শামুকের সংসার - হ্যাশ তন্ময়





গত দু দিন ধরে কোলবালিেশর গা ঘেঁষে তিনটে শামুকের সংসার। দেওয়াল গুলোর প্লাস্টার ফুঁড়ে ঘাম ঝরছে ভোর রাত্রি সকাল বিকেল। আমার পায়ের থেকে তিন আঙুল দূরে ভেজা আলকাতরার মত শীত পাহারা দিচ্ছে। তারও দু ধাপ উপরে আমার হলুদ রঙের দেওয়াল আর সেই দেওয়াল জুড়ে বৃষ্টি থাকে সারাটা বর্ষাকাল। এই বর্ষা জুড়ে আমার ঘর গুলোয় ভাড়াটে আসে প্রতি বছর। প্রতিবার নতুন নতুন মুখ, আর নতুন নতুন জীব। আমার ভারি ইচ্ছে করে আমি তাদের ঘর গুছিয়ে দি, আমার ইচ্ছে করে আমি ওদের আলনা সাজাই, আমি চাই আমার বাবার সেই মার্বেল পাথরের দেওয়াল আলমারি জুড়ে ওদের ছেলেপুলে দের বই গুছিয়ে দিতে, আমার ওদের খুব বলতে ইচ্ছে করে এই যে তোমরা এই এত মাঠ এত জঙ্গল এত দেশ পেরিয়ে আমার বাড়ি এলে আজ রাতে আর হাড়ি চাপিয়ে কাজ নেই, আমি বরং আমার সাথেই আরও দু মুঠো চাল নিয়ে নি, কিন্তু কেমন করে বলি এর থেকে আরও নিচে নেমে ডান দিকে আমার বসবার ঘর, তার আরও দু সিঁড়ি নিচে ঠাকুর ঘর, তা পেরিয়ে লম্বা বারান্দা, তার থেকে দক্ষিণে গিয়ে আরও নিচে আমার রান্নাঘর। আমার রান্নাঘরে আজকাল আর আলো ঢুকতে পারে না, চার বছর আগে চৈত্র মাসে শেষবার আমি এই ঘরে এসে থেকেছি। এখনো ঘরের কার্নিশ, জালনার পাট, শিলনোড়া, জাঁতাকল, হাতপাখা জুড়ে পায়েশের গন্ধ। এখনো আমার সারা শরীর জুড়ে সেদিনের বাসী খাবারের ক্লেশ। বহুবার কালো দেরাজ খুলেও তোমার দেওয়া সাবান খুঁজে পাইনি, এর থেকে আরও নিচে নেমে স্নানঘরে যেতে যেতে রাস্তা হারিয়ে ফেলেছি, অথবা কখনো ভুল বশত পৌঁছে গেলেও আমার বাসী কাপেড়র পাড় জুড়ে একের পর এক কাঠপিঁপড়ে লাইন বেঁধে আমার শরীরে উঠে এসেছে।
আজকাল আমার আর এত সামর্থ্য নেই যে আমি এতটা পথ পেরিয়ে নিচের থেকে আরও নিচে নেমে খুঁজে নেব রান্নাঘর, তার থেকে আরও নিচে পৌঁছে স্নান সেরে আমি আবার ফিরে আসব। তাই আজকাল এই তিন মাস জুড়ে আমি ছাদের ঘরে থাকি। আর কুড়ি বাই ষোল ফুটের আমার সব কটা ঘর জুড়ে ভাড়াটেদের গোঙানির শব্দ এই দেওয়াল থেকে ওই দেওয়াল অবধি পৌঁছতে পারে না। এই তিরাশি বছরের আমি এখন কেবল ছাদ ভালোবাসি আর ভালোবাসি আমার ছাদের উপরের এই মস্ত বড় আকাশকে। আমার শাড়ির আঁচল বেয়ে এখন সাদাকালো মেঘ মাঝে মাঝে ঘুমিয়ে পরে আমার পায়ের কাছে এসে, কখনো বা আমি ওদের পাহারা দিই, কখনো বা ওরা আমায় সামলায়। এই ভাবে আমার ছাদ জুড়ে আর একটা বাড়ি তৈরি হয়। আমরা আবার আর একটা স্বপ্ন দেখি, আমরা ভাবি এর উপরের আর একটা দেওয়াল, তার উপরে আর একটা ছাদ, এই ভাবে ছাদের উপর ছাদ গড়তে গড়তে আমরা এক সময় আকাশ ছুঁয়ে ফেলি। তখন আমার ভয় আস্তে আস্তে কমে আসে, আমার মনে হয় এত উপর থেকে তোমায় খোঁজা ভারি সহজ হবে।
