দত্তদের বেড়াল - নীলাঞ্জন দরিপা




Dolchhut weekly


সদর দরজা দিয়ে ধীরে বেরিয়ে গেল দত্ত দের বেড়ালটা। পোয়াতি। বাঁ হাতে তুলে রাখা ঝাঁটা নামিয়ে, ডানহাতে খিড়কি দিল ঝিমলী। ভেতরে দোতলার রেলিং থেকে তখনো শান্তার গলার আওয়াজ আসছে জোরে, "আটকুড়ির বিটি, মাগী, ঘরটা খেয়ে দিলি রাক্ষুসী!" ঝিমলীর শাড়ীর নিচ থেকে সায়া বেরিয়ে আছে, কোমরে ছেঁড়া আঁচলটা গুঁজে সরু গলিপথে ফিরে কুয়োতলায় এসে দাঁড়ালো ঝিমলী। মেজবৌ জল তুলছে। পাশে তার বড় খোকা। "মুখপুড়ি, বড়দিভাই এর কথা তোর কানে ওঠে না" - মেজবৌ এর হাত ধরে একটা হ্যাঁচকা টান মেরে হেঁশেলের দিকে এগিয়ে গেল ঝিমলী। খালি হাঁড়িতে জল ফুটছে উনুনে। ধোঁয়া উঠছে, পাশের বাড়ির আকাশে।

পালদের মেজো মেয়ে ঝিমলী, ভালো নাম ভোটার কার্ডে না থাকলে ল্যাঠা চুকে যেত। তিন মেয়ে, তিন ছেলে। ছেলেরা সংসার করছে সব বাপের ভিটেয়। ছোটো মেয়ে শ্বশুরবাড়িতে মাসে দু-তিন দিন থাকে। তা বাদে বাপের বাড়িই তার ঠিকানা। যদিও বাপ গেছে অনেকদিন হলো।  মেজবৌ ছোটোবৌ চোখে দেখে নি, বড় দেখেছে তবে টুকাই হবার আগেই বাবা চলে যান। বাকি দু বোন, মানে শান্তা আর ঝিমলীর বিয়ে হয় নি। শান্তা সেই আমলের গ্র্যাজুয়েট, তাও নাকি তার পাত্তর জোটে নি, পাড়ায় কানাঘুষো চলে, একটা ব্যাটাছেলে নাকি বেঁচে গেছে এ মেয়ে আইবুড়ো থাকায়। সে নিন্দে শুচিবাই শান্তার কানে পৌঁছয় কি না জানা নেই। শাশুড়ি মালা জপে আর নকুলদানা গুনে দিন কাটান। বাড়িটা প্রায় দেড়শ বছরের পুরনো। এ তল্লাটে নতুন বাড়ি নেই অবিশ্যি বিশেষ।

শাশুড়ি ছাদে বড়ি আর চুল শুকোচ্ছিলেন। হঠাত কার্নিশে মুখ বাড়িয়ে নিচে কুয়োর দিকে কি যেন দেখলেন। ছোটবাবু আপিস বেরোলেন, শনিবার, হাপ বেলা আপিস। সদর খোলা পড়ে রইলো, শাশুড়ির চোখ উঠোনের দিকে ফিরতে ফিরতে হঠাত থমকে গেলো।  দত্তদের বেড়ালটা উঠোনের পাঁচিলে, মুখে একটা কি নিয়ে টানছে। পাঁচিল থেকে বাথরুমের চালে লাফটা দিতেই আঁতকে উঠলো বুড়ি। পোয়াতির মুখ থেকে এঁটো-কাঁটা পড়ল না তো তুলসী মঞ্চের গায়ে ?

মেজবৌ মেজননদের হাতের টানে কুয়োর পাড়ে পড়ে যাচ্ছিল প্রায়, কোনমতে সামলে, বসে যেন নিস্তার পেল খানিক। গেল মাঘে হয়েছে ছোট খোকা। এখনও শরীরে এত ধকল নেয় না তার। বড় খোকা মায়ের হাত ধরে দাঁড়িয়েছিল চুপচাপ, এমন সময় পাঁচিল বেয়ে বেড়ালটাকে দেখতে পেল সে। মুখে একটা মাছের ছাল তুলে এনেছে কোত্থেকে।  ওপরের ভাঙাচোরা রেলিং থেকে একটা নারকেলের ভাঙ্গা খোলা আর একটা তীক্ষ্ন চিত্কার উড়ে এলো একই সাথে, বেড়ালটাকে লক্ষ্য় করে, "মরিস না কেন অভাগী, মর; মর তুই !" বেড়ালটা শান্তার নারকেলের খোলার থেকে অন্তত দু হাত দূরে নির্বিকার ভাবে থাবা চেটে একটা লম্বা লাফ দিয়ে পড়লো বাথরুমের চালে। সেখান থেকে আরেক লাফে সদর দরজার গলি।

এইসব গলি গুলো; অন্ধকার স্যাঁতস্যাঁতে পচে যাওয়া সংস্কারের আখড়া গুলো, অহংকারী অভিমানী দারিদ্র্য় গুলো খুব ধীর পায়ে কিন্তু খুব অবজ্ঞার সাথে পার করে বেড়াল। বেড়াল এ সমস্ত গলি গুলো ভালবাসে, এফোঁড় ওফোঁড় করে বেরিয়ে যায় বদনাম নিয়ে, কাল্পনিক মালিকের বাড়ি। মেজবৌয়ের বড়খোকা বড় বড় চোখ মেলে দেখে, মেজপিসী ঝাঁটা হাতে তাড়া করে দত্তদের বেড়ালকে। মেজপিসি মাকেও তাড়া করে, মা ভয় পায়।  খোকা তাই বেড়ালকে ফলো করে। বাঁ হাতে তুলে রাখা ঝাঁটা নামিয়ে, ডানহাতে খিড়কি দেয় ঝিমলী।

শুধু, দত্তদের বেড়াল দত্তদের ঘরে ঢুকে পালদের বেড়াল হয়ে যায়।
|

Comments