হারাতে হারাতে একা -- কিস্তি ২৯ ( দ্বিতীয় খন্ডে )





হারাতে হারাতে একা (২৯)


প্রথমবার কবিতা পাঠ ও শোনার দিনের কথা কখনো ভুলবো না। ২৩-শে জুন ১৯৬৮ সাল। সুভাষ, কমল, অরুণ ওরা তিনজনই কবিতা পড়লো। স্বরচিত কবিতা। স্বরচিত কবিতা নিয়ে ছোটবেলায় স্কুলের বন্ধু নীলুর ঠাট্টার কথা মনে পড়লো। কমলকে নীলুর গল্পটা করতেই ও বলল নীলু নাকি ওর ছোটবেলার বন্ধু ছিল। এক পাড়ায় থাকতো। বেচারা বাংলাদেশে ... ইত্যাদি। কিন্তু আমার রাজপুত্র কোথায় গেলেন ? ভাবলাম আমিও স্বরচিত কবিতা লেখা শিখবো। আপাতত কমলের কাছেই হাতেখড়ি হোক। ব্যাটা ভাল লেখে মনে হল। অবশ্য আমার জীবনে কারো পাশে বসে স্বরচিত কবিতা শোনা এই প্রথম। ব্যাপারটা কালচার করতে হচ্ছে। আমার ছেলেবেলার সেই কবিতার রাজপুত্র, নাম সত্যেন্দ্রনাথ দে, টেলকোতে চাকরি করেন, সেখানেই থাকেন শুনলাম। কবিতার অভাবে প্রথমদিন আমি সেই হিজরাদের গল্পটাই পড়েছিলাম। ভালো লেগেছিল সবার। কমল বলল --- গল্প ভালোই লিখেছো। তবে মাঝে মাঝে কবিতাও পোড়ো। চেষ্টা করো কবিতা লেখার। তুমি পারবে।
    কবিতা লিখলেই হল ? ইয়ার্কি ? কোনদিন ইন্টারেস্ট নিইনি। পড়িওনি। এবার থেকে সুযোগ পেলেই পড়বো। ব্যাপারটা কি, পড়ে কি ফিলিং হয়, বোঝে কিভাবে – না জেনে শুনে লিখবো কি করে ? ফাঁকিবাজি পারবো না।
    সেদিন আড্ডা মারার পরে একসাথে বসে পানাপানি গুড়কির স্বাদ জিভে রয়ে গেল। আমার ট্রেনিং জুলাই পেরোলেই শেষ। সুভাষের হিজরা কোম্পানি তো চলছেই কুথিয়ে কুথিয়ে। কমল ডিপ্লোমা (ইং) করে বেকার বসে আছে, টিউশন পড়িয়ে যা কিছু পায়। অরুণ এখনো কলেজে। রাত নটার মধ্যে সবাই বাড়ি ফিরে গেল। আমি সেই আগের মতো। লাগামকাটা। জুলাইয়ের পরে কি করবো ভাবছি। মাঝে মাঝে কাগজ দেখে এদিক ওদিকে অ্যাপ্লিকেশন করছি চাকরির জন্য। হচ্ছে না। ১৯৬৮, চাকরির বাজার ডাউন। হেলতে দুলতে বাড়ির পথে চললাম। ওরা অনেক দূরে থাকে। কবিতার বই পড়তে হবে এবার থেকে। ছোটবেলা থেকে বাড়িতে এত বই পত্রিকা ছিল কিন্তু কক্ষণো কোন কবিতার বই দেখিনি। কালটিভেট করতে হচ্ছে। বাড়িতে তো এখনো মাসিক আর পূজোসংখ্যা রাখা হয়, তবে গল্প ছাড়া কিছুই তো পড়ি না। কি দিয়ে শুরু করি ? কার লেখা বই ? রবীন্দ্রনাথ মনে পড়ল। কমলকে জিজ্ঞাসা করতে বলল --- সে তো সমুদ্র। নামলে কূল পাবি না। তার চেয়ে জীবনানন্দ দাশ, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, সুনীল গাঙ্গুলী,  শক্তি চট্টোপাধ্যায় পড়া যাক।
    --- নাম তো মুখস্ত করে রেখেছিস। আরো জানিস ? পাই কোথায় ?
