কী-ওয়ার্ডে ব্যথা | মৃগাঙ্কশেখর




                             ব্যথা? | মৃগাঙ্কশেখর গঙ্গোপাধ্যায়

সৌম্য বলেই এরকম একটা ন্যাকাপনা বিষয় বেছেছে। ব্যথা। দুঃখবিলাসিতা। যাদের হাতে অনেক সময়, তারা দুঃখ বিলাস করে। আমার ধারণা। তাই মালবিকা জিজ্ঞেস করে, আমি কখনো কেঁদেছি কিনা, স্মার্টলি বলি, না। কেঁদেছি, অভিনয় করার সময়। সেই সময় দু এক জন ছিল যাদের এমনিতেই চোখে জল এসে যেত, অভিনয় পেরিয়ে একটা ব্যথা গলায় বিঁধে যেত, তাদের। আমার সেরকম কিছু হত না। সুতরাং আমাকে জিভটা উলটে গলার কাছে চেপে ধরতে হত, হাল্কা ওয়াক শব্দে চোখে জল। আর হাততালিপাড়ার দর্শক চোখে জল আনার তারিফ ঠুকতো। তখন সেভেন-এ পড়ি।
ছোটবেলায় কি কাঁদি নি? কেঁদেছি। একবার দোতলার ব্যালকনির রেলিঙে উঠে পা দুলিয়েছিলাম, বাবা বেধড়ক মেরেছিল। যদি পড়ে গিয়ে মরে যেতাম! সেদিন বাবার মারে দম বন্ধ হয়েও মরে যেতে পারতাম। হাঁপাচ্ছিলাম কাঁদতে কাঁদতে। সে ঠিক ব্যথায় নয়। চামড়ায় একটা জ্বালা থেকে। আরো ছোটবেলায়, বাড়ি থেকে স্কুলে পাঠাতে পারছিল না। আমি ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম মাঠে ঘাটে। ফড়িং প্রজাপতি কাঠপিঁপড়ে। ধরে সূতো বেঁধে দিচ্ছি পেটের সাথে। আর সূতোর অন্যদিকটা বেঁধে দিচ্ছি জানলার শিখে। উড়ছে আর গোঁত খেয়ে পড়ছে। পিঁপড়ে পালাবার চেষ্টা। পেটের কাছে আরো চেপে বসছে সূতো, নেতিয়ে পড়ছে আসতে আসতে। মরে গেলে, পেট থেকে শরীরের দুটো পাশ ছিঁড়ে, আমার কি আনন্দ। ওদের কি ব্যথা লাগে সৌম্য! রক্ত না বেরলে আবার ব্যথা কিসের! এরপর অনেক চেষ্টায় আমার নার্সারি। লক্ষীনারায়ণ বিদ্যালয় না বিদ্যাভবন এরকম কিছু একটা। সেখানে আমার একটা খেলা ছিল, অন্য ছেলে-মেয়েদের কাছে বলতাম, এই একটা পেন্সিল দিবি লিখেই দিয়ে দেব, আমারটার শিষ ভেঙ্গে গেছে। বাচ্চা ছেলে-মেয়ে সব, দিয়ে দিত। আমাদের সময় বাড়ি থেকে কেউ বলে দিত না, অন্যরা চাইলে কিছু দিবি না। আমি তার পেন্সিলটা নিয়ে জানলা দিয়ে ফেলে দিতাম। আবার আর একজনের কাছে। এই ভাবে একবার ক্লাসের প্রায় সবার পেন্সিল ফেলে দিয়েছিলাম লাস্ট বেঞ্চের জানলা দিয়ে। তাদের নতুন পেন্সিলের ব্যথা, এখনো টিনের চালে পড়ে থাকতে পারে।
