বর্ষার গল্প । জয়ন্ত দেবব্রত চৌধুরী
| |
“অনেকদিন অর্থাৎ
কয়েকদিন থেকেই ভাবছি বর্ষা নিয়ে একটা গল্প লিখে ফেলা যাক। কিন্তু কী লিখব কিছুতেই
মাথায় আসছে না। অথচ না লিখলেও নয়! এম্নিতে বর্ষা আমার বিশেষ পছন্দের কিছু নয়,
অপছন্দেরও বটে। কিন্তু এবার— বৃষ্টি পড়লেই
তাড়না, নিজেকে নিজের; কাদাপায়ে জল ঠেলতে ঠেলতেই চোখে স্বপ্ন, নাকি মাথায়, চোখভর্তি
স্বপ্ন বলাই প্রচলিত যখন। ‘একমাথা স্বপ্ন’ লিখলেই আড়ংধোলাই এবং/অথবা তির্যক হাসির
আতঙ্ক। তাছাড়া বর্ষা সবারই প্রিয়, বিশেষত কবিগুরুর, আর আমার সহকর্মীদেরও। হাবিজাবি
যাহক লেখাও এক্ষেত্রে অচল, লেখার আবার ব্যাকরণ-হাম্বাকরণ প্রভৃতি মানার দায় রয়েছে!
মানসিক আর মানবিক পরিবর্তনের কার্যকারণ হিসেবে আপাতত প্রেমকেই দর্শানো সোজা। এখন
থেকে ঠিক সতেরো দিন পনেরো ঘণ্টা আগে প্রেমে পড়বার স্মৃতি এখনও মাথায় তাজা। প্রেমের
সাথে বর্ষার, বর্ষার সাথে হৃদয়ের সম্পর্ক নির্ধারণ করবার চেষ্টা অর্থহীন, অন্তত
যুক্তিহীন। আমার কাছে আপাতত বর্ষাই প্রেম। বর্ষা আসার আগে আমি গ্রীষ্ম, শরৎ, শীত
আর বসন্ত মিলিয়ে মোট দেড়বার শুধু প্রেম করেছি। অঙ্কের ছাত্র আর মুদিখানার
দোকানীদের খোলসা করে বলাই বাহুল্য যে আমার আস্ত প্রেম মোটে একটা। ওর নাম ছিল
মালঞ্চ, এম্নিতে ভালোই, কিন্তু সমস্যা ছিল দ্বিবিধ। প্রথমত আমার কোষ্ঠীতে
পষ্টাপষ্টি বলাই আছে যে মালঞ্চ নামের মেয়ের সংসর্গ নিষিদ্ধ, দ্বিতীয়ত আমার মায়ের
আবার জ্যোতিষে বিশ্বাস অগাধ। প্রতিকারের কোনো উপায়, কবচ কিম্বা পাথর-টাথর, আছে
কিনা জানতে লজ্জা করেছিল সেবয়সে। কাজেই! যাই হোক, ছাতে বসে ডেকচেয়ারে দোল খেতে
খেতে বর্ষাকে আসতে দেখার আগে প্রেম ব্যাপারটা ঝাপসামতো ছিল মনের কাছে, কান্নাচোখে
রাস্তা চলার মতন। এবছর বর্ষা—”
দশ টাকা দামের পাঁচবছর বয়সী খাতাটা বেশ পাক খেয়ে খেয়েই মাটিতে পড়ছিল কয়েক
মুহূর্ত ধরে। ও যদিও সেদিকেই তাকিয়েছিল, কিন্তু দেখছিল না। বস্তুত কিছুই দেখছিল
না। দূর দূর এভাবে জোর জবরদস্তি করে কি লেখালেখি হয়! অথচ না লিখতে পারলে হেরে
যাওয়াই প্রকারান্তরে। বানিয়ে বানিয়ে গল্প লেখার চেয়ে ফিচার লেখা ঢের ঢের সোজা। আর
কে যেন বলেছে সমস্ত লেখাই আসলে আত্মজৈবনিক! বোগাস! বাজে কথা যত! ও এসব একেবারেই
বিশ্বাস করে না। ‘গল্প’ লিখতে হলে লেখা উচিৎ বানিয়ে, গল্পের চরিত্ররা যেন লেখকের
মনের কথা না প্রকাশ করে, ওরা যেন গল্পকারের হাতের সুতোর টানে এদিক ওদিক ছোটে!
