নগ্নতা | পাতাউর জামান

|
‘Nature’ by Renee Robinson |
|আমাদের যাবতীয় যা কিছু তারই আধিকাংশ সীমানার দ্বারা নিয়ন্ত্রণাধীন। এই সীমানা বলতে চিত্রশিল্পের মাত্রাবোধকে ইঙ্গিত করেছিলেন অবনঠাকুরকিন্তু এই কথা সমস্ত শিল্প মাধ্যমের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। ঠিক কতটা দেখাবো বা ঠিক কতটা বলব বা ঠিক কতটা লিখবো– এই প্রসঙ্গটাই বড়ো হয়ে দেখা দেয় সেখানে‘নগ্নতা’র ক্ষেত্রেও এই একই কথা সত্যি। আমাদের ছোটোবেলায় আসমত পাগল বছরে মাসখানেক আমাদের বাড়ি থাকত। গরু চরাতো মাঠেঘাটে বাকি সময় উধাকোনো পাত্তাই থাকত না। আসমতের বয়স কত হবে, এই বছর চল্লিশেক। কালো। মাসে কোনো দিন গোসল করত কী না আল্লাই জানে। আমাদের বাড়িতে যখন এক গা গন্ধ নিয়ে ঢুকত, মার প্রথম বাক্য ছিল, ‘ওটাকে পুকুরে ফেলে ঢলে-ঘসে তবে ঘরে তোল’। আমরা হাতে লাঠি নিয়ে যে ভাবে গরু তাড়ায়, হেই হট হট হট, সেই ভাবে ওকে আমাদের বড়ো পুকুরে নিয়ে ফেলতাম। লাঠি হাতে বুবুজান বলত, ‘এই শরীরটাকে ঢলে ঢলে পোস্কার কর’আসমত, একে একে গায়ের সব পোশাক ফেলে দিত পানিতে। তারপর ডলতে শুরু করত। এই রকম একদিন, সেবার আমি থ্রি বা ফোরে পড়ি, আসমতকে পুকুরে গোসল করাতে গিয়ে দেখি আসমতের হাতের ঘর্ষণে পুরুষাঙ্গ খাড়া হয়ে গেছে। তখন কিন্তু আমার কাছে আসমত নগ্ন অঙ্গ পীড়া দেয়নি। শুধু বয়েস সুলভ একটা কৌতূহলের জন্ম দিয়েছিল। কিন্তু আমার ছাত্র জীবন শেষ হবার পরে সেদিন সুকান্তসেতুর উপর, সন্ধ্যে সাত বা আটটার দিকে একটা পাগলকে দেখেছিলাম চাঁদের দিকে মুখ করে পুরুষাঙ্গটাকে হাতে করে নাচাত। সেদিন আমাকে পুরুষাঙ্গের ‘নগ্নতা’ পীড়া দিয়েছিল