এরপর শিখা দিদিমণি কান টানা, বিশু স্যারের মার, পাপড়ি আন্টির চড়- কিন্তু ব্যথা লাগল না। সবটাই শরীরের টনটন বা কানের চিনচিন হয়ে কমে যেত ঘণ্টাখানেক বাদে। তবে হ্যাঁ, ভয় লাগল। পড়াশোনাটা শুরু হল। রহড়া রামকৃষ্ণ মিশন। প্রথম যেটা হল, সেটা একটা অসুখ। আমার মাথা ভর্তি কোকড়া চুল। যা কাটতে গিয়ে বাবার সাথে মারামারি। বা, স্কুলের আসার সময় আঁচড়াতে না দেওয়ার চেঁচানি। সব চুপ হয়ে গেল কমাসে। চুল-ভ্রু-চোখের পাতা সব পড়ে গেল। এক মাস আগের ছবির সাথে কোন মিল নেই। একটা সাদা টুপি। আর বন্ধুদের সেটাকে ডাস্টবিনে ফেলে দেওয়া। কারো কারো মাথায় গাঁট্টা। বাকিদের জিজ্ঞাসা কি হল, চুল নেই! ব্যথা? না। টুপি ফেলে দিলে স্যারকে নালিশ, গাঁট্টা মারলে, তাকেও ঘুষি, আর জিজ্ঞাসা করলে বিজ্ঞের মত বলে যেতাম যা ডাক্তার বলেছে।
প্রথম যখন ব্যথা শব্দটা শুনি, তখন জুনিয়ার হাই। পাশে ভবনাথ ইনস্টিটিউশনগার্লস স্কুল। বন্ধুরা প্রেমে পড়ছে। আর জানান দিচ্ছে কোন মেয়ের প্রতি কার কত ব্যথা। আমার সেসব বালাই নেই। চুল ভ্রু নেই- ভীনগ্রহের প্রাণীদের জীবনে প্রেম ব্যাপারটা মানায় না। আমি পিকের মতো বোকা মোটেই ছিলাম না। তবে প্রেম করবার জেদ চেপেছিল টুয়েলভের শেষের দিকে। প্রীতম বলেছিল, হুহ্‌ তোর সাথে কে প্রেম করবে! মুখে কিছু না বললেও, চ্যালেঞ্জটা এক্‌সেপ্ট করেছিলাম মনে মনে। কিন্তু পরীক্ষা এসে যাওয়ায় টাইম পাচ্ছিলাম না। কারণ পড়াশোনাতেও রবি সোমকে ল্যাং মেরে ফার্স্ট আমাকে হতেই হত। যখন সেটা হয়ে গেলাম, নামলাম পরের রেসটায় একটা মেয়েকে পটাতে হবে। কবিতা লিখি টুকটাক ছোট থেকেই। মা পড়ে শোনাতো, তখন নিজেরও লিখতে ইচ্ছে হত। ফার্স্ট ইয়ারে কবিতার হাতটা পাকছে অল্প অল্প, অর্কুট তখন। টুকটাক ফ্যান হচ্ছে। দু একটি মেয়েও আছে। তার আগে রপ্ত করতে হয়েছে, কি কি করলে মেয়েরা পটে। তেমন ভাবেই পটিয়ে ফেলেছি। একজন স্টেডি। যেটা বন্ধুদের দেখাতে হয়। ভালো ছেলেদের একটার বেশী গার্লফ্রেণ্ড থাকতে নেই। বাকিরা ভার্চুয়ালে। ততদিনে শিখে গেছি, ব্যথাকে কি করে মোড়ক পড়াতে হয়। দলছুটে মোড়ক নিয়ে একটা ইস্যু করেও ফেলেছি। কিন্তু সমস্যা হল ৫৭৯ টা শব্দ খরচ করেও ব্যথা নিয়ে কিছুই লিখতে পারলাম না। আর বেশীর ভাগ মানুষ এতোটা পড়বে না। যারা পড়েছে চরম গালাগালি দিয়ে ভাবছে বাকিটা পড়বে কিনা। 