আজ থেকে ঠিক ষাট বছর আগে তোমার সাথে আমার পরিচয়। তখনও আমি ছাদে দারিয়ে আকাশ মাপতে শিখিনি। তখন আমি অনেক ছোট, ভুল ঠিক ভালো খারাপ ততটা ভালো করে বুঝতে শিখিনি যতটা ভালো করে বোঝা উচিত ছিল। তুমি হয়ত পারতে, কিন্তু কখনও বলনি, আর আমিই বা তোমায় দোষ দিই কেমন করে, আমি তখন ক্লাস নাইনের হেডগার্ল, পুরো স্কুল জুড়ে আমার কদরই আলাদা, আর তুমি তখন ক্লাস সেভেন। আমি ভারিই কাউকে তোয়াক্কা করতাম সেই সময়, কাউকে অপছন্দ হলে, কথার আগেই হাত চলত বেশি। মনে আছে, একবার এক বাংলার মাস্টার মশাই মারকুটে লিখে আমার স্কুল ডায়েরিতে গার্জিয়ান কল করেছিলেন, পুরো ক্লাস জুড়ে সবাই আমার সমর্থনে একপ্রকার ঝগড়া করেছিল স্যার এর সাথে এবং বেগতিক বুঝে স্যার আমার উপর এতটাই চটে গেলেন যে একপ্রকার আমায় বুঝিয়েই দিলেন যে নেক্সট দিন গার্জিয়ান না নিয়ে স্কুলে এলে উনি আর ওনার ক্লাস করতে দেবেন না। শুধু তাই নয় সেখানেই থেমে থাকলেন না উনি, আমার দিকে তেড়ে এসে বললেন আমি যদি এক্ষুনি ক্লাস থেকে বেরিয়ে না যাই তবে উনি আর আমাদের ক্লাসই নেবেন না এই বছর, অগত্যা আমি বেরিয়ে এলাম, এবং তারপর আমার সামনে কেবল ভূস্বর্গ। আমি দেখলাম দূর থেকে তুমি আসছ খালি নীল রঙের বোতল হাতে। তখন আমার এতটা বোঝার বয়স হয়নি তোমার কখন তেষ্টা পায়, তোমার কখন ঘুম আসে, তুমি কখন স্নানে যাও, তোমার কিসে রাগ হয়, ছুটির দিনে তুমি কোনটা খেতে ভালবাস, এসব কিছুই আমি বুঝতে শিখিনি তখন। আমি শুধু এটুকু বুঝতাম, জল ভরবার সময় তোমায় নিচু হতে হত, তোমার কান বেয়ে চোখের পাশ ছুঁয়ে তোমার সাদা ফ্রেমের চশমাটা বার বার নিচে নেমে আসত, সত্যি বলছি জানো আমি তখন খুব করে চাইতাম, তোমার বোতলতা কেরে নিয়ে আমি ভরে দিই, এর থেকেও বেশি বার বার চেয়েছি আমার বাড়ি থেকে বয়ে নিয়ে আসা বোতলটা তোমার হাতে দিয়ে বলি, তুমি এটা নিয়ে যাও, এরকম ভাবে টানা চার বছর আমি রোজ জল পালটে যে ভরা বোতল নিয়ে স্কুলে যেতাম ঠিক সেই বোতল নিয়েই ফিরে আসতাম। আমি ভাবতাম এই জল দেওয়ার বাহানায় রোজ একবার তোমার সাথে অন্তত কথা তো হতে পারত। কিন্তু আদৌ তেমনটা হয়নি, আমরা তো কোনোকাল এক স্কুলে পরতেই পারলাম না, আমার সেই বয়সে পৃথিবীর উপর ভারী রাগ হত। সত্যি বলতো পৃথিবীটা যদি আর একটু ছোট হতো তার থেকেও বড় কথা আমার এই দেশটা যদি আমার তিন শামুকের সংসারের মত এতটা ছোট হতো তবে হয়ত চেষ্টা করে আমি তোমার নাগাল পেতাম। কিন্তু, তুমি পশ্চিমে আর আমি পূর্বে বসে এই সরল রেখার সমাধান করতে পারিনি।