    --- চল আমরা মাসে মাসে চাঁদা তুলি, যারা সাপ্তাহিক পাঠে বসছি। কিছু টাকা হলে কলকাতা থেকে বই কিনে এনে লাইব্রেরি করবো। সেখান থেকে নিয়ে পড়বো। কমল বলল।
    --- এই রেটে ক’বছর লাগবে লাইব্রেরির জন্য ? অরুণ বলল।
    --- আমরা চারজনই থাকবো নাকি ? টেগোর সোসাইটিতে গিয়ে দ্যাখ। নিখিল বঙ্গে যাবি ? ডি এম লাইব্রেরি ? ঘুরে এসে কথা বলিস। কারা লাইব্রেরি করছে তাদের ওপর ডিপেন্ড করে কি বই, কত বই, কতদিনে জমবে। চারজন চল্লিশ হয়ে যাবো দেখতে দেখতে। তিনদিন সিগারেট না খেলেই হয়ে যাবে।
    পরের রবিবারই বিকেলে আবার আমরা কথামতো জড়ো হয়েছিলাম কবিতার আসরে। গল্প হচ্ছিল সেদিন সুভাষের পাড়ায় অন্য একটা বাড়ির ভেতরে বসে। কারা যেন বেড়াতে গেছে সুভাষের মা’র কাছে চাবি গচ্ছিত রেখে। সেদিন শক্তিপদ হালদার নামে কমলের সমবয়সী একটি ছেলে, ছোটখাটো চেহারা, হেভি লেন্সের চশমা চোখে, কবিতা পড়ল আমাদের সাথে। সবাই দেখি ভাল কবিতা লেখে। গল্প শুধু আমি, আর অরুণ মাঝে সাঝে। তবে অরুণও মেইনলি কবিতাই লেখে। ভাল লেখে। আমি তো নবীশ। আমার সব ভাল লাগা কিছুই না। গল্পের কথা বলতে পারি। ২৩শে জুনের পরে আজ সেই ৩০শে জুন রবিবার, আমার দ্বিতীয় দিন। আবার আমরা বসেছি বিকেলে। কবিতা আর কবিতা। সুভাষ উদাত্ত কন্ঠস্বরে ঝোঁকের মাথায় কবিতা পড়ল। যেন ট্রেন চলছে। গায়ে কাঁটা দেয়। কমল অদ্ভুত শব্দ ব্যবহারে, ছন্দ কেটে কিছু বক্তব্য দাঁড় করালো। কমলের কবিতায় গল্প আর নাটকের এলিমেন্ট আছে। সংলাপ সুদ্দ। অ্যাপিল করে খুব। অরুণ মোটামুটি ছন্দ মেনে কবিতা লিখেছে। ছন্দই বা কী তার কীই বা জানি। শক্তি ভালোই পড়ল। এরা অনেকদিন ধরেই কবিতা লেখে বোঝা গেল। স্মার্ট আর সড়গড় সাবলীল উচ্চারণ ওদের। ওরা অন্যের কবিতা নিয়ে সবাই কিছু না কিছু বলল। কখনো প্রশংসা, কখনো সমালোচনা, আপ ডাউন। আমি আবারও একটা গল্প পড়লাম। গল্পটা পড়ার সময় কমল অনেকবার আমাকে থামিয়ে আবার অংশটা পড়তে বলল। ঘন্টা দুয়েক পড়াশোনা হবার পর আমরা সবাই সুভাষের পাড়ার চায়ের দোকানে গিয়ে ঢুকলাম। কমলকে বললাম --- গুরু, আমাকে কবিতা লেখাটা শিখিয়ে দিতে হবে।
    --- শর্ত আছে। আমাকে গল্প লেখাটা কারেক্ট করে দিতে হবে। আমি গল্প লিখতে চাই। তুই তো গল্প জানিস। নাটকও করতি। মনে নেই তোদের ক্লাবের নাটকের কথা ? তুই তো অভিনয় আর ডাইরেকশনের কাজও করতি। এই দুটো, গল্প আর নাটক মিক্স করে দিলেই কবিতা হবে। লিখতে তো শুরু কর। ওই যে কবিতাটা আজ পড়লি সেরকম --গোঁফের আমি গোঁফের তুমি -- লিখলে চলবে না। প্রথমে ইমোশন ঢেলে দে। তোকে একটা বই দেবো শক্তিদার। পড়ে দেখিস। প্রথমে যা খুশি লিখবি। যা মাথায় আসে। পসিবল ইমপসিবল ভাববি না। শুধু লিখে যা। এর মতো ওর মতো করিস না। তৎসম তৎভব বাদ। মুখের ভাষা। আকাঁড়া শব্দ। আঞ্চলিক ভাষা। সব মিশিয়ে দে। এভাবে আমাকে কবিতা খিচুড়ি বানানো শিখিয়ে দিলো কমল। শক্তির কবিতা পড়িস।
    --- কে ? শক্তিপদর ?
