Script - Robot - Sayantan Bhattacharya

   
Dolchhut weekly
 
রোবট

চরিত্র-
অসীম: ষাটোর্দ্ধ, মোটার দিকে, চশমা আছে, হাল্কা ঝুঁকে হাঁটেন।
জিষ্ণু: অসীমের ছেলে। চল্লিশোর্দ্ধ, বাবার সাথে মুখের মিল আছে। স্যুটেড বুটেড হয়ে প্রাইভেট ফার্মে চাকরি করে, মুখে ক্লান্তির ছাপ।
শ্রীতমা: জিষ্ণুর কলিগ। ফর্সা, রোগা, সুন্দরী নয় কিন্তু বেশ স্মার্ট।
শ্রেয়সী: জিষ্ণুর স্ত্রী। সুন্দরী কিন্তু মুখে মধ্যবয়স থাবা বসাতে শুরু করেছে।
ডাক্তার: কোঁকড়া চুল, ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি, কালোর মধ্যে সুন্দর মুখাবয়ব।
ঋদ্ধিমান: পঁচিশ- ছাব্বিশের ছোকরা, অসীমের অসমবয়সি বন্ধু, ছটফটে, ঠোঁটকাটা।

দৃশ্য- ১ (সকাল)
আউট অফ ফোকাস হাসপাতালের মধ্যে মানুষের ব্যস্ত দৌড়ঝাঁপ দেখা যায়। মানুষের ইনঅডিবল কোলাহল, অ্যাম্বুলেন্সের শব্দ, হার্টবিট মাপার যন্ত্রের বিপ বিপ ছাপিয়ে নেপথ্যে শোনা যায় জিষ্ণুর কন্ঠস্বর।
জিষ্ণু: ডাক্তারবাবু, বাবা ঠিক হয়ে যাবে তো?

কাট টু
দৃশ্য- ২ (সকাল)
অসীমের বেডরুম, অসীম খাটে বসে আছেন একা। গায়ে একটা ময়লা স্যান্ডো গেঞ্জি, সাথে লুঙ্গি। খাটের সামনের টেবিলে একটা ফুলদানি আর গাদা ওষুধের স্ট্রিপ, দেওয়ালের গায়ে চে গ্যেভারা'র একটা ফটো টাঙানো কিন্তু সেটায় আলাদাভাবে কোনো গুরুত্ব দেওয়া হবেনা।
অসীম: কি ভেবেছিস কি তোরা? কিছু বুঝিনা আমি? অপদার্থ, অপদার্থ জন্ম দিয়েছি একটা! খাবোনা আমি এসব, নিয়ে যা সব, নিয়ে যা!
[অসীম টেবিল থেকে ছুঁড়ে অষুধগুলো সব মাটিতে ফেলে দেন। শ্রেয়সী ঘরে ঢোকে, তারপর মেঝেতে বসে ওষুধগুলো কুড়োতে থাকে।]
শ্রেয়সী: বাবা, তোমার এখন এত উত্তেজিত হওয়া ঠিক না, একটু বোঝো!
অসীম: সব বুঝি আমি। একটা কিচ্ছু বাদ দিলেনা বৌমা অ্যাঁ! আর কটাদিনই বা বাঁচতাম? কি ক্ষতি করেছিলাম তোমাদের?
শ্রেয়সী: তুমি একটু ঠান্ডা হও বাবা, চা বানিয়ে দেব?
[অসীম শ্রেয়সীকে পাত্তা দেয়না, সে বলতেই থাকে একা একা]
অসীম: হার্ট, লাঙস, কিডনী কিচ্ছু বাকি রাখল না। ভেবেছিস মেশিন বসালেই তোদের গোলাম হয়ে যাবো? ওরে আমি তোর বাবা, তুই আমার বাবা নোস!
[শ্রেয়সী আর বাক্যব্যয় না করে ওষুধগুলো টেবিলে রেখে পাশের ঘরে আসে এবং এসে জিষ্ণুকে ফোন করে।]

