সব ভালো যার | দূর্বা সরকার





কফি তে চুমুক দিয়ে পাত্রের মামা জিজ্ঞেস করলেন,"গ্রামের দিকের স্কুলে গেলে কেন?" পাত্রী বললো,"সবচেয়ে কাছে এই স্কুলটাই ছিলো, আমাদের বাড়ি থেকে মাত্র পাঁচ কিমি।" মামাবাবু বললেন,"লোক গ্রাম থেকে শহরের দিকে যায়, তুমি তো উল্টে শহর থেকে গ্রামে গেছো। তোমারই পরে অসুবিধা হবে। কলকাতার দিকে স্কুল নিতে পারতে।" পাত্রীর বাবা বললো,"কলকাতার দিকে স্কুল নিতেই পারতো, ওর তো সব অপশন ছিলো, রাজারহাটের একটা ভালো স্কুল পেয়েছিলো। কিন্তু এতবছর বাইরে থেকেছে, তারপর আবার বাইরে থাকা! বাড়ি থেকে সহজে যাতায়াত করতে পারবে বলেই ...." মামাবাবু একটু ভ্রু কুঁচকে বললেন,"স্কুল সিলেক্ট করার সময় খেয়াল করতে হতো, মেয়েদের বিয়ের কথা খেয়াল করে এই স্কুলটুল সিলেক্ট করা উচিত। তোমার কলকাতার স্কুল নেওয়া উচিত ছিলো।" পাত্রীর চোখ চকচক করে উঠলো, ঠোঁটের কোনা সামান্য কেঁপে গেলো, কিন্তু কিছু কথা ফুটলো না।
সদ্য বিকেল। পাত্রপক্ষের আজ সেকেন্ড ভিজিট। প্রথমদিন পাত্র এক বন্ধুর সাথে এসে দেখেশুনে গেছে। আজ দ্বিতীয় দফা, আজই পাকাকথা হয়ে যেতে পারে। আজ এসেছে সাতজন। পাত্রের মা, বাবা, জ্যাঠা, মামা, দিদি, জামাইবাবু আর তাদের বছর আটের পুচকি মেয়ে। সবার হাতে কফির কাপ, পুচকির হাতেও। সিঙাড়া-মিষ্টি ও এসে গেছে। সবার মুখ সমানে চলছে।
জামাইবাবু বাটার কুকিজ-এ কামড় দিয়ে বললেন,"তুমি তো কলকাতায় পড়াশোনা করেছো?" পাত্রী মাথা নেড়ে সায় দিলো। পাত্রীর বাবা বললো,"ও অনার্স আর মাস্টার্স দুটোই কলকাতায় থেকে করেছে।" জামাইবাবু মাথা নেড়ে বললেন,"হু! পড়াশোনার জন্য সেই কলকাতায় যেতেই হয়। ভালো স্কুল-কলেজ-ইউনিভার্সিটি সব কলকাতায়।" পাত্রীর মা বললো,"আমাদের স্কুলের লাইব্রেরীয়ান রঞ্জনবাবু একদম স্কুলের পাশেই থাকতেন। মেয়েকে কলকাতার এক স্কুলে ভর্তি করে এখনকার বাড়ি বিক্রি করে ফ্ল্যাট নিয়েছেন। সে স্কুলে নার্সারি থেকে টুয়েলভ অবধি পড়ে বেরোবে মেয়ে। এখন রঞ্জনবাবু ডেলিপ্যাসেঞ্জারী করছেন।"
কফি শেষ হলে মিষ্টির প্লেট টা এগিয়ে দিতেই জ্যেঠামশায় হাত দিয়ে ঠেলে দিলেন। পাত্রের মা জানালেন,"দাদা মিষ্টি খাবেন না, হাই সুগার।" পাত্রীর মা ব্যস্ত হয়ে বললো,"এমা! সুগার ফ্রী সন্দেশ আনা হয়েছে তো! আমি ভুলেই গেছি!" পাত্রের বাবা মিষ্টি মুখেই বললেন,"কলকাতায় এখন সব বড়ো মিষ্টির দোকানে সুগার ফ্রী মিষ্টির আলাদা আলাদা স্টাইল, প্রত্যেকের নিজস্ব আইটেম।" পাত্রীর বাবা হাসিতে মিষ্টি মাখিয়ে বললো,"সে তো হবেইকলকাতার দোকান বলে কথা।"