    --- আরে না। বিখ্যাত কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কথা বলছি। সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে আমি এগোলাম বাড়ির পথে। পথে সমীর আটকালো। --- কিরে, আমাদের ছেড়ে অন্য ঠেক ধরেছিস ? কোন পাড়ায় বে ?
    --- এক্স এন টাইপে। সুভাষের ওখানে। কবিতা হচ্ছে আজকাল। বললাম।
    --- তাই নাকি ? বেশ বেশ। লাঠি ছোরা প্রেম গিটার ব্যায়াম জুয়া গল্প – এবার কবিতা হচ্ছে ? শোনা শোনা।
    --- সিগারেট ছাড়। ধোঁয়া ছেড়ে বললাম --- একটা কবিতা বল তো সমীর। --- সোজা। ‘জল পড়ে / পাতা নড়ে’। বা, ধর, -- ‘আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে / কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে’। সোজা। বছরের পর বছর স্কুলে এত কবিতা মুখস্ত করলি সেগুলো কম কি ? তুই আবার কবিতা লেখা শুরু করলি কেন ? জয়তী বলেছে নাকি ? দাঁড়া কাল রটাবো। ‘প্রেমিকাকে খুশি রাখার সহজ উপায় কবিতা লেখা’।
    --- ধুশ শালা। কবিকে বুঝতে হবে, সেটা আবার প্রেমিকাকেও বোঝাতে হবে ... প্রেম করা শিকেয় উঠল।
    --- রবীন্দ্রনাথ অত কবিতা লিখেছিল কি করে জানিস ? সমীর জিজ্ঞেস করল। --- ওনার হাজার জন প্রেমিকা ছিল। একজনের কথা চোখ বন্ধ করে ভাবতো, আর লিখে ফেলতো একটা কবিতা। তুইও চালু হয়ে যা।
    ভুয়োদর্শী সমীরকে সন্দেহের চোখে দেখাতে ও বলল --- আপন গড, বানিয়ে বলছি না, সুনীল গাঙ্গুলীর লেখায় পড়েছি দেশে। তুই পড়িসনি ? কবিতা লিখতে হলে কিন্তু সব পড়তে হবে। লড়ে যা। পরের বার সিগারেট চাইলে কিন্তু কবিতা শোনাতে হবে। লিখে পকেটে রেখে ঘুরিস। কি জানি কখন জয়তীর সাথে দেখা হয়ে যায়।
      বাড়িতে ফিরে পুরনো ম্যাগাজিন সব ঘাঁটতে বসলে মা ধমক দিলো --- ওকিরে ! খেতে আয়। বাবা বসে আছে যে। খেতে বসে বললাম --- মা, ম্যাগাজিনগুলো কাল গুছিয়ে এক জায়গায় রেখো তো। আমার কাজ আছে। অফিস থেকে ফিরে বসবো। আর কদিন মাত্র বাকি। অফিসের কথাটা আমার কানেই অদ্ভুত শোনালো।
    অফিসে গিয়ে আর মন বসে না। ট্রেনিরাও আমার গা ছাড়া ভাব দেখে বিস্মিত হল। --- কিরে ? চাকরি হল না প্রেম ? কোথায় রে ? বল, আমরাও লাইন লাগাই। সারাদিন ফুরফুর করে কেটে গেল। দুপুরে ক্যান্টিনে ভাত খেতে বসে বললাম --- আজ বিকেলে কোয়ালিটিতে বসে মাল খাওয়া যাক চল। সময় তো ফুরিয়ে এল। এরপর কোথায় কে চলে যাবো। কাম্বলে বলল --- নারে ভাই। হোস্টেলে চল। দারু পিকে কোই হসেগা, কোই রোয়েগা, কোই গানা গায়েগা ... কোয়ালিটিমে জমেগা নেহি। তাই ঠিক হল। পাঁচটা বাজলে আমরা বিস্টুপুর থেকে মালপত্র কিনে হোস্টেলে গিয়ে থিতু হলাম। আমি, রাম, কাম্বলে, মুরারি আর মুন্না। একটা অ্যারিস্টোক্র্যাট ফুল আর কিছু চানাচুর। বিকেলের চা সেরে হাত পা ধুয়ে বিছানায় গুছিয়ে বসলাম। আমি বললাম --- চল খেতে খেতে আমরা আমাদের ফিউচার নিয়ে কথা বলি। কে কি করব ভাবছি। আমি তো এই শহরেই কিছু পেয়ে যাবো। কারখানার শহর বলে কথা। মনে মনে তো ভাবছি কবিতা লেখা শিখতে হলে এখানেই থাকতে হবে। কাম্বলে বলল --- পুণেও কারখানার শহর তৈরি হচ্ছে। বাড়ির কাছেই। স্লাম্প কাটবেই। কাজ সিওর পেয়ে যাবো। বাবার শরীর ভাল না। একসাথে থাকাই ভাল। বোন আছে একটা ছোট। মা চায় সঙ্গে থাকি।
    --- পুণের কাছাকাছি অনেক সুন্দর জায়গা আছে বেড়াবার। তাই না ? খান্ডালা, লোনাবালা, আর কি সব ...
