম্পলেন করতেন! সেটা কোন টিচার সম্পর্কে হতে পারে। ছাত্র ছাত্রীর এগেনস্টে হতে পারে। নিতান্তই কাউকে হাতের কাছে না পেলে এন এস বিল্ডিঙের সামনে ঘুর ঘুর করা কুকুরটার বিরুদ্ধেও হতে পারে।
একবার সেই কুকুরটা তথা ভুলু হঠাৎ কোন কারণে ক্ষেপে গিয়ে ওকে আঁচড়ে দিয়েছিল। এ আর পি সঙ্গে সঙ্গে প্রিন্সির কাছে নালিশ করতে হাজির! রীতিমতো রেগে গিয়ে বললেন—‘ ভুলু আমায় আঁচড়ে দিয়েছে! ’
প্রিন্সি প্রায় আকাশ থেকে পড়লেন। কলেজের কোন ছাত্রের নাম ভুলু, আর কেনই বা সে আঁচড়ে দিয়েছে তা তার বোধগম্য হচ্ছে না! কোনমতে আসল ঘটনা উদ্ধার করা গেল! তাঁর ইনস্ট্যান্ট প্রতিক্রিয়া—‘ কি? আঁচড়ে দিয়েছে! রক্ত বেরোয় নি তো! ’
-‘হ্যাঁ’ এ আর পি ও ঘাবড়ে গেলেন—‘ একটু বেরিয়েছে! কি করবো? অ্যান্টির্যা বিস লাগবে না কি? ’
প্রিন্সি চশমার ফাঁক দিয়ে গম্ভীর একটা ‘লুক’ দিচ্ছেন—‘আপনি সুস্থ আছেন? শরীর খারাপ লাগছে না তো? ’
-‘শরীর খারাপ? কই’ উনি প্রায় ঘেমে নেয়ে একশা—‘না তো! ’
-‘শিওর? ’
-‘ইয়েস! ’
-‘যাক্’। প্রিন্সি দীর্ঘশ্বাস ফেলেন—‘কুকুরটা বোধহয় এ যাত্রা বেঁচে গেলো! ’
তারপর কি হয়েছিল বলে আর কাজ নেই! শুধু এইটুকুই বলা যেতে পারে এরপর প্রায় দীর্ঘ একমাস প্রিন্সির মুখ দেখেননি এ আর পি!
আমাদের অনেকের পাস পেপারে সোশিওলজি ছিল। যাদের ছিল তাদের দুঃখের শেষ নেই! এ আর পি এর জ্বালায় প্রাণ প্রায় ওষ্ঠাগত! ক্লাসে এসেই পড়া ধরতে শুরু করেন। পাস পেপার কেউ পড়ে নাকি? ওটা তো গুলতানির ক্লাস! কিন্তু এ আর পি কিছুতেই বুঝবেন না! সোশিওলজিতে আমাদের সবাইকে প্রায় মাস্টার করেই ছাড়বেন ঠিক করেছেন!
একদিন এমনই একটা দিন। পড়তে কিছুতেই ইচ্ছে করছে না। সচরাচর কৌ রা চৌ এর ক্লাসের পরই এ আর পি এর ক্লাস থাকতো। আর আমরা বেশির ভাগ ছাত্র ছাত্রীরাই ঐ ক্লাসটার পর স্রেফ ভেগে যেতুম! বলাই বাহুল্য এই পলায়ন কান্ডে বীরেনবাবু এবং সৌ রা চৌ এর যথেষ্ট প্রশ্রয় ও সহযোগিতা থাকতো।
সেদিন সবে গুটিগুটি পায়ে করিডোর বেয়ে পালাচ্ছি, হঠাৎ দেখি এ আর পি নির্ধারিত সময়ের আগেই হনহন করে এদিকেই আসছেন!
কি সর্বনাশ! বুড়ো এতো তাড়াতাড়ি এসে হাজির! এবার পালাই কোথায়!
সৌ রা চৌ কোন কারণে টিচার্সরুম থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন! তিনি একঝলক করিডোরের দিকে তাকিয়েই ইঙ্গিত করছেন—‘ আসছেআসছেঘরে যা ঘরে যা! ’
ছুটে ঘরে ফিরে এলাম। সব ছাত্র ছাত্রী মিলে ভাবতে বসেছে এবার কি করা যায়! কি করে মুক্তি পাওয়া যায় এই ক্লাস থেকে!
হঠাৎ কোথা থেকে দেবর্ষি এসে আমাকেই ক্যাঁক করে চেপে ধরল!
-‘এইশুয়ে পড়শিগগির শুয়ে পড়’
আমি তো অবাক! শুয়ে পড়বো! কেন?
-‘ তাড়াতাড়ি কর! ’ সে প্রায় আমাকে ধাক্কা মেরে চিৎ করে ফেলেছে। আপাদমস্তক ওড়না দিয়ে ঢেকে দিয়ে বলল—‘একদম স্টিল হয়ে শুয়ে থাক! খবর্দার নড়বি না! ’
আমি প্রায় ল্যাম্পপোস্ট হয়ে শুয়ে আছি। মাথামুন্ডু কিছুই বোঝা যাচ্ছে না! ভ্যাবচ্যাক দশা! এমন সময় শুনতে পেলুম এ আর পি বলছেন—‘ একি! ফার্স্ট বেঞ্চে লম্বা হয়ে কে শুয়ে আছে! ’
দেবর্ষির গলা—‘স্যার, মেয়েটার শরীর ভীষণ খারাপ! উঠে বসতেই পারছে না! ’
-‘ কি হয়েছে! দেখিদেখি! ’ ভদ্রলোক উদ্বিগ্ন হয়ে ছুটে এলেন। ওড়নাটা আমার মুখের উপর থেকে সরাতে যাবেন, তার আগেই নীরভ্র বলল—‘স্যারসাবধান স্যার ছোঁবেন না! হিতে বিপরীত হতে পারে! ’
স্যার ভয় পেয়ে তিন পা পিছিয়ে গেলেন। ওদিকে ওড়নার তলায় শুয়ে আমার বীভৎস হাসি পাচ্ছে! অতিকষ্টে ও চেপে রাখা যাচ্ছে না! একদম সাইলেন্ট মোডে খুঁখুঁ করে হাসছি! হাসির দমকে শরীর থর থর করে কাঁপছে। তাই দেখে স্যার আরও ভয়ার্ত গলায় বললেন—‘একি! কাঁপছে কেন? ’
ওদিকে বিপদ বুঝে সৌ রা চৌ ও চলে এসেছিলেন। টের পেলাম তার ব্যারিটোন ভল্যুম—‘কি হল অখিলদা! কি হয়েছে? ’
এ আর পি যেন খানিকটা আশ্বস্ত হলেন—‘ সৌমিত্র, দেখো তোমেয়েটার কি হল! ’
-‘কি হয়েছে? ’ সৌ রা চৌ একঝলক তাকিয়েই গোটা ঘটনাটা বুঝতে পেরেছেন। কোনমতে হাসি চেপে বললেন—‘চিন্তা করবেন না! সব ঠিক হয়ে যাবে। আপনি টিচার্সরুমে এসে একটু বসুন’।
এ আর পি সৌ রা চৌ এর পেছন পেছন চলে গেলেন। শুনলাম যেতে যেতেই বলছেন—‘ মেয়েটার কি হয়েছে বল দেখি? কোন নিউরোলজিক্যাল প্রব্লেম? ’
-‘হতে পারে’।
-‘ কিন্তু ওরকম কাঁপছে কেন? ’
ওদিকে এ আর পি প্রশ্ন করে করে সৌ রা চৌ কে ব্যতিব্যস্ত করছেন! সৌমিত্রবাবু কোনমতে হাসি চাপতে গিয়ে আরও উৎকট গাম্ভীর্য মুখে মেখেছেন! আর সেই ফাঁকেই তাঁর চওড়া পিঠের আড়াল দিয়ে লম্বা লম্বা পা ফেলে সবাই পালাতে ব্যস্ত!
পরে অবশ্য এ আর পি ধরে ফেলেছিলেন কান্ডটা! তারপর কি কেলো! ফের প্রিন্সির কাছে নালিশ গেলো! বীরেনবাবু সে যাত্রা সামলে নিলেন।
আমাদের একটা বদ অভ্যেস ছিল। আমরা প্রত্যেক সপ্তাহে একেক জন স্যারের বাড়িতে ঘুরতে যেতুম। সকাল থেকে হা হা হি হি করে, দুপুরে খাওয়া দাওয়া সেরে। বিকেলে আরো একচোট গজল্লা মারার পর সন্ধ্যের সময় ফিরে আসতুম। বীরেন বাবু বা সৌ রা চৌ এর বাড়ি তো আমাদের প্রায় পিকনিক স্পট হয়েই গিয়েছিল, এমনকি এ আর পি ও সেই অত্যাচারের হাত থেকে রক্ষা পাননি।
এ আর পিকে প্রথম থেকেই একটু ভয় পেতাম আমরা সকলেই। কিন্তু সিনিয়র দাদা দিদিরা বলতো—‘ভয় পাস না! উনি মানুষটা খারাপ নন’।
আমরা বলতাম—‘ কি করে বুঝবো? উনি তো হাসেনই না! ’
ওরা হাসে—‘ উনি ফার্স্ট ইয়ারে হাসেন না। সেকেন্ড ইয়ারে মুচকি মুচকি হাসেন। আর থার্ড ইয়ারে একেবারে হো হো হাঃ হাঃ করে হাসতে শুরু করেন! ’
উঃ, কি কমপ্লিকেটেড ব্যবহার!
সেকেন্ড ইয়ারে ওঠার পরই শুরু হল প্ল্যান! এ আর পি এর বাড়ি যেতেই হবে। কিন্তু যত বারই বলা হয়, ততবারই ভদ্রলোক চোখ পাকিয়ে মাথা নাড়তে শুরু করেন!
বাধ্য হয়েই ওনার চালেই ওঁকে গজচক্র করার ষড়যন্ত্র হল। উনি যেমন কথায় কথায় প্রিন্সির কাছে ছোটেন তেমনি ওঁর বাড়িতে ফোন করে বাড়ির প্রিন্সিপাল, তথা ওঁর মায়ের কাছে নালিশ করা হল। ওনার মা সব শুনে বললেন—‘ কি? অখিল তোমাদের বাড়িতে আসতে বারন করেছে? ঠিক আছে। তোমরা সবাই শনিবারই চলে এসো’।
এ আর পি এর কিছুই জানলেন না। শনিবার সকালে উনি মহানন্দে লুঙি পরে বাজারে গেলেন! দু হাতে গুচ্ছ জিনিস নিয়ে বাজার থেকে ফিরে এসেই চক্ষু চড়কগাছ! বত্রিশটা ছেলে মেয়ে তাঁর বাড়িতে এসে গ্যাঁট হয়ে বসে আছে! কেউ তার আরামকেদারায় বসে পা টিকটিকাচ্ছে! কেউ বা আবার শখের বিছানাটার উপর চিৎ হয়ে শুয়ে চিল্লিয়ে চিল্লিয়ে গান গাইছে! ওনাকে দেখেই বত্রিশ ইন্টু বত্রিশ পাটি দাঁত ঝলমলিয়ে উঠলো—‘গুড মর্ণিং স্যার! আমরা এসে গেছি! ’
প্রায় বাঁশ গেলার মতো পরিস্থিতি বেচারার। একটা অপ্রস্তুত হাসি মুখে মাখিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। পারলে এক্ষুনি ঝাঁটা হাতে তাড়া করেন। কিন্তু একেই মা সামনে, তার উপর পরনের লুঙিটা খুব প্রফেসরোচিত নয়!
ভদ্রলোক ওখানেই স্থাণুর অতো দাঁড়িয়েছিলেন। কফিনে শেষ পেরেকটা ঠুকলেন তাঁর মা।
-‘ ওরা দুপুরে এখানেই খাবে’।
বেচারা! ফের বাজারে থলে নিয়ে দৌড়তে হল তাঁকে!
অবশেষে সেই দিনটাও এলো যেদিন এ আর পি রিটায়ার করলেন! কেউ কেউ বেশ হর্ষিত! কেউ বিমর্ষ! খ্যাপানোর এমন একটা মজার জিনিস আর কোথায় পাওয়া যাবে!
কিন্তু সব কিছুরই শেষ আছে! এ আর পি রিটায়ার করলেন। তাঁকে ফেয়ারওয়েল দেওয়া হল।
আমরা চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিলুম লাইন করে। তিনি এসে আমাদের সামনে দাঁড়ালেন। মুচকি মুচকি হাসছেন। যেন ভারি মজার কিছু হচ্ছে!
সবাই মিলে বলা হল—‘স্যার আবার আসবেন’।
স্যার মুচকি হাসলেন—‘কেন আসবো? আমায় পাগল পেয়েছিস নাকি? ’
এই প্রথম পাগল শব্দটা বলার আগে তিনি রাগলেন না!
