কালবৈশাখী ও রূপকথা | সোহম চক্রবর্তী




আজ আবার শুরু হল হাওয়াটা হঠাৎই সারা দিনের শেষে, যখন সব পাখির দল বাসায় ফেরার জন্য একে অপরকে ডেকে চলেছে রকমারী সুরে, ঠিক তখন শুরু হল হাওয়াটা যেন ঐ পাখিদের ডাকের ছন্দে ছন্দে কোনো মন মাতোয়ারী গান খুঁজে পেল আকাশ তাই তার অঙ্গে জাগল স্পন্দন সেই স্পন্দন প্রবাহিত হয়ে ছুঁয়ে যেতে চাইল বিকেলের শেষ সূর্য দেখবে বলে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা আমার মতন কয়েকজনকে আরো অনেকেই ছিল, রাস্তায়, ট্রামে, বাসে, অথবা অফিসের চৌকো কামরায় বাক্সবন্দী হয়ে তাদের সকলকে সেই হাওয়া হয়ত ছুঁতে পারে না, বা হয়ত পারে কিন্তু সেসব নিয়ে আমি আজ হিসেব কষতে চাই না

আজ দিনটা বড়ই ক্লান্তিকর কেটেছে রোদের তাপ মনের কোণে কোণে জমিয়ে তুলেছিল কিছু অবসাদের ছায়া শরীরটায় ক্লান্তি জমা হয়ে তাকে করে তুলেছিল নিষ্কর্মা দুপুরের ঘুমের পরেও গায়ে লেগে ছিল নিস্তেজ ঈশারা প্রাণ পড়ে ছিল সেই ক্লান্ত ঘুমের দেশেতে

তাই হঠাৎ যখন হাওয়াটা বইতে শুরু করল, আমার চোখের মধ্যে শুরু হল এক সীমাহীন ব্যাকুলতা আকাশের গায়ে এক আবছা হলুদ রঙ, ওই দূরে ছাইরঙা মেঘগুলো ঘন হতে শুরু করেছে কালবৈশাখী নিশ্চয়ই হাওয়ার মধ্যে সেই প্রাঞ্জল পরিপূর্ণতা বিরাজমান আর কিছুক্ষণের মধ্যেই চারিদিক অন্ধকার হয়ে বৃষ্টির ফোঁটাগুলো ছড়িয়ে দিতে থাকবে তাদের ক্লান্তিবিনাশী স্নিগ্ধ জলের ধারা কিন্তু ততক্ষণ একলা বারান্দায় বসে, অথবা রেলিঙের ওপর ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আকাশের এই বাসন্তী রূপ প্রত্যক্ষ করার মধ্যে রয়েছে এক পিপাসুর তৃষ্ণা মিটবার আগের উৎসুক চেতনা

হঠাৎ পাশ ফিরে চাইতেই দেখা হল তার সাথে সে, যার কথা মনে পড়ে শুধু আনন্দে আর বিষাদে এই মুহূর্তটা ঠিক কী আমি বুঝে ওঠার আগেই তার মধুর কণ্ঠে সে বলে উঠল, “আকাশের দিকে তাকিয়ে তোমার কথা বড় মনে পড়ল, তাই না এসে পারলাম না

ভালোই করেছ,” আমি বললাম, “প্রকৃতি যখন ব্যাকুল হতে চাইছে, তখন তার তালে তাল মিলিয়ে আমাদেরও হারিয়ে যাওয়া উচিৎ সেই সীমাহীন উন্মাদনায়

তাই তো এলাম তোমার কাছে,” বলে সে রেলিঙের ওপর রাখা আমার হাতের ওপর আলতো করে রাখল তার নরম হাতের তালু

