ইন্টারভিউ - অনুপম মুখোপাধ্যায় পর্ব-১

মৃগাঙ্কশেখর গঙ্গোপাধ্যায়: একটা বিষয় বারবারই দেখা যায়, 'কমার্শিয়াল' এবং আউটস্ট্রিম শিল্পের মধ্যে একটা বিরোধ। এই দু-দিন আগে অর্জুন দার সাথে কথা হচ্ছিল। এখানে মানুষের সমস্যা হল, তারা মাথা খাটাতে চায় না। 'কমার্শিয়াল' বুঝতে মাথাটা খাটাতে হয় না। তা পরিচিত ভাষা। ভাষাটা চলে আসছে। কিন্তু আউটস্ট্রিমের ভাষা পরীক্ষামূলক। সেটা প্রচলিত না হওয়ায় সেই ভাষাকে মেনে নিতে এদের অসুবিধা হয়। যারা পরীক্ষামূলক কাজ করেছেন তাদের কাউকেই সেই সময় মানুষ নেয়নি। এখন ৫০ বছর পরে কি হবে, সেই দূরদর্শিতা আমাদের কারোরই নেই। কিন্তু পরীক্ষা ছাড়া কোন কিছুতেই নতুন কিছু করা সম্ভব নয়। এবার এখানে একটা প্রশ্ন ওঠে, যা অনেকেই আমাকে করেছেন- একটা নতুন চিন্তাকে পুরোনো বা প্রচলিত ভাষায় প্রকাশ করতে কি অসুবিধা? এক্ষেত্রে আমার মত যেটা, কিছুকে খারাপ বা ভালো বলার আগে, সেটা সম্পর্কে একটু জেনে নিলে ভালো হয়। তোমার কবিতার ক্ষেত্রেও কবিতা ভাষার একটা পরীক্ষা দেখা যায়। আমরা যেমন ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’-এর মতো সিনেকবিতা বানাই, তেমনি ‘ব্ল্যাকবোর্ড’-ও। কিন্তু তুমি বরাবর পরীক্ষামূলক লেখালিখিতেই থেকেছ। আমার অনুমান কি ঠিক? 
অনুপম মুখোপাধ্যায় : পরীক্ষা না করে কেউ নিজের কবিতা লিখতে পারে না। কেউই পারেননি। কেউ পারবেনও না। এ নিয়ে আলাদা করে কথা বলতে হয়, এটাই আফশোস, আসলে এ হল আমাদের তাসের দেশ, এখানে ছক্কা-পাঞ্জার বাইরে কোনো মাপ নেই আজকাল। হ্যাঁ, আমি পরীক্ষা করেছি। অনেক করেছি। সেগুলো আড়ালের ব্যাপার। আর এ ব্যাপারে সিনিয়র কবিদের কাছে ঋণও স্বীকার করি। কিন্তু পরীক্ষার স্তরটা পেরিয়েছে এ ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েই একটা কবিতা আমি কোনো পত্রিকায় ছাপতে দিই। পরীক্ষা-কবিতা আমি কখনই ছাপতে দিই না। ওটা আমার কাছে তখনও পর্যন্ত আমার সবচেয়ে সম্পূর্ণ কিন্তু অশেষ কাজ। পরে হয়তো সেই কবিতা আবার অতৃপ্তির জন্ম দেয়। নতুন আর পুরাতন তো অবিচ্ছেদ্য বলে মনে হয় মৃগাঙ্ক। আমি আলাদা করি না ওদের। যেমন আমি আউটস্ট্রীম বা মেইনস্ট্রীম আলাদা করি না। আমি ভাবতেই পারি না একজন রমেন্দ্র কুমার আচার্য চৌধুরী বাংলা কবিতায় বাহিরের লোক, বা একজন স্বদেশ সেন। আমি মনে করি একটা কবিতার বই বা পত্রিকামাত্রই কমার্শিয়াল কারন তাতে দাম লেখা থাকে, তাতে ISSN কোড থাকে। বিক্রিতে আপত্তি নেই। নিজেকে বিক্রয়যোগ্য করে তোলার গাড়লপনায় আমার আপত্তি। একটা বাস বা ট্রেন থেকে যে লোকগুলোকে হুড়মুড়িয়ে নেমে যেতে দেখি, তারা ভাত নিয়ে ভাবে, মাছ নিয়ে ভাবে, মমতা ব্যানার্জিকে নিয়ে ভাবে। তারা বিনয় মজুমদারকে চেনে না। না চিনলেও তাদের কোনো ক্ষতি নেই। এ-দেশে ভালো চালের কদর আছে, কবিতার নেই। কোনো কবিই ইলিশ-ভেটকি বা গলদা চিংড়ির চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নন। গুরুত্ব একমাত্র সামাজিক ব্যাপার। আমাদের এখানে কবিতার কোনো সামাজিক গুরুত্ব নেই। আগামী একশ বছরে হবে বলেও আমি আশা করি না।


