সোনার কেল্লা | কৌস্তুভ বসু





এ আমার গতজন্মের কথা তখন ক্লাস ফাইভ, চলে এলাম সোনার কেল্লায় এর আগে পাড়া বলতে সঠিক কোন ধারনা ছিল না বড় রাস্তার উপর একটা তিন তলা বাড়ির গ্রাউন্ড ফ্লোরে পিছনের দিকে দুটো ঘর নিয়ে আমরা ভাড়া থাকতাম ঘরের সামনে একটা সরু সিমেন্টের প্যাসেজ তাতে সবুজ বলতে দাঁড়কাকের মত দাঁড়িয়ে থাকা একটা মাত্র করবী ফুলের গাছ হাওয়া দিলে, গাছের তলায় লুটিয়ে পড়ত হলুদ ফুল ও তার মৃত দেহের বিক্ষিপ্ত কিছু অংশ ধূসর রোগা কংক্রিটের উপরই ছিল আমার সব রকমের উৎসব পালন কখনও সরু জমিটাই হয়ে উঠত লঙ্কার যুদ্ধক্ষেত্র; শলার ঝাঁটার কাঠিতে তীর ধনুক সাজিয়ে সেখানে চলত রামানন্দ সাগরেররামায়ণ’-এর লাইভ ডিসপ্লে কখনও আবার, রানিং কমেন্ট্রিতে ক্ষীণ-কটি চাতালটাই বনে যেত ইডেন উদ্যান তখন সেখানে রাজা, হয় বেঙ্গসরকার, নয় কপিলদেব সদর গেট খুললেই বাসস্টপ এক পাশে জামাইদার ধোপাখানা; সেখানে খাটের পাশে দরজার কোণে গনগনে কমলা উনুনের উপর শরীর গরম করছে লোহার ইস্ত্রি, নিচে এক ধারে জমে আছে পোড়া ফ্যাকাশে ছাই; অন্ধকার ভিতর থেকে ভেসে আসছে রেডিওর গান অন্য পাশে ছাপা শাড়ির দোকান, সামনে ঝুলছে রঙবেরঙের তন্তুজ; শরীরে তাদের নানান কারুকাজ বড় রাস্তার উলটো ফুটপাথে সেলুন, চায়ের আড্ডা কালো পিচে সারাক্ষণ লেগে আছে ঘোড়-দৌড় বাসের হর্ণ, মানুষের কোলাহল, মিছিল, ধুলো দিন-রাত এক জমজমাট অর্কেস্ট্রা অতএব, পাড়া যে ঠিক কী, তা বোঝার উপায় ছিল না  

এ চত্বরে যখন এলাম তখন চারধার ফাঁকা, শুনশান রাস্তার একেবারে মাথায় আমাদের একতলার কেল্লা ডানদিকে দুটো প্লট ছেড়ে হিরকদের চারতলা ফ্ল্যাট তার পাশে আড়াই কাঠা বাদ দিয়ে পিকুদের বাড়ি দূরে দাশগুপ্তদের ঘর বাকিটা পুরো শূন্য স্থান রাস্তা কাঁচা রাবিশ খেয়ে আদিম অবস্থায় শুয়ে পাঁচিল ঘেরা সাহাদের প্লটে তখন ঘাসের রাজত্ব ওখানে বিকেল হলে বসত ফুটবলের আসর এ পাড়া ও পাড়া থেকে অল্প বয়সী স্কুল পড়ুয়া, কিংবা সদ্য কলেজের খাতায় নাম লেখানো ছেলেরা ভিড় জমাতো পিকু ওদের সঙ্গে খেলত একদিন ওদের দলে আমিও মিশে গেলাম সেই প্রথম আমারপাড়ার বন্ধুপ্রাপ্তি ফুটবলে পা ছুঁয়ে অদ্ভুত রোমাঞ্চ হত একটা ছোট গোলক যে এতগুলি মানুষকে একসঙ্গে এত আনন্দ দিতে পারে, আগে ধারনা ছিল না পাড়ার ফুটবলের মজাই আলাদা একটা অদ্ভুত শব্দ শিখেছিলাম, ‘ফ্লাইং গোলকিপার যে গোল বাঁচায়, সে গোলও করে এক কথায়, অলরাউন্ডার আমার কোন নির্দিষ্ট পজিশন ছিল না গোলকিপার থেকে শুরু করে ডিফেন্ডার, মিডিফিল্ডার, এমনকী স্ট্রাইকারও হয়েছি তবে পছন্দের জায়গা ছিল তিন কাঠির তলায় অবশ্য সনাতন তিন কাঠি বা জাল বলে সেরকম কিছু ছিল না দুটো থান ইঁট নির্দিষ্ট দূরত্বে রেখে তৈরী হত আমাদের গোল আর সেই মধ্যবর্তী শূণ্যস্থানেই নিজেকে মনে হতনেরি পম্পেদ্যু গায়ে কাদা মাখতাম হাত পা ছড়ে যেত ঘাম ঝরত নির্মল আনন্দ লুটে খেতাম সাহাদের সবুজ মাঠে