আস্তে আস্তে বললেন—‘সোশিওলজিটা একটু পড়িস! পাস পেপারের গুরুত্ব নেই ঠিকই, কিন্তু ফেল করলে কিন্তু পুরো ফেল। সাবজেক্টে ফার্স্ট ক্লাসটাও তখন মাঠে মারা যাবে! বুঝলি? ’
তারপর সবাইকে অবাক করে দিয়ে গেয়ে উঠলেন—‘ যে তোরে পাগল বলে তারে তুই বলিস নে কিছু’
আমরা সবাই ‘থ’ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। হঠাৎ কোথা থেকে একরাশ মন খারাপের মেঘ এসে জড়ো হল। স্যার গাইতে গাইতেই ফেরার পথ ধরেছেন! সিঁড়ি ভেঙে নামছেন নীচের দিকে! আমরাও তার পিছন পিছন
‘আজকে আপন মানের ভরে/থাক সে বসে গদির পরে/ কালকে প্রেমে আসবে নেমে/ করবে সে তার মাথা নীচু’
গাইতে গাইতেই বোধহয় অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিলেন। হঠাৎ স্যারের পা পিছলে গেলো। তিনি পড়তে পড়তে সামলে নিয়েছেন—
পরক্ষণেই পরিচিত ফর্মে—
-‘মোহনমো-হ-ন! ইডিয়ট! ঠিকমত সিঁড়িটাও মোছেনি! ছেলেমেয়েরা কেউ যদি পড়ে যায়! আমি এক্ষুণি প্রিন্সিপালের কাছে মোহনের নামে কমপ্লেন কোরবো! ’
আমরা তাড়াতাড়ি স্যারকে গিয়ে ধরলাম। তিনি তখনও মাথা নেড়ে –‘কিছু হয় নিকিছু হয়নি’ বলছেন।
সেই ফাঁকেই তার চশমার পেছনের চোখদুটো ধরা পড়ে গেলো আমাদের কাছে! চশমায় ঘন বাষ্প জমেছে! চোখদুটো ভেজা!
বলাই বাহুল্য যে সিঁড়িটা ভেজা ছিল না!
তিনি চলে যাওয়ার মুহূর্তে অনুভব করলাম তাঁর ভালোবাসা কতটা খাঁটি ছিল—যা আমরা কখনই বুঝতে পারিনি! আর তাঁর পাগলামি কতটা মিথ্যে ছিল, সেটাও সেদিনই বুঝলাম।
‘যো দিখতা হ্যায় উয়ো হোতা নেহি
যো হোতা হ্যায় উয়ো দিখতা নেহি’
জীবনের অন্যতম মূল্যবান পাঠটা পড়িয়ে আমাদের ভেজা চোখের সামনে দিয়েই অদৃশ্য হয়ে গেলেন—‘আমি রাঁচি পলাতক’!
গানওয়ালা-নবনিতা সেন
ইদানীং বাড়তি সুখটুকু দেরাজে তালা মেরে রাখছেন ননী বাবু। দরাজ গলায় গানও গাইছেন মাঝে মাঝে। যদিও কোনো কিছুর উপরিই আর সহ্য হচ্ছে না আজকাল। ” তুমি শালা ঠুনকো গাঁজাখোর তোমার বোধহয় এক গাল টিপলে আরেক গাল দিয়ে তেল গড়াবেবাঞ্চো-শালা হারামির বাচ্চা” । খিস্তিটুকুতেই কাজ হয়। কে কাকে খিস্তি-খেউর করল না জানলেও দিব্যি চলবে। মোট কথা কাজ সারা। কিছু সভ্য জাতীয় লোকজন পালিয়ে বাঁচল সিন থেকে। এরা যেমন এক ধরনের ‘মল’এর নামে নাক সিঁটকোয়, ততোধিক উৎসাহে আরেক বিশেষ ধরনের ‘মল’এ মাছির মত ভনভন করে। পৃথিবীর সমস্ত ফেরেববাজদের পদপিষ্ট করে মারার ইচ্ছেটাকে আপাতত সিগারেটের শেষ টানেই সীমিত রাখলেন ননী। হি-টিং-ছটআর ঠিক তখনই চোখ গেল ল্যাম্পপোষ্টের নীচে বসে থাকা জড়ভরতটির দিকে। নোকিয়ার চার্জারের মত কালোগিঁটপাকানো চেহারাপরনের ধবধবে পোশাকে বেশ সাদা-কালো মিলমিশ ‘অবাক’ চিত্রনিরেট নটবর। পাশে ডাঁই করে রাখা নানান ব্র্যান্ডের দেশলাই বাক্সঅসংখ্য। নিবিষ্ট মনে স্তূপাকার দেশলাই থেকে একটা একটা করে সরিয়ে অন্যদিকে আরেকটি স্তূপ বানানোয় রত। ননী মনোযোগ দিয়ে তাই দেখছিলেন।
লোকটার পাশে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলেন ননীবাবু। বুড়োর বগলের তলায় রঙ-বেরঙের প্যাঁটরা গোছের কিছু। পাশে নামানো রাজ্যের তেলচিটে ঝোলা একখানা। পাকা চুলো মাথাটাকে ঝাঁকিয়ে সরিয়ে নিয়ে হঠাৎ বুড়োটার কাঁধ বরাবর তাকিয়ে রইলেন। মগজ মালিশ? ‘নো দরকার’হোর্ডিং-এ ছাপানো অক্ষর। এক অদ্ভুত আবেগ পেয়ে বসল তাঁকে। উবু হয়ে বসতেই বুনো গন্ধের ঝাপটা। হাঁটু খামচে ধরলেন” চুলোয় যা মুখপোড়ারা” । গেলবার তুখারাম কে বাগে পেয়েও ছেড়ে দিতে হয়েছিলব্যাটা উজবুক। ঘরে ঢোকার মুখেই রাম-লক্ষণের বেঞ্চিতে পাক মেরে বসা নেড়িটা গন্ধ শুঁকতে যেতেই তুখারাম দুহাতে পিছন ঢেকে দে ছুট ছুট ছুট। গায়েব নিমেষে। আহ্বেবাক মিসআবার! অজান্তেই গোল্লা চোখগুলো বারকতক ঝাপকে নিলেন। নাহঅনেক হল। এইবার বেশ সস্তায় জমাটি মাল পাওয়া গেছে। শুধু লাগসই ছুতোআর মার দিয়া কেল্লা। উত্তেজনায় বুড়োর কাঁধ চাপড়াতে গিয়ে সামলান কোনরকমে।
ননীঃ” বলি নাম কি হে তোমার? ”
বুড়োঃ -[কাঠি নিয়ে একমনে সামনে তাকিয়ে আবার]
ননীঃ” থাকা হয় কোথায়? ”
বুড়োঃ -[ পায়ের নখ নজরে এবারখুঁটছে]
ননীঃ [গলা খাঁকারি ]” তেল-জড়িবুটি কদ্দিনের ব্যবসা তোমার? কাজ হয়? ”
বুড়োঃ [ নড়েচড়ে বসে ]” এজ্ঞ্যেকিসের ব্যাথা কয়েনতেল আচে গো বাবুমাতার ব্যাতা, দাঁতের গোড়া, কোমর অসার, প্যাট সুরসুর, গেঁটের
ব্যাতাসঅঅঅব সেরে যায় গো”
ননীঃ [ মাথা চুলকে ভাবনায় ]-
বুড়োঃ” কয়েন দিকি বাবুধন্বন্তরী দাওয়াই বুইলেন? বাগের তেজনিন গো কই”
ননীঃ” তোমার তোরঙ্গে কি ও? ” [ বাক্সের দিকে তর্জনী ]
বুড়োঃ” অইসব জড়িবুটি কিচ্ছুটি লাগবেক না বাবু এক ছটাক তেলেই কাজ্ দিবে অডরান ক্যান? ”
ননীঃ [ চারদিক চোখ বুলিয়ে ফিসফিসিয়ে বুড়োর কানে ফুসমন্তরটি ঝাড়লেন]” এ বড় কঠিন ব্যামো হে। বাড়ি চল আমার। বুঝিয়ে বলি। রাস্তায় এ হবে না” ।
বুড়োঃ [ থম মেরে এক দণ্ড ]” অঃ”
বলেই ধড়মড়িয়ে সমস্ত শিশি ঝোলায় ভরে তবলায় চাঁটি মারার ক্ষিপ্রতায় প্যাঁটরা তে ধাঁইধপাধপ। বাক্স বন্ধ। আকাশের দিকে উঁচিয়ে কি দেখল খানিক। তারপর ননীর পিছন পিছন গুটিগুটি চলা শুরু। রাস্তায় এখন ঘোড়দৌড়। গোঁত্তা মেরে এগিয়ে যাওয়ার খেল অনবরত। বাজখাঁই গলায় লারেলাপ্পা গান ছেনাল নাচবিকট অঙ্গভঙ্গিবাজার গরময ত্ত স ব! টিভি’র শো-রুম টা পাশ কাটিয়ে এসে পিছনে তাকালেনআসছে তো ব্যাটা? হ্যাঁ ওই তো হাত পাঁচ দূরে মোড়ের বটগাছের দিকে চেয়ে আছে পাঁশুটে দৃষ্টি নিয়ে। হলটা কি? কাছে যেতেই বিড়বিড় কানে এল। আতিপাতি করে খুঁজেও ননী কিছু ঠাহর করতে না পেরে বুড়োর জামার হাতা ধরে টান দিলেন। “ শালিক পাখির ছানা দু’টা গো বাবুমা টো নাই বুদয়বড় খিদা যে” । পাত্তা না দিয়ে ননী এগিয়ে গেলেন। আজব জিনিস বটে একখানা।
ফোনের তারে কাক দোল খাচ্ছে ক’টাফুলের ঝুড়ি নিয়ে বসা লোকটার একটা হাত কনুই থেকে ফাঁকা। হঠাৎ পাশ দিয়ে থপথপ হেঁটে যাওয়া মনুষ্যেতর জীবটির পানের পিকে সাদা ফুল ছিটছিট লাল। চোয়াল মুহূর্তে শক্ত ননীরছড়ি মেরে সটান ল্যাংহুড়মুড়িয়ে রাস্তার হাতি নর্দমায়। আহ্যারপরনাই সোয়াস্তি। পা চালালেন। আজকাল ভিড়ে নামলেই একটা পচা গন্ধ টের পান যেনউপায় থাকলে এড়িয়ে চলেন তাই। কই এমন তো ছিলেন না তিনিসৌদামিনী লোকজন খুব পছন্দ করত। তাঁরও মন্দ লাগত না। ছুটিছাটায় সান্ধ্য বাসর বসত প্রায়ই। সৌদামিনী নিজের হাতে রকমারি পদ বানিয়ে খাওয়াত সকলকে। অবিশ্যি তার জন্যে আনা ‘মনোহরা’ টি ছিল শুধু তার একার। ওটির ভাগ দিতে তার কি যে কষ্ট। আলগা হাসি ঠোঁটে মুছে গেল। বুড়ো নেই তো? ? ? আসছিল তো দিব্যিহাঁচোড়-পাঁচোড় করে কিছুটা পিছোতেই হাতির জটলায় খুঁজে পাওয়া গেল প্যাঁটরা সমেত। নিশ্চয়ই মাল কে জড়িবুটি গছানোর তালে ছিল। ঝোলা ধরে টান ওমনি বাপু নিশ্চিন্তে হাঁটা শুরু করলে ফের।
বাড়ির কাছাকাছি রাম-লক্ষণের চায়ের দোকান। ঈষৎ টেরিয়ে নেড়ীটা আছে কি না দেখে নিলেননাঃনেই ধারে কাছে। যাকবাঁচা গেল। বুড়োকে নিয়ে ঘরের দিকে এগোতেই যেন ইথারে ভেসে আসে ক’খানা শব্দ-” দ্যাখ দ্যাখ আজ আবার একটা মালকেদাদুর হেব্বি ক্যালি কিন্তু বসআর পিসগুলোও জব্বর জোটে মাইরি! দাদুকে জিগা তো এমন রঙ্গীলা আইটেম পেল কোথায়? খ্যাক খ্যাকবাবাঃ পাগল নাকি? দাদু দেওয়ালে সাঁটিয়ে পোস্টার বানিয়ে দেবে এখনই খ্যাক খ্যাক”