বর্ষাকাল বরাবরই আমার খুব একটা পছন্দের সময় নয়। আর আজকাল আমার খাটের তলা জুড়ে ছত্রাকের ঘরবাড়ি। তবে আমার এখন আর এদের জঞ্জাল বলে মনে হয় না। একা একা থাকতে থাকতে আমারও মনে হয় মাঝে মাঝে কারর সাথে কথা বলি। যখন সামর্থ্য ছিল তখন ঘুম আসবার জন্য চুয়ান্ন সিঁড়ি বেয়ে অন্তত বারো বার ওঠানামা করেছি, তারপর যেই ক্লান্ত মনে হতো তখন বিছানায় এসে শুতাম। আর তখন আমার সারা শরীর জুড়ে ঘাম বইছে, আমি এপাশ ওপাশ করছি রাতের পর রাত। মাঝে মাঝে দুপুর হোলে রেডিও শুন্তাম কখনো কখনো, তখন আমরা একই শহরে থাকি। কিন্তু তাতেও কোন লাভ হয়নি, আমি থাকি কলকাতার গা ঘেঁষে, আর তুমি থাকো কলকাতার দক্ষিণে। তোমার ঘরের বাইরে দুপা পেরলে সমুদ্রের জল ছোঁয়া যায়, এত কাছাকাছি থেকেও তখনো আমি খোঁজ নিতে পারিনি কেমন আছো তুমি, যখন রাতের পর রাত জাগতে তুমি তখন আমি শুধু এপাশে বিছানায় শুয়ে তোমার আলো নেভানোর অপেক্ষা করেছি। মনে আছে সপ্তাহ ভর তোমার পরীক্ষা, জানো আমার ভারি ইচ্ছে হতো আমি তোমার পাশে গিয়ে বসি, তুমি যখন এবই সেবই ঘেটে এপাশ ওপাশ ঘুরে কখনো বা বারান্দায় দুপাক পায়চারি দিয়ে আবার ঘরে আসতে, আর ঘরে এসে চলে যেতে সোজা বাথরুমে, আমি এপাশ থেকে বুঝতাম তুমি এই হয়ত চশমা খুলে চোখে মুখে জল দিচ্ছ, আমি কতবার ভেবেছি তোমার পিছনে গিয়ে দাড়াই তোমার চশমাটা হাতে নিয়ে গামছা এগিয়ে দিই, কিন্তু কিচ্ছু পারিনি, আমি শুধু পেরেছি এখানে শুয়ে এপাশ ওপাশ করতে, এরপর যখন ওপাশ থেকে ফ্লাশের শব্দ হতো আর ছিটকিনি খুলে তুমি ঘরে আসতে তারপর আবার ঢুকে পরতে এবই সেবই এর ভিতর। যানো দেখতে দেখতে সকাল হয়ে যেত, আমি ভীষণ ভাবে চাইতাম বই এর ভিতর থেকে তোমায় মুখ তুলে তোমায় শুয়ে দিই, তোমায় ঘুম পাড়িয়ে দিই, দেখেছ যেমন ভেবেছি ঠিক তাই, কাল রাতে বাথরুম থেকে ফিরে তুমি আলো নেভাতে ভুলে গেছো, এমনটা হতো প্রায়শই, কিন্তু আমি কোনদিন পারিনি এসব কিছু করতে। আমি শুধু পেরেছি ভোরবেলা বাসিমুখে ছাদের ঘরে গিয়ে কাঁদতে।