কাট টু
দৃশ্য- ৩ (সকাল)
জিষ্ণুর অফিস। টেবিলের উপরে জিষ্ণু মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে। সামনে ফোকাসে মোবাইল ফোন, জিষ্ণুর উল্টোদিকে শ্রীতমা বসা।]
শ্রীতমা: এখনো?
জিষ্ণু: পাগলামোটা দিনকে দিন বেড়েই যাচ্ছে, কিভাবে এসব বিদঘুটে জিনিস মাথায় ঢোকে কে জানে!
শ্রীতমা: সেরেব্রাল অ্যাটাক ব্যাপারটা বেশ সিভিয়ার, আমার এক মেশোর হয়েছিল। ডাক্তার কি বলছে?
জিষ্ণু: দেখতে চাইছিল, বাড়িতে ডাকতেও ভরসা পাচ্ছিনা যা ভায়োলেন্ট হয়ে আছে। আমার যে কি অবস্থা হচ্ছে ভাবতে পারবি না!
শ্রীতমা: তুই বরং নেক্সট উইকটা ছুটি নিয়ে নে, আমরা এই দিকটা ম্যানেজ করে নিচ্ছি।

কাট টু
দৃশ্য- ৪ (বিকেল)
একটা সুদিং আবহ'র সাথে জিষ্ণু ফাঁকা রাস্তা দিয়ে হাঁটতে থাকে। গরমে তাকে স্যুটে বেশ বেমানান দেখায় কিন্তু হাঁটতে তাকে হবেই। দেখতে দেখতে দৃশ্য পালটে জিষ্ণুর জায়গায় দেখা যায় অসীম হাঁটছে। তার পরনে পাঞ্জাবী- পাজামা, কাঁধে ঝোলা ব্যাগ, হাতে সিগারেট। অসীম হাঁটতে হাঁটতে খেয়াল করে তার কানে একটা অস্পষ্ট কীর্তনের আওয়াজ ভেসে আসছে। অসীম হাঁটতে থাকে আর তার তালে তালেই একে একে কীর্তন, আজান, খ্রিশ্চিয়ান চ্যান্ট সবকিছু একসাথে মিলেমিশে তীব্র হতে থাকে। অসীম ভয় পেয়ে দৌড়তে গেলে আছাড় খেয়ে রাস্তায় পড়ে যায়- কোনোমতে সামলে উঠে সে দেখে পা টা বাড়ি খেয়েছিল মাটি ফুঁড়ে দাঁড়িয়ে থাকা একটা শিবলিঙ্গে। অসীমের এবার চারিদিকে চোখ যায়, তাকে ঘিরে কখন যেন গোল করে গাদা গাদা শিবলিঙ্গ মাটি ফুঁড়ে চাড়া দিয়েছে।
অসীম: সিফিলিস...সিফিলিস...সংখ্যালঘু ভেবে ইয়ার্কি পেয়েছ? সব জানি শালা, সব!
আচমকা পেছন থেকে ডাক্তারের গলা ভেসে আসে। অসীম চমকে পিছন ফিরে দেখে ডাক্তার অ্যাপ্রন, হাতে গ্লাভস, মাথায় সার্জিকাল ক্যাপ, মুখে মাস্ক পরে দাঁড়িয়ে আছে।
ডাক্তার: অসীমবাবু..নিন, এই ওষুশ ক'টা খেয়ে নিন তো! বিশ্বাস করুন, কোনো সাইড এফেক্ট নেই।
[ডাক্তার ওষুধ দেওয়ার মত করে মুঠো খুলে তার হাতটা অসীমের দিকে এগিয়ে দেয়। সেই মুঠোতে ওষুধের বদলে রয়েছে গাদা গাদা তাবিজ-কবচ-ঈশ্বরের ছবি দেওয়া লকেট।]