উত্তরে জম্পেশ পাঞ্চলাইন মাথায় এসেছিল, কিন্তু থাকথুতুর সাথে সেটাও গিলে ফেললেন আপাতত। “ দূর দূরমড়াখেগোর দল সব! ” একটা তির্যক চোখরাঙানি ছুঁড়ে বুড়োকে বগলে ভরে ঘরে এসে ঢুকলেন। বাকি রাস্তায় আর একটাও শব্দ করেনি সে। সাদা চুল ঘেঁটে ইতিউতি দেখে এক কোণে ঝুপ করে বসে পড়লঝিমিয়ে রইল। ঘরখানায় আসবাবপত্র বলতে তক্তাপোশ, গুটিকয়েক বই ছড়ানো-ছেটানো, সাদামাটা টেবিল, ভাঙা হাতলের চেয়ার, গুচ্ছের রেকর্ড ডাঁই করে রাখা জায়গা জুড়ে আর ঘরের কোণে পেল্লাই দেরাজ একখানা। এই দেরাজটাই সব থেকে বেশী নজর কাড়ে। এরূপ হা-হতশ্রী ঘরে নিতান্তই বেমানান। পালিশ করা সেগুন কাঠের তৈরি কি অদ্ভুত রাজকীয় জৌলুস! সৌদামিনী চলে যাবার পর যাবতীয় জিনিস বেচেবুচে দিয়ে এই ঘরখানিকে আশ্রয় করেছিলেন ননীশুধু হৃদয়ছাড়া করতে পারেননি দেরাজটি। ওই এতক্ষণে জ্ঞান হয়েছে বুড়োর। রংবাহারী তোরঙ্গ খুলে তড়বড়ে শেকড়-বাকড় ঘাঁটতে শুরু করল। আচমকা কাছে এসে চুপিচুপি বলে” নজ্জা কি গো বাবু? এ তো কত্ত মানুষের হয় রোগ বই ত নয়! তবে কিনা এই বয়সেহেঁ হেঁ বুইলেন নাহেঁ হেঁ তা এট্টু সময় লাগতি পারেএই যা। ঘাবরানোর কিচু নাই। এমন বুটি দিব নি কত্তাশিলাজিতেরও বাপ গো বাবুমারণ দাওয়াই এক্যেবারেকই ইদিকে আসুন দিকি” বলে ননীর ধুতির খুঁট ধরতে যেতেই- ধাক্কা সামলাতে না পেরে ননী খাটে চিত্তির হন আর কি! এ ব্যাটা করে কি? কি বলে এ? এ্যাঁ! বুটি! শিলাজিৎ! কুঁজো থেকে জল ঢেলে মুখে-মাথায় ছিটোলেনঢকঢক করে গিললেন প্রায় দু-গ্লাস। এমত কান্ড-কারখানায় বুড়ো খানিক ভ্যাবাচ্যাকা। ফিরে গিয়ে নিজস্থানে বসে পড়ল আবারঝিমোচ্ছে। ননীর বোধগম্য হল পুরো ব্যাপারটাই ততক্ষণেবেয়াকুবটা ভেবেছে তাঁর গুপ্তরোগ হয়েছে বুঝিবাইরে বলতে বাধছিলতাই ঘরে এনে। উফ, কপাল বটে তাঁরফুঃ।
একটু ধাতস্থ হতেই উঠে পড়লেন। নাহ্এবার কাজে লেগে পড়া যাক। বেঁটেখাটো মানুষ তিনি। চেয়ারটা টেনে এনে কোণায় দেরাজ ঘেঁষে কোনমতে দাঁড় করালেন। তাতে চেপে দেরাজ খুলে বার করে আনলেন বহু যত্নে রক্ষিত তাঁর চিলতে সুখটুকু সৌদামিনীর শখের সেই গ্রামাফোনআর তার গানের রেকর্ড। বুকের এক কোণায় জমে থাকা স্মৃতিগুলোও এসে ভিড় জমাল চুপিচুপি। সৌদামিনীর পরম সাধের গ্রামাফোনটি তখন সবে কেনা হয়েছে। তাতে রবীন্দ্র, অতুল, দ্বিজেন্দ্র সবাই আসেন এক এক সময়ঘুরে যান। ননী বাড়ি ফিরলেই চায়ের আসর মাতিয়ে গানের সুর। সৌদামিনীর গানের গলাও চমৎকার। তার গাওয়া গানের একটি রেকর্ডও বেরয় সে সময়। পরমসুখে ননী-গিন্নী। গিন্নীর গান দুবেলা চায়ের মতই প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ছিল। গিন্নী আর গান এই দুই নিয়ে মনের সুখে ঘরকন্না করছিলেন। কিন্তু সবার বোধহয় সব সুখ সয় না। ছন্দপতন হঠাৎ। ক’দিনের জ্বরে সৌদামিনী গত হলেন। ননীর বাঁচা-মরা এক। রা টি নেইগ্রামাফোনও চুপ সেই থেকে হারিয়ে গেল অপ্রয়োজনীয়দের ভিড়ে। বছর গড়ালে ননী ধীরে ধীরে স্বাভাবিক ‘কিন্তু প্রাণে গান নাই’। বছর কয়েক পরে একদিন হঠাৎ ঘুম ভাঙতে গুনগুন করে উঠলেন অজান্তেই। সৌদামিনীর গানের লাইন। খুঁজে খুঁজে বার করলেন সেই গ্রামাফোন। রেকর্ড চাপালেন। নাহপারলেন না। দুজনের সব স্মৃতি আনাচে কানাচে। তাঁর ‘দোকা’টি নেই তো আর। গিন্নীর সেই গান শুনতে ইচ্ছে হয় তাঁর বড়কিন্তু একা সম্ভব নয় কোনমতেই। তাই এই ব্যবস্থা। কাউকে ধরে এনে সৌদামিনীর রেকর্ড শুনবেন ‘দোকা’য়গিন্নীর ঘাটতি কিছুটা হলেও তো তবু। ইতিমধ্যেই বহু চেষ্টা বিফল। তবু বান্দা নাছোড়। আজকের শিকার ওই বুড়ো। হুঁ:আজ এসপার নয় ওসপার। ক্ষীণ একটা হুঙ্কারও ছাড়লেন মনে মনে।
ঝিমন্ত বুড়োকে ঠেলা মারতেই ধড়মড় করে উঠে বসল। খানিক জড়োসড়োসাদা ভাটার মত চোখ। আচ্ছা এ চোখে স্বপ্ন বাঁধে? হাল্কা চালে গিয়ে ননী গ্রামাফোনে রেকর্ড চাপালেন। ননীর হাবভাবের এহেন পরিবর্তনে বুড়ো ঈষৎ সন্দিগ্ধ। লক্ষ্য ননীর দিকে। শুরু হল গানসৌদামিনীর মধুর কণ্ঠ। বুকের ভেতর দিয়ে মরমে বিঁধছে সে গান। “ কুসুম দোলায় দোলে শ্যাম-রাই” । আহ আজ কতদিন পর। সেই সব গানসেই সব মুহূর্তরা আবার ধরা দিচ্ছে যেন এই ছাদের তলায়। ননী ভাবে মশগুল। এদিকে বুড়ো অস্থির। কেমন পালাই পালাই ভাব। ইতঃস্তত চোখ ঘুরিয়ে দেখছে। যেন একটা ফাঁক খুঁজছে। বিভোর ননীর চটকা ভাঙতেই শুরু হল উপদ্রব। বুড়ো কখনো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কড়িকাঠ গোনে, কখনো চেয়ারে উঠে ঘুলঘুলি ছোঁয়ার চেষ্টা করে বৃথাই, কখনো বা রেকর্ডের স্তূপ থেকে একটা একটা করে রেকর্ড তোলেখানিক নাড়াচাড়া করে রেখে দেয় আবার। গানে মন নেই যেন ওর। ননীর শত ডাকাডাকিতেও কান নেই। কালা নাকি? ননীর হঠাৎ খেয়াল হয়আচ্ছা ওর নামটাই তো জানা হয় নি এখনো। শুধিয়েছিলেন একবার কিন্তু বলে নি তো। জিজ্ঞেস করলেন” তোমার নামটা কি যেন?” । তাকিয়ে আছে ভ্যাবলার মত দেখ। ” বলি নাম তো আছে একটা নাকি? ” এবারও কোনো উত্তর নেই। ফ্যালফ্যাল করে ননীর দিকে তাকিয়ে আছে একদৃষ্টেমাঝে মাঝে চোখ সরু কিছু একটা বোঝার চেষ্টা। এবার ননীর সন্দেহ ঘনায়। ব্যাটা সত্যি কালা নয় তো? তাঁর শেষ প্রশ্নেও যখন সেই একইরকম নিরুত্তর, তখন ননীর আর কোনো সন্দেহই বাকী রইল না। হা হতস্মি! ! মাথা চেপে ধরে ধপ করে মেঝেয়। “ শেষপর্যন্ত এই ছিল কপালে আমার? যাও বা একজনকে পেলামসেও এমন। ওহএই ‘দোকা’ দোকা’ খেলার শেষে এমন ‘ধোকা’ লুকিয়ে ছিল আমার জন্য?” বেজায় মুষড়ে পড়লেন। ঝিম মেরে বসে রইলেন কিছুক্ষণ মেঝেতেই।
কতক্ষণ এভাবে বসেছিলেন জানেন না। হঠাৎ লক্ষ্য করলেন বুড়োও কখন পাশটায় এসে বসেছে। রেকর্ডগুলো সাজিয়ে যাচ্ছে একমনে। লোকটার দিকে তাকিয়ে একটু মায়াই হল ননীর। নাহ্এ যাত্রায়ও আর হল না। সবই ভবি। শরীর নিংড়ে দীর্ঘঃশ্বাস বেরল একটা। বুড়োর কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে বললেন” হ্যাঁ গোতোমার ওই ওষুধে হাঁটুর ব্যাথা সারে? ”
ডপলার এফেক্ট-সায়ন্তন ভট্টাচার্য্য
১
পৃথিবীতে যখনই কোনো বড় ঘটনা ঘটে, আর্টে তার প্রভাব পড়ে। পড়তে বাধ্য। মিউজিক বল, স্কাল্পচার বল, পেইন্টিং বল” আমরা পাঁচজন-আমি, সুতীর্থ, অভিষেক, অর্ক আর রাতুল একটা টেবিল ঘিরে গোল হয়ে বসে হুইস্কি খাচ্ছিলাম। অ্যান্টিকুইটি ব্লু। প্রত্যেকবার শো'র শেষে আমরা তাই করি। অর্কর গাড়িতে করে পাঁচজন সোজা চলে আসি রাতুলের ফ্ল্যাটে, তারপর সারারাত ধরে খিল্লি চলে। আজ আমাদের ব্যান্ড, ডপলার এফেক্টের যুবভারতীতে শো ছিল। রাতুল বলে চলল, “ যেমন ধর পেইন্টিং। অ্যালফ্রেড মানিংসের নাম শুনেছিস? ভদ্রলোক হেব্বি ঘোড়ার ছবি আঁকতেন! ফার্স্ট ওয়ার্ল্ড ওয়ারের সময় কাকু যুদ্ধের ছবি আঁকা শুরু করলেন।” আমরা সবাই জানি নেশা হলে রাতুল জ্ঞান দেয়, অর্ক তাই ছোট্ট একটা “হুঁ, তারপর?” বলে নেক্সট পেগ বানানোয় মন দিল। “ বা ধর কিউবিসমের লোক, আমাদের পাবলো পিকাসো-একে তো চিনিস? ইনিও স্প্যানিশ সিভিল ওয়ারের সময় গুয়েরনিকা এঁকেছিলেন।” সুতীর্থ মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, “ হ্যাঁ, এই মালটার নাম শুনেছি।” তিন নম্বর পেগটা একঢোকে মেরে দিয়ে রাতুল বলতে থাকল,” একটা কথা জানিস তো, গুয়েরনিকায় আমি ড্যাজেল ক্যামুফ্লাজ দেখতে পাই। বাট এদের মধ্যে কোনো সম্পর্ক আছে কি না, জানিনা। এখন ড্যাজেল ক্যামুফ্লাজ কাকে বলে জিজ্ঞেস করে আমায় লজ্জা দিসনা প্লিজ! ”
দিলাম না লজ্জা, মনে মনে ভেবে রাখলাম জিনিসটা পরে গুগল করে দেখতে হবে। অভিষেক এতক্ষন চুপ ছিল, এবার বলল, “ তার মানে তুই বলছিস কোনো বড় ইতিহাস টাইপের ঘটনা না ঘটলে কখনো ভালো আর্ট জন্মায় না?”
রাতুল এবার হঠাৎ টেবিল থেকে উঠে জানলার সামনে এগিয়ে এসে একটা সিগারেট ধরাল। বাইরে কুয়াশা পড়তে শুরু করেছে, এখন নভেম্বরের শেষ। স্ট্রীটল্যাম্পের আলোয় ফ্ল্যাটের সামনের কৃষ্ণচূড়া গাছটাকে ইয়াব্বড়ো একটা দুর্গের মত লাগছিল। সেদিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে রাতুল বলল, “ তোকে যদি কাল তিন্নি লেঙ্গি মেরে চলে যায়, পরশুদিন পশ্চিমবঙ্গ সরকার পড়ে গেলেও তোর কিস্যু ছেঁড়া যাবেনা। কারন তোর পৃথিবীতে সিপিএমের চেয়ে তিন্নি অনেক বেশি ইম্পর্ট্যান্ট। বুঝেছিস?”