ফুটবল খেলে যখন বাড়ি ফিরতাম, সূর্য তখন সারাদিনের ক্লান্ত শরীর পশ্চিম আকাশে এলিয়ে দিয়েছে চারধারে ধীরে ধীরে নেমে আসছে অন্ধকার এক সময় মুখ লুকোতো গোধূলি চারপাশ কালো হয়ে যেত ফাঁকা জমিগুলোতে ঘাসের ডগায় জ্বলে উঠত জোনাকি কোরাসে গলা মেলাতো ঝিঁ ঝিঁর দল বাড়িতে তখনও ইলেক্ট্রিক কানেক্সন আসেনি রাস্তার ধারেও স্ট্রিট ল্যাম্প বসেনি পাড়ায় আলো বলতে পিকুদের বাড়ির হলুদ বাল্ব, হিরকদের চারতলার ফ্ল্যাটবাড়ির কয়েকটি খোপ থেকে হলদে-সাদা উঁকি কিংবা দূরে নারকেল গাছের ফাঁক দিয়ে দাশগুপ্তদের জানলা থেকে চোরাপথে আল বিছানো টিউব লাইটের চিলতে আভা ঘরের ভিতর কেরোসিন তেলে জ্বলে উঠত লোহার কঙ্কালের খাপে পেট মোটা কাচের কফিনে টিমটিমে হারিকেন সেই হলদে আলোয় পড়তাম এস্কিমোদের কথা, নরওয়ের মধ্যরাতের সূর্য, টম সয়ার-হাকেলবেরি ফিনের অ্যাডভেঞ্চার সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হারিকেনের কাচের দেয়ালে জমত কার্বনের গাঢ় অভিমান মশার কামড়, ঘাম, হালকা হলুদ তালপাতার পাখা দিদির তখন ক্লাস নাইন প্রায়শই পড়তে যেত বাইরে কখনও কখনও মা যেত মাসির বাড়ি বাবা কলেজ থেকে ফিরে এলে আমরা দুজন মাঝে মধ্যে বারান্দায় বসে গল্প করতাম কখনও বরিশালের কথা, কখনও লেখাপড়া, কখনও আবার নতুন দেশে শিকড়-গড়ার রূপকথা বারান্দার গ্রিলের ফাঁক দিয়ে দেখতাম, দূরের আকাশে তারাগুলি আমাদের দিকে প্যাট প্যাট করে তাকিয়ে মিটি মিটি হাসছে অন্ধকার পাড়াটাকে জোনাকির আলোয় এক ঝলক দেখে তখন মনে হত বাটিকের ছিটকাপড়

