একেকরকম দূরত্ব | জ্যোতির্ময় বিশ্বাস

|
‘Landscape’ by Darter Photography |
|
()

শান্তিবৌদি যখন ডেকে ঘটনাটা বললো সুজনের পুরো পাগলপ্রায় অবস্থা, ঘৃণায় নাকি রাগে নাকি মারাত্মক একটা দুঃখ, ও যে ঠিক কি একটা অবস্থা, বোঝানোর নয়

পাখি, ওর চার বছরের বিয়ে করা বউকে সুজন বাড়িতে সত্তরোর্ধ্ব মার কাছে রেখে সিকিমে কাজে ঢুকেছে বছরখানেক হলোওদের ফুলবাড়ীরই রহিদুল ঠিকাদারকে ধরেওদের এলাকা থেকে ওরা পাঁচজন গ্যাছে ঢালাই-এর কাজ করে ওদের দলটা মাসে যেকোনো এক শনিবার ওরা ভাগ ভাগ করে বাড়ি আসেসুজনও তাই আগে বাড়ি এলে পাখির বাড়তি সোহাগটায় সুজন খুব মজা পেত রাতে বিছানায় পাখি যেন তিনসপ্তাহের অনশন ভাঙতো ঘুমোতোনা কেউ সারারাত ওদের ঘরের সাথে লাগালাগি মায়ের ঘর বুড়ি পাগলদাসী কানে কম শোনেন তা সত্ত্বেও দু-একবার এরকম শনিবারে সুজন এলে পাখির মধ্যরাত্রিকালীনআঃস্তে...উঃমমইত্যাকার নানাবিধ উচ্চারণ এড়াতে বুড়ি যে কানে বালিশ দ্যায়নি এরকম হয়নি বরাবর লাজুক আর মিতবাক সুজনও এই ব্যাপারটা ভেবে লজ্জা লজ্জা পায়, আবার কাজে ফিরে ভুলে যায় তখন পাখির কামড়গুলোই মনে পরে উফ, পাখি একটু খ্যাপা হয়ে যায় যেন ওর গাল গলা বুকে কেমন করে জিভের লালা মাখিয়ে চেটেচুটে দ্যায় ও নিজেও যে দ্যায়না তা না তবে ওর আদর করার খুঁটিনাটিগুলো একটু আলাদা পাখির উজ্জ্বল শ্যামবরণ নাঙ্গা শরীরে লণ্ঠনের আলো যেভাবে সোনালী নকশা তোলে সেটা চেয়ে চেয়ে দেখা ওর একটা প্রিয় কাজ তারপর চেয়ে দেখতে দেখতে ছুঁয়ে দেখা, বুকে তুলে নেয়া কিংবা নিজের মুখটা ওর বুকের খাঁজে ফেলে কিসের একটা দুর্দান্ত পাগল পাগল খোঁজ, আঃ!

...কাজের ফাঁকে ফাঁকে সিকিমের পাহাড়ে বসে বসে এইসব ভাবে সুজন আর ভাবে পাখিকে যে ভালোবাসাটা ও বাসছে সেই ভালোবাসাটা যেন বাড়তে বাড়তে এই পাহাড়টার সমান হয়ে যায় একদিন

()

পাগলদাসী বিরক্ত হননা, বরং লজ্জা পান এরকম সময়ে মন সরানোর চেষ্টা করেন, ঘুমোনোর চেষ্টা করেন মাঝরাতে পাশের ঘরে ছেলে আর ছেলের বউ কখন সুখ করছে না করছে সেটা গ্রামবাংলার পাটকাঠির ঘরবাড়িঅলা গেরস্ত বৃদ্ধ শ্বশুর-শাশুড়িরা টের পায়, স্বাভাবিকভাবেই পায় পাগলদাসী যখন নিজে বউ ছিলো, তখন পূর্বপাকিস্তান, চিতলমারী মধুমতির পারে ওর শ্বশুরের ভিটে শ্বশুরের ভায়েরা সবাই ভিন্ন কিন্তু পাশাপাশি একটানা শনের ঘর সবার দূর থেকে খড়ের পুঞ্জির মতো দেখতে লাগতো বারো বছর বয়সে হুট করে একদিন এই বাড়ির আন্দাজ তখন তেইশ বছরের সুবল দাসের সাথে ওর বিয়ে খাটুনি ওর শরীরসওয়া ছিলো বাপের বাড়ি থেকেই তারপরও সারাদিন ধান সেদ্ধশুকনো করা, চাল ঝাড়া ও সমস্ত টুকিটাকি কাজ; ও হাপিয়ে উঠতো অপেক্ষা করতো রাতে সুবল কখন আসবে সবগুলো শনের ঘরের কুপির আলো একে একে নিভে গেলে, পাশের ঘর থেকে বৃদ্ধ শ্বশুরের নাকডাকার আওয়াজ শুরু হলে সুবল নির্বিকারভাবে দৈনিক একইরকম ধরণের কাজকর্ম করতো ঐটুকু ছিলো পাগলদাসীর সব এতোগুলো দিন পর সেসব মনে পড়েনা খুব একটা, কেবল ওই, পাশের ঘর জীবন্ত হলে একটা ঘটনা মনে পড়ে যায়