আমি চোখে-মুখে জল দিয়ে খাটের উপর ধপাস করে শুয়ে পড়লাম, আজ আর টানতে পারছি না। বাকি চারজন তখনো খেউড় করে যাচ্ছে। ঘুমোনোর আগে শুনতে পেলাম সুতীর্থ বিড়বিড় করে বলছে,
“ মৌতাত মহেশ্বরমৌতাত মহেশ্বর”
২
বিকেল চারটে বাজে। পাঁচটা থেকে রিহার্সাল। আমি আর রাতুল আগেই অর্কদের বাড়ি এসে বসে আছি। রাতুল মুখে একটা বিড়ি গুঁজে প্রসেসারে টোন তৈরী করছিল। বিড়ি কখন নিভে গেছে খেয়ালই নেই! আমি ভয়ে ভয়ে পকেট থেকে কাগজটা বের করলাম,
“ ভাই, কাল রাতে একটা গান লিখেছি, দেখবি? বাউল আর রকের ফিউশন।”
রাতুল নির্বিকার চিত্তে গিটার নিয়ে টুং-টাং করতে করতে বলল, “পড়, শুনি।”
“ ভোলা মন বোবা সেজে থাকে
ভোলা মন গলার কন্ঠি বরফ ঢেকে রাখে
মন আমার ভালোবাসার কারসাজিতে
সাদা মোজা, লালচে ফিতের টানে
ছুটে মরে বোকার মত
বোকামিরাও জানে।
তুমি প্রেমিক মানেই কষ্ট পাবে
প্রত্যেকদিন পথ হারাবে
হয়তো মন চাইলেও হারিয়ে ফেলবে তাকে
মন আমার গলার কন্ঠি বরফ ঢেকে রাখে
এ জীবন আমার ভাঙ্গা-চোরা
ডানা মেলে পড়ে থাকে
পক্ষীরাজের ঘোড়া।
তবু রাপুনজেলকে খুঁজে মরি
রোজ রাতে অপেক্ষা করি
জানি আসবে ফিরে রেখে এলাম যাকে
মন তাই গলার কন্ঠি বরফ ঢেকে রাখে”
পড়া শেষ করে রাতুলের দিকে তাকালাম। রাতুলের চোখ বন্ধ, কোলে গিটারটা রাখা।
“ বাউল-ওয়ান ম্যান ব্যান্ড। কো-অর্ডিনেশনটা খালি ভাব! পায়ে নুপুর, কোমরে ডগর, হাতে একতারা-একটা মানুষ গান গেয়ে যাচ্ছেউফ! শালা ওরা একটা তার দিয়ে যা করে, আমি ছ'টা তার দিয়েও তা জীবনে করতে পারব না! ”
“ এটা কি গান হবে?”
আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে রাতুল আবার গিটার নিয়ে টুং-টাং করতে শুরু করল। হতাশ হয়ে উঠতে যাবো, এমন সময় রাতুল বলল, “তুই মৌ কে এখনো ভুলিসনি, না?”
আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। জানি উত্তরটা ওর জানা। রাতুল উঠে দাঁড়িয়ে গলায় গিটার ঝোলাতে ঝোলাতে বলল, “যত তাড়াতাড়ি ভুলে যাবি, তোর মঙ্গল, ও আর ফিরবে না। আর গানটা জঘন্য হয়েছে! শুধু চাঁদের গায়ে চাঁদ লেগেছে,মিলন হবে কত দিনে আর সব লোকে কয় লালন কি জাত শুনে বাউলে হাত দিতে আসিস না, ছড়াবি।”
রাতুল এমনই। প্রচন্ড ঠোঁটকাটা, অসম্ভব ভালো গিটার বাজায় আর সর্বজ্ঞানী। আমলাশোল থেকে আইফোন-সবকিছুর খবর একজন মানুষ কিভাবে রাখতে পারে, জানিনা! রাতুলের আসল বাড়ি ছিল মালদায়। কলকাতায় ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে এসে আমাদের সঙ্গে আলাপ। তারপরেই ডপলার এফেক্টের জন্ম, তিন-চার বছরের অমানুষিক স্ট্রাগল। আজ কিন্তু আমরা বেশ সফল ব্যান্ড! কলেজ টলেজে বেশ ভালো নাম! সামনের বছর অ্যালবাম বের করব ভাবছি।
বিটেক শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও রাতুল মালদা ফেরেনি। স্বাভাবিক, ততদিনে আমরা ফেমাস। ওর বাবা শুনেছিলাম বিরাট বড়লোক। এখানে আমরা সবাই হস্টেলে থাকতাম, আর রাতুলের বাবা রাতুলকে পড়াশোনা করার জন্য একটা আস্ত ফ্ল্যাট কিনে দিলেন! ব্যাস, টিম ডপলারের সৌজন্যে সেই ফ্ল্যাট এক বছরের মধ্যে শুঁড়িখানা হয়ে গেল।
রাতুলের ঘরে ঢুকলে দরজার পাশেই তিন চার জোড়া জুতো, তার পাশে সার দেওয়া এক গাদা খালি মদের বোতল। রান্নাঘরের বালাই নেই, রাতুল হোম সার্ভিসে খায়, রান্নাঘরের জন্যে বরাদ্দ ঘরটায় তাই শুধু একটা টেবিস বসানো, যেখানে আমরা বসে মদ খাই। সবচেয়ে নোংরা ছিল ওর শোয়ার ঘর। খাটের ওপর ডাঁই করা বই, গল্পের বই, পড়ার বই কি নেই? তাতে আবার সাত প্রজন্মের ধুলো জমেছে, দেওয়ালে মোমরং দিয়ে জিম মরিসনের ছবি আঁকা, নিজেই এঁকেছে, খুব ভালো না হলেও মুখ চেনা যায়। খাটের একপাশে গাদা গাদা ইলেকট্রিকের তার, প্রসেসার আর রাতুলের দুটো গিটার রাখা-একটা ইলেকট্রিক, অন্যটা অ্যাকোস্টিক। উল্টোদিকে কম্পিউটার টেবিল, সামনে চেয়ার যার ওপর রাজ্যের নোংরা গেঞ্জি, জাঙ্গিয়া আর জিনস পড়ে আছে।
এই ঘরেই ডপলার এফেক্টের জন্ম। আমি, রাতুল আর সুতীর্থ আড্ডা মারছিলাম। এমন সময় রাতুল আমায় বলল, “সায়ন্তন, সেন্ট রক কে চিনিস?”
আমি ন্যাচারালি না জানিয়ে ওর উত্তরের অপেক্ষা করতে থাকলাম। রাতুল একটা সিগারেট জ্বালিয়ে গড়গড় করে বলতে শুরু করল,
“ক্যাথোলিক মতানুসারে ইনি মন্টপেলিয়ার থেকে পায়ে হেঁটে ইতালি গেছিলেন প্লেগ রুগীদের সেবা করতে। ইতালিতে তখন প্লেগের মড়ক চলছে। শোনা যায়, ভদ্রলোক ওখানকার পাবলিকদের সেবা করতে গিয়ে নিজে কেস খান এবং তার থেকে যাতে অন্য কারো প্লেগ না ছড়ায়, তার জন্য তিনি তার একমাত্র পোষা কুকুরকে নিয়ে কোনো এক অজ্ঞাত জঙ্গলে চলে গিয়ে বাকি জীবন কাটান।”
এখান থেকে আড্ডা ‘রক’ হয়ে মেটাল মিউজিকের জন্ম, অল্টারনেটিভ রক, ইলেকট্রোনিকা, বাংলা ব্যান্ড, মহীনের ঘোড়াগুলি ঘুরে নিজেদের ব্যান্ডে থেমেছিল। আমি হলাম ভোকালিস্ট, রাতুল লিড গিটারিস্ট, অর্ক ড্রামার, সুতীর্থ ব্যাস
৩
২৯শে মে, ২০১০।
দিনটা কোনোদিন ভুলবো না আমি। সকাল সাতটা নাগাদ সুতীর্থের ফোনে ঘুম ভাঙল। গতকাল রাত্রে জ্ঞানেশ্বরী এক্সপ্রেস অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে। খবরটা পেয়ে বোঁ করে মাথা ঘুরে গেল। ট্রেনটাতে রাতুল ছিল তো! সেদিন পাগলের ছোটাছুটি করে কাটল। রাতুলকে পাওয়া গেছে, মোটামুটি অক্ষত, শুধু মাথা ফেটে গেছে। রাতুলের বাবা পরের দিন বন্ড সই দিয়ে ওকে কলকাতায় এনে এএমআরআই তে ভর্তি করে দিলেন। আমরা যখন রাতুলকে দেখতে পেলাম, তখন ওর মাথায় ব্যান্ডেজ বাঁধা, মুখটা কেমন বিশ্রীভাবে ঝুলে আছে! ডাক্তার বলল পেশেন্টের বেলস প্যানসি হয়ে গেছে, সাত নম্বর ক্রেনিয়াল নার্ভে চোট লেগেছে। বেশ কয়েক জায়গায় ঘ্যানঘ্যান করার পর জানলাম চিন্তার কিছু নেই, প্রাইমারী ট্রমা কাটিয়ে উঠতে পারলেই সব ধীরে ধীরে সেরে যাবে।
এই ঘটনার তিনদিন পর সবাই মিলে রাতুলকে দেখতে গেছি। বিকেল পাঁচটা থেকে ছ'টা অবধি ভিসিটিং আওয়ার। একসাথে একজনের বেশি অ্যালাউড নয়। প্রথম আমি ঢুকলাম। রাতুল খাটে হেলান দিয়ে বসে আছে, এখনো মাথায় ব্যান্ডেজ। আমি কিছু বলার আগেই ও বলল, “তোর ফোনে কোনো ভালো রবীন্দ্রসঙ্গীত থাকলে চালা তো, লো টেম্পোর গান।”
আমার চোখে জল এসে গেল। এই ছেলেটা রবীন্দ্রসঙ্গীত পাগল! মনে আছে একদিন আমি বলেছিলাম রবীন্দ্রসঙ্গীতের সুর বিদেশী লোকগিতী থেকে ঝাড়া। রাতুল বলেছিল, “রবীন্দ্রনাথ ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোকে দেখে গাইলেন আমি চিনি গো চিনি তোমারে, সেই সুর কিভাবে বিদেশি হবে রে গাধা! কোনোদিন দূরে কোথাও গানটা ভালো করে শুনেছিস? আহা! ওই দুরেদুরেবলার বলার সময় যে সুর, সেটাই তোকে টেনে নিয়ে চলে যাবে।”
সেদিন প্রথম মনে হয়েছিল, আমি রবীন্দ্রসঙ্গীতের কিচ্ছু বুঝিনা।
আমি মোবাইলের মিনিমাম ভলিউমে “এই করেছো ভালো” চালালাম। পনেরো-কুড়ি সেকেন্ড পর রাতুল ভুরু কুঁচকে বলল, “বন্ধ করে দে, সহ্য হচ্ছে না!”
আর চারদিন বাদে রাতুল ফ্ল্যাটে ফিরে এলো, সাথে রাতুলের মা। এরমধ্যে আমরা কমপক্ষে সাতটা শো ছেড়েছি। রাতুল ছাড়া ডপলার এফেক্ট কানা যে! ক’দিন বাদে আমরা চারজন রাতুলকে দেখতে গেলাম। ঘরটা এখন অপেক্ষাকৃত পরিষ্কার, কাকিমা আছেন যে! আমাদের আড্ডা মারার ঘরে যখন ঢুকলাম, রাতুল তখন খাটে বসে জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে, হাতে কফির কাপ।
আমাদের দিকে না তাকিয়েই রাতুল বলল, “লিজাইরোফোবিয়া জানিস?”
অভিষেক ইয়ার্কি করে বলল, “কাপে ওটা কি? কফি না রাম?”
রাতুন নির্বিকার, কেউ যেন কিছু বলেইনি!
“লিজাইরোফোবিয়া হল লাউড আওয়াজের ভয়। জানিস তো অভিষেক, আমার উল্টোদিকে একটা ফ্যামিলি ছিল, স্বামী-স্ত্রী আর তাদের চার বছরের বাচ্চা মেয়ে, নাম মিঠিবেশ ভাব জমিয়েছিলাম! সেদিন রাত্রে একটা শব্দ হল, কান ফাটানো শব্দতারপর যখন চোখ খুললাম, চারিদিকে সূর্যের আলো, আমায় ধরে দুটো লোক হিঁচড়ে বের করে নিয়ে আসছেআমার একদম পাশে মিঠির একটা কাটা পা পড়ে ছিল জানিস!”
কিছুক্ষন সবাই চুপ, আমি বললাম, “সবার লাইফে এমন কিছু ঘটনা আসে, আবার চলেও যায়। চিন্তা করিস না।”
রাতুল এতক্ষনে আমাদের দিকে ফিরল। কি অবস্থা হয়েছে মুখের! মাথার চুল ছোট করে ছাঁটা, গালে দাড়ি গোঁফের জঙ্গল!
“সায়ন্তন, আমি ক্লাস এইটে গিটার ধরেছি। তারপর থেকে এমন একদিনও হয়নি যেদিন আমি গিটার বাজাইনি। এখন দেখ, তারগুলোয় মরচে পড়ে গেছে, আমার গিটারে ধুলো জমে গেছে। আমি আর কোনোদিন গিটার বাজাতে পারবো না!”
“কেন?”
