মেড ফর ইচ আদার | কৌস্তুভ বসু

|
‘Gray’ by Anonymous |
|
অঙ্কগুলো ঠিক মিলছে না।

রাত বেশ গভীর। সারাদিনের ভ্যাপসা গরমের পর অবশেষে বাইরে অল্প একটু হাওয়া বইতে শুরু করেছে। জানলার পর্দাটা ঝিরঝিরে বাতাসের আলতো টোকায় মাঝে মাঝে খিলখিলিয়ে ওঠে। রাস্তার নিয়নে গ্রিলের ফাঁক দিয়ে একটা সরু লম্বাটে কমলা রম্বাস ত্যাড়ছা ঢুকে কালো আলমারিটার গায়ে এক টুকরো শ্বেতি এঁকেছে। পর্দার হালকা উচ্ছ্বাসে পাতলা দাগে কখনও ধাক্কা লাগে। 

শ্যামলী পাশে শুয়ে। ক্লান্ত। ঘুমে কাদা। ঢেউগুলি এখন অনেক শান্ত। একটু আগেই অতলান্তিকে ডুবসাঁতারে ভিজেছি। শরীর দুটো ঘামে এখনও আর্দ্র। ঠোঁটে নোনতা স্বাদ লেগে। সাত মাস হল দু’জনে এক সঙ্গে ঘর করছি। সম্বন্ধ করে বিয়ে। অল্প ক’মাসেই দু’জন পরষ্পরের খুব কাছাকাছি এসে গিয়েছি। বন্ধুরা বলে, ‘মেড ফর ইচ আদার’!
   
তবু, আজ হঠাৎ ঐন্দ্রিলা কীভাবে আমাদের মাঝখানে চলে আসছে, সেটাই রহস্য। শ্যামলীকে আদর করতে করতে ওর অজান্তে মোবাইলে একটা সেল্ফি তুলেছিলাম। ছবিটা দেখে নিজেই আঁতকে উঠি। শ্যামলীর জায়গায় শুয়ে রয়েছে সাত বছর আগে ছেড়ে যাওয়া বান্ধবী! কিন্তু, মোবাইল স্ক্রিন থেকে চোখ ফেরাতে আবিষ্কার করি, রোমশ বুকের নিচে ঐন্দ্রিলা নয়, শ্যামলীর ঘামে ভেজা শরীরটা উত্তাপের লাভায় নুন-মাখা কইমাছের মত ছটফট করছে! কিছুই বুঝতে পারছি না। একটু আগে যে শরীরটা আদর করছিলাম, সেটি আসলে কার? শ্যামলী, না ঐন্দ্রিলার?

আবছা মনে পড়ছে। দু’দিন আগে আফিস থেকে ফিরে রাতে খেতে বসে নানান কথার ভিড়ে শ্যামলীও একবার আলগোছে বলেছিল, ‘ফোনটায় বোধহয় কিছু গন্ডগোল আছে’। ওর কথায় তখন তেমন আমল দিইনি। এখন মনে পড়ছে স্পষ্ট। কিন্তু শ্যামলী কেন ওরকম বলেছিল? খানিকটা কৌতূহলেই ছবির ফোল্ডারে গিয়ে আর্কাইভে স্ক্রল করলাম। কয়েকটা ছবি পিছনে হাঁটতেই হোঁচট খেলাম। বুকের ভিতর পাঁচশ পঞ্চাশ ভোল্টের একটা চোরা স্রোত বয়ে গেল! একটা ফোটো। শ্যামলী আদর খাচ্ছে একটা পুরুষ শরীর। মানুষটি আমি নই। লোকটাকে চিনি। এর কাছ থেকেই মোবাইলটা কিনেছিলাম। কিন্তু সেই লোকটা হঠাৎ আমাদের বেডরুমে এল কীভাবে? শ্যামলী কী ওকে চেনে? সময় দ্যাখাচ্ছে রাত সোয়া তিনটে! তখন তো শ্যামলীর সঙ্গে আমিই ছিলাম। তাহলে ঐ লোকটা কীভাবে আসছে আমাদের মাঝে? বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল!