নিজের কথা লিখলে আর ‘গল্প’ কি? সে তো সবাই পারে। নিজের তো কত কথাই বলার থাকে।
তাহলে চিঠি লিখলেই তো হয়, পোস্ট না করলেই মিটে যায়। ও যখন ছোটবেলায় বর্ষার রচনা
লিখেছিল, বাংলাস্যার ক্লাসে ওটা পড়ে শোনাবার সময় অনেকের চোখে ও ঈর্ষা দেখেছিল,
জীবনে প্রথমবারের মতন। ভগবান হবার সুখ ছোট্ট মাথা পুরোপুরি ধরতেও পারেনি, তাও চোখে
জল এসেছিল, খুশিতে। সেসব ব্যাপার ভাষা-টাষা দিয়ে লিখলেই আজ তা সাহিত্যে পরিণত হবে
এ বিশ্বাস ওর নড়বড়ে। একবার ও ‘দেবদূত’ নামের একটা গল্পে লিখেছিল একটা বাচ্চা ছেলের
ফড়িংদের ধরে পাশবিক সব খেলার কথা। সেটা পড়েই, অর্ণবদা, ওদের অফিসের, যখন ওর মুখের
দিকে খানিকক্ষণ হাঁ করে তাকিয়ে নরমগলায় জিজ্ঞাসা করেছিল যে আসলে শিশুটি ও নিজেই কিনা
তখন খুব রাগ হয়েছিল, লজ্জা ঢাকতে গিয়ে। সেই থেকে আর না! ও উত্তমপুরুষেই লিখবে
স্থির করেছিল, যেন বা নিজের কাছেই অকপট স্বীকারোক্তি, যেন বা একখানা না-পড়া খোলা
চিঠি যার লেখক আর প্রাপক দুইই গল্পের ছেলেটাই নিজে। এই তো, চমৎকার! ও নিজে যা যা
নয়, তাই হবে ওর গল্পের হিরো। রোম্যান্টিক, নিজের কথা বলা একজন নরম মানুষ। আইডিয়াটা
দারুণ মনে হয়েছিল, নিজের পিঠও যেন চাপড়েছিল মনে পড়ে, কিন্তু লেখার সময় কী অসহায়!
ভাঙা খাটে শুয়ে কি ডেকচেয়ারে দোল খাবার অনুভূতিকে যথার্থ ধরা সম্ভব? আবার ও কলম
হাতে নিল, খাতাটা মাটি থেকে তুলে ঝেড়ে নেবার পরে। লিখতে তো কিছু হবেই, যা হোক।
“এবছর বর্ষা দেখে আবার লেখার তাগিদ ঝাপ্টা দিচ্ছে বুকের ভেতর। ভেবে দেখলাম,
ঠিকমতন চেষ্টা করলে কতকিছুই হতে পারতাম! ফোটোগ্রাফার হবার শখ ছিল এককালে; সম্বল
ছিল কিছু কমদামী কল্পনা আর একটা দামী ক্যামেরা। হল না স্বাভাবিকভাবেই। আগে লিখতে-টিখতেও
পারতাম একটু একটু। মাঝে লিখতে পারছিলাম না কিছুতেই; পেনের রিফিল ফুরিয়ে গেছিল তো,
তাই। নতুন পার্কার পেন কিনে আবার লিখতে পারছি, অন্তত তাই ধারনা ছিল আজকের আগে…….লোকজনের জ্বালায় শান্তি করে একটু লেখবারও জো নেই!
দরজায় টোকা পড়তে উঠতে হয়েছিল আবার। কথা বলবার ইচ্ছে কম, লেখারই বেশি, তাই দরজা না
খুলেই চ্যাঁচালাম, ‘কে?’ ‘আমি, দরজাটা একটু খুলুন’ ওপাশ থেকে নাছোড়বান্দা গলা।
‘আচ্ছা, আপনি কালকেও এসময়ে এসেছিলেন তো?’ ‘না না, আমি আসিনি।’ ‘বাজে কথা বললেই হল,
কালও কে একজন নাম জিগ্যেস করতেই এই একই নাম বলেছিল। আমি নামের আর কতজন আছে এপাড়ায়?