“পারছি না তো! এখন সমস্ত লাউড আওয়াজ ট্রেনের কু-ঝিকঝিক লাগে। আমি আজকাল একফোঁটা আওয়াজ সহ্য করতে পারছি না! শেষ কবে গান শুনেছি জানিস? এই সায়ন্তনমনে আছে, একদিন বলেছিলাম পৃথিবীতে যখনই কোনো বড় ঘটনা ঘটে, আর্টে তার প্রভাব পড়ে? প্রভাবটা এত মারাত্মক হতে পারে, কোনোদিন স্বপ্নেও ভাবিনি রে”
আমরা আর বেশিক্ষন বসলাম না। এই রাতুলকে দিয়ে শো হবেনা। ওর এখনো মিনিমাম এক বছর লাগবে সুস্থ হতে। যখন বেরিয়ে যাচ্ছি, রাতুল আমায় ডেকে বলল, “দেখ ভাই, আমি এভাবে বেশিদিন বাঁচবো না। আমি চলে গেলে ডপলার এফেক্ট যেন ভেঙ্গে না যায়।”
আমি আর থাকতে পারলাম না। দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় শুনলাম রাতুল বলছে, “বাউলের সাথে রক মেশানো খুব টাফ কাজ, তুই পারলে কিছু প্রভাতী বাউলের গান শোন।”
লিজাইরোফোবিয়া-নামটা কোনোদিন ভুলবো না।
৪
একজন মানুষ একটা ঘটনার দিকে যত এগোতে থাকে, ঘটনার তীব্রতা তত বাড়তে থাকে। সেই ঘটনার আগে আর পরে সে একদম ঠান্ডা-বরফের মত ঠান্ডা। রাতুল এটাকেই ডপলার এফেক্ট বলত।
২১শে আগস্ট রাত সাড়ে বারোটা নাগাদ রাতুল হাতের শিরা কেটে আত্মহত্যা করে। বারোটা-সোয়া বারোটা থেকেই রাতুলের ঘর থেকে তীব্র গিটারের আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল। রাতুলের মা ঘরে ঢুকে দেখলেন কম্পিউটারে ফুল ভলিউমে জিমি হেনড্রিক্সের সোলো বাজছে। খাটের উপর চিত হয়ে পড়ে আছে রাতুল। বাঁ হাত রক্তে লাল, ডান হাতে একটা সুইসাইড নোট মুঠো করে ধরা। তাতে লেখা-
“If you miss the train, I'm on
you will know that I am gone
you can hear the whistle blow
a hundred miles”
অ্যাড অ্যাজ ফ্রেন্ড-নির্মাল্য সেনগুপ্ত
১
পার্থদা বলল- “দ্যাখ গল্পটার শুরুতেই কিন্তু হাজারটা বিবরণ দিসনা। আস্তে আস্তে ভাঙ্গিস। তাতে গল্পের এসেন্স বাড়ে।”
আমি বললাম” ওফ তুমি এই ফেলুদা মার্কা কথাবার্তা বন্ধ করবে! এছাড়া আমি আর লিখিনা। মোদ্দা কথায় আস। তুমি আসবে কি না?”
“ সেকি রে লিখি না মানে? তুই আবার না লিখে পারিস না কি? ধ্যাত হতেই পারেনা। ঢপ দিসনা।”
আমি একটু বিষন্ন হয়ে বললাম” না গো, লেখালিখি আমার দ্বারা হবেনা। এই বেশ ভালো আছি। কি-বোর্ড ঘষছি রাতদিন। খিস্তি খাচ্ছি। চলে যাচ্ছে। ব্যাস।”
কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর পার্থদা বলল” না রে পাগলা তুই ঠিক নেই তাহলে। নে আমাদের এই প্রজেক্টটা নিয়েই আবার লেখ। এটা ভালো একটা টপিক।
“ আমার কাছে এটা টপিক না পার্থদা। অনেক বড় কিছু। তুমি প্লিজ এসো।”
পার্থদা হেসে বলল” আরে আমি একটা সিক্রেট মিশনে আছি রে। নইলে সিওর আসতাম। আমি না হয় সব ঘটনা তোর লেখায় পড়ব।
আমি রেগে বললাম” অটোমোবাইল ইঞ্জিনিয়ারের আবার সিক্রেট মিশন কি? জ্ঞান দিওনা আমায়। বল তোদের এইসব ফালতু বচপনায় আমি নেই।”
“ বাবু রাগ করিসনা প্লিজ। সত্যি রে অসুবিধে আছে একটু। নইলে বলতে হতনা এতবার করে। আমারটা না হয় বাবিকে দিয়ে দিস।”
আমি এবার হেসে ফেলে বললাম” মনে আছে সেই নবমীর দিন? বাবি তোমারটা খেয়ে নেওয়ায় কি খিস্তি দিয়েছিলে ওকে?
পার্থদা বলল” ওটা গালাগাল খাওয়ার মতই কাজ ছিল, আবার করলে এখনও খাবে। যাক তোরা মজা করিস। সবাই আসবে বলেছে?”
আমি বললাম” হ্যা মোটামুটি সবাই। শুধু তোমাকেই খুব মিস করব। প্রজেক্টে তুমিও ছিলে।”
পার্থদা হেসে বলল” ওরে আমি না থাকলে মালটা থাকত কোথায়? হু হু। আচ্ছা চল রাখি। সাইটে যেতে হবে। আর হ্যা লিখিস কিন্তু। বাই।”
আমি ফোনটা রেখে ধপ করে সোফাটায় বসে গা এলিয়ে দিলাম। আহ কতদিন পর আবার সেই একসাথে। সেই সব কেচ্ছা। ভাবলেই হাসি পায়। আচ্ছা আমার মত বাকিরাও এই দিনটা নিয়ে এত ভেবেছে? বিশটা বছর। একবারে ঝলসাবে। আস্তে আস্তে। এক এক করে
২
২৮শে নভেম্বর, ২০১০
আমার মগজে এখনও রয়েছে নিভে যাওয়া স্বপ্নের দেশলাই
যেভাবে পেরনো যায় আরও দু তিনটে স্কাইলাইট
“ ওয়ে এটা দিয়ে শেষ করলে কেমন হয় রে?” পিকু আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল।
বিরক্তের সাথে গ্লাসটা ঠাস করে রেখে বললাম” বোর করছিস শালা পুরো বোর করছিস। প্লিজ চুপ কর। শান্তিতে নেশাটা আসতে দে।”
“ প্লিজ ভাই। আর ৩দিন বাকি লাস্ট ডেটের জমা দেওয়ার। শেষ বছর স্কুল। একটা ভালো লেখা না দিলে”
“ ধুর মোটা।” বাবি গ্লাসটা এক চুমুকে শেষ করে রেখে মুখ মুছতে মুছতে বলল” তবে যাই বল গুড্ডু হুইস্কিই বেস্ট। একটা আলাদা টেস্ট আছে। ওই চিরতার জল খাওয়ার কোনো মানে হয়না। আসল হল টেস্ট রে টেস্ট।”
আমি মাথা নেড়ে বললাম” না রে ভাই। রামে একটা বনেদিয়ানা আছে। হ্যাং ওভার হয়না, এছাড়া সুব্রতদা বলে”
“ হ্যাং ইওর সুব্রতদা।” সমু পেশাদার বিড়িখোরদের মত বিড়িটা টান দিয়ে শেষ করে বলল” আমি অতশত বুঝিনা। ফোঁকা মানে ধোয়া আর গেলা মানে লাল জল। ব্যাস।”
“ হ্যা ব্যাস। তাহলে যা না তিমিরের দোকানে গিয়ে চুল্লু আর গাঁজা খা গিয়ে। কোথাকার বোদ্ধা এসেছেন।” আকাশ সমুকে খিস্তি মারল।
একটা ঝটাপটি বাধার আগেই আমি হাত তুলে বললাম” সাইলেন্স। আসল কথা হল আমরা অকেশনাল ড্রিঙ্কার। তাই কার কি সুট করছে সেটা খুব দরকার। হুইস্কি খেলে আমার গা গোলায়। কিন্তু তাই বলে আমি খেয়ে বাওলামি করিনা।”
“ না বাওলামি করিনা।” ভাস্কর ভেংচি কেটে বলল” শুধু ছাদের পেছনে গিয়ে লম্বা হই।”
“ প্লিজ ওটা একটা অ্যাকসিডেন্ট ছিল ওকে। অত খাটাখাটনির ফলে।” আমার তীব্র প্রতিবাদ।
“ আর আর ওই পার্থদার বাড়ির কেসটা? শালা আমি সারারাত ধরে বমি সাফ করেছি।” ভাস্কর কঁকিয়ে উঠল।
“ হয়েছে হয়েছে। ওরকম দু একদিন হয়। আজ দ্যাখ তো কিছু হয়েছে?”
“ বস ওই দু পেগ খেলে বিড়ালের বাচ্চাও টলেনা। আর তুমিতো হি হি” সবাই জোরে হেসে উঠল।
আমি প্রচন্ড অপমানিত ফিল করে চেঁচিয়ে উঠলাম” ও তাইতো? কখনও বুঢঢা পেগ মেরেছ? শালা এক পেগ খেলে না বাপের নাম দশবার ভেবে লিখতে হবে।”
আকাশ অবাক হয়ে বলল” সেটা আবার কি?”
হু হু, এবার বাগে এসেছে। আমি ছাদের পাচিলটায় আরাম করে ঠেস দিয়ে বসে বললাম” আছে। আমাদের খাওয়ার অকাদ নেই রে। ওসব বাপেদের জিনিস।”
“ ধ্যান্তারামো ছাড়।” বাবি ভুরু কুঁচকে বলল” সেটা কি জিনিস?”
আমি মুখে একটা বাদাম ছুড়ে সোজা হয়ে বসে বললাম” আরে মালটা কি? কিছু ইস্পেশাল কার্বোহাইড্রেটকে ইস্টের সাহায্যে কোহল সন্ধান ঘটিয়ে গেঁজিয়ে তারপর ফ্লেবার দেওয়া। পাতি ভাষায় পচিয়ে ফেলা। এখন যতদিন যাবে মাল আরো পচবে, অ্যালকোহলও বাড়বে। তাই কিছু মদকে এইভাবে পুরনো করা হয় অনেক বছর। একে বলে বুঢঢা পেগ। বোঝলা?”
পিকু এতক্ষন চুপচাপ ছিল। হটাত বলে উঠল” তার মানে তো তার দাম অনেক বেড়ে যাবে?”
“ আরিব্বাপ বাড়বে মানে! আরে শুরুই বোধহয় হাজার খানেক দিয়ে এক একটা পেগ। তাইতো বললাম ওসব বাপেদের জিনিস।” আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম।
“ হুম।” বাবি বলল” কিছু কিছু ওরকম স্কচ আছে শুনেছি প্রায় ১০০ বছর পুরনো। আর তার বোতলের দাম প্রায় এক দেড় লাখ টাকা।”
“ নো চিন্তা বস। আমরাও বাপ হব। আজ থেকে ঠিক ২০বছর পর। এই নে এই গ্লাসের বাকিটুকু খেলামনা। ২০বছর পর খাবো। তখন এর দাম হবে ১লাখ টাকা, হি হি।” ভাস্কর গ্লাসটা নামিয়ে রাখল।
“ মালটার চড়েছে। ওই তুই আর খাবি না।” সমু ভ্রু কুঁচকে গ্লাসটার দিকে হাত বাড়াল।
“ উহু এটা ২০বছর পর খাব চাঁদু। পচতে দাও, পচতে দাও।”
“ শালা মাতাল। আবার আমাকে বলে।” আমি হেসে বললাম” চল একটা কাজ করি আমরা এই ধান্দা খুলি। এখন প্রচুর মদ কিনে রেখে দিই, ২০বছর পর বেচে দেব। হেব্বি মুনাফা হবে।”
পিকু বলল” তাহলেই হয়েছে, ভাটিখানা খুলি এবার। শালা আমার ম্যাগাজিন”
“ হ্যাং ইওর ম্যাগাজিন।” আমি বললাম” আচ্ছা একটা কাজ করলে হয়না? ধর একটা বোতল আমরা এখন কিনে রেখে দিলাম। ২০বছর পর সেটা আমরাই খাব। কেমন হয়?”
“ খুব বোকা বোকা হয়। ২০বছর ধরে থাকবে যেন? বাড়িতে রাখবি তুই? তোর বাবাই শালা খেয়ে নেবে।”
“ আরে বাড়িতে কেন? লুকিয়ে রাখব। গুপ্তধনের মত। দারুন হবে, চল না।”
আকাশ বলল” আরে ধুর ২০বছর পর কে কোথায় থাকব কোন আইডিয়া আছে তোর? বাঁচব কিনা সেটাই সন্দেহ। ধুস।”
আমি উত্তেজনায় তালি মেরে বললাম” আরে সেটাই তো, আমাদের বন্ধুত্ব কতটা বোঝা যাবে। সেই গল্পে পড়িসনি? বিশ সাল বাদ। একটা দিন ঠিক হবে। সেদিন মিট করব সবাই। একটা লেজেন্ডারি কেস হবে ভেবে দ্যাখ।”
“ হুম।” বাবি জেমস বন্ডের মত গালে হাত বুলোতে বুলোতে বলল” আইডিয়াটা মন্দ নয়, কিন্তু কথা হচ্ছে যে থাকবে কোথায় মালটা? আমাদের মধ্যে কে এতো স যে ২০বছর না খেয়ে রেখে দেওয়ার দায়িত্ব নেবে?”
আমি বললাম” কারো বাড়িতে না, কোনো নিউট্রাল জায়গা চাই।”
“ কোথায় বল তো?”