মৃগাঙ্কশেখর গঙ্গোপাধ্যায়: তোমার লেখাগুলো কি মানুষের মনে থাকছে? কী মনে হয় তোমার? বা কতদিন থাকবে বলে মনে হয় তোমার?

অনুপম মুখোপাধ্যায় : এর উত্তর কে দেবে? যারা বলছেন আমার কবিতা মানুষ মনে রাখবে না, এটা জেনো তাঁরা কিন্তু আমাকে মনে রেখেছেন, গোচরে রেখেছেন, কারন ওই উক্তি অবধি তাঁদের তো পৌঁছতে হল! ‘মানুষ’ তো একটা বিরাট শব্দ। আমার কবিতা তোমার মনে থাকছে কি? যদি না থাকে, তবে আমার নতুন বইটা তোমাকে তাকে রাখতে হবে কি? যদি না রাখতেই হয়, এই কথোপকথন আমরা কেন চালাচ্ছি? তুমি তো এটা জয় গোস্বামীর সঙ্গে চালাতে পারতে, কারন প্রায় সকলেই ওঁর স্থায়ীত্ব নিয়ে নিশ্চিত, তাই না? মানুষের মনে অনেক জরুরি কিছুই থাকে না। কালস্রোত অত বিচার-টিচার করে না। সে ফ্যাশনেই বেশি থাকতে চায়, কিন্তু স্টাইলের জোর তাকে সেটা করতে দেয় না। ফলে ভাসিয়ে নিয়ে যায়, আবার ফিরিয়েও দিয়ে যায়। যেমন ধরো আজ অধিকাংশ বাঙালি 'মেঘনাদবধ কাব্য' অরিজিনাল ভাষায় আর পড়তে পারে না, তার মানেবই লাগে, একসময়, এই ধরো বিংশ শতকের প্রথমের দিকটায়, বহু শিক্ষিত মানুষ ওটা মুখস্থ বলতে পারতেন, তাঁরা জাঁক করতেন সেটা নিয়ে, সেটা তখনকার ফ্যাশন ছিল, ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ মুখস্থ বলতে পারাটা তখন আজকের দিনে একটা উইন্ডোজ ফোন রাখার মতোই ফ্যাশন স্টেটমেন্ট ছিল, কালস্রোতে তা ধুয়ে গেল, পবিত্র হলআজ প্রেমেন্দ্র মিত্রকে তেমন কেউ  পড়ে না, এটা তিক্ত সত্য, ঘনাদা নয়, তাঁর কবিতার কথা বলছি। অথচ তাঁর সময়ে তিনি জীবনানন্দ দাশের চেয়ে অনেক পঠিত কবি ছিলেন, মানুষের মুখে মুখে ফিরতেন তিনি, সবার উপরে কবিতা ছাপা হত, এ নিয়ে জীবনানন্দর দুঃখও নাকি ছিল শুনেছি। আজ তিনি শুধু ঘনাদার লেখক। আজ বনফুলকে কজন পড়ে? কী জনপ্রিয় গল্পকার ছিলেন তিনি, ভাবো! রবীন্দ্রনাথের চেয়ে বেশি টাকা নিতেন গল্পের জন্য। আজ মানুষ প্রমথেশ বড়ুয়ার সিনেমা আর দেখে কি? একসময়ের ম্যাটিনি আইডল। ওঁর ‘গৃহদাহ’ বাংলা সিনেমার একটা মাইলস্টোন। আন্তর্জাতিক মানের পরিচালক ছিলেন, অভিনেতা ছিলেন। ঋত্বিক ঘটক ওঁর দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন, কেউ আজ মনে রেখেছে? শরৎচন্দ্রকেই কি আজ কেউ তেমন পড়ে? মানুষের ভুলে যাওয়ার তালিকা যদি দ্যাখো, দেখবে মানুষ একটা সময় 'চৈতন্যচরিতামৃত' ভুলে গিয়েছিল, 'চর্যাপদ' ভুলে গিয়েছিল, 'মবিডিক' ভুলে গিয়েছিল, এমনকি কারাভাজ্জিওর মতো লোকের ছবিকেও ভুলে গিয়েছিল। ভাস-এর তুমুল জনপ্রিয় ও 'কালজয়ী' নাটকগুলো হারিয়েই গিয়েছিল বেশ কয়েকশ বছর, পরে আবার সেগুলোর কিছু পাওয়া যায়, তবে বেশির ভাগ নয়, আজও সেগুলোর খোঁজ মেলে না। কোনটা মানুষ মনে রাখবে, কোনটা মানুষ ভুলে যাবে, কোনটা মানুষ মনে রাখবে ভেবেও ভুলে যাবে, কোনটা মানুষ ভুলে গিয়ে আবার মনে করবে... কেউ জানে না। আর সেটা সমকালে বসে বলে দেওয়া অসম্ভব, একেবারেই। আমি যেটা করছি ১০০ % সৎ থেকে করছি। নিজের কবিতার অমরত্বের লোভ আমার অবশ্যই আছে, নিজের জন্য কোনো মুকুট বা মালার লোভ একদম নেই। কাজটা করে যেতে চাই। আমার কাজ। এটুকুই।