একদিন গভীর রাত্রে একবার মিলনের পর ওর ঘুম ভাঙিয়ে সুবল ওকে মধুমতিতে নোঙ্গর করা ওদের শরিকি ডিঙি নৌকাটায় নিয়ে গেছিলো সুবল যখন হাত ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে; লজ্জায় ভয়ে কুঁকড়ে গিয়ে পাগলদাসী অস্ফুটে বলেছিলো, “আপনে পাগল
- ক্যান!
- ডিঙ্গায় মেজদায় শুইয়া রইছে!
- না নাই
পাগলদাসী সুবলকে নকল করে বললো, - ক্যান!
- উনায় খালিশাখালী বাজারে গ্যাছে আইজ আবার মিটিং, শুননাই?

পা চালিয়ে ওরা তখন নৌকায় পৌঁছলো অল্পক্ষণই ছিলো ওরা ওখানে সুবল ওর পাগলিকে অবাক হয়ে শুধু দেখছিলো আর দেখছিলো পাগলদাসীর গোটা গলায় মুখে আর কানে গয়না বলতে কেবল নাকে একচিলতে নাকছাবিটা একটুকরো কচি চিকচিক সোনা সুবল কি ভেবে আচমকা ওর মুখটা নিজের বুকে টেনে নিয়েছিলো স্বামীর বুকে মুখ রেখে ওর চোখ চলে গ্যালো নদীটির দিকে এবং অকারণেই নিজেকে মনে হলো যেন ওই আসলে নদীটি যেন একইরকমভাবে চাঁদের স্নিগ্ধ আলো মধুমতির জলে লক্ষটুকরো সোনার নাকছাবি ভাসিয়ে দিয়েছে চিকচিক করছে ঝিলমিল করছে পার্থক্য কেবল এই যে মধুমতির বুকে ওই মুহূর্তে কেউ সাঁতার কাটছিলো না

অল্পক্ষণ ছিলো ওরা ওখানে

()

শান্তবৌদির ওখান থেকে ফিরে এসে স্নান করলো সুজন শরীরটা জ্বরজ্বর লাগছে ওর কাল থেকে রহিদুল চাচাকে ফোন করে বলে দিলো ও রোববারের মধ্যে সুস্থ না হলে সোমবার আসতে পারবেনা পাখি ভাত বেড়ে ডাক দিলো চুপচাপ খেয়ে উঠলো সুজন ছোট ছোট চ্যাপ্টাপুঁটি দিয়ে শাপলা আলুর গরম ঝোল ওর পাতে ভর্তি করে দিলো পাখি

পাখি দাস ফুলবাড়ীর সুজন দাসের বউ হবার আগে রায় ছিলো পদবি ওরা একই স্কুলে ক্লাস এইট অব্দি পড়েছে কেউ কারুর সাথে তখন কথা বলেনি পরে ওদের প্রতিবেশী শান্তি সরকার সম্বন্ধ এনে এই বিয়েটা দ্যায় ওরা পরস্পরকে চিনতে পেরে হেসেছিল

[ প্রিয় পাঠক, পাখি একটু রহস্যময় থাকুক? মানে ও যা করছে একান্তে ওকে তাই করতে দেয়া হোক প্লিজ, একমাত্র রহস্যই কোনো কোনো নারীব্যক্তির সম্পদ, সর্বস্ব ]

()

দুদিন আগের ঘটনা রাত আন্দাজ দেড়টা পাগলদাসীর ঘুম ভেঙে গ্যালো পাশের ছেলের ঘর থেকে আবার ওই আওয়াজগুলো আসছে! আরও বেশি পরিষ্কার, উন্মত্ত! লজ্জায় বুড়ি বিছানার কিনারে রাখা কাপড়ের দলা কানে চাপতে চাপতে ভাবলো, নাঃ সুজনকে বলতেই হবে ঘরের বেড়াগুলো ইটের গাঁথনী দিয়ে তুলতে এর মধ্যেই, এই পুজোটা গ্যালেই কিন্তু মুহূর্তেই, মাথায়সুজননামটা আসতেই বুড়ির মনে পরে গ্যালো, ‘আইজ তো শনিবার না! আইজ বুধবার গেলোসুজন তো আইজ আসে নাতাইলে কি রাইতে আইলো! রাইত বাজে অহন কয়টা?

অন্ধকার আন্দাজ করে পাগলদাসী সিদ্ধান্তে এলেন রাত অনেক, প্রায় তিনটা এবং এটাও মনে মনে ভেবে নিলেন, সুজন এসেছে এসেছে উনি শুয়ে পড়ার পর ঘুমোচ্ছিলো বলে ডাকেনি ছেলে তাছাড়া, উনি যা তাড়াতাড়ি ঘুমোন

পরদিন পাগলদাসী ঘুম থেকে উঠে দেখেন উঠোন ঝাড়ু দিচ্ছে পাখি রাতের বেলা বড়ো জামগাছটার পাতাগুলো উঠোন জুড়ে একেবারে বিছিয়ে থাকে পাগলদাসী হেঁটে ছেলের ঘরে ঢুকলো, না, সুজন তো বিছানায় শুয়ে নেই, তাহলে কি দাঁত মাজতে মাজতে বাইরে গ্যাছে? ও তো তাই যায়কিন্তু নাহ, তাহলে ওর লাল ব্যাগটা কোই? আর জুতাজোড়া?