আমি কিছুক্ষন ভেবে বললাম” হয়েছে। উছুমাঠের পোড়ো হনুমান মন্দিরের পিছনটাতে পুঁতে দি চল। রাতের দিকে যাব, কেউ জানতে পারবেনা।”
“ ব্যাস তাহলেই হয়েছে।” পিকু বলল” ২০ দিনও থাকবেনা, ঝাপ হয়ে যাবে।”
তাহলে কোথায়, কোথায়? সমুর পায়ে চটাস করে একটা চড় মেরে চেঁচিয়ে বললাম” বল না”
“ প্লিজ তুই এখন আর কোনরকম নাটক করিসনা। সব ঠিক হয়ে আছে। পার্থদাটাও নাটক মেরে দিল। র এখন তুই।”
“ আমি চেষ্টা করছি রে। এত চাপ অফিসেরামি খুউব চেষ্টা করছি।”
আকাশ এই দিনটা কিন্তু লাইফে আর আসবেনা, কতগুলো দিন ধরে অপেক্ষা করেছি ভাই। সবাই আসছে। প্লিজ”
কিছুক্ষন চুপচাপ।
“ ওক্কে, আমি আসছি সিওর। শালা আমায় চাকর বানিয়ে রেখেছে। ডোন্ট ওরি দোস্ত, টিকিট না পেলে ভ্যান্ডারে বসে আসব শালা। দেখে রাখ তুই।”
হাসতে হাসতে ফোনটা রাখলাম। মালটা চিরকালই বার খায় খুব। যাক সবাই মোটামুটি কনফার্ম। পিকুকে নিয়ে নো চিন্তা, ও কাছেই থেকে গেছে চিরটা কাল। আকাশ দিল্লীতে, বাবি আর ভাস্কর ব্যাঙ্গালোর, সমু দক্ষিন কলকাতা। আর আমি বাড়িতে।
বাবি আর আকাশ কে দেখব ১৮ বছর পর। ভাস্কর মাঝে মাঝেই আসে কাজের সূত্রে। সমুকে আগের পুজোয় দেখেছিলাম। এখন একটা অনামী কল সেন্টারে চাকরী করে। সারা মুখে পাকা দাড়ি। আমি হেসে বলেছিলাম” কিরে তুইতো রবীন্দ্রনাথ হয়ে গেছিস পুরো। কি অবস্থা। সমুর মুখে একটা ক্লান্ত হাসি ছিল। এখনও মনে পরছে সেই হাসিটা।
সবার কত্ত স্বপ্ন। আকাশছোয়া। আর ৫টা টিনএজারদের মত। সবাই কি নিজের স্বপ্নগুলো পূরণ করেনি? হয়ত করেছে। হয়ত সমুর ওই হাসিটুকুই স্বপ্ন ছিল। আমার স্বপ্নটাই হাসির ছিল।
লেখক হব আমি। আনন্দ পাব্লিশার্সের কর্মকর্তারা আমার বাড়িতে ধন্না দিয়ে পরে থাকবে। একটা লেখার জন্য। বাবাকে বলেছিলাম ইঞ্জিনিয়ারিং পড়বনা। জানো ৪টে লিটিল ম্যাগে আমার লেখা বেড়িয়েছে। লিখেই খাব। ভাগ্যিস আমার কথার তখন কোনো দাম ছিলনা। নইলে আজ আমিই সাহিত্য হয়ে যেতাম অন্য কারো কলমে।
দোষটা কি শুধু ভাগ্যের? নাহ। আমিই পারিনি। এখনকার লেখনীর সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে। কল্পনা, মায়া, সেক্স, প্রেম নিখুত মাপ মত মিশিয়ে তবে একটা জমাট লেখা বের হয়। আমি ওই মিশ্রণের পরিমানটাই বুঝে উঠতে পারিনি।
“ রাম।”
“ না প্লিজ। হুইস্কি। এটা গনতান্ত্রিক ডিসিশন।”
“ ওকে।” আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম।
জায়গাটাও ঠিক। পার্থদার বাড়ির বিশালাক্রিতি ক্যাকটাসের চৌবাচ্চা। একটা সিগনেচারের বোতলে ৭জনের নাম লিখে মাটি দেওয়া শুরু হল। সবুজ রঙের ছিপিটা আস্তে আস্তে ছোট হতে হতে যখন নেই হয়ে গেল সবাই মিলে চেঁচিয়ে উঠলাম উল্লাস!
“ ব্যাপারটা ঠিক হল? শালা মাসের শেষে ১০০টাকা। তাও ফিউচার প্ল্যা্নিং।”
“ ওরে আমি ১৭৫ দিয়েছি তাও হুইস্কির জন্য।” আমি কাঁদ কাঁদ হয়ে বললাম।
“ প্ল্যানটা তোমার গুরু। তোমায় তো খসাতেই হবে। হি হি”
“ হুমম। তাহলে ঠিক ২০বছর পর। সন ৩০শে নভেম্বর, ২০৩০। মনে থাকবে তো?
“ আছে রে আছে। এলাম তো।”
হা করে তাকিয়ে রইলাম। এটা বাবি। সারা মুখে সোনালী দাড়ি।” শালা তুই ব্যাঙ্গালোর গেছিলি না ক্যালিফোর্নিয়া?”
“ ইস্টাইল বস ইস্টাইল। বুঝবিনা। তুই তো সেই আমসিই রয়ে গেলি।”
“ অনেক হয়েছে। আয় ভাই যাদু কি ঝাপ্পি।”
নবু আর বুবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে ৬টা আপকামিং বুড়োর দিকে।
“ কি তুই খাবি নাকি এক ঢোক?”
“ আমার কোনো ইচ্ছে নেই।” মুখ ঝামটে নবুর রান্নাঘরের দিকে প্রস্থান।
দরজাটা খুলতেই একটা ভ্যাপসা গন্ধ নাকে এল। প্রায় একবছর পরে খুলল দরজাটা, শেষ আগের পুজোয় পার্থদার আসার পর এই। বাবা মা মারা যাওয়ার পর আর কলকাতায় থাকেনি পার্থদা। বছরে একবার আসে। এইবারই গ্যাপ। বাড়িটা তদারকির দায়িত্ব একরকম যেছেই নিয়েছিলাম আমি। সেটাও কি ওই বোতলটার নিরাপত্তার জন্য? সেটাও প্রায় ১২বছর হয়ে গেছে।
“ কি বস মাল্লু কি আদেও আছে? এ যে দেখছি পুরো খান্ডার।” ভাস্করের কথায় অবাঙ্গালী ছাপ এসে গেছে।
“ হাম হ্যে না। আকাশ বাথরুমের পাশ থেকে গাইতিটা নিয়ে আয়।”
আসছে আসছে। পাক্কা দশ মিনিট পর সেই ট্রেজার আইল্যান্ডের গুপ্তধন পাওয়ার মত ঢং করে একটা শব্দ হল। আর সবাই হইহই করে উঠল।
“ আস্তে বাপ। ভেঙ্গে গেলে টোটাল লস।”
বিশকাপ জেতার মত বোতলটা হাতে নিয়ে আমি উইনিং পোজ দিলাম।
প্রথম ঢোকটা গলায় পরতেই মাথাটা ঢং করে উঠল। কার বয়েসের দোষ এটা? আমার না বোতলের?
পিকু বোতলটা নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছিল।” দ্যাখ ভাই আমার মার্কারে লেখা সেই নামগুলো। এখনও অস্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।”
সে তো যাবেই গাধা। আমার চোখে একটা জয়ের ছাপ। সবার চোখেও একই ছবি খুজছিলাম আমি।
“ এই সমু কি হয়েছে রে তোর? এত মনমরা কেন? বিড়ি শেষ?”
সমু একটু হেসে বলল” বিড়ি খাইনা রে। অনেকদিন হল ছেড়ে দিয়েছি।”
আমি প্রায় চেয়ার থেকে পরে যাচ্ছিলাম। কার মুখে কি কথা?
“ তো হয়েছে টা কি বলবি তো?”
“ না রে কিছুই না।”
গ্লাসটা এগিয়ে দিয়ে বললাম” নে গেল। গিলে বল।”
কাঁপা কাঁপা হাতে গ্লাসটা শেষ করে সমু বলল” নিপার শরীরটা ঠিক নেই রে। গলব্লাডারে স্টোন ধরা পরেছে। ২লাখ টাকার দরকার। এক আমি জোগার করেছি। তোদের বলব ভাবছিলাম। কিন্তু
“ ভাগ এক পয়সাও দেবনা। অত ভাবলি কেন তুই?” বাবি চোখ পাকিয়ে বলল।
আকাশ হেসে বলল” অনেক বিড়ি নিয়েছি আমরা তোর থেকে। সুদে আসুলে ১লাখ তো হবেই।”
আমি বললাম” এবার যদি তুই আমাদের হাত ধরে বলিস কিভাবে তোদের ধন্যবাদ দেব তো পরের পেগ ভুলে যা।”
“ মাথা খারাপ।” চেয়ারটায় হেলান দিয়ে বসে সমু বলল” দে একটা সিগারেট দে। আয়েশ করে খাই।”
সবাই হেসে উঠলাম। হাসিকান্না মিলেমিশে এক হয়ে গেল।
এবার সবার গর্তে ফেরার পালা। আমি হেসে বললাম” চল আরেকটা বোতল, আবার ২০বছর।”
বাবি বলল” ধুর। অতদিন না। নেক্সট বছর ঠিক এই দিন। যতই কাজ থাকুক আসব। এবার না হয় কিনেই খাব।”
সবাই হাত তুলে বলল রাজি।
সবাই এক এক করে বেড়িয়ে যাওয়ার পর বাবি উকি মেরে আমায় কানে কানে বলল” গুড্ডু আমার স্পষ্ট মনে আছে, বোতলটা পোঁতার ঠিক ৩দিনের মাথায় আমি, সমু আর পার্থদা ওটা বের করে খেয়ে নিয়েছিলাম। আর খালি বোতলটা পুঁতে দিয়েছিলাম। ওটা ভরল কি করে বে?”