মৃগাঙ্কশেখর গঙ্গোপাধ্যায়: তোমার কি মনে হয় না আমরা কতগুলি লিটল ম্যাগাজিন মিলে একটা গোষ্ঠী গড়ে তুলেছি। একটা প্রতিষ্ঠান। সেখানে একটা প্যাটার্নের লেখালিখি হচ্ছে। 'দাদা/দিদি' গড়ে উঠছে। হচ্ছে কি এমন? 
অনুপম মুখোপাধ্যায় : দ্যাখো, সেটা যদি হয়, তাহলেই ভালোই। আমার যতদূর জানা আছে রবীন্দ্রনাথকে কেউ ‘রবি-দা’ বলে ডাকতেন না। বুদ্ধদেব বসুকেও কোনো নবীন কবি ‘বুদ্ধ-দা’ বলতেন কি? না সম্ভবত। দাদাগিরিটা বিচ্ছিরি লাগে মৃগাঙ্ক। করতেও বিচ্ছিরি লাগে, সইতেও পারি না। গোষ্ঠী থাকলে থাকুক, ওভাবে যদি কেউ-কেউ বাঁচে, গোষ্ঠীবদ্ধতার বিশ্রী গন্ধটা না এসে পড়লেই হল, গোষ্ঠীপতিকে পুজো দেওয়ার বাধ্যবাধকতা না থাকলেই হল। এই সময়টা তো একেবারেই রিক্ত। সাহিত্য-সংস্কৃতির নিজেকে টিকিয়ে রাখাটাই আজ চ্যালেঞ্জ। তারমধ্যে সব পত্রিকা মিলে যদি সত্যিই চলা যায়, তাহলেই ভালো।  তবে একই প্যাটার্নের লেখালেখি একটা বিরাট সমস্যা এখন। এটাই এই সময়কে আরো মূল্যহীন করে তুলছে। আজকাল অনেকেই ভালো লেখেন, কিন্তু তাঁদের ভালো লেখায় কোনো ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্য খুঁজে পাওয়া যায় না। লেখা দেখে চেনাই যায় না। কেন লিখছে সেটাও বোঝা যায় না। খারাপ কবিতা লেখার রিস্ক তারা নিচ্ছে না কেন? কবিতা থেকে তারা কী চায় যে অতখানি মাপা পায়ে তারা হাঁটছে? হয়ত অভিনয়, গান, ক্রিকেট ইত্যাদি পারেনি, তাই নাম ফাটানোর জন্য কবিতা লিখতে এসেছে, এমন ভাবতেও লোভ হয়, নিজেকে সামলাতে পারি না। একটা সিনেমা বানানোর বা অভিনয়ের সুযোগ পেলেই কেউ কেউ কবিতাকে লাথি মেরে কি চলে যাবে? হয়তো যাবে। হয়তো নয়, তখনও হয়তো দু-চারটে কবিতা লিখবে শুটিঙের ফাঁকে, রিয়ালিটি শো বানাবে কবিতার তখনএরকম ভাবতেও ভালো লাগে। আসলে এটা পোস্টমডার্ন পরিসরের লক্ষণ। আমি যে পুনরাধুনিক প্রকল্প শুরু করেছি, সেটার পিছনে এই বিরক্তিটাও কাজ করেছে। 'কবিতায় তোমাকে যদি নিজের নামই লিখতে হল, তবে আর তুমি কী কবি হলে ভাই! তোমার লেখাই তো অন্যরা লিখছে! তুমি কী চাও?' ... একজন নতুন কবির  আজ এটা নিজেকে বলা খুব জরুরি। বেপরোয়া হওয়া জরুরি। আবেগ, দায়বদ্ধতা বানিয়ে তোলা খুবই সোজা হয়ে গেছে আজ। ছাপার জায়গা প্রচুর। এবং 'ছাপ্য' কবিতা লেখা একজন শিক্ষিত মানুষের কাছে বাঁ হাতের খেল।