খুব বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয়নি একদিন ঘরে আলো এল ধীরে ধীরে এল ইনভার্টার লোডশেডিং হলে তখন আর ঘামতে হত না একটা ঘরে পাখা ঘুরত তালপাতার পাখাটা কিছুটা বিশ্রাম পেল এবার হারিকেনগুলির আয়ু ফুরিয়ে এল একদিন আমাদের কেল্লাটা লম্বা হল এক তলা বেড়ে হল তিনতলা পিছনের দশফুটের কিছুটা অংশ ছেড়ে বাউন্ডারি ওয়ালের ভিতর চারধারের মুক্ত মাটি চাপা পড়ল কংক্রীটে একদিন যে মৃত্তিকায় জল-খনিজ-শর্করা খেয়ে বেগুন, ঢ্যাঁড়শ, লাউ, মোরগঝুঁটি, রজনীগন্ধা কিংবা মাদুর গাছ রীতিমত সবুজের বিপ্লব করেছিল, তাদের কপাল পুড়ল কেবল, সদর গেটের ধার ঘেঁষে একটা ভাগ্যবান মাধবীলতা স্পাইডারম্যানের মত তরতর করে বেয়ে উঠল তিন তলা বাড়িটার বহরই গেল বদলে একদিকে কেল্লার চেহারা যেমন পাল্টালো, অন্যদিকে পাড়ার ভূগোলও আর আগের মত থাকল না শূন্যস্থানগুলো ধীরে ধীরে ফ্যাকাশে হতে লাগল সাহাদের ফাঁকা জমিগুলো গগনচুম্বী প্রাসাদে চাপা পড়ল ফুটবল খেলার বন্ধুরা যারা এ পাড়া ও পাড়া থেকে ভিড় জমাতো, তারা ভ্যানিশ হয়ে গেল ! কাঁচা পথ পিচ মাখল রাস্তার ধারে জ্বলে উঠল স্ট্রিট ল্যাম্প বাড়ির সামনে নর্দমাটা কংক্রীটের তলায় মুখ লুকোলো লজ্জায় নিরবে মিলিয়ে গেল জোনাকি আর ঝিঁ ঝিঁ পোকার ব্যান্ড পার্টি পাড়াটা ঝলমল করে উঠল

আকাশটা মনে হল ছাদ ঘরগুলি এক দেহের অংশ সাড়ম্বরে শুরু হল সরস্বতী পুজো সকলে মিলে মিশে সে এক এলাহি উদযাপন ! বছরখানেকের মধ্যেই শুরু হল দোল উৎসব গোটা পাড়া রঙের নেশায় মাতাল হয়ে উঠল মাঠগুলো অট্টালিকায় বুজে যেতে ফুটবল খেলাটা রাস্তায় নেমে এল তার সঙ্গে যোগ হল ক্রিকেট কালো পিচে তিন চারটে থান ইঁট একটা আর একটার উপর চাপিয়ে তৈরি হত উইকেট ব্যাটের দাপটে বল কখনও পথ ভুলত অন্য বাড়ির ছাদে; কখনও বা ভাঙত কাছের বাড়ির কাচ গোস্বামীদের বাড়ির সামনে যখন খেলা হত, ব্যাট করার সময় মাঝে মাঝে দেখতাম, উল্টোদিকের ফ্ল্যাটের মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে বারান্দায় গ্রিল ধরে ওর ভাই খেলত আমাদের সঙ্গে আমাদের দুটো চোখ পরষ্পর ধাক্কা খেলে ও হাসত ওর হাসিতে ঘুম ভাঙত সূর্যমুখী বাউন্ডারি বা ওভার বাউন্ডারি হাঁকালে, ওর চোখে আবিষ্কার করতাম এক চোরা বিদ্যুৎ নিজেকে তখন মনে হত টাইগার !
 
সব কিছুরই একটা হাফলাইফ থাকে সময় ফুরিয়ে গেলে শুকনো পাতায় লেগে থাকে দীর্ঘশ্বাস সব সম্পর্কেই বোধহয় কিছুটা শূণ্যস্থান খুব জরুরি খুব কাছে এসে পড়লে বেমক্কা ব্রেকফেলের সম্ভাবনা থাকে একদিন খেয়াল করলাম পাড়ার মানুষগুলোর মধ্যে ছোট ছোট হাইফেনগুলো বড় প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে দূরত্ব বড় হল দোল বন্ধ হয়ে গেল তারপর সরস্বতী পুজো পাড়াটার শরীরে ধীরে ধীরে বিচ্ছিন্ন দ্বীপের জন্ম হল একে একে নতুন ঠিকানার খোঁজে হারিয়ে গেল অতনু কাকু, মুনিয়া, মান্তু, পিকু চোখের সামনে পাড়াটা বুড়িয়ে যেতে লাগল ফাঁকা হতে লাগল একা হতে লাগল একদিন কোচিং ক্লাস থেকে ফেরার পথে, গোস্বামীদের বাড়ির উল্টোদিকের ফ্ল্যাটের মেয়েটির সঙ্গে বাসে দেখা হল একটা দুটো সাধারণ কথার পর আস্তে আস্তে জানালো, ওর বিয়ে ঠিক হয়ে গিয়েছে চুপচাপ শুনলাম তারপর মৃদু হেসে কেটে কেটে বললাম, অনেক শুভেচ্ছা -ও হাসল দুটো হাসিতেই প্রাণ ছিল না তাই খুব বোকা বোকা, আরোপিত লেগেছিল কিন্তু হাসিটার খুব প্রয়োজন ছিল   