আমি হেসে উঠলাম। এর উত্তর আমার জানা নেই। এই ২০বছরে কতবার বোতলটা ভর্তি আর খালি হয়েছে তার হিসেব রাখিনি। কারন আজ অনেক বড় একটা হিসেব আমি মিলিয়ে দিয়েছি। মদের থেকেও বেশি একটা জিনিস আছে যা যতদিন যায় তত নেশা বাড়ে। সেটা বন্ধুত্ব। প্রতি বছর না হোক আজ থেকে ২০বছর পরে আবার ৬টা মাথা মিলবে, সে যেখানেই থাকি, আবার সেই হাসি, খিস্তি, স্বপ্ন, গড়ে ওঠা, ভেঙ্গে যাওয়া। আবার ৬টা গেলাস একসঙ্গে আওয়াজ করে চেঁচিয়ে উঠে বলবে চিয়ার্স।
স্বার্থপর – অংশুমান
সোহিনী ভাবতে চায় না নাকি ভেবে পাচ্ছেনা? এটা তার কাছে গুরুতর কিছু না হলেও জয়-এর কাছে বাধ্যতামূলক ভাবে একটা প্রশ্নসূচক অসংজ্ঞা। জয় মানে জয়ন্ত বানার্জী, ইংরেজি অনার্স-এর ছাত্র, প্রেসিডেন্সি কলেজ। সোহিনী রায় বাংলা অনার্স এর দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। এক বছর আগে মিলিউ তে হুল্লোড় নাচ করতে করতে আলাপ দুজনের, তারপর প্রেম। সোহিনী, জয়ের এক বছরের জুনিয়র।
এ বছর জয় এর শেষ মিলিউ। সোহিনী বাড়িতে। জয় এর নিশ্বাসে প্রশ্বাসে গাঁজা আর হুইস্কি এর তীব্র গন্ধ তার সাথে ধুলো ধুলো লালা। লাল চোখ, উস্ক খুস্ক চুল। কনসার্ট অনেকক্ষণ শুরু হয়ে গেছে। চারপাশের উল্লাসের উড়ন্ত স্পর্শ জোরে জোরে আঘাত করছে জয়ের মন কে। সকালেই মিলিউ এর আয়োজন সংক্রান্ত ঝামেলার জেরে সিনিয়র দের কাছে মার খেয়েছে রজত। রজত তার খুব কাছের বন্ধু। একটা তীব্র ক্ষোভ কোথাও কোনো দলবাজির উদ্দেশ্যে অনবরত কাজ করে চলেছে তার মনে। সকালের ঘটনায় তার আবেগ আহত হয়েছে। সারাক্ষণ মনে মনে বিরোধ চলছে তার। কোথাও একটা দুর্বলতার অনুভূতি যেমন আপাত ব্যর্থতার সম্মুখীন করেছে তাকে তার সাথে সাথে যেন বার বার গর্জন করে উঠছে মন। কারা যেন বোঝেনি, রজত কে আঘাত করলে তার কষ্ট হয়। কারা যেন শুধু নিজের স্বার্থ টুকুই বোঝে। তারা জয়ের আবেগ, ভালবাসা, বন্ধুত্বের গুরুত্ব না বুঝে, মূল্য না বুঝে গুড়িয়ে দিতে পারে সবকিছুকে। কুমোর পারার দেবল পাল, তাকে জয় শুধু চিনতো, তার বাবা বাজ পড়ে মারা যাওয়ার পর সে স্কুল ছেড়ে মাটির বাসন তৈরী করে মা-বোনের দায়িত্ব নিয়েছিল। এই কথা জয়কে রাতের পর রাত ভাবিয়েছিল, চোখে জল এনে দিয়েছিল। যখন পল্লবীর মা কালী পুজোয় ঠাকুরের অস্ত্র-গয়না কেনার টাকা দিয়ে প্রার্থনা করেছিল যেন তার সংসারে কোনো ক্ষতি না হয় আর তারপর দিন, মাত্র এক দিনের অসুখে পল্লবীর বাবা মারা গেছিল, জয় মনে হয় পল্লবীর থেকে বেশি দিন ধরে কেঁদেছিল যদিও ওদের সাথে জয় এর কোনো সম্পর্ক ছিলনা, নেই। তার ক্লাসমেট অর্নব, ট্রেন -এ আলাপ হওয়া পার্থ, বাবার বন্ধু উজ্জল প্রামানিক সবার আবেগ নিয়ে দুঃখ নিয়ে দিনের পর দিন ভেবেছে জয়। কারোর আবেগ কে কেউ কি করে আঘাত করতে পারে? কি, সে তো পারেনা! সবার নিশ্চয় ভাবার সময় নেই। কিন্তু তাতে তো কত মানুষ কত কি হারায়ে, ক্ষতিগ্রস্থ হয়, আঘাতপ্রাপ্ত হয়। এগুলোর প্রতি কি কারোর দায়িত্ব নেই? কারোর দায়িত্ব তাই বা কিসের?!! সব প্রশ্ন গুলো তার মাথায় এসে ভিড় করছিল। হঠাত সে বুঝলো তার প্রিয় রক গান তার সবচেয়ে শেষের গিটার পার্টটা সে শুনতেই পায়নি, বরং শোনেনি অথবা বোধয় সন্দিগ্ধই থেকে গেল অদৌ সেটা বেজেছিল কিনা।
সেই সময়টুকু রাগে, ক্ষোভে, ব্যর্থতায়, কষ্টে হারিয়ে ছিল সে। হঠাত গান টার শেষ হওয়া বোধহয় তাকে ফিরিয়ে আনলো আবার কোলাহল এ; বাস্তবিক কোলাহলে। জয় ভাবতে শুরু করলো সে বোধহয় বোকা। এত সব কিছু ভাবার হয়ত কোনো মানে হয় না। নিশ্চয় সবাই ভাবতে পারতে পারে এসবই কিছু কিন্তু সবাই সীমাবদ্ধ করে ন্যায় আর সেটাই বুদ্ধিমানের কাজ। বুদ্ধিমান? না হতেও পারে, কিন্তু কেউ কি এত কিছু ভেবে কষ্ট পায়না। আমি কেন পাই? আমার আবেগ কেন এত গভীর? ভাবতে ভাবতে জয় এর ক্ষোভ থিথিয়ে আসছিল। যতই ভাবছিল ততই নিজের চিন্তার থেকে বাস্তবের দূরত্ব বাড়ছিল কোথাও যেন। নিজেকে আলাদা মনে হচ্ছিল; অন্যদের বোধয় দোষ নেই, তারা সোজা সমীকরণ মেনে চলে; একটা ঐকিক নিয়ম, রৈখিক নিয়ম।’Head Banging’ছন্দ হারাচ্ছিল, ধীর হয়ে আসছিল। একটা হতাশার ছায়া তার উদ্দামের উপর একটা মন্দিত প্রভাব ফেলল। চারপাশ চেয়ে দেখল জয়। সবাই গানের তালে নেচে চলেছে ; কলেজ-এর ভিন -কলেজ এর ছাত্র -ছাত্রী রা।হাজার হাজার মানুষের মধ্যে ক্লান্ত ও একা বোধ তাকে ঘিরে ধরতে শুরু করলো। ক্লাসমেট মসিউর কিছু একটা জিজ্ঞেস করলো তাকে, সে শুনতে না পেয়েও মাথা নাড়ল, তাকে ফের জিজ্ঞেস করার মতো জোরটুকু পাচ্ছিল না সে। এই তীব্র আওয়াজ তার কাছে ক্লান্তিকর হয়ে উঠতে শুরু করলো। জয় একটু মনে মনে নিজেকে আবার নাড়া দিল, গাঁজা -মদ খেয়ে বোধহয় একটু বেশি ভাবছে সে, আসলে অনুভূতি নিয়ে অতকিছুও ভাবনা বোধহয় নেশার ঘোর-এ তাকে আরো আচ্ছন্ন করে। নিজেকে হালকা ঢং এ তাচ্ছিল্য শুরু করলো। ধুত!! সালা! আসলে একটা অভিমান। নিজের প্রতি শ্রদ্ধা কে যখন অন্য কেউ বোঝেনা, উদার মানবিকতা বোধ যখন বাস্তবের পায়ে দলিত হয় তখন বোধহয় এই অভিমান টা আসে। নিজের মধ্যে থেকে একটা বোঝাপড়ার প্রস্তাব ভেসে আসে। নাঃ আমি এরকম ই থাকব, থাকতে চায়। জয় নিজেকেই নিজে উত্তর দিল মনে মনে।
কিন্তু যে গান শুনলে জয় সারারাতেও ক্লান্ত হয়না আজ সেই গান তার এই মূহুর্তের একাকিত্বে ভালো লাগছেনা। সত্যি ই ভালো লাগছেনা। ভেবে দেখল বোধহয় তার শুধু মাত্র আবেগজনিত পার্থক্য বা একাকিত্ব এই ভালো না লাগার শুধু মাত্র কারণ নয়। বেশি মদ খাওয়া, গাঁজা খাওয়া তার অভ্যেস তাই ওটাও হয়ত কারণ নয়। তাহলে কি তার আসে পাশে থাকা মানুষের সাথে দূরত্বের অভিমান? নাকি ক্ষোভ? কিন্তু তা দিয়ে তার ভালোলাগা নষ্ট হবে কেন? নাঃ কোনো ক্ষোভ বা আঘাত তার ভালবাসা কে তো পাল্টে দেয়না, নষ্ট করে দেয়না। আসলে কি তবে তার গান শুনতে ভালো লাগছে? সাথে নাচতে ভালো লাগছে? শুধুই কোথাও একটা নাটকীয় ভাবনা তাকে গ্রাস করে অস্থির করে দিচ্ছে? ভাবতে ভাবতে আবার মাথা ঝাঁকাতে আর গানের সাথে গলা মেলাতে শুরু করলো জয়। চারপাশের কোলাহলের মধ্যে বোঝা যাচ্ছেনা জয় ঠিক কতটা জোরে গান গাইছে; সে নিজেও বুঝছেনা। জয় বুঝছে না হাজার মানুষের ভিড়ে তার উদ্দাম মাথা ঝাঁকানো কতটা শ্লেষ তৈরী করতে পারে, বা কতটা অশোভনীয়তা অথবা কতটা অনিয়ম। এই বোঝাগুলোর তাগিদ এই মূহুর্তে হারিয়ে ফেলেছে সে। হয়ত বা জয়ের বাবা এই মূহুর্তে হাঁপানির কষ্টে বাঁচবার জন্য একটু ভরাট নিশ্বাস প্রার্থনা করছে। জয় এর অপরাধী মনে হলো নিজেকে। মনে হলো নিজের মনে স্রোতের সাথে ক্রমশ এগিয়ে যেতে যেতে সবার থেকে অনেক দুরে চলে এসেছে সে। তার মনে পড়ল গত দু-মাস ধরে ঠিকঠাক বই এর সাথে সম্পর্ক রাখেনি সে। বাবা -মা আত্মীয় স্বজন এর আশা কে সে গুরুত্বহীন কোনো জায়গায় বসিয়ে রেখে ভুলে গেছে। তাকে অনেক পড়াশোনা করতে হবে। অপরাধী মনস্তত্ব তাকে আক্রমন করতে শুরু করলো। জয় নিজেকে বোঝালো সে এখন থেকে এগুলো নিয়েই ভাববে। তার মনে হলো শুধু নিজের মতো থাকা টা স্বার্থপরতা আর এই স্বার্থপরতা থেকে সে আসতে আসতে দুরে সরে যাচ্ছে সাধারণের থেকে, বাবা -মার থেকে, আর সবার থেকে। নিজের মধ্যেই শুধু ঘুরপাক খাচ্ছে জয়। নিজের বাইরে বেরিয়ে আসতে চায় সে।
চুল সম্পূর্ণ ভিজে গেছে ঘাম-এ, চোখে ঘাম এসে ঢুকে এক লবনাক্ত জ্বালা তৈরী করেছে, ওই অবস্থায় হাতের ধুলো বালির সাথে ঘষে যাচ্ছে চোখ। কপাল, নাক, গাল, ঠোঁট চিবুক একসাথে মুছে যাচ্ছে একবার এদিকের জামার হাতায় আর একবার অন্যদিকের টাই। পায়ের আঙ্গুল, পায়ের তলা ক্লান্ত হয়ে এসেছে। শুকনো গলার থুথু বেসামাল হয়ে এক -একবার নিজের জুতোই এসে পড়ছে আবার শুকিয়ে যাচ্ছে। জয় এর প্রচুর জল তেষ্টা পাচ্ছে। তেষ্টা, একটা যথেষ্ট সহ্য সীমা অতিক্রম করেছে। জয় নাচ গান থামিয়ে একবার চারপাশ চেয়ে দেখল; জল পাবার কোনো আশা নেই। প্রোগ্রাম অনেক টা গড়িয়ে এসেছে, যারা জল এনেছিল নিশ্চয় এতক্ষণ এ নিশ্চয় শেষ করে দিয়েছে। একবার ভাবলো বাইরে গিয়ে জল খেয়ে আসবে। কিন্তু যদি এই ফাঁকে কোনো ভালো গান হয়? এতক্ষণ ধরে যে অনুষ্ঠান সে উপভোগ করতে পারেনি তার সবথেকে আকর্ষনীয় অংশ যদি এবার আসে? এগুলো কখনই ছাড়তে চায় না জয়। এই স্বতস্ফুর্ত উন্মত্ততা তাকে অগাধ টানে। জয় এই উন্মত্ততায় নিজেকে হারিয়ে দেয় আবার খোঁজার চেষ্টা করে। কোথাও বোধহয় একটা স্বাধীনতার স্বাদ পায়; উন্মুক্ত স্বাধীনতা। একটা অনায়াস নির্লজ্জতা অবলম্বন করতে পারে সে। একটা সময়ে দাঁড়িয়ে সবার মধ্যে থেকেও একা হতে পারে, নিজেকে ইচ্ছেমত ছড়িয়ে দিতে পারে। এই একা হওয়াটা অন্য রকম। এর উপর কোনো প্রশ্ন ওঠেনা। এই স্বাধীনতার কোনো লজ্জা নেই; কারোর হস্তক্ষেপ নেই। এটা ভাবতে ভাবতে বোধহয় কোনো সমান্তরাল ভাবনা জয় কে আক্রান্ত করছিল, জয় এর চোখে মুখে একটা বিরক্তির প্রকাশ। একটা ভ্রু কোঁচকানো চেহারা নিয়ে কিছুক্ষণ দাড়িয়ে থাকার পর অনুভব করলো তার এই মুহুর্তেই জল চায়। কিন্তু জল খেতে যাবে না জয়। জয় আরো দৃঢ় হলো। নিজেকে কোথাও আরো সহিষ্ণু মনে করলো; চাপিয়ে দিল একটা অতিরিক্ত সহিষ্ণুতা। জল না খেলেও চলবে। এত কিছুর বদলে সে জল তেষ্টা কে গুরুত্ব দেবেনা। জয় অনেক কষ্ট সহ্য করতে পারে, এটুকু তেষ্টা কে নিয়ন্ত্রণ করা তার পক্ষে কিছুই না। যদিও কষ্টকর হয়, সে সহ্য করবে। কষ্ট টাই তার নিয়তি। এতদিনে হয়ত সব কষ্ট সে পায়নি। জয় এর ভাই বাপন যখন জলে ডুবে মারা যায় চার বছর আগে, তার মনে হয়েছিল বাপন কে এক -জীবন কথা বলা বাকি ছিল তার। কতকিছু চাওয়ার ছিল, কত কিছু পাওয়ার ছিল। ওই মূহুর্তে দাড়িয়ে সে ঈশ্বর এর দিকে অভিমানী লাথি পর্যন্ত তুলতে চেয়েছিল। তার পা ভারী হয়ে এসেছিল, তার অস্তিত্ব পাথরের মতো হয়ে এসেছিল। চোখের জল মাসের পর মাস বাধ মানেনি। কোথাও যেন কিছু একটা বাপন কে না বলতে পারার ব্যথা, বাপনের জন্য কিছু না করতে পারার ব্যথা তার বুকের মাঝে চাপ ধরিয়ে রাখে। শেষ মেশ বাপনের কাছে আর পৌছতে না পেরে জয় বাপন কে প্রশ্ন করে,”বাপন তুই মরে গেলি কেন?”---সেটাও পৌছয় না। অক্লান্ত স্বপ্ন দেখে জয়, বাপনের ফিরে আসার। স্বপ্ন চোখ খুলে গেলে ছল -ছল করে ওঠে, অসীম জোরে চেচিয়ে উঠতে ইচ্ছে করে জয় এর। মৃত কে ফিরিয়ে না আনতে পারার আকুল -আর্তনাদ, জয় বোঝে। জয় আর নাচছে না, গান ঢুকছে না মাথায়ে; কানে হয়ত জোর করে ঢুকছে। এক -চোখ জল নিয়ে জয় আকাশের দিকে তাকালো; আবার কাউকে কিছু বলার চেষ্টা করলো কিন্তু ব্যর্থ হবার অভ্যেস তার ব্যবহার এ একটা অভিজ্ঞতার ছাপ দিল।
একটা আভ্যন্তরীণ হাসি নিয়ে চারপাশে তাকালো সে। সবার হয়ত এতটাই কষ্ট আছে। সবার হয়ত বাপন ছিল না কিন্তু কেউ ছিল যে আজ নেই আর অথবা অন্য কোনো কষ্ট অন্য ব্যাকুলতা। কিন্তু কেউ জয় এর মতো থেমে যাচ্ছেনা। তাহলে কি জয়ের মতো কেউ ই ভাবে না?? হয়ত সবাই ভাবে, তাদের আবেগ কে গুরুত্ব দেয়, কিন্তু বোধহয় কোনো নিয়মে অথবা কোনো সীমায়। কিন্তু না, কষ্ট তো সবার সমান তবে হয়ত সবাই খুব অল্প সময়ে ভুলে যেতে পারে আমি সহজে ভুলিনা। নাঃ আমি আমার হারিয়ে যাওয়া আপনজন কে বেশি মনে রাখি এরকম অহংকারের শিকার হতে পারিনা। না কখনই না। জয় কোথাও সবাই কে নিজের মনে করলো। চেনা ও অচেনা সবাই তার নিজের। অন্তত আবেগ এর ক্ষেত্রে, কষ্টের ক্ষেত্রে। হলেও বা না হলেও সবার স্বাধীন অনুভূতি তার ই মতো। সেই সবার নিজের আবেগ কষ্টের অনুভূতি তাদের নিজের কাছে অনেক গভীর। সবাই তার ই মতো মূল্যবোধ সম্পন্ন। জয় নিজের অজান্তেই নিজের সাময়িক বিরুদ্ধাচরণ শুরু করলো। জয় কাউকে খুঁজে পায়নি যে তার আবেগ কে বুঝবে তাই সবার মতো সীমাবদ্ধ হবার কথা ভেবেছিল। অন্যের ও নিজের অনুভূতির অতটাও গভীর গুরুত্ব দেবেনা ও পার্থিব বস্তুর ও চিন্তার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল। জয় আবার এক ই জায়গায় নিজেকে খুঁজে পেল। জয় নিজেকে সংজ্ঞা দিতে পারছে। যেখানে আমি বারবার ফিরে আসি সেটাই আমার ঠিকানা। কিন্তু একথা, যারা রজত কে মেরেছে তাদের কিকরে বোঝাবে? কিম্বা আরো ঘটনার অনুরূপ চরিত্র দের? বোঝানোর কি ই বা দেয়? কিন্তু দায় এড়িয়ে গেলে সে আবার কষ্ট পাবে অন্য কোনো রজত কে আহত হতে দেখে। আবার নিজেকে ব্যর্থ মনে হচ্ছে জয় এর। জীবিত দের কাছেও কি পৌছতে পারবে জয়?