ভিখারি এসেছ

ঘরে চাল নেই

দুটো শব্দ আছে

খাবে?

এরকম কিছু লাইন লিখে ফেসবুকে পোস্ট করলেও তো মনে হয় আজকাল কয়েকশ লাইক পড়ে যায়। লোকজন আজকাল বানিয়ে তোলা আবেগের দিকে ঢলে পড়ছেন বেশি। আসলে কবিতাচর্চা ভয়ানক কমে গেছে আমাদের মধ্যে। পাঠক নেই। সবাই কবি। কবিরা কবিদের খেয়ে বাঁচছে। মেরে খেয়ে বাঁচতে চাইছে কেউ কেউ। তারা শেষ বিচারে কবি নয়। কবিরা নরখাদক হতে পারে না। বহুরূপী হতেই পারে না। কিন্তু, অস্বীকার করা যাবে না, ভয়াবহ পরিস্থিতি!


মৃগাঙ্কশেখর গঙ্গোপাধ্যায়: কিন্তু কবিতার কোনো ডেফিনেশান দিতে পারবে কি? ধরা যাক ‘আমি ভাত খাই / আমি স্নানে যাই’... এই যে ছন্দ মিলিয়ে দু-লাইন এটাও কারো কারো কাছে পদ্য মনে হতেই পারে। আমার তোমার কবিতা মনে হতে পারে ধুর কি বলছে কিছুই বুঝছি না- এগুলো কবিতা! বলো কি বলবে?



অনুপম মুখোপাধ্যায় : পদ্যকে আমি গদ্যের চেয়ে অনেক হ্যাটা করি। পদ্য আদৌ কবিতা নয়, হতেই পারে না। তাছাড়াও, ডেফিনিশন আর সংজ্ঞা আমার কাছে আলাদা কিছুটা। সাহেবরা ডেফিনিশন পছন্দ করে, বাঙালিরা নয়। বিজ্ঞানীরা পছন্দ করেন, কবিরা নয়। সংজ্ঞা অনেক অনির্ণেয় জিনিস। ভারতীয় জিনিস। আমরা বরং ওটাতেই থাকি মৃগাঙ্ক।  দ্যাখো, এটা বলতে বেশ 'কাব্যিক' লাগতে পারে যে, কবিতার সংজ্ঞা কী আমি জানি না, তাই আমি কবিতা লিখি। সেটা নয়। একজন কবি অবশ্যই জানবেন কবিতা কাকে বলে। সেটা জানেন বলেই তিনি কবিতা লেখেন, নাহলে লিখতেন না। কেউ কেউ এই ধারণাটা আগে থেকেই নিয়ে আসেন। তাঁরা শিক্ষিত কবিতালেখক, তাঁরা দক্ষ, তাঁরা জানেন। কেউ এটাকে অর্জন করেন, তিনি দক্ষ নন, শুধু পারেন। আমার কাছে কবিতা হল ধ্বনি এবং শব্দের মধ্যে থেকে যাওয়া ভাষার স্মৃতি। সামাজিক ভাষা যতদূর হতে পারে মুছে গিয়ে স্মৃতিতে পরিণত হয়, এই হল কবিতা। এটা দক্ষতায় হয় না। এর জন্য উন্মাদনা দরকার, অসামাজিকতা দরকার।  যদি কেউ কবিতায় 'না বোঝা'-র অভিযোগ তোলেন, তাহলে তিনি কবিতার নয়, আসলে গদ্যের রসিক। কবিতা হল হোমিওপ্যাথিক ওষুধের মতো, আসলে সেখানে ওষুধটা নয়, শুধু উপশম রয়ে গেছে। আর পদ্যকে কী বলবে? জাপানি তেল গোছের কিছু বলা যাক। হা হা হা হা ...