কাল আসুন, আজ ব্যস্ত। নমস্কার।’”
অন্ধকার ভীষণ। আলো হল হঠাৎ। ঘরে আলো জ্বলছিল আগে থেকেই। আসলে ও চোখ বুজে
ভাবছিল, এখন চোখের পাতা খুলল। হ্যাঁ, এই জায়গাটা বরং আগের চেয়ে ভালো হয়েছে। কিন্তু
ছেলেটা বলছে বর্ষা নিয়ে লিখবে, অথচ ভ্যানতাড়া করছে। অবশ্য এই দায় তো ওর নয়, গল্পের
ছেলেটার। ওর ভুরুগুলো তাও ঈষৎ কুঁচকেই রয়েছে। আচ্ছা, এটাকে যদি গল্পের বদলে
একেবারেই চিঠি অথবা ডায়েরি করে দেওয়া যায়! প্রগতিশীল লেখা বলে চালানো যাবে অন্তত।
ছোটবেলায় স্কুলে বাংলা পরীক্ষার হলে ও আতঙ্কিত
হয়ে দেখত বাকীরা আধঘণ্টা পর থেকেই নতুন পৃষ্ঠা চাইছে লেখার জন্য। কে কত পাতা
নিচ্ছে সেটা থেকেই যেন প্রমাণ করা কে কত ভালো লিখছে। অথচ কোনো বাড়তি পাতা না
নিয়েই, মূলখাতার পৃষ্ঠা বাকী থাকতে খাতা জমা দিয়েই ও বাংলায় ফার্স্ট, বরাবর। বাড়তি
কথা ওর বরাবরই অপছন্দের। প্রিয় লেখক বনফুল, গল্পাণুগুলোই আসল সাহিত্যনিদর্শন।
ছেলেবেলায় একটা নেশাই ছিল নামকরা বাংলা উপন্যাস-গল্পগুলো থেকে অপ্রয়োজনীয় বাড়তি
লাইনগুলো খুঁজে বের করা। জানলার বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে, ও বারবারই একবার জানলার দিকে,
একবার বামহাতের কব্জির দিকে তাকাচ্ছে। হাতের ঘড়িতে সন্ধ্যে সাতটা। সন্ধ্যেটা যদিও
বাইরের অন্ধকার দেখে বুঝল! একবার আড়চোখে দরজার দিকেও চাইল। অন্যের কাহিনী যথাযথ
লেখা এত কঠিন জানলে- গল্পের
ছেলেটার ওপরেও রাগ জমতে শুরু করেছে এতক্ষণে। পরেরবার থেকে এই ‘সেমি অটোম্যাটিক’
স্টাইলে লেখার চেষ্টা বন্ধ করতে হবে। গল্পের চরিত্ররাই গল্পকে নিজেরা টেনে নিয়ে
যাবে আপনা থেকেই, এটাও মেনে নেওয়া যায়না।
“অদ্ভুত ব্যাপার! মাঝরাতে ঘুমের মধ্যেই আবছা কত লাইন মনে পড়ে, আমি লাইট
জ্বালিয়ে উঠে বসি, কিম্বা উঠে বসে লাইট জ্বালাই, ক্রমটা ঠিক মনে পড়ছে না কিন্তু
লাইনগুলো লিখে যে রাখি এটা প্রমাণিত। অথচ একটা লাইন, একটা শব্দও এখানে লাগসই হচ্ছে
না। কতক্ষণ আগে বর্ষা নিয়ে লেখা শুরু করেও শুরু করিনি, এতক্ষণ নিজের কথাই লিখচ্ছি
শুধু। ধ্যাৎ! আচ্ছা, একটা সোজা-সরল এক লাইনের কথা বলবার জন্য কি ভণিতার এত
প্রয়োজন? কথাটা হচ্ছে, আর এই লেখারও শেষ, আমি বর্ষাকে ভালোবাসি। ভালোবাসি ব্যাস,
গুছিয়ে কার্যকারণ দর্শাবার কিছু তো নেই! বর্ষাকে আমি ভালোবাসি।”
‘অসহায়’ শব্দের আভিধানিক অর্থ ‘সহায়হীন’, ‘নিঃসঙ্গ’, ‘একক’। কিন্তু বস্তুটা
আসলে কী সেটা ওকে এখন দেখলে কিছুটা আন্দাজ পাওয়া যেতে পারে। ভুতগ্রস্থের মতন একা
বসেছিল, সামনে মদের গ্লাস। কোথায় শুনেছিল নেশা করলে নাকি সৃজনশীলতা বাড়ে, সেই থেকে
মদ্যপান শুরু, শুধুই লেখার দায়ে। ড্রাগের সাহস-সাধ্য কোনটাই ছিল না বলেই, ও নিজেকে
বোঝায়, নইলে ঠিকই এতদিনে—
সদর
দরজায় কলিংবেল বাজতেই বিষম কেঁপে উঠল ও। এখন সাড়ে সাতটার ভাদ্র। করিডর পেরিয়ে
দরজায় পৌছতে পৌছতে কাঠের ডেকচেয়ার দুলুনি শেষে নিঃস্পন্দ, স্থির। দরজার এপারে ও
একা, ওপারে- ওপারে বর্ষা। ও জানে, নিশ্চিত জানে।| |
Comments
Post a Comment