কাট টু
দৃশ্য- ৫ (রাত্রি)
জিষ্ণুর বেডরুম। অন্ধকার ঘরে আচমকা বেডসাইড কমলা ল্যাম্পটা জ্বালিয়ে দেয় অসীম, তারপর জিষ্ণুর পায়ের কাছে এসে দাঁড়াতেই জিষ্ণু, শ্রেয়সী- দুজনেরই ঘুম ভেঙে যায়।
জিষ্ণু: কি ব্যাপারটা কি? এত রাত্রে-
অসীম: রিমোটটা কোথায়?
জিষ্ণু: কিসের রিমোট?
শ্রেয়সী: বাবা, তুমি একটু বোসো, জল আনছি।
অসীম: হাহ, জল না চরনামৃত? সব ধরে ফেলেছি আমি। ভেবেছিলি সার্জারীর নাম করে ভেতরে কয়েকটা মেশিন ভরে দিলেই আমায় কন্ট্রোল করতে পারবি! আমার নাম অসীম ঘোষ, তুই নিজে ওই বুর্জোয়াদের চাকর হয়েছিস বলে ভেবেছিস আমাকেও তোর কথামত উঠতে- বসতে হবে!
[ঘরের আলো জ্বলে ওঠে। শ্রেয়সী এক গ্লাস জল নিয়ে অসীমের দিকে এগিয়ে দেয়।]
শ্রেয়সী: তুমি কি কোনো স্বপ্ন টপ্ন দেখেছো?
অসীম: স্বপ্ন! ন্যাকামো হচ্ছে! শোনো বৌমা, লাইফে কোনোদিন কারো কাছে মাথা নামাইনি, এই শেষ বয়েসে এসে ঠাকুরঘরে মাথা কুটবো ভেবোনা।
জিষ্ণু: তুমি চুপ করবে! রাতবিরেতে যতসব জ্বালাতন!
অসীম: চলে যাবো, আগে বল কোন রিমোট দিয়ে আমার মাথাটা খাচ্ছিস? আর কোনো উপায় পেলিনা! ঈশ্বরের ভয় দেখাচ্ছিস আমাকে!
জিষ্ণু: রিমোট আলমারিতে আছে, কাল সকালে নিও, এখন নিজের ঘরে যাও।
[অসীম কিছুক্ষন বোকার মত চুপ করে থেকে ঘর থেকে ধীর পায়ে বেরিয়ে যায়।]
অসীম: "রিলিজিয়ন ইস দি ওপিয়াম অফ দ্য পিপল"..খেয়েছো কি ডুবেছ..আমারো নাম অসীম ঘোষ.."রিলিজিয়ন ইস দি ওপিয়াম অফ দ্য পিপল"...
ফেড টু ব্ল্যাক

দৃশ্য- ৬ (সকাল)
একটা ফাঁকা খেলার মাঠ, তারই একটা বেঞ্চে অসীম আর ঋদ্ধিমান বসে আছে। অসীমের মাথা নিচু করা, যেন বকা খেয়েছেন এইমাত্র। ঋদ্ধিমানের যে মাথা গরম সেটা তার হাবভাবে বোঝা যাচ্ছে।
ঋদ্ধি: আর ইউ নাটস! একটা অর্গান রিপ্লেস করতে কত খাটনি হয় জানো! কত খরচা পড়ে জানো! বেকার জিষ্ণুদা'র মাথা খারাপ করছ!
অসীম: পাকা পাকা কথা বলিস না, তুই জানিস উইদাউট কনসেন্ট মানুষের উপর কতরকমের এক্সপেরিমেন্ট হয়? লোবাটমির নাম শুনেছিস?
ঋদ্ধি: তোমার হিসি কেমন হচ্ছে?
অসীম: নর্মাল যেমন হয়।
ঋদ্ধি: শ্বাসকষ্ট হচ্ছে?
অসীম: আগের মতই, একটু বেশি খাটলে দম কমে আসে।
ঋদ্ধি: খিদে কেমন পায়?
অসীম: ঠিকঠাক। তোর বক্তব্যটা কি-
ঋদ্ধি: মাথা? সাইনাসের যন্ত্রণা হয়?
অসীম: না মানে, সেরকম তো কিছু...
ঋদ্ধি: বুক ধড়ফড় করে?
অসীম: চিৎকার করার পরে, এমনি নর্মাল।
ঋদ্ধি: তবে তোমার কেন মনে হচ্ছে এই সমস্ত অর্গান মেশিনের?
অসীম: জানিনা, ভগবানকে ভয় করে খুব। ওই অপারেশনটার পর থেকেই দেখছি তোর জিষ্ণুদা রা কিসব খাওয়ায় আর আমার ভয়ানক অসহায় লাগে। আগে এমন হতনা জানিস, ভয় বলে কিছু ছিলনা শরীরে!
ঋদ্ধি: অসীম জেঠু, ছোটোবেলা থেকে তোমার কোলেপিঠে মানুষ হয়েছি। গাদা রেসপেক্ট করি তোমায়, ভালোবাসি। মরার সময় পাগল হয়ে মোরো না, প্লিজ ডাই উইথ সাম ডিগিনিটি!
অসীম: তুই খুব উদ্ধত জানিস তো, অন্য কেউ হলে থাবড়ে গাল লাল করে দিতাম!
ঋদ্ধি: একটা শিবঠাকুরের মুর্তির সামনে কনফিডেন্স হলুদ হয়ে যাচ্ছে তিনি এসেছেন আমায় থাবড়াতে! চলো, আমার পড়া আছে ন'টা থেকে, তোমায় ঘরে দিয়ে আসে।
অসীম: তুই যা, আমি আরেকটু বসব।
ঋদ্ধি: শিওর? জিষ্ণুদা বলেছিল একা না ছাড়তে।
অসীম: আমি পারব, তুই যা।
[ঋদ্ধি চলে যায়। অসীম কিছুক্ষন একা একা পাথরের মুর্তির মত বসে থাকে। তারপর কাঁদতে শুরু করে।]
অসীম: হে ভগবান, এ কি হল আমার! হে ভগবান..হে ভগবান...
[অসীম কাঁদতে কাঁদতে হঠাৎ থেমে যায়, তারপর মুখটা গম্ভীর করে, চোখের জল মুছে উঠে দাঁড়ায়।]