প্রত্যেক শনিবার ঠিক চারটের সময় যে নীল আইসক্রীমওয়ালা হেড়ে গলায়কোয়ালিটিইইইইবলে গলির মোড়ে হাঁক পাড়ত, একদিন দেখলাম ও আসা বন্ধ করেছে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাবার ছাত্রের সংখ্যাও কমে এল চোখের সামনে গমগমে রোববারগুলি আদুর-গা মুড়ির মত বেরসিক মিইয়ে গেল কাঠের টেবিলগুলো এখন মৃত নদীর মত স্থবীর দাঁড়িয়ে থাকে ওদের গায়ে শ্যাওলার মত লেগে থাকে পুরোনো ছাত্র, বই-নোট্স, ক্ষ্যাপাটে দিনের গন্ধ আমার বুড়ো বাবা প্রত্নতাত্ত্বিকের মত ম্যাগনিফাইং গ্লাসে সেই অস্পষ্ট পায়ের ছাপগুলো খুঁজে বেড়ায় আমি, দিদি, আমরা দুজনেই আজ শিকড় থেকে অনেক দূরে তিনতলা বাড়িটায় আমরা এখন বন্দী কেবল ছবির ফ্রেমে মা নিয়ম করে সেগুলোয় ধুলো মোছে আর আঙুল দিয়ে স্পর্শ করার চেষ্টা করে আমাদের ছেলেবেলা, ফেলে আসা হুলুস্থুলু ফ্ল্যাশব্যাক প্রাণবন্ত কেল্লাটা কবে যে একটা বৃদ্ধাশ্রম হয়ে গেলো, টেরও পেলাম না !

পুরোনো নোনা ধরা দেয়ালে চুন-সুড়কি খসে যাবার মত আজকাল মাঝে মাঝে মৃত্যুর খবর পাই সেদিন শুনলাম বিশ্বনাথকাকু চলে গেলেন খুব যে বয়স হয়েছিল, তা নয় হার্ট অ্যাটাক তার কিছুদিন আগেই মারা গেলেন পাশের বাড়ির সেন কাকিমা ক্যান্সার হয়েছিল জ্যান্ত পাড়াটা চোখের সামনে ধীরে ধীরে কেমন মরে গেল ! আজ কেউ আর পাড়ায় ক্রিকেট খেলে না, ফুটবলে লাথি মারে না বিকেলবেলা কালো পিচের রাস্তাটা মৃত নদীর মত শুয়ে থাকে, যেমন ফ্যালফ্যাল দাঁড়িয়ে থাকে বাবার পড়ানোর টেবিল      

আমার কাছে আমার পাড়াই কলকাতা কক্ষচ্যূত আমি দূর থেকে উপগ্রহের মত দেখে চলি আমার ভাঙাচোরা শহরে কীভাবে প্রতিদিন জলগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে এক একটা নৌকো ছড়িয়ে পড়ছে এটলাসের নানান কোণে, নীলের সন্ধানে মরুভূমির বুকে ফণিমনসার মত মাথা তুলে একা দাঁড়িয়ে আছে আমার বৃদ্ধ সোনার কেল্লা সেখানে এখন চিতোর রাণার মত রাত-দিন পাহারা দেয় আমার বুড়ো বাবা-মা আর একটা ঝাঁকড়া চুল মাধবীলতা


Comments