    --- আমি ফিরে গেলে তোরা আয় বেড়াতে। সব জায়গায় ঘুরিয়ে দেবো। বোম্বে নিয়ে যাবো। আয়। কিরে রাম, আসবি ? মুরারী ? মুন্না ? চল সবাই ডেট ঠিক করে একসাথে। মস্তি হবে।
    রাম আর মুন্না ঠিক করে রেখেছে আমেরিকায় যাবে আত্মীয়ের কাছে। এম এস ক’রে সেখানেই চাকরি করার জন্য। মুরারীর বাবা ডাক্তার, কলকাতায় বাড়ি। ও আমার কলেজের ক্লাসমেট কিন্তু যাওয়া আসার পথে কখনো ওর বাড়ি যাওয়া হয়নি। ভাবলাম এরপর থেকে যোগাযোগ রাখতে হবে। এদের সাথে একবছর ট্রেনিং-এ কাটালাম। অনেক সুখদুঃখের সময় কাটলো। কলেজ ছাড়ার সময় এরকম বেদনাবোধ হয়েছিল। আরো কতবার যে হবে। 
    সন্ধ্যার আড্ডা শেষ করে উঠলাম। বাইরে এসে মুরারী বলল --- যাবার আগে একদিন তোর সাথে কাটাবো বারীন। টাইম দিস। ধর আগামী রবিবার। আমি চমকে উঠলাম রবিবারের কথায়।
    সেদিন রাতে পার্টি থেকে ফিরে ম্যাগাজিনগুলো, দেশ-অমৃত-শনিবারের চিঠি-বসুমতী উল্টে পাল্টে কবিতাগুলো পড়ে ফেললাম। কিছু বুঝলাম না। মনে হল একটাই লেখা পড়ে গেছি। গোল গোল উচ্চারণ। এটাই কি ছন্দ ? কোনটায় গল্প ছিল পরিষ্কার। ক্লাইম্যাক্স। রাজনীতি। শাসানি। এসবই কি কবিতা ? কিন্তু কমল শক্তিপদ যা পড়ল তাতে ছিল কান্না, ভালোবাসা, মজা। শুনতে ভাল লাগছিল। ঠিক করলাম আমাকে আরো পড়তে হবে, কবিতা লেখার চেষ্টা করতে হবে। আমি পিছিয়ে পড়ার পার্টি না। চিরকাল না-পারা-গুলো চ্যালেঞ্জ করে শুধরেছি। স্কুল লাইফ, কলেজ লাইফ, ক্লাব লাইফ আমার এভাবেই কেটেছে, আর আমি কবিতা লিখতে পারব না ? ওই ম্যাগাজিনের লেখাগুলো যদি কবিতা হয়ে থাকে তাহলে ... আমি কাল থেকেই নেমে পড়ছি।
    --- এক সপ্তাহ পরে পরে না, আরো ঘন ঘন বসতে হবে আমাদের। দরকার হলে রোজ। সুভাষ কমলের কাছে প্রোপোজ করতে ওরা বলল বেশ, মাঝে বুধ বা বৃহস্পতি যে কোন একদিন বসা যাক। আর বারীন, তুই পারলে রোজ আমার কাছে আয়। এখন তোর কবিতার মুডে লেখা বেড়ে যাবে। ছাই পাঁশ জমাবার আগে সারাতে সারাতে চল। কমল বলল। আর বারীন, একটা কাজ কর। একটা ছোট খাতা করে আমাদের পাঠসভাগুলোর হিসাব রাখ। ডেট। কে কে উপস্থিত, কে কি পড়ল, কে কি বলল লেখা থাক। ভবিষ্যতে ইতিহাস হয়ে যাবে।