এমনসময় মামাবাবু জিজ্ঞেস করলেন,"রান্না টুকটাক জানো তো তুমি?" পাত্রী চোখ তুলে দেখলো, যেন মনে মনে কলকাতা সফর করে ফিরলো। তার বাবা তাড়াতাড়ি বললো,"ও এমনি সবই  রাঁধতে পারে। তবে ইদানীং কেক বানানোর শখ হয়েছে।" মা ততক্ষণে কেকের প্লেট নিয়েও হাজির। কেকের দেখে পুচকি হঠাৎ "মা" ডেকে উঠলো অনুযোগের সুরে। দিদি বললেন,"আমার মেয়ে মনজিনিস-এর কেক ছাড়া অন্য কেক মুখেই তুলবে না। বাড়ির সামনের মোড়েই একটা স্টল আছে। এখন তো আবার নাম পাল্টে 'মিও আমোর' করেছে। ওকে এ কেক দিয়ে লাভ নেই।" দিদির মা বললেন,"মাইক্রোওয়েভ থাকলে কেক বেক করা কোনো ব্যাপার না।"
জ্যাঠামশায় সন্দেশ ঠুকরে নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,"আপনাদের তো একেবারে হসপিটালের গায়ে বাড়ি। এ হসপিটালে পরিষেবা কেমন?" পাত্রীর বাবা মাথা চুলকে বললো,"এমনি তো ঠিকঠাক, এখানে পেশেন্ট হয় অনেক, ডাক্তার ও আছে; কিন্তু ক্রিটিক্যাল কেস এরা একদম হ্যান্ডেল করে না। সব কলকাতা পাঠায়।" জ্যাঠামশায় হাসলেন, অভিজ্ঞের মতো মতামত দিলেন,"কলকাতার সরকারি হসপিটালগুলোয় যা রোগীর ভীড় হয়, তা বলার না। তবে বেশ কিছু বেসরকারি হসপিটাল খুব ভালো। আমার এক শালী টাটা মেডিকেল-এ ভর্তি ছিলো। দেখতে গেলাম। সে হসপিটালে তো নর্থ ইস্টের কত পেশেন্ট; বাংলাদেশ, নেপালের পেশেন্টও আসে। ভালো চিকিৎসা করাতে হলে সেই কলকাতাই ভরসা।"
দিদি হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন,"তোমার শাড়িটা কোত্থেকে কেনা? বেশ রং!" পাত্রীর মা গদগদ হয়ে গেলো,"এখানেই, শ্রীনিকেতন এর একটা আউটলেট আছে।" দিদির মত,"শ্রীনিকেতন ভালো। তবে বড়োবাজার গেলে অনেক ভ্যারাইটি আর দাম ও কম। এসপ্ল্যানেড আর গড়িয়াহাটেও। পুজোর সময় তো বাইরের সবাই কলকাতার বাজারে হামলে পড়ে।" পাত্রীর মা আরো খানিকটা গলে গেলেন,"ওর বিয়ের বাজার তো আমরা কলকাতা থেকেই করবো।"
পাত্রের বাবা শেষ আইটেম হিমসাগর আমের টুকরো কাঁটা চামচে বিঁধে বললেন,"তুমি ভালো গান গাও শুনলাম। কার কাছে শিখতে? অনুষ্ঠানে গাও নাকি?" উত্তরে পাত্রীর বাবাই বললো,"না না, এখানে কি আর কলকাতার মতো অত অনুষ্ঠান হয়? ও বাইরে কোথাও গায়ও না। ভালো গুরু এখানে তেমন নেই। তবে ও শেখে যার কাছে, তিনি কলকাতায় শেখাতেও যান।" "কি গান গাও?" প্রশ্ন মামাবাবুর। সাথে সাথে মা বলে দিলো,"রবীন্দ্রসঙ্গীত"।
জামাইবাবু কেকের প্লেট নামিয়ে একটু উশখুশ করে উঠলেন,"আমরা ট্রেন কখন ধরতে পারি ?" পাত্রীর বাবা হাতঘড়ি দেখে বললো,"ট্রেনের দেরি আছে। আরো মিনিট কুড়ি পর রওনা দিলেই পেয়ে যাবেন। এ লাইনে ট্রেন ঘন্টায় একটা করে যায় আসে। সমস্যা।" জ্যাঠামশায় শোনালেন,"সে তো, মুশকিল! এই জন্যে কলকাতায় থাকা সবচেয়ে সুবিধাজনক। সবরকম সুবিধা একেবারে হাতের মুঠোয়।"
পাত্রী চোখ পাপোশে রেখে ধীরে কিন্তু স্পষ্টভাবে বললো,"কলকাতায় থাকতে পারা সবদিক দিয়েই ভালো, মরলেও নিমতলা আছে, রবীন্দ্রনাথকে পোড়ানো হয়েছিলো যেখানে, সেখানেই পোড়ার চান্স পাওয়া কত্ত ভালো!
সবার মুখ নড়া একদম থেমে গেলো।




Comments