মৃগাঙ্কশেখর গঙ্গোপাধ্যায়: এখন একটা বিষয় খেয়াল করি কবিতায়। ধর, কিইইই বা ধর চুমুউউউউ এই জাতীয় শব্দ কবিতায় ব্যহার করছেন। মানে কি বা চুমু না লিখে এই কিইইই বা চুমুউউউ লিখছেন। এটা কেন বলতো ?

অনুপম মুখোপাধ্যায় : এটা আমি করি। অন্যরা কেন করেন তাঁরা বলবেন, বা কোথায় প্রযুক্ত হয়েছে দেখে বলতে হবে, আমি করি আমার সেই মুহূর্তের প্যাশনটাকে ধরে রাখার জন্য। ওটা পাঠকের মধ্যে সঞ্চারিত করতে চাই, ওভাবে। তখন মনে হয় না শব্দটা তার প্রচলিত দৃশ্যে আমার প্রয়োজন মেটাচ্ছে, বা ধ্বনিটাও সন্তুষ্ট হচ্ছে।


মৃগাঙ্কশেখর গঙ্গোপাধ্যায়: আর একটা বিষয় যেটা আমাদের কথাবার্তায় একবার এসেছিল। তুমি বারীন দা কে জিজ্ঞেস করছিলে। 'আমি' শব্দের ব্যবহার নিয়ে। আমি শব্দ ব্যবহারে আপত্তি উঠছে কেন?

অনুপম মুখোপাধ্যায় দ্যাখো, আমি ছাড়া আর আছেটা কী? আমি তো অনাদি-অনন্ত। আমারই চেতনার রঙে এই পৃথিবী হয়েছে, পান্নার রং চুনির রং... সব আমার জন্য। এই পৃথিবীর কোলে কে জেগে উঠেছে? আমি। আমি ১ আমি। তুমি ১ আমি। কাজেই তাকে বাদ দেওয়ার প্রশ্নই ওঠেনা। আমি 'আমি'-কে কী করে বাদ দেব? বারীনদাকে শুধু বলেছিলাম অহংকার বাদ দিতে। একটু তুঁহু-তুঁহু করতে... সেই রামকৃষ্ণের গল্পর মতো। 'আমি' শব্দটাকে এমনভাবে বলতে হবে যেন 'তুমি' বলা হল।  উনি ওঁর আমি-কে সেলিব্রেট করেন, কিন্তু অহংকারের কাদায় যে কেন বারবার আটকে যান। অত বড় মাপের একটা মানুষ, অমন মানুষ আজ খুব বিরল... দুঃখ হয়। আমি এই করেছি, সেই করেছি, আমি ছিলাম বলে এটা হয়েছে, সেটা হয়েছে... তেমন নয়।

আজকাল জীবনের লিখিত স্বভাবটা আমার চোখে খুব স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। আজকাল টের পাই, আমাকে লেখা হচ্ছে। আমি আমাকে লিখছি, এমন স্পর্ধা আমার হয় না। বরং মনে হয় আমি লিখিত হচ্ছি, একইসঙ্গে হয়ে উঠছি ১ কাচখন্ড, কাঠের পাটা নই আর আমি। আমাতে ধুলো লাগছে, ময়লা লাগছে, সেগুলো সাফ হয় প্রখরতায়, খুব রুক্ষ ১ হাত তা মুছে দিয়ে যাচ্ছে, আমার লাগে, আমি শুদ্ধ হচ্ছি।

কবিতা আমাকে লেখে। সেই লেখা মাঝেমধ্যেই আমার নিজের স্বভাবকে পেরিয়ে যায়, বুঝি নিজের বোধ আমার গোচর হবে এমন আশা আমার করা ঠিক নয়।

এই যে এই কথাগুলো বললাম, ১ ট্রিগার যেন টানা হল। আমার। আমার নয়।

হে মোর জীবনদেবতা...