    ছাই পাঁশ ! দাঁড়া কিছুদিন। দেখাচ্ছি শালা। আমার চোখ পাকানো দেখে কমল আন্দাজ করলো আমার খারাপ মুড। বলল --- ঠিক হয়ে যাবে বারীন, চিন্তা করিস না। সব ঠিক হয়ে যাবে। কাল থেকেই তাহলে। সন্ধ্যাবেলা। ঠিক আছে তো ? এই নে আমার প্রথম চাঁদা ১০ টাকা। আমরা হাঁটছিলাম। এগ্রিকো মেন রোড দিয়ে। আমার বাড়ি পেরিয়ে নিচের দিকে। আরো নিচের দিকে। যে দিকে সুবর্ণরেখা। হাঁটতে হাঁটতে কোন কোন বাড়ির দিকে ঘনিষ্ঠ ভাবে তাকাচ্ছিল কমল, যেদিকে লাইন লাগিয়ে হাঁটতো আগে কম বয়সে আর আমি ভাবতাম ব্যাটাকে প্যাঁদাবো। কমল এখন আমার কবিতার গুরু। ভাগ্যিস মারধর পর্যন্ত এগোইনি। এগিয়ে ডান পাশে বড় মাঠটা পড়ল যেটাতে আমরা ছোটবেলায় ফুটবল খেলতাম। পাকা রাস্তার পাশে বড় বড় গাছ আর ওপাশে কোয়ার্টার্স। একটা গাছের নিচে চটি পেতে আমরা বসলাম। সিগারেট বার করলাম। কমল বলল ও খাবে না। --- আজ চাঁদা দিয়েছি না, ফলে তিনদিন নো সিগারেট। ওই দিকে তাকা। ওই বড় বড় হাইরাইজের দিকে। এন-এম-এল ফ্ল্যাটস। ওখানে বীরেনদা থাকেন। শৌনক গুপ্ত নামে লেখেন গল্প, উপন্যাস, রাজনৈতিক ইতিহাস। সরকারি চাকরি তো, তাই ছদ্মনামে। ওর ইংরাজি বইয়ের লাইব্রেরি দেখলে চমকে যাবি। আমি তো ইংরাজি পড়তে পারি না। ওনাকে ভেড়াবো আমাদের মধ্যে। ইনি আমাদের পশ্চিমের জানালা হবেন। কেমন দিলাম গুরু ? আমি ভাবতেই থাকি হাইটের কথা। কোত্থেকে কোথায় যাবো। দ্যাখ না কি হয়।
    --- এত ভাবিস কেন ? আজ যেটা ভাবলি তা কাল মনে থাকবে ? তোর যে চাকরি নেই সেকথা মনে থাকে ?
    --- সেটা তো বাবার চিন্তা। রোজ মনে করিয়ে দ্যায়। ভুলবার জো আছে ? আমি তো সেটা ভাববো যেটা শুধু আমার ভাবনা। রোমান্টিক আর কাল্পনিক। আমি আমাদের পুবের জানালাও পেয়ে গেছি ভাবনায়। দ্যাখ না কি হয়। চল হাঁটি একটু। বড় ফ্ল্যাটবাড়িগুলো ছাড়িয়ে বাঁ দিকে এগোলাম ভুঁইয়াডির দিকে। আমার প্রাইমারি স্কুলের পথে। যেখানে এগ্রিকো শেষ হচ্ছে, পথের পাশে একটা চায়ের দোকানে বসলাম চা খেতে। বললাম --- গঙ্গা, দুটো চা দেরে ভাই। পুবের জানালাটা কে রে ? --- ক্রমশ বন্ধু। হবে হবে। আগে ভাবনাটা জমে যাক। জানালা মানাবার মতো পোক্ত হোক বাড়িটা।
    --- বাড়িটা ! এর মধ্যে বাড়ি আসছে কোত্থেকে ? আর কি কি ভেবে রেখেছিস ? ছাদ, দেয়াল, বাড়ি, বিছানা জানালা, আর ঘুম, হয়তো রমণী। কিন্তু কবিতার কি হবে ?