গাঁজা, মদ, ধুলো বালি, ঘাম, প্রশ্ন, ব্যর্থতা, ব্যাকুলতা একসাথে ফিরে এলো জয় এর কাছে। জয় আরো দুর্বল বোধ করছে, তেষ্টা আরো স্পষ্ট হয়ে আসছে। জোর করে জয় বেরিয়ে আসতে চাইছে নিজের ভেতর থেকে। বিক্ষিপ্ত ভাবে নাচার চেষ্টা করছে কিন্তু গান গাইতে পারছে না। নিজে থেকে ভেবে যাওয়ার স্রোতে কি জয় দুর্বল হয়ে পড়ল? নাকি আরো কারোর বোধহয় একটা দায় বর্তায়? আর সবার? না না জয় নিজেই অযাচিত ভাবে এগুলো কে ডেকে এনেছে। অভিমানী হয়ে উঠেছে নিজে নিজেই। পাথরের যদি আমার হাজার ডাকে, হাজার প্রার্থনায় আমার দিকে না এগিয়ে আসে আমি অভিমান করতে পারিনা তাদের ওপর। কিন্তু আমি -ই তো বেশি ভাবার দায়িত্ব নিয়েছিলাম, আমি -ই ভেবেছি, আমি কাছে যেতে চেয়েছি, আমি মূল্য দিয়েছি অন্যদের আবেগ কে। তবে কেন আমি এত দুরে দাড়িয়ে আছি আজ একা? নাকি শুধু ভাবলেই মূল্য দেওয়া হয়না? না সত্যি ই হয়না। কিন্তু আমি তো শুধু ভেবে জানি। আমি সোহিনী কে অসীম ভালোবেসেছি। তাকে তার মতো করে গুরুত্ব দিয়েছি। অনেক সময় দিয়েছি। অনেক কথা, অনেক উত্তেজনা, অনেক আবেগ। আমি মা -বাবার কথা ভাবিনি বেশি যতনা আমি সোহিনীর কথা ভেবেছি। আমি অনেক কাছে গেছি। আমি অনেক চিনেছি ওকে। অনেক দিয়েছি। যা চেয়েছে তার অনেক টাই। আমি সোহিনীর সাথে একা হয়েছি। একা হতে হতে আমি রুপম, বিপাশা, তন্ময় দের থেকে অনেক দুরে চলে এসেছি। আমি ওর হয়ে বাঁচতে চেয়েছি, ওকে বাঁচাবো সুখে বলে অঙ্গীকার করেছি। কত বলা না -বলা আরো প্রতিজ্ঞা, আরো কল্পনা -পরিকল্পনা। আমি নিজেকে ঢেলে দিয়েছি। আমি ওকে গান দিয়েছি কবিতা দিয়েছি। মান -সম্মান অস্তিত্বের সাথে জড়িয়ে নিয়েছি। চোখের জল দিয়েছি, শরীরের ক্লেদ, ক্লান্তি, ক্ষয়, বিমর্ষতা, অন্ধকার সব দিয়েছি। আরো কত বস্তুবাদ, কত আলো, কত অপচয়, কত অভিনয়, কত সত্যি, কত মিথ্যে, কত আকাশ, কত জল, কত অনুনয়, কত অনুভূতি, কত রাত, কত দিন, কত রাজনীতি, কত রাস্তাঘাট, কত শহর, কত নদী, কত মশা -মাছি -ঝি ঝি পোকা, কত ডাল -ভাত, কত কফি, কত দারিদ্র্য, কত দৃষ্টি, কত আয়না, কত স্বপ্ন......
এর বাইরে কি কোথাও ছিলাম আমি সোহিনী?
রুপম বিপাশা তন্ময় জিব্রান জাহির .....দেবল পল্লবী উজ্জল প্রামানিক ....বাপন ....
তোমায় দিয়েছি সোহিনী...
জয় একটু খানি পিছিয়ে এসে রেলিং ধরে বসে পড়ল। ঢোক গিলে যাচ্ছে জয়, জলবিহীন। চ্যাট -চেটে মাটি স্বাদের থুথু গলা দিয়ে নিচে নেমে আবার উঠে আসছে। শুধু চেঁচামেচি আর সমবেত উল্লাস আর তীব্র রক কনসার্ট কান দিয়ে শরীরে ঢুকে আসছে। শরীর কে কাঁপিয়ে দিচ্ছে। শিরশির করে উঠছে জয়। আর ভাবছেনা বোধহয়। জয় এর শরীর আরও নুইয়ে পড়ছে। হাত দুটো মাটি থেকে তুলে বোতাম খুলে দিল জামার। একটা পা গোটানো আর একটা ছড়ানো। মাথা একবার এপাশ একবার ওপাশ রেলিং এর উপর গড়াচ্ছে। এই অবস্থায় বোধহয় জয় কিছু আর ভাবছেনা। নিশ্চয় ভাবতে পারছে না। হাতে পায়ে ঘামের সাথে ধুলো বালি মিশে একটা কাদা তৈরী করেছে। কেউ ওকে দেখছে কিনা, ওর ওই অবস্থার প্রতি অশ্রদ্ধা করছে কিনা বা অন্যদের কাছে তাকে কি কি প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে এই ধরণের কিছু কথা জয় এর মাথায় এসে ঘুরপাক খেয়ে ফিরে যাচ্ছে। তারা অবান্তর হয়ে যাচ্ছে।
জয় এক মূহুর্তের জন্য কেঁদে উঠলো ...ঊঊফ্ফ্ফ্স!
পরের মুহুর্তেই শান্ত হয়ে গেল। জয় বোধহয় আরো একটু পারবে, পারবে কষ্ট সহ্য করতে আরো খানিক টা, কেঁদে ফেলার আগে। অথবা আরো অনেক পারবে। জয় এর চোখে অন্ধকার ঘুম নেমে আসছে।
জয় লক্ষ্য করলো ফোন বাজছে ....; সোহিনী।
ফোন টা তুলতে তার একটা পাহাড় তলার ক্ষমতা লাগলো।
"হ্যালো"
"তুমি কোথায়?"
"মিলিউ"
"তন্ময় রা এখনো আছে? কখন ফিরবে? খাবে কোথায়?"
"............"
"হ্যালো"
"..........."
"আরে কি হলো? কি করছ তুমি?"
".....হাঁ"
"কি হাঁ? আরে যা জিজ্ঞেস করলাম উত্তর দেবে তো!"
"...হমমম"
"আশ্চর্য তো! গাদা গাদা মদ গিলেছ নিশ্চয় ...disgusting একেবারে! এত মানা করি তাও শুনবে না, তাও এত মদ খেতেই হবে ....অল্প খেলে কি হয়? মাত্রাহীন সবকিছু .......একদিন বুঝবে এসব বলে দিলাম ....প্রোগ্রাম যা হয়েছে হয়েছে তুমি বেরিয়ে এস ওখান থেকে ...এক্ষুনি ...."
".........."
"হ্যালো! কি হলো? তোমাকে বললাম না বেরিয়ে আসতে ....আসছে? এসে বেরিয়ে আমায় ফোন কারো ...আর গিয়ে খাবার ব্যবস্থা করবে আগে ...হ্যালো!!"
"............"
"হ্যালো!! জয়? কি হলো উত্তর দেবে তো ...হ্যালো ......ধুত!.....তুমি নয়েজ থেকে বেরিয়ে আসবে প্লিজ ....হ্যালো!!"
"..........."
"হ্যালো! হ্যালো!.....হ্যালো! ধুত ...."
".........."
ফোন টা মাটিতে পড়ে আছে। জয় বমি করছে গায়ে হাতে পায়ে, অনর্গল। গত শরীরে আঁশটে মদ মদ গন্ধের বমি লেগে যাচ্ছে জয় এর। ফোন টা কোথায়? সোহিনী আর কি কি বলত জয় এর জানতে ইচ্ছে করছে না। জয় এর ক্ষমতা নিঃশেষ। ফোন এর উপরেও বমি এসে পড়ছে। আশেপাশের সবাই ওখান থেকে দুরে সরে যাচ্ছে। একটা ছোট খাটো জটলা। একটা কয়েক মূহুর্তের হুলুস্থুল হয়ে আবার জন-স্রোত নাক সিটকে মেতে যাচ্ছে কনসার্ট এ। ভালো করে দেখলে দেখা যাবে জয় এর গায়ে বমির সাথে এখন কিছু ঘেন্না আর করুনা লেগে আছে। জয় বমি মেখে পড়ে আছে মাটিতে। ফোন বেজে চলেছে অনবরত ; জয়ের জ্ঞানসীমার অনেক বাইরে। অনেক দুরে।
"জয়! জয়! এই জয় .....ওই জয়!"
জলের কয়েকটা ঝাপটা এসে পরার সাথে সাথে ডাক শুনতে পেতে লাগলো জয়। জয় এর জ্ঞান ফিরে আসছে আসতে আসতে। জয় শিথিল, নিস্প্রচেষ্ট।
"তন্ময় ...এদিকে আয়, জয় কে দেখ কি অবস্থা ...শালা মদ খেয়ে লটকে পরবি তো খাস কেন?"
"এই নে জল খা ...ওঠ ওঠ ...এই নে”
জয় রেলিং এ ঠেস দিয়ে উঠে বসলো। বোধহয় ঘেন্না, করুনা আর অপমান বোধ থেকে একটা শক্তির সৃষ্টি হয়েছে। বা অন্য কিছু। চোখ বুজে বসে আছে জয়।
"জলের বোতল টা শেষ করবিনা কিন্তু ...একটু রাখবি ...এবার’আমার গোলাপ’গাইবে নাচব চল ...আমরা ডান দিক তাতে আছি ...এক্ষুনি উঠে আই ...জল টা কিন্তু শেষ করবিনা পুরো ..."
"তন্ময় চল ..."
"জয় চলে আয় নাচব ..."[অপেক্ষাকৃত দূর থেকে রুপম ]
---------
সোহিনী তাও কত দুরে তুমি! জয় ভাবা শেষ করলো। করলো কি? বোধহয় আর পারল না ...অন্ধকার হয়ে গেল সব।
Comments
Post a Comment