আমাদের প্রত্যেকের মধ্যে দুটো মানুষ আছে। থাকবেই। একটা মানুষ একা বাড়িতে ভূতের ভয় পাবে, একটা মানুষ বোঝাবে ভূত বলে কিছু নেই। কিন্তু আমার মধ্যে তেমন কোন মানুষ নেই। আপনার একটা মানুষ সব সময় আর একটা মানুষের সাথে কথা বলে যায়। আমার তেমন কিছু হয় না। আর এই কারণেই ঐন্দ্রিলা যখন এসে বলল, হঠাৎ একদিন, সে আমাকে আর ভালোবাসে না। ক্লাসের অন্য একটা ছেলের প্রেমে পড়েছে। আমি কিন্তু ওকে আর বিরক্ত করলাম না। সব থেকে বড় যেটা ব্যথা পেলাম না। বরং আরো চার পাঁচজন মেয়ের সাথে নতুন ভাবে প্রেম করতে লাগলাম। আপনার ক্ষেত্রে কি হত, একটা মানুষ জিজ্ঞেস করত কেন ছেড়ে দিল? আর একটা মানুষ ভাবত, ছেড়ে দিল! একটা মানুষ ভেঙ্গে পড়ত, আর একটা মানুষ স্বান্তনা দিত। বা ব্যথা সাড়ানোর টোটকা। আমার ক্ষেত্রে কোনটাই হল না। ডাক্তার বলল, ব্যথার যে হরমোনটা দরকার হয় সেটা ওর নেই। বাবা বলল, কি করে হয়! ওর কবিতা আমি পড়ে দেখেছি, সেখানে ও মানুষের ব্যথা নিয়ে লিখছে। রতিমত আবেগপ্রবণ। আপনি পড়বেন? ডাক্তার বাবু হাতে নিলেন ডায়েরিটা, পড়ে বললেন, বুঝতে পারছেন না, এগুলো ওর নিজের ফিলিং নয়। যেমন ধরুন, এই ফুটপাতের বাচ্চাদের কষ্ট নিয়ে কবিতা লিখেছে, যদি না কাগজে বইতে ও পড়ত, লিখতে পারত না। ওর নিজের পক্ষে ব্যথা বলে কিছু এগ্‌জিস্টই করে না। ও যা লিখছে সবটাই অন্যের ফিলিংস। সেটাকেই ও ছন্দ মেটাফর এসব দিয়ে বলছে। বাবা বলল, তা হলে! ডাক্তার বলল, তাহলে কি আপনারা তো লাকি, ও ব্যথাই পাবে না কখনো লাইফে। সেটাই তো সব বাবা মা চায়। সব মানুষ চায়। বাবা মার মুখটা দেখে আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না। ভাবলাম, ওরা কি ব্যথা পেলেন!
এখানে একটা জিনিস কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে। যে ব্যথা কি বোঝে না, সে অন্যেরা কিসে ব্যথা পায় তাও জানবে না। যদি না সেটা বইতে ম্যাগাজিনে নিউপেপারে বা বন্ধুর মুখে শোনে। আমিও বুঝি না যতক্ষণ না গুড্ডু বুঝিয়ে বলে কেন আমি বাদ। যখন সত্যজি বলে কেন আমাকে বাকিরা সহ্য করতে পারে না। যখন অর্ণব বলে,  কেন ওর বাড়ির প্রবলেমের জন্য আমিই দায়ী। সেসব শুনে আমি তন্ময়কে বলি, এগুলো করেছি বলে এখন খুব কষ্ট হয়। ও বলে, অন্যকে ব্যথা দিলে ব্যথা তো পেতেই হবে। কিন্তু আমি কিছুতেই বুঝতে পারি না ব্যথা কি! ব্যথা কি নিজের তৈরী দল থেকে বাদ পড়ে যাওয়া, ব্যথা কি ব্লক লিস্টের ফোন নম্বর, ব্যথা কি অবিশ্বাস, ব্যথা কি! এই শালা সৌম্য, ব্যথাবিষয় করেছিস্‌- ব্যথা কি! একটা অচেনা মানুষের টাইম-লাইন ঘাটতে ঘাটতে, কবিতা পড়তে পড়তে জানতে পারা বন্ধুটা আর বেঁচে নেই?


['Iti Mrinalini' by Aparna Sen ]
 


আড্ডা, সাবেকী ভাষায় Interview



আমার জীবন থেকে উঠে আসা সুর


এখনো অ্যানাউন্সমেন্ট হয় নাই, আসবে কি না জানা নাই

Comments