‘নগ্ন’ বা ‘নগ্নতা’ ব্যাপারটা তখন পর্যন্ত আমাদের সবার চোখ বা মন বা ভাবনার সহায় হয়ে ওঠে যতক্ষণ না আমাদের চোখ বা মন বা ভাবনাকে পীড়া দিচ্ছে। আসলে ‘নগ্নতা’র মধ্যে যে মাত্রা থাকে সেটা নির্ভর করছে কতটা দেখানো হচ্ছে বা কতটা দেখাচ্ছে বা কীভাবে দেখানো হচ্ছে বা উদ্দেশ্যটাই বা কী! ব্যাপারটা এই রকম, একটু ভেদ খুললেই বোঝা যাবে। এই তো বেশ কয়েক লাইন আগেই আমি লিখলাম, ‘আসমতের হাতের ঘর্ষণে পুরুষাঙ্গটা খাড়া হয়ে গেছে’ বা ‘চাঁদের দিকে মুখ করে পুরুষাঙ্গটা হাতে করে নাচাচ্ছে’। এখানে আমি সোজা কথাতেই বলতে পারতাম। এটা তো কবিতা নয়, গদ্য। আর গদ্যে সোজাসাপটা কথা বলার হক আমারও আছে। আমি বলতেই পারতাম ‘হ্যাণ্ডেল মারছে’ বা বলতে পারতাম ‘ধোন খেচ্‌ছে’– তা না বলে কী বললাম! না বললাম- একটু ভাষার মারপ্যাঁচ দিয়ে, একটু পেলব, একটু তুলতুলে, একটু মিষ্টি করে, ভদ্রতার রাখঢাকে- ‘আসমতের হাতের ঘর্ষণে পুরুষাঙ্গটা খাড়া হয়ে গেছে’ বা ‘চাঁদের দিকে মুখ করে পুরুষাঙ্গটা হাতে করে নাচাচ্ছে’। আসলে আমার মধ্যেও একধরনের ভদ্রতার সংস্কার কাজ করেছে। যেটা সমাজ কাঠামোর একটি অলৌকিক নীতি, যা আমরা মেনে চলি। কিন্তু স্থান-ভেদে আবার এটি পাল্টায়। আপনি পুরুলিয়ার উপর খাজুরা গ্রামে যাবেন, সেখানে হয়তো আপনাকে আপনার আত্মীয় বা বন্ধু বা নিকটবর্গ থেকে এমন আহ্বান আকসার শুনতেই পারবেন, ‘এই নুনু খেয়ে যা বা যান’। ‘নুনু’! না যেটা ভাবছেন, সেটা নয়। এখানে আদর করে বড়োরা ছোটোদের নুনু বলে ডাকে। যেমন আমরা ডাকি ‘কচি’, ‘খোকা’, ‘মনা’ কিংবা ‘বাবু’– সেই রকম।
শুধু মাত্র ‘নগ্ন’ বা ‘নগ্নতা’র সামাজিক ধারণা পালটে যায়- এমটা কিন্তু ‘খাঁটি’ (যদিও খাঁটি প্রশ্নের বাইরে নয়) সত্যি কথা নয়। শিল্প সাহিত্যের ক্ষেত্রেও এই কথাটা খাটেযেমন ভাবে মরুভূমিতে এক জন পিপাসার্থী যদি মরিচিকা না দেখে তবে তার পিপাসা নিয়ে সন্ধেহ জন্মায়শিল্পীর ক্ষেত্রেও তেমন। কারণ শিল্পীর ‘অন্তর্নিহিত অপরিমিতি’ ‘স্বতন্ত্রতা’ যথার্থ শিল্পীত বোধ তৈরি করে। যা সাহায্য করে শিল্পীকে ‘বর্ণিকাভঙ্গের’। সমালোচকদের ক্ষেত্রে এই কথা খাটবে কিনা! – এ নিয়ে বিস্তর তর্কের অবসর আছে। তবে একথা ঠিক সময় ভেদে এই ‘নগ্নতা’র ধারণা বদলায়। এর মস্ত উদাহরণ স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ‘চোখের বালি’র সেই পরিসরটা ভাবুন। আশালতা মহেন্দ্রর সঙ্গে ‘মিলন’-এর ‘রসোদগার’ বিনোদিনীর কাছে করছে। বিনোদিনীর নাক দিয়ে গরম নিঃশ্বাস বের হচ্ছেকিংবা ‘বিষবৃক্ষ’ পড়ার সময়কালের কথা। ‘শনিবারের চিঠি’-রা দাবি করল এটা চুড়ান্ত অশ্লীল। কারণ যৌনতা, যেটা গোপনীয়, তাকে ‘গরম নিঃশ্বাস’ দিয়ে প্রকাশ্যে এনে ‘নগ্ন’ করা হয়েছে। কিন্তু মজার কথা হল ভাবনাকে কতটা ‘নগ্ন’ করলে ‘অশ্লীল’ হবে! এটা কে ঠিক করে দেবে। ‘কল্লোল’-দের কাছে কিন্তু রবীন্দ্রনাথের বিনোদিনীর এই ‘নগ্নতা’ যৌনতার জন্য কাফি নয়। যদিও তর্কের অবসর থেকেই যাই। ফারাকটা এই যে রবীন্দ্রনাথের ‘যৌনতা ভাবনার’ ‘নগ্নতা’ দেখানো না কী রবীন্দ্র-বিদূষণ করা– কোন্‌টা? এ তর্কটা পাশে রেখেই ভাবনা (সে নগ্নতাই হোক না কেন) ‘প্রকাশের মাত্রা’ যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি গুরুত্বপূর্ণ তাকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি। এই দৃষ্টিভঙ্গিকে নিয়ন্ত্রণ করে দেখনেওয়ালা কোন সময়ের অবসরে বসবাস করছে, তার উপর। সময় ও মানসিকতার দাবিতে ‘কল্লোল’ বা ‘শনিবারের চিঠি’ যৌনভাবনাকে কেন্দ্র করে নগ্নতাকে দেখেছেন।