ভেবেও এইসকল প্রশ্নের একটারও উত্তর পাননা পাগলদাসী, বরং অন্য একটা ভয়ানক ও নোংরা প্রশ্নে বুক ধড়াস করা উঠলো ওঁর দাঁড়িয়ে থাকতে না পেরে কোনোমতে চলে গেলেন প্রায় একই উঠোনের ওপর ওনার প্রতিবেশী শান্তিদের বাড়ি শান্তির বউও উঠোন ঝাড়ু দিচ্ছিলো বুড়ি গিয়ে অস্ফুটেবৌমালে ডাক দিলেনবৌমাওনাকে ঘরে নিয়ে বসালেন নিজের সমস্ত কথা দিনে একবার করে এসে ওকেই বলেন পাগলদাসী সবকিছুতেই একরকম পরামর্শ চান অঙ্গনওয়াড়ির দিদিমনি এই স্ত্রীলোকটির ওপর ওনার অগাধ ভরসা এমনকি ওইআওয়াজএর বিষয়টিও বলা হয়ে গিয়েছে আজও বললেন ব্যাপারটা লজ্জার মাথা খেয়ে জানতে চাইলেন, এটা কিভাবে সুজনকে জানানো যায় বা না জানালেও কেমন হয় ঘটনা শুনে দিদিমণি প্রথমে পাগলদাসীকে বোঝাতে চাইলেন উনি হয়তো ভুল শুনেছেন কিন্তু যখন পাগলদাসী নানাবিধ দিব্বি কেটে কেটে বলতে লাগলেন এবং ভয়ানক উত্তেজিত হয়ে পড়লেন, দিদিমণি ওঁকে আশ্বাস দিলেন শনিবার সুজন এলে ওকে বলার দায়িত্বটা ওর নিজের

পাগলদাসী বাড়ি ফিরে দেখলেন  উঠোনের কোনার যে ধুন্দুলের জাংলা,পাখি সেখান থেকে একটা গামলায় করে ধুন্দুলগুলো তুলছে ধুন্দুল রাতারাতি বেড়ে যায়

()

শনিবার রাত সুজনের জ্বর বেড়েছে রাতে খায়নি খালিপেটেই ওষুধ এনে খেয়ে নিয়েছে চোখ বন্ধ করে ঘুমের মতো শুয়ে আছে সুজন পাশে ঘুমোচ্ছে পাখি পাখির উষ্ণ নিঃশ্বাস সদর্থক বটে, তবে আজ যেন সুজনের জ্বরের কাছে হেরে ফিরে যাচ্ছে

()

পরদিন ভোরে ঘুম ভাঙলো পাখির সুজন নেই বালিশের ওপর চিঠির মতো একটা কিছু আবিষ্কার করলো পাখি চিঠির মতোই, ওষুধের খাপটা ছিঁড়ে পৃষ্ঠার মতো বানিয়ে নিয়েছে সুজন, গোটাকয়েক লাইন তাতে লেখা সুজনের হাতের লেখা তেমন সুন্দর নয় তবে পাঠযোগ্য সুজন ভালো ছাত্র ছিলো, বোধবুদ্ধি ছিলো পড়াটা চালিয়ে যেতে পারেনি কারণবশত

পাঠকের মনে হতে পারে একজন ক্লাস এইট পড়া রাজমিস্ত্রির মুখে এই কথাগুলো ঠিক যাচ্ছেনা, কিন্তু এই কথাগুলো শুধু যে সুজন দাস বলছে তা তো আর নয় আচ্ছা চলুন, আগে চিঠিটা তো পড়ে নেয়া যাক...

যে দূরত্বের কারণে আমার তোমার ওপর টানটা বেড়েছে; যে দূরত্বের কারণে মুহূর্তে মুহূর্তে আরও বেশি করে তোমায় কাছে পাওয়ার ইচ্ছেটা অনুভব করেছি, তুমি সেই একই দূরত্বের কারণে অপরের কাছাকাছি যেতে পেরেছো; ওই একই দূরত্বের কারণে রাতে নগ্ন হতে পেরেছো অন্যজনের চোখের সামনে সমস্ত সম্পর্কে দুজন মানুষের মধ্যে সূক্ষ্ম ব্যবধান তো ওইটুকুই, পারার আর না-পারার তোমায় এই মুহূর্তে বলার মতো এটুকু ভাষাই জুটলো ঈশ্বরের তরফ থেকে অনেক দূরে হারিয়ে যাবার জন্য যে সামর্থ্যের প্রয়োজন, আমার তা নেই তাই, প্রতি শনিবার আমি আসবো তুমি থেকো


আরেকটা কথা, সিকিমের পাহাড়গুলো সত্যিই অনেক বেশি বড়ো
|

Comments

Post a Comment