মোবাইলটা ক্রমশই রহস্যময় হয়ে উঠছে। দোলের সময় খবরের কাগজে একটা স্পেশাল বিজ্ঞাপন দেখে কিনেছিলাম। কেনার সময় দোকানের মালিক বেশ মিষ্টি করে দাঁত বের করে বলেছিল, ‘স্যার এ যে সে খেলনা নয়। এর ভিতর সফিস্টিকেটেড ‘আই-ওপেনার’ সফ্টওয়ার রয়েছে। ছবি তুললে শুধু উপরের চেহারাটা নয়, মনের ভিতরের ছবিও দেখতে পারবেন। পিকচার কোয়ালিটি ফাটাফাটি। সেল্ফি তুললে নিজেকে একেবারে নতুনভাবে চিনবেন!’ ভদ্রলোকের কথা যে খুব ভাল বুঝেছিলাম, তা নয়। তবে এটা বুঝেছিলাম, লোকটা ওস্তাদ বেচুবাবু। কাস্টোমারের কাছে জিনিস গছাতে কথার প্রয়োজনীয় মারপ্যাঁচ ভালই জানা আছে। মোবাইলটার দাম কম ছিল। কিনে নিয়েছিলাম। কিন্তু এখন এ কী বিপত্তি!

শ্যামলী পাশে ঘুমিয়ে। খাট থেকে নেমে পাশের ঘরে গেলাম। গলা নামিয়ে কাস্টোমার সার্ভিসে ফোন করলাম। ওপ্রান্তে এক কিন্নরী ফোন ধরলেন। সমস্যা ব্যাখ্যা করলাম। বললাম, মোবাইলে যান্ত্রিক ত্রুটি রয়েছে। মহিলা-কন্ঠ সবিনয়ে মিষ্টি হেসে বলল, ‘দুঃখিত স্যার। আপনার যন্ত্র ঠিক আছে। সমস্যা, আপনি নিজেকে সঠিক চেনেননি’। নিজেকে চিনিনি মানে? মাঝরাতে এ কীধরনের রসিকতা? আমি যতটা উত্তেজিত, উল্টোদিকের গলা ততই শান্ত, ‘বুঝতে পারছি স্যার। এরকম সমস্যা আরও অনেক কাস্টোমারেরই হচ্ছে। আসলে আমরা নিজেদের বাইরেটা বেশি বেচি, ভিতরটা চিনি কম’। ফোনটা কেটে গেল।   

মোবাইল ফোনটার দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম ফ্যালফ্যাল। সব কিছু বড় ভূতুড়ে ঠেকছে। যন্ত্রটার ক্রিয়াকলাপ, কাস্টোমার সার্ভিসের কথাবার্তা, সবটাই বড় গোলমেলে! ধীর পায়ে এসে খাটে শরীরটা ফের এলিয়ে দিলাম। একটা নরম হাত টের পেলাম। লতার মত আগলে ধরেছে আমায়। শ্যামলী আমাকে জড়িয়ে পরম নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে। ওর নিষ্পাপ মুখের দিকে ভাল করে তাকাই। খুঁটিয়ে পড়ার চেষ্টা করি। এই মুহুর্তে আমাকে জড়িয়ে আসলে কে শুয়ে? শ্যামলী? নাকি, শ্যামলীর খোলসে ঐন্দ্রিলা? শ্যামলীর আলিঙ্গনেই বা কে? আমি? নাকি, মোবাইল বিক্রেতা?  

অঙ্কগুলো মিলছে না। সব কিছু অস্পষ্ট। রাস্তার আধো-আলো নিয়নে অন্ধকার ঘরটার ভিতর অদৃশ্যে হেঁটে বেড়ায় হাজারখানা প্রশ্নবোধক চিহ্ন। পরিচয়গুলো ভেজা হ্যান্ডমেডে জলরঙের মতই অ্যাবস্ট্রাক্ট! খাটের উপর দুটো আদিম শরীর শুয়ে আছি পাশাপাশি। এই মুহুর্তে এইটাই একমাত্র সত্যি। দুটো শরীরের ভিতর আরও ঠিক কতগুলি শরীরের বিস্তার, পরষ্পরের কাছেই তা অজানা। বাইরের পৃথিবীর চোখে আমরা ‘মেড ফর ইচ আদার’; কিন্তু ভিতর-ঘরে কে কার সঙ্গে সহবাস করছি, নিজেরাও জানি না। এ এক আবহমান প্রবঞ্চনা। অন্যের সঙ্গে। নিজের সঙ্গেও।
|

Comments

Post a Comment