শিল্পীর কাছে অন্যতম চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায় এই নগ্নতাকে ‘নিয়ন্ত্রণ’ বা ‘ট্যাকেল’ করার প্রশ্নে। তা না হলে ক্যানভাসে ‘রেখা’-র ‘বর্ণ’-র সাহায্যে ফুটিয়ে তোলা প্রতিটি বিষয় শুধুমাত্র ‘চোখ চরিতার্থ’-র, ‘রিপু চরিতার্থ’-র মাধ্যম হবে। ‘আনন্দ’ সৃষ্টি হবে না। বাস্তব কিন্তু অন্য কথা বলে। ধরুণ আমাদের পাড়ার পিকলুর কথা। নদীর ধারে বসে গুগুল মামুতে পর্ণ-ভিডিও বা তারকাদের নগ্ন ছবি দেখে এবং ইত্যাদি ইত্যাদি খুব আনন্দ পেল। পরের দিন সকালে সেই আবার স্কুলে গিয়ে ‘সোনার তরী’ কবিতাটির সৌন্দর্য বিচার করে স্টাফরুমে ফিরল। ওর কাছে কিন্তু দুটোই নন্দের। আবার বাড়ি ফিরে সন্ধ্যে বেলা টিভিতে ভারত পাকিস্তানের আসন্ন যুদ্ধ হয় কিনা এই প্রশ্নে যখন নেতা ও মিডিয়া যুদ্ধ বাধিয়েই ছাড়ছে– এমন তর্কে বিরক্ত হয়ে যখন চ্যানেল ঘোরাতে ঘোরাতে ‘মোহরা’ সিনেমার ‘টিপ টিপ বরসা পানি’ গানের দৃশ্য দেখে, তখন কিন্তু চোখ আঁটকে যায় রবিনা ট্যান্ডানের শরীরেঝড় ও পানির ফোয়ারায় রবিনা ট্যান্ডানের গায়ে শাড়ি থাকলেও রবিনা ট্যান্ডান কিন্তু পিকলুর কাছে ‘নগ্ন’এই ‘নগ্নতা’ দেখেই কিন্তু ঘরে বাপ-মা ছেলের অবস্থান দেখে বৌকে চোখ মেরে বেড্ররুমের ইশারা করে। এবং ‘চুটিয়ে আনন্দ’ নেয়। পরের দিন আবার স্কুল। স্কুলে আজ এক ইয়াং টিচারের বিরুদ্ধে পিকলু খেপে গেছে। কারণ ক্লাস টুয়েলভে ওই ‘চ্যাংড়া’ মাস্টার ইয়োজেন অঁরি পল গোগ্যাঁর ‘দি স্পিরিট অব দ্যা ডেড ওয়াচিং’ পেন্টিংটা দেখিয়েছে। নগ্ন একটা কালো মেয়ে, যার শরীরে একটা কাপড় পর্যন্ত নেই, যে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। একটা স্পিরিট বাঁ দিকে, পায়ের কাছে চেয়ারে বশে আছে। ‘এই রকম অশ্লীল কর্মকান্ড ঘটতে দেওয়া যায় না স্কুলে’- এ নিয়ে মিটিং বসেছে। ছেলেটিকে কারণ দর্শাতে বলা হয়েছে। হেড মাস্টার তখনও আসেননি। পিকলু তখন বিনোদবাবু, অঙ্গকের মাস্টার, পঞ্চাশের উপর বয়স, তাকে গতকাল রাতে মোহরার ‘টিপ টিপ পানি’ গানটার সৌন্দর্য বোঝাচ্ছিলেন

কেন এই দুটো ঘটনাটার উল্লেখ করলাম! কারণ আছে নিশ্চয়। একটা আবরণ থেকেও চুড়ান্ত ‘যৌন তাড়নামূলক নগ্ন’আর একটি নিরাবরণ, নগ্ন থেকেও ‘যৌন তাড়নামূলক’ নয়। বরং আমাদেরকে ঐ ‘নগ্নতা’ বিপন্ন করে। অশ্লীলতার ভ্রমকে জাগরিত করে না।

এখানে আসলে বোঝাতে চাইছি ‘নগ্ন’ বা ‘নগ্নতা’কে দর্শক বা পাঠক বা শ্রোতা কীভাবে ট্যাকেল করবে সেটা। এখানে আসে রুচি, মানসিকতা ইত্যাদির কথামধ্যবিত্ত সুবিধেভোগী আপোসকামী মানুষের কাছে ‘নগ্ন’ বা ‘নগ্নতা’র প্রশ্নে ‘রিপু’ নয়, যথার্থ ‘আনন্দ’ খোঁজাটা মুস্কিল। তাঁরা ভুলেই থাকতে ভালোবাসেন যে, সেই বিখ্যাত বাক্য নিরাবরণ শরীরে যদি মোজা পরা থাকে তাহলে সেটা অশ্লীল এবং নগ্নকিন্তু শুধু নিরাবরণ (শিল্পীত রীতি মেনে) কিন্তু নগ্ন নয়। তা বিশুদ্ধ সৌন্দর্যের।