    --- ভাব। ভাব বারীন। ভাবনাই কবিতা। যত ভাববি তত ভাল লিখতে পারবি। তত পোক্ত হবে আমাদের বাড়ি, কবিতার বাড়ি। পুবের জানালা আর পশ্চিমের জানালা মানে বিশাল লাইব্রেরি আর বন্ধু রে, মনের বন্ধু। লেগে পড় সিরিয়াসলি। নাঃ, খুব এক্সাইটেড ফিল করছি। বারীন, কিছু টাকা আছে সঙ্গে ? একটু চোলাই খেতে ইচ্ছে করছে। খাওয়াবি ?
    সেদিনের মতো খেয়ে দেয়ে যে যার বাড়ি ঢুকে গেলাম। খুঁজে পেতে একটা চটি মতো ডাইরি আর পেন নিয়ে বালিশের পাশে রাখলাম শোবার আগে। সেই রাতে কতবার ঘুম ভেঙেছিল মনে নেই। কিন্তু সকালে উঠে দেখি ডাইরিটা ভরে গেছে। কারখানায় গিয়ে দেখা যাবে। অফিসে বেরিয়ে গেলাম চা খেয়ে।
    ট্রেনিং-এর শেষ মাসে কোন কাজকর্ম নেই। পুকুরপাড়ে বসে ডাইরিটা বার করে বার কয়েক পড়লাম। পাঁচ ছ’টা পাতায় দু-চার লাইন ক’রে কবিতা লেখা, যদি এগুলোকে কবিতা বলি। বারে বারে পড়েও মর্মোদ্ধার হল না। এবার কাজ হল কাটা জোড়া, বাক্য তৈরি করা, কোনরকমে মিনিংফুল করে তোলা ... এগুলোকে বোধহয় পংক্তি বলে। বারবার চোখ বোলালাম, পড়লাম, প্রতিবার একটু একটু করে বেড়ে গেল কবিতার দৈর্ঘ্য। শেষপর্যন্ত চারটে কবিতা দাঁড়ালো। নাম দিলাম না। ১-২-৩-৪ নম্বর দিলাম শীর্ষে। প্রথম দিনের জন্য যথেষ্ট হয়েছে মনে হল। এই করতে গলদঘর্ম একেবারে। কমলের কেমন লাগবে জানি না। তবে আমি আমার প্রথম কবিতা লেখায় খুব স্যাটিসফায়েড হয়েছি। ভাবা যায় ? তাহলে বারীনও কবিতা লিখে ফেলল। কিন্তু কাল রাতে কখন ঘুম থেকে বারে বারে উঠে লাইনগুলো লিখেছিলাম খেয়াল নেই। সকাল থেকেই অবাক ব্যাপার ঘটে চলেছে। কাল ছিল ৩-রা জুলাই  ১৯৬৮। রাতে ঘুমের ঘোরে নেমে এসেছিল কবিতা। ঘটনাটা লিখে রাখতে হচ্ছে। কলেজে আমি ডাইরি লিখতাম। সেটা আবার নামাতে হবে। কতক্ষণে বিকেল পেরিয়ে কমলের সাথে দেখা করব সেই উত্তেজনা। আর একবার চোখ বোলানো যাক ঃ কবিতা (এক) --- “ যেমন দুঃসংবাদ আনে নৈশব্দ ঝুরঝুর / স্বনিহত নির্জন মৈথুনকারী / যেমন ভগ্নদূত অসবর্ণ মেঘ বেছে রাখে / সমভিব্যাহার শেষে শিবিরের পর্দা তুলে / পরিখা পেরিয়ে যায় সম্রাট / কাড়া নাকাড়ার সাথে ভালোবাসা হঠাৎই এলে / এমনিই আসো। এবার পথের দিকে চাও / এবার আগল খুলে চৌকাঠ ঘুণপোকা পার হয়ে যাও / যেমন অনর্গল দুঃসহ যোনিমূলে শিশুর কান্না শোনা যায়”।
    বাড়ি ফিরে পোষাক পালটে চা খেয়ে কমলের বাড়ির উদ্দেশে রওনা দিলাম। জীবনের প্রথম কবিতা আমার পকেটে। বলো ? 
 (ক্রমশ )

Comments