বৃষ্টিটা শুরু হল ঠিক সেই মুহূর্তেই চোখ বুজে বুকভরে শ্বাস নিলাম আকাশের গন্ধ, বাতাসের ঘ্রাণ ভরিয়ে নিলাম নিজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বৃষ্টি ভিজ্যে দিয়ে গেল আমাদের দুজনকে আমার হাতের ওপর ওর হাতটা আরো শক্ত হয়ে চেপে বসল তাকিয়ে দেখলাম, ও তখনো চোখ বুজে বৃষ্টিকে অনুভব করে চলেছে ওর চোখ, ওর গাল, ওর ঠোঁট, ওর সমস্ত অবয়ব সিক্ত হয়ে উঠেছে প্রকৃতির প্রেমের পরশে

আমি ওর দুটো হাত ধরে তাকালাম ওর দিকে ওর চোখদুটো খুলতেই ওর চোখের তারার মধ্যে সেই উজ্জ্বলতা অনুভব করতে পারলাম আকাশ এখন অন্ধকার, সেই আঁধারের বুক চিরে হঠাৎ ঝলসে উঠল হালকা বেগুনি রঙের আলো আর তারপর আরো বৃষ্টি আর হাওয়ার খেলা চলতে লাগল অবিরত

এভাবে হয়ত আর কিছুক্ষণ কাটল তারপর যখন ফিরে যাওয়ার সময় হয়ে এল, তখন কাঁধের ওপর মাথা রেখে শান্ত স্বরে সে বলল, “আসবার সময় হল এবার

তবে এসো,” আমার মুখে ফুটে উঠল এক স্নিগ্ধ হাসি পরিপূর্ণ সেই হাসি তারপর চোখ ফিরে ওর দিকে তাকালাম, “আবার কবে আসবে তুমি?”

যেদিন আবার ক্লান্ত হয়ে বারান্দায় দাঁড়াবে এসে, আমি আসবো আবার সেইদিন,” মুখে দুষ্টুমির হাসি এনে বলল সে

আর যদি রোজ এসে দাঁড়াই?”

আসবেই না তুমি,” আমার চোখে থেকে চোখ ফিরিয়ে বলল সে তারপর বুকের ওপর মাথা রেখে আকাশের দিকে চেয়ে বলল, “আমি যে চিনি তোমাকে তাই তো তোমার সাথে আমার প্রেম

আকাশটা এখন অনেক শান্ত হয়ে এসেছে বৃষ্টির তেজ স্তিমিত হয়ে ফুরিয়ে যেতে চাইছে আমি ওর গালে আমার হাতটা রেখে বললাম, “তোর ফিরে যাওয়ার সময় হল আজ উঠে পড় এবার

নাহ, আজ উঠব না আমিশান্ত ভাবে বলল সে

তবে!” অবাক বিস্ময়ে আমি চেয়ে রইলাম ওর দিকে


নিজেই দেখ না চেয়ে,” বলে আমায় আরো নিবিড় করে জড়িয়ে ধরল সে আকাশের বুক শান্ত হল, বাতাসের তীব্র ছন্দ এখন আর নেই, শুধু মৃদু অনুভন লেগে আছে তার গায়ে আর যেন কোনো যাদুমন্ত্রের ছোঁয়ায় আমি দেখলাম, সেই মেয়ে যার চোখের মধ্যে আকাশের জল, কাজলে আকা আকাশের মেঘ, যার চুলের গহনে বাতাসের ঢেউ, সেই মেয়ে আমার বুকের মধ্যে মিশে যাচ্ছে ধীরে ধীরে আমার অবয়বকে অতিক্রম করে আমার মজ্জায় মজ্জায় মিশে যেতে থাকছে, আমার শিরায় শিরায় তার শীতল ছোঁয়ার স্পর্শ ব্যাস, তারপর পুরোপুরি সে বিলীন হয়ে গেল রূপকথার দেশে নয় কল্পনায় ফের হারিয়ে যাওয়া নয় আজ যেন আমার সমস্ত বাস্তবতায় পরিণত হল সে।


Comments