দর্শক বা পাঠক বা শ্রোতাদের এই ‘ট্যাকেল’-এর প্রশ্নে বিস্তর গলদ এবং ফাঁকি থাকলেও শিল্পীদের বেলায় কিন্তু তা খাটে না। ‘নগ্নতা’-কে কীভাবে ট্যাকেল করতে হয়, এই সময়ের কথাকারদের মধ্যে সে বিষয়ে বিস্তর কাজ করে গেছেন এপার বাংলায় নবারুণ ভট্টাচার্য। ওপার বাংলায় আল মামুদ (ইলিয়াসের কথা মাথায় রেখে)আল মামুদের ‘সৌরভের কাছে পরাজিত’ গল্পের নায়ক বাড়িতে ভাড়া করে আনা বেশ্যার ফুটি ফাটা পেটের নগ্নতায় বাংলাদেশের নদী মানুষ এবং হতাশাকে খোঁজে। সাধারণ ভাবে বেশিরভাগ মানুষ ‘নগ্নতা’ বলতে ‘উদোম’ নারী শরীর এবং তা থেকে জাত যৌনতা বোঝে। কিন্তু সব সময় এটাই সত্য হবে, এমনটাও না। এই ক্ষেত্রে ‘নগ্ন’-কে ‘আবরণ’ এবং ‘নগ্নতা’-কে ‘আবরণহীনতা’ অর্থে মেনে নিয়ে ‘শুধু শরীর’ নয়, যে কোনো ভাবনা-বিষয়-বস্তু ইত্যাদি অর্থে ব্যবহার করা যেতে পারে। যেমনটা আল মামুদ করেছেন। যেমনটা করেছেন অভিজিৎ সেন ‘বালা লখিন্দর’ গল্পে। বালা যখন কবিরাজের নিষ্ফল কামনাকে দমন করতে গিয়ে নগ্ন হয় তখন শংকা, যিনি কবিরাজের শিষ্য হয়েও বালার শরীরের উপর ‘অধিকার কায়েম’ করার প্রশ্নে কবিরাজেরই প্রতিদ্বন্দ্বী, সেই শংকার ‘ক্ষমতা কায়েমী’ মানসিকতাও বালার শরীরী ‘নগ্নতা’র ক্ষেত্রকেও ছাড়িয়ে যায়। স্বকৃত নোমানের ‘হীরকডানা’ উপন্যাসে আবার উনিশ শকতের বেনিয়া জাতির  মানসিকতা নগ্নভাবে প্রকাশিত হয় হলওয়েলের দূত হ্যারি যখন শামসের গাজীর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতে গিয়ে কৃষ্ণমোহনের আমন্ত্রণে ‘মহলে দুদিন বিশ্রাম নিল হ্যারি। মৌজমস্তি করলেন। বাঙালি জেনানার স্বাদ নিলেন’। প্রসঙ্গটাতে যৌন বাসনার কথা থাকলেও এই বাক্যের আবহে লুকিয়ে থাকা বেনিয়াদের মানসিকতার ‘নগ্নতা’ই মুখ্য। একটি জাতি আবার ‘নগ্ন’ (নগ্নতার মধ্যে যে ‘বিকৃত’ এর বোধ বা ধারণা বা প্রসঙ্গ থাকে, তাকে মাথায় রেখে) হয় তসলিমা নাসরিনের ‘লজ্জা’ উপন্যাসে চরিত্রের লুঙ্গি উচু করে ধর্মীয় পরিচয়  চিহ্নিত করার প্রশ্নে। কিন্তু জাতির মানসিকতার মধ্যে যে ‘নগ্নতা’ থাকে থাকে ‘ট্যাকেল’ করার প্রশ্নে মান্টো এদিক থেকে লক্ষ হস্ত এগিয়ে। মুরাকামির ‘সমুদ্রতটে কাফকা’ উপন্যাসে নাকাতা চরিত্রের কয়লার মতো অন্ধকারে কালো বিড়ালকে ‘নগ্ন’ পায়ে হাঁটার দৃশ্য নাকাতার বিপন্নতাকে ‘নগ্ন’ করে তোলে।