কাট টু
দৃশ্য- ৭ (সকাল)
অসীমদের ছাত। অসীম কার্নিশের একদম কোনায় দু-হাত সোজা করে দাঁড়িয়ে আছে। সেখান থেকে একটু দুরত্বে জিষ্ণু, শ্রেয়সী, শ্রীতমা, ডাক্তার, ঋদ্ধিমান একটা হাফ সার্কেল করে অসীমের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে কিন্তু কেউ এগোনোর সাহস পাচ্ছে না। এখন এটা বাস্তবও হতে পারে, অসীমের কল্পনাও হতে পারে, সেটা ক্ল্যারিফাই করার দরকার নেই।

জিষ্ণু: বাবা, এসব কি পাগলামো হচ্ছে! প্লিজ নেমে এসো ওখান থেকে!
শ্রেয়সী: বাবা, নেমে এসো, চলো ঘরে চলো, চা বানাই।
ডাক্তার: আপনার এত এক্সাইটমেন্ট এখন ঠিক নয়, ওষুধগুলো ঠিকঠাক খেয়েছিলেন তো?
শ্রীতমা: এগুলো সব ডিপ্রেশন থেকে আসে মেশোমশাই, আপনি বরং কটা দিন ছুটি নিন।
ঋদ্ধি: কাম অন জেঠু, ডাই উইথ সাম ডিগনিটি, সুইসাইড কাওয়ার্ডরা করে!
[অসীম কিছুক্ষন সবার দিকে হাসিমুখে তাকিয়ে থাকে।]
অসীম: তোরা কেউ বিশ্বাস করলি না আমায়, উলটে আমার বিশ্বাসটাকেই পালটে ফেলার চেষ্টা করলি। হয়না ওভাবে, বছরের পর বছর ধরে জন্মানো একটা বিশ্বাসকে শুধু কয়েকটা যন্ত্র দিয়ে রেগুলেট করা যায়না। তোদের ঈশ্বরের মুখে মুতি আমি! আমার নাম অসীম ঘোষ- আমি কম্যুনিস্ট ছিলাম, কম্যুনিস্ট আছি, কম্যুনিস্ট থাকবো।
[অসীম চোখ বন্ধ করে পরম শান্তির সাথে ঝাঁপ দেয় ছাত থেকে। আচমকা গোটা স্ক্রীন অন্ধকার হয়ে যায় আর আমরা শুনতে পাই অনেক যন্ত্রাংশ ভেঙে পড়ার কর্কশ, ঝনঝন শব্দ। স্ক্রীনে অল্প অল্প করে সিনেমার নাম ভেসে ওঠে- "রোবট", ব্যাকগ্রাউন্ডে বিটলসের "ওয়র্কিং ক্লাস হিরো ইজ সামথিং টু বি...]

শেষ
||

Comments

  1. ছবি টা স্পষ্ট দেখতে পেলাম। এটার একটা শর্ট ফিল্ম দিব্ব্যি হত

    ReplyDelete

Post a Comment