মৃগাঙ্কশেখর গঙ্গোপাধ্যায়:  তুমি যে পথটা বেছেছ। তাতে খুব কম সংখ্যক মানুষকে কমিউনিকেট করতে পারছ। তোমার মনে হয় নি বেশি সংখ্যক মানুষকে কমিউনিকেট করা যায় এমন পথ বাছি?

অনুপম মুখোপাধ্যায় :   কাউকেই যে কমিউনিকেট করতে পারছি, মৃগাঙ্ক, সেটাতেই আমি নিশ্চিত নই। একজনকেও কি কমিউনিকেট করতে পারছি? তুমিই কি পেরেছ তোমার একটাও লেখায়? সেটা কি করা যায়? সেটা করার চেষ্টা কি আত্মহত্যাই নয়? কবি হলাম কেন, রিপোর্টার হতে হত তো তাহলে! রবীন্দ্রনাথ আক্ষেপ করেছিলেন যে তাঁর কবিতা গেলেও বিচিত্র পথে, হয় নাই তা সর্বত্রগামী। বোঝো!! তাহলে আমাদের কী হবে? জীবনানন্দর 'ভোর' কবিতাটা কজনকে কমিউনিকেট করে বলো? পড়তে ভালো লাগে। একটা প্রতারক লাবণ্য কবিতায় ছড়িয়েই দেওয়া চলে। সেটার সঙ্গে যদি থাকে মধুর ছন্দ আর পেলব অন্ত্যমিলের উপহার, তাহলে 'সাধারণ' (?) পাঠকের মন পাওয়া সোজা হয়। কিন্তু, যদি ছন্দে লিখিও, ছন্দকে তার প্রচলিত রূপে নেওয়া আমার পক্ষে আত্মপ্রতারণা হবে।


মৃগাঙ্কশেখর গঙ্গোপাধ্যায়:  আমরা কি কমিউনিকেট করার কথা ভাবি না লেখার সময়? বা লেখার সময় না ভাবলাম, পরে গিয়ে, পাঠকের কাছে পৌঁছতে চাই বলেই তো পত্রিকায় লেখা পাঠাও, নাকি?

অনুপম মুখোপাধ্যায় :  কমিউনিকেট করার জন্য পত্রিকায় গদ্য দিই। কবিতা দিই না। কবিতা দিই নিজের অনির্ণেয়তাকে পাঠকের সঙ্গে শেয়ার করার লোভে। যদি নিজের একটা অংশকে তাঁর হাতে তুলে দিতে পারি, যেন নিজের ভাঙা দাঁত আরেকজনের হাতে... সেই দাঁত আমার কোনো কাজের নয়, তাঁরও নয়, তবু সেটা দাঁত, সেটাতে লেগে আছে চিবোনোর স্মৃতি।


মৃগাঙ্কশেখর গঙ্গোপাধ্যায়: এবার আমাদের কথাবার্তা একটু অন্যদিকে যাক এবং আবার আমরা ফিরব এই অংশটায় আমি কিছু কবির কবিতা নিয়ে তোমাকে প্রশ্ন করব প্রথম আসুক, রবীন্দ্রনাথ কেমন লাগে তোমার ওর কবিতা, এই সময়ে দাঁড়িয়ে? 

অনুপম মুখোপাধ্যায় : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পেরেছিলেন ব্রিটিশ আধুনিক, ব্রিটিশ রোমান্টিকতা, পদাবলী, এবং উপনিষদের মিলনে এক অপরূপ বাংলা কবিতায় পৌঁছতে। সে এক অন্য আধুনিক। সেখানে শেলি-কীটস এবং জ্ঞানদাস-গোবিন্দদাস এক হয়ে যান শৃঙ্গাররস এবং ভিক্টোরিয়ান নৈতিকতা সেখানে ঝগড়া করে না ম্যাথু আর্নল্ড এবং বিদ্যাপতির কোনো বিরোধ নেই সেখানে। ভানু সিংহ হাত রাখেন নিবারণ চক্রবর্তীর কাঁধে। আমার কাছে ওঁর আসল কবিতা হল ওঁর অনেক গান। আমি কেন, সম্ভবত অনেকের কাছেই। এই সময়ে দাঁড়িয়ে আমার 'দুই বিঘা জমি' বা 'পুরাতন ভৃত্য'-কে কবিতা নয়, দুর্দান্ত গল্প মনে হয়। 'আফ্রিকা'-কে, 'বাঁশি'-কে, বা 'সাধারণ মেয়ে'-কে কবিতার চেয়ে অফুরন্ত গদ্য বেশি মনে হয়। ওঁর অনেক কবিতাকেই 'কাব্যি' মনে হয়, যেন নিজের ভিতরের সবুজকে উনি যেটুকু মেলে সেই খাদ্য আপ্রাণে জুগিয়েছেন। কিন্তু 'সোনার তরী' বা 'বলাকা'-র দাম কে মেটাবে? 'শিশু'? রবীন্দ্রনাথ আমাদের মধ্যে নেমে আসা শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি। এ নিয়ে প্রশ্ন তোলার যোগ্যতা কারও হয়নি, হবেও না, কারন যোগ্য ব্যক্তি ওঁকে প্রশ্ন করবেন শুধু ঋদ্ধ হওয়ার জন্য, ওঁকে বিদ্ধ করতে চেয়ে কিছুই মিলবে না ‘যে ফুল কানন করত আলো/ কালো হয়ে সে শুকালো’... জানি না ঠিকঠাক বললাম কিনা... স্মৃতি আমার খুব খারাপ, কিন্তু এই দুটো লাইন যদি কেউ লেখেন, তাঁকে তো আর কিছু লিখতেই হয় না। এবং এমন উনি হাজার-হাজার লিখেছেন। কী বলবে? এসো কিছু না বলে, একটা প্রণাম করি, দণ্ডবৎ হই।

মৃগাঙ্কশেখর গঙ্গোপাধ্যায়: জীবনানন্দ vs রবীন্দ্রনাথ ? 

অনুপম মুখোপাধ্যায় : রবীন্দ্রনাথ বিশ্বপ্রতিভা মহাজাগতিক আকাঙ্ক্ষা নিয়ে তিনি কাজ করতে এসেছিলেন, একমাত্র মাইকেল ছাড়া অতখানি ইচ্ছা নিয়ে আর কেউ কাজ করেননি আমাদের এখানে বাঙালিকে উনি মানুষ গন্য করতেন না। তবু বাঙালির সীমায় নিজেকে আঁটানোর জন্য তিনি নিজেরই অনেক হানি করেছেন, তবুও তিনি বাঙালির ভাতের থালা আর মুড়ির ডিসে ধরা দিতে পারলেন না জীবনানন্দ দাশ বঙ্গীয় প্রতিভা উনি মধ্যবিত্তের কবি। বাঙালির তন্দ্রালুতাকে তিনি চরিতার্থ করেছেন, বাঙালির বসে-বসে দ্যাখার যে অভ্যাস, চারদিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফ্যালার যে প্রবণতা, তার পূর্ণরূপ তিনি শহুরে মধ্যবিত্ত অলস বাঙালি তাঁর সঙ্গে নিজেকে সহজেই আইডেন্টিফাই করতে পারে মাদকতা আছে তাঁর মিশ্রকলাবৃত্তে, প্রায় ভাতঘুমের মতো ওই ছন্দ আমাদের কর্মপ্রবণতাকে শুষে নেয়, আলস্যকে প্রলম্বিত করে দু-জনেই সারা পৃথিবী থেকে উপাদান নিয়েছেন, কিন্তু এটাই বলতে হয় শেষ অবধি জীবনানন্দ যদি না আসতেন, বাংলা কবিতা গরীব হত, কিন্তু ফতুর হত না রবীন্দ্রনাথ না আসলে সেটাই হত  ওই vs-টা রেমব্রান্টের সঙ্গে নন্দলাল বসু বা পিকাসোর সঙ্গে রামকিংকর বেজের তুলনা করার মতোই অবাস্তব এই তুলনাটা দুজনকেই অপমানিত করে ঠিক যেমন আমাদের এখানে রবীন্দ্র-নজরুল সন্ধ্যার আয়োজন হয়, এমনকি রবীন্দ্র-নজরুল-সুকান্ত সন্ধ্যার বন্দোবস্তও নাকি থাকে কোথাও কোথাও
তবে এগুলো কবিতার সাপেক্ষে বললাম। জীবনানন্দর উপন্যাস আমার অসম্ভব প্রিয়, বিশেষ করে ‘জলপাইহাটি’ বা 'কারুবাসনা' ওগুলোকে ‘যোগাযোগ’ বা 'চতুরঙ্গ- পাশে রাখতে আমার দ্বিধা নেই


মৃগাঙ্কশেখর গঙ্গোপাধ্যায়:  আর অনুপম মুখোপাধ্যায় না এলে বাংলা কবিতার কী হত ?

 অনুপম মুখোপাধ্যায় : এই প্রশ্নটার উত্তর আমার দেওয়ার কথা নয়, মৃগাঙ্কআগের প্রশ্নগুলোর উত্তর যে দিয়েছে সে আমি নই। সে একজন পাঠক। এই প্রশ্নটা সম্ভবত কবি অনুপমকেই করা হচ্ছে। তবু দিচ্ছি। দ্যাখো, আমার মনে হয় অনুপম মুখোপাধ্যায় যেদিন মনে করবে সে বাংলা কবিতায় কোনোকিছু সংযোজন করতে পারছে না, শুধু নিজের জন্য লিখছে, সে কবিতা লেখা ছেড়েই দেবে। হয়তো তখন গদ্য লিখবে। গল্প-উপন্যাস নিয়েই থাকার চেষ্টা করবে। আমি লিখি, কারন আমি ‘আমার নিজের বাংলা কবিতা’-র জন্য লিখি। ব্যাপারটা এরকম... আমারই চেতনার রঙে (সেখানে আমার পড়া হয়তো আমার লেখার চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়, তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল আমার নির্বাচনপ্রক্রিয়া।) লেখাবিশ্বের একটা টুকরোর নাম হয়েছে ‘বাংলা কবিতা’ সেটা আমার একটা ধারণা বলতে পারো, আমার যাপনও বলতে পারো। আমার কাছে সেটা খাঁটি। অন্যের মুখে আমি বাংলা কবিতার ঝাল খাই না আমি যদি না লিখি, নিজস্ব রূপনারায়ণের কূলে আমার জেগে ওঠাটাই হবে না। আমার যে বাংলা কবিতা, সে একটা পৃথিবী, সেখানে অনুপম মুখোপাধ্যায় যে কোনো কবির চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, সে কবিতা না লিখলে ওই পৃথিবীটা উজাড় হয়ে যাবেএটা নার্সিসিজিম নয়, আত্মকেন্দ্রীকতা নয়। চেতনার রঙে যে চুনি লাল হয়ে ওঠে, সেই চুনি কি  সিন্দুকে থাকে নাকি? পুনরাধুনিকে কোনো সিন্দুক নেই, শুধু পদচিহ্নহীন ১ পথকে খোঁজা, সেই পথে পড়ে থাকা চুনিকে খোঁজা।

মৃগাঙ্কশেখর গঙ্গোপাধ্যায়: প্রথম পর্ব এটুকুই থাক

অনুপম মুখোপাধ্যায় : থাক এসো অপেক্ষায় থাকা যাক।

Comments

  1. মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনলাম। শুধু পড়ে গেলে হয়তো অতোটা নিতে পারতাম না। অনুপম মুখোপাধ্যায় কোনো ব্রান্ডের নাম নয়, একজন প্রকৃত পাঠক-কবি। কবি-পাঠক এর মতো তিনি সংখ্যার কবিতা বাড়াতে ব্যস্ত নন। তাঁর সমস্থ সত্তায় এক্সপেরিমেন্ট, আর সমস্থ এক্সপেরিমেন্ট মিলে তিনি একক।
    অনেক কিছু শিখলাম, চিনলাম। মৃগাঙ্ক দা প্রশ্নগুলি দারুন করেছেন। ভবিষ্যতে কবিরা পুনরাধুনিক কবিতা নিয়ে অনেক কাজ করবে এই আশা রাখি।

    ReplyDelete

Post a Comment