তবে একথা ঠিক যে ‘নগ্নতা’র মধ্যে একটা প্রকাশ থাকে। সে শরীর হোক বা অন্য কিছু। আবার উল্টোটাও ঠিক। প্রকাশের মধ্যেও এক ধরনের ‘নগ্ন’ বা ‘নগ্নতা’ থাকে। সেই ‘নগ্ন’ বা ‘নগ্নতা’ যিনি প্রকাশ করছেন তাঁর। দর্শক বা পাঠক বা শ্রোতা সেটা অনুভব করে মাত্র, যদি প্রকৃত দর্শক বা পাঠক বা শ্রোতা হন, তবেই। এই ‘প্রকৃত’ দর্শক না পাঠক না শ্রোতারা কারা? এ তর্কের অবসরে সহৃদয় হৃদয় সংবাদীগণকেই গ্রহণ করছি। যেমন সংবাদ প্রভাকরে ১২৬১ সালে ৬ই ফাল্গুন ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত ‘বরিশালের বিবরণ’ এ লিখতে গিয়ে ‘মুসলমান’ ও ‘নৌকা’ সম্পর্কে লিখতে গিয়্যে লেখেন “মুসলমান জাতি ‘শিয়া’ ও ‘সুন্নি’ দুই ভাগে বিভক্ত, তন্মধ্যে সুন্নি ৯/১০ এবং শিয়া অর্ধ আনা মাত্র।  সুন্নির মধ্যে আবার অধিকাংশ ফিরজি মতাক্রান্ত হইয়াছে। ওই ফিরজি দলের ক্রমস্য প্রাবাল্য হইতেছে। ইহারা পৌত্তলিক নহে, অথচ মহরম করে না। ফিরজি দল অতিশয় অত্যাচারী। এখানকার মুসলমানরা  দুগ্ধ বিক্রয় করে, নৌকা চালায়, গোরু এবং ছাগলাদি বিক্রয় করে ও কৃষিকর্ম করে। জেলখানার ভিতরে কয়েদির মধ্যে যবনের সংখ্যাই অধিক দেখিলাম।’ বা ‘নৌকা’ সম্পর্কে লিখতে গিয়ে লেখেন, ‘এই বাকরগঞ্জ জেলার মধ্যে অনেক স্থানেই দৃষ্ট হইল স্ত্রীলোকেরা নৌকা চালনা করে, তাহারা উত্তমরূপে হাল ধরে, দাঁড় বহে, এবং গুণ টানিয়া থাকে। তরী সঞ্চালন ব্যাপারে স্ত্রী-পুরুষ উভয়ের তুল্য ক্ষমতা দর্শন করিলাম।’ বিবরণকারী গুপ্ত মহাশয়ের মধ্যে মুসলমান ও নারী সম্পর্কে ধারণা প্রকাশের ক্ষেত্রে যে ‘প্রকাশের মধ্যে যে নগ্নতা আছে’ (ভালগার নয় কিন্তু) তা কিন্তু গুপ্ত থাকেনিবাংলা সাহিত্যে তো বটেই সর্ব ভারতীয় সাহিত্যসের ক্ষেত্রেও ‘নগ্ন’ ‘নগ্নতা’ এবং ‘প্রকাশ’ হাজারোধিক উদাহরণ আছে। এক্ষেত্রে পঞ্চাশ ষাটের মিথিক কবি উপন্যাসিক অমৃতা প্রীতম এর কথা না লেখার লোভ সামলাতে পারছি না। লাহোরের লেখক সাহিরের কথা বলতে গিয়ে তিনি লেখেন, ‘সে চুপচাপ সিগারেট টানত, অর্ধেক সিগারেট শেষ করে অ্যাশটড়েতে গুঁজে দিত, তারপর আবার নতুন সিগারেট ধরাতো। চলে যাবার পর শুধু সিগারেটের বড় বড় টুকরো ঘরে পড়ে থাকতো। ... সে চলে যাবার পরে, তার পরিত্যক্ত সিগারেটের অংশ যত্ন করে আলমারিতে তুলে রাখতাম, তারপর এক-একটা টুকরো একা একা বসে ধরাতাম। আঙুলের ফাঁকে গুঁজে যখন ধরাতাম, মনে হত যেন তার আঙুল স্পর্শ করে আছি ... প্রতিটি সিগারেট ধরানোর সময় মনে হতো সে বুঝি আমার কাছে আছে।’ যদিও এটাই ছিল তাঁর ‘এক ছিল অনিতা’ উপন্যাস লেখার প্লট। কিন্তু এই ‘ছোঁয়া’ বা ‘আসঙ্গস্পৃহা’-র প্রকাশের ‘নগ্নতা’ এবং ‘পরিমিত মাত্রাবোধ’ যে ভাবে ‘নগ্নতা’র ধারণাকে সৃষ্টিশীলতার কাছে নিয়ে গেছে, সেটাই অভিপ্রেত শিল্পীর কাছে।|

Comments

Post a Comment