এখন সেই ছাদের ঘরেই আমার সংসার, এই সংসার ফেলে আমার আজকাল আর নিচে আসা হয় না। আমার উঠন পেরলেই এখন মস্ত বড় সমুদ্র, সেই সমুদ্রেই মাঝে মাঝে আমি রাত পেরলে সাঁতার কাটতে বেরই। এই ভাবে সাঁতার দিয়ে দিয়ে কলকাতার রাস্তা, গলি, ড্রেন, ম্যানহল পেরিয়ে আমি শুধু তোমায় খুঁজে যাই। এরপর ভোর হবার আগে আগে আবার সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে আমি ছাদে ফিরে আসি। সেখান থেকে শাড়ির জট ছাড়াতে ছাড়াতে আমি আমার আকাশ থেকে তোমার আকাশে পৌঁছে যাই, তোমার আকাশ জুড়ে বড় শীত, আমার আকাশে কেবল মেঘ করে আসে, এভাবেই ঠিক ষাট বছর আগে তুমি কলকাতার আকাশে আমায় একা ফেলে তোমার আকাশ খুঁজতে বেরিয়েছিলে। আমি শুনেছি তোমার আকাশে কেবলই সকাল থাকে, আমার আকাশ বয়েসের ভারে ক্লান্ত, সে এখন কেবল রাত হতে চায়। আসলে সত্যি কি যান, তোমায় আমি ঠিক করে কোনদিনও বোঝাতেই পারলাম না, কারন আমি যে ভাষায় আদর করতে জানি, সে ভাষা তোমার কাছে অপরিচিত, কথার উপর কথা জমতে জমতে একসময় আমি হারিয়ে গেলাম, এর পর থেকে রোজ আমি তোমায় স্বপ্নে খুঁজি। আমার খুব মনে হয়, হয়তো কালই তুমি তোমার সূর্যের দেশ থেকে উঠে আমার কলকাতার আকাশে এসে দাঁড়াবে, এভাবে ভাবতে ভাবতে আমার কলকাতার আকাশে ভোর হয়ে আসে, আমি ছাদের সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামার চেষ্টা করি। আমি দেখি আমার কুড়ি বাই ষোল ফুটের ঘর গুলোয় কোথাও কোন ভাড়াটে নেই, সেখানে কেবল শেওলার আশ্রয়। আমার খুব ভয় হয়, আমি দৌরে আমার ছাদের ঘরে ফিরে আসি, আমি দেখি আমার কোলবালিশের গা জুড়ে যে তিন শামুকের সংসার তাদের মধ্যে একজন কেবল খোলস আর দুটো প্রাণ আঁকড়ে ঘিরে আছে সেই খোলস কে। হয়ত তারাভাবে এই বুঝি তাদের আত্মজ ঘুম ভেঙে কলকাতার শহর ঘাট নদী নালা ঘুরতে বেরোবে, আমিও ছাদের উপর এসে দাড়াই, আমার ছাদ জুড়ে কুয়াশার ভারী চাদর, আমি পা দিয়ে সেই চাদর ঠেলে তোমার সাথে আমার আকাশের উপর এসে দাঁড়াতে চাই, এরপর আমি জানি হয়ত বা তুমি একদিন কোন এক ভোরবেলা আমার ছাদে এসে দাঁড়াবে, তখন আমার বাড়ি জুড়ে অনেক অতিথি, আরও কত প্রাণ, আরও কত জীব একের পর এক দেওয়াল পেরিয়ে, সিঁড়ি ডিঙিয়ে, ছাদের উপর ছাদ তুলে সংসার করবে সবাই, তুমি তাদের নিয়ে ভালো থেকো, আমি জানি কেউ কোনোদিন তোমায় আমার কথা বলবে না, তুমিও কোনোদিন কাউকে আমার কথা বলবে না, তবু আমি জানি তুমি একদিন ঠিক আসবে, হয়ত বা মাঝখান থেকে আমার কলকাতার আকাশের আয়ু আরও ষাট বছর কমে যাবে।




Comments