কী-ওয়ার্ডে ব্যথা | কোয়েল




                ব্যথা... ব্যথা... ব্যথা... | কোয়েল মজুমদার


[চিত্রণ: বিরগিট হুটম্যান-হল্‌জ, জার্মানি]

দলছুটদের ব্যথা দেওয়ার আমন্ত্রণটা পেয়েই প্রথমে চোখ গেল ‘ব্যথা’ বানানটার দিকে। ভালো করে দেখছিলাম। ব-এ য-ফলা, থ-এ আ-কার। মনে পড়ল, মাধ্যমিকের আগে বাংলা ব্যাচের এন.ডি. স্যার বলেছিলেন, “দেখিস! ব-এ য-ফলা আ-কার দিস না যেন! তাহলে কিন্তু বেশী ব্যথা হবে!”
বাড়ি ফিরে সবক’টা ডায়েরী খুলে চিরুনি তল্লাশি। ব্যথা নিয়ে কি কখনও লিখেছি কিছু? দেখলাম, সব লেখাই ব্যথায় শুরু কিংবা ব্যথায় শেষ (বা “শেষ হয়েও হইল না শেষ”)। কবিতা বা অ-কবিতা। কিন্তু ব্যথা নিয়ে এখানে কি লিখব? ভাবতে ভাবতে কবিতা, সিনেমা (আঁতলামির যাবতীয় সব আর কি!) আরও কি কি সব মনে আসছিল!

মনে পড়ল, ‘রকস্টার’ নামে একটা বলিউডি সিনেমা দেখেছিলাম কয়েক বছর আগে। ব্যথার একটা অদ্ভুত ব্যাখ্যা ছিল ছবিটায়। মূল প্রোটাগোনিস্ট গায়ক। কিন্তু শিল্পী হওয়ার সমস্ত সম্ভাব্য পন্থা অবলম্বন করেও ঠিক ফল পাচ্ছে না। গানটা সে দারুণ গাইত কিন্তু ওই ‘অ্যাটিটিউড’-এ কি যেন ছিল না। তার জীবনের ‘পিকু-দা’ বা ‘ভোম্বল-দা’ গোছের ভদ্রলোক নানান উপায় বাতলে দিলেও ঠিক সুবিধে হচ্ছিল না। সেই ‘এক্স-ফ্যাক্টর’টা আসছিল না! শেষে উনি হাল ছেড়ে বলেছিলেন “তোর মধ্যে সেই ব্যথাটা নেই”এমন একটা ব্যথা যেটা বুকের খাঁচায় ধরতে আর বইতে পারলেই ওর শিল্পী হওয়া কেউ আটকাতে পারবে না। হলও তাই। একটা না ফুরোনো ব্যথা নিয়ে ‘জনার্দন’ হয়ে উঠল ‘জর্ডন’। আর রুমী’র কবিতা একটা আশাবাদের সূর্যাস্ত দিয়ে শেষ করল ছবিটা। কিন্তু কেমন দুঃখ দুঃখ টাইপের আশাবাদ! একটা বেশ ব্যথাময় ব্যাপার!

ব্যথা মনে পড়লে যেটা তড়িতের বেগে ছুটে যায় মাথায়, সেটা হল ব্যথা থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায়কেউ যেন মাথার দিব্যি দিয়েছে, ব্যথা থেকে রেহাই পেতে হবে বস্‌! সে তোমার পেট-খারাপের মোচড়ানি হোক বা প্রেম খারাপের। ফারাক হল একটা পেটে, আরেকটা ওই পাঁজরের ভেতরে কোথাও একটা।

এক বন্ধুর বাবা অসুস্থ থাকাকালীন, হাসপাতালের চড়া কফির গন্ধওলা লবিতে বসে ব্যথা নিয়ে তুমুল ‘ইনফিউশন চলকে’ যাওয়া গোছের আলোচনা হয়েছিল। প্রায় চল্লিশোর্ধা এক বন্ধু বলেছিলেন, post-traumatic phase-এ মানে খুব তীব্র কোনও ব্যথার অনুভূতির পর, নানান ঘটনা যা ঐ ব্যথার মতই, তা মনকে ঐ রাস্তায় আবার নিয়ে যায়। যে পথে ব্যথা এসেছিলো আর তারপর সুখী আস্তানা গেঁড়ে বসেছে। আসলে মানুষের মাথায় না কোথায় নাকি নিউরনগুলো ঐ ব্যথার চক্র ধরে রাখে। আর তাই ’pain’ না থাকলেও ‘feeling of pain’-টা থেকে যায়। আর মজার ব্যাপার হল, ঐ ব্যথার চেয়ে আরও গভীর বা বেশী ব্যথা দিলে চক্রটা ভেঙ্গে যেতে পারে। কিন্তু তখন ডাক্তার, বন্ধুর বাবার ব্যথা সারাতে চলে এলেন, তাই আর বিস্তারিত জানতে পারিনি। এই নতুন ব্যথা সারানোর পদ্ধতিটা বেশ লেগেছিল। কিন্তু কিভাবে আরও বেশী ব্যথা দেওয়া যাবে, তাই নিয়ে বোধহয় পরীক্ষা চলছে। কারণ আসলে তো ব্যথা থেকে মুক্তি চাই!

পায়ে আর্থ্রাইটিস, বড় ব্যথা, মুক্তি চাই। মাঝরাতে বুকে ব্যথা, চড়া কফির গন্ধওলা হাসপাতাল, আর মেডিক্লেম আছে, মানে মুক্তিও আছেজীবনটা জাস্ট ভাল্লাগছে না ডাক্তারবাবু! ডিপ্রেশন... মুক্তি চাই! (আর না হলে পাঁচ টাকার মেট্রো-মুক্তি তো কলকাতায় আছেই!) খবরের কