ব্যথার পূজা হয়নি সমাপন | উল্কা




| |                                 এ ব্যথা নিজে ব্যথা | উল্কা

ব্যথাবানানটা ছোটবেলা থেকে ভুল করার অভ্যাস এখনও পুরোপুরি যায়নি। খুব সচেতন না থাকলে অবলীলায় য-ফলাকে এক ডাণ্ডা মেরে ঠাণ্ডা করে দিই। সেইসময় আমার গৃহশিক্ষিকা ছিলেন যথেষ্ট সংবেদনশীল, তাই কোনোরকম ডাণ্ডা প্রয়োগ না করে তিনি বানানটিকেই দিলেন বদলে! ব্যথা সেই থেকে হয়ে গেল বেথা। তা বানান তো বদলে দিলেন তবে এই বেথা-র অর্থ অবিকল ব্যথার মতোই থেকে গেল। সেইসময় অতশত বোঝার বুদ্ধি গজায়নি তাই পেনসিল সামলে যখন ঝর্ণাকলম ধরলাম, বানানকে পূর্ণাঙ্গ রূপে ফেরাতে ডাণ্ডাঘাতের সাথে এক প্রকার সমঝোতা করে নিলাম। তখন বানান ভুল করলে কেও সমব্যথী হওয়ার মতো ছিল না, বরং ব্যথার ওপর ব্যথার বোঝা বাড়ত। পরিস্থিতি বুঝিয়ে দিল ব্যথা খাওয়ার সাথে সাথে মাথায়-ও মাখা যায়। জিনিসটি বলতে ছোট হলেও আকারে বিশাল। তখন পঞ্চম শ্রেণি। স্কুলে গরমের ছুটি চলছে। এই সময় বাড়িতে আমার জন্য ডাব আনা থাকত। দুপুরে ভাত খেয়ে উঠে কাটারি দিয়ে বাবা সেই ডাবের মুখটা কেটে গ্লাসে উল্টে ধরত সবুজ খোলাটা। তার মধ্যে থেকে গ্লুপ গ্লুপ আওয়াজ করে ভরে যেত গ্লাসটা। ওই রকম করে আমারও গ্লাস ভরতে ইচ্ছা করত। একদিন সুযোগ করে নিলাম। একটা ডাব তুলে কাটারি দিয়ে কোপ মেরে ফুটো করে গ্লাসের ওপর ধরলাম। দেখি গ্লাসের ভিতরে ডাবের জলের সাথে সাথে বাইরের গা দিয়ে বেয়ে ঝরঝর করে নামছে রক্তপ্রচণ্ড উত্তেজনা তখন খানিকটা ভয় খেয়ে নিয়েছে। বাঁ হাতের দিকে তাকিয়ে দেখলাম ডাবের সাথে তর্জনীটাও কোপ খেয়েছে। ধীরে ধীরে চিনচিনে ব্যথা টের পেলাম। গ্লাস-ডাব-রক্ত সব ফেলে বাবাকে দেখালাম ঘটনাটা। আচমকা কোথা থেকে একটা বিরাশি শিক্কার চড় এসে আছড়ে পড়ল গালে। মায়ের হাত বুঝতে পেরে আর কথা বাড়ালাম না। সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতাল। বুঝলাম স্টেপ বাই স্টেপ ব্যথা বাড়ছে। তার মানে, সামনে যা যা আসছে তার জন্য প্রমাদ গোনা শুরু করলাম। কোথা থেকে একটা ডাক্তার এসে বেঁকানো ছুঁচ আর কালো সুতো নিয়ে টেনে টেনে আমার আঙুল সেলাই করতে শুরু করল। সেই ব্যথা যে কি ব্যথা তা হয়তো তার জানা ছিল না তাই হাতটাকে অসাড় না করেই কাজ চালিয়ে দিল। বরং আমার ব্যথার বেশ অনেকটাই সহ্য করল হাসপাতালের নার্স। এমন জোরে তার হাত চেপে ধরলাম যে মট্‌মট্‌ করে শাখা-পলা সব চুরচুর হয়ে গেল। সে আমায় উল্টে আর ব্যথা দেওয়ার রাস্তা না পেয়ে প্যাঁক করে ফুটিয়ে দিল অ্যান্টি-টিটেনাস সিরিঞ্জ। এটা আরও পাঁচ ক্লাস পার করার পর বুঝেছিলাম যে প্রত্যেক ঘাতেরই সমান ও বিপরীত অভিঘাত আছে। কথায় আছে- আঘাত পেতে পেতে ব্যথা চলে যায়। তখন আর ব্যথা নিয়ে মাথাব্যথা থাকে না। তবে যে যাই বলুক না কেন আমি দমাদ্দম টেবিল ঠুকে অবজেকশন দেবো। সে আমার হাতে যতই ব্যথা লাগুক। এই তো যাদের প্রতি মাসে তিন সপ্তাহের জন্য এক একটি প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে, তারাও ব্যথা পায়- তাই এক সপ্তাহ সময় নেয় একটু ওয়ার্ম আপ করে নেওয়ার। ফের শুরু নতুন অভিযান। কাটা-ছেঁড়াতে কুছ পরোয়া নেহি। তাছাড়া আগেকার দিনে যে সব মহিলারা বারবার মা হতেন। প্রসব বেদনার সময় চেঁচিয়ে পাড়া মাথায় করতেন। এখানেও একটা কথার কথা গোঁজা আছে, “এই ব্যথা নাকি পৃথিবীর সেরা ব্যথা!বোঝো! ব্যথাও নাকি সেরা... লে হালুয়া! তো আমি আঠারোর ঘর ডিঙোতেই ব্যথার ওপর অক্ষরেখা দ্রাঘিমারেখা টেনে আমার মনের মতো করে তার একটা চেহারা দিতে চাইলাম। শুধু আমি কেন সকলেই আঠারোর ঘর পেরিয়ে ব্যথাকে নতুন করে আবিষ্কার করে। কখনও শব্দে, কখনও তরলে, কখনও ধোঁয়ায়। কেউ কবিতা হারিয়ে ব্যথা পায়, কেউ কবি! ব্যথার কোন গন্ধ নেই। গন্ধরাজনীতির সৌরভ না সৌরভের গন্ধরাজনীতি? দ্বন্দ্ব লেগেই থাকে। সৌরভ চলে যায় পশ্চিমে ব্যথা পড়ে থাকে পূর্বে। দেখা হয়না, কথা হয়না। শুধু স্লো-মোশনে সূর্যোদয় আর সূর্যাস্ত হয়। ব্লেডে চেরা ব্যথাগুলোকে এক সময় ‘ভ্যালেন্টাইন-ব্যথা’ বলতাম, অবিশ্যি এখন এসব ব্যথার দাম নেই বাজারে। তার চেয়ে টেডি-বিয়ারের কদর বেশি। ন্যাকা ব্যথাদের কেনা বেচার পাট কবে চুকে বুকে গেছে। থেকে গেছে খানিক মিথ্যে আর অপমানের ব্যথা। যারা নিজের দাঁতের বদলে অন্যের হাতুড়িতে নিজের নাম লিখে, তাই দিয়ে আখরোট ভাঙেন- তারা এসব ব্যথা বোঝেন না। আরে, তাতে ক্ষতি কিছুই নেই; বেশ করেন, বোঝেন না। গৌতম বুদ্ধই তো বলেছেন “pain is certain, suffering is optional” উদ্দেশ্য তো সেই আখরোট খাওয়া! লোকে বলে থাকে হৃদয়ে ব্যথা! একদমই উড়িয়ে দেওয়ার নয়। কিন্তু এটাও ভেবে দেখার, ব্যথা না থাকা সত্ত্বেও যারা ইম্যাজিনারি ব্যথা অনুভব করেন তারা মাথা চুলকেও দেখেন না সার্ভিস দিতে দিতে হাত-পা-কোমর ব্যথা করেই থাকে; কিন্তু সেই জন্ম থেকে যে হৃদয় নির্ভেজাল সার্ভিস দিচ্ছে তার পেশীতে কোনো ব্যথা নেই। সত্যি বলতে কি ব্যথাও ওই বানানটারই মতো মন গড়া। চাইলে আমার গৃহশিক্ষিকার মতো বদলে নিলেই হল। তাতে কিছুই ঝামেলা হবে না কারণ আমরা ভুল করলেও আসল বানানটা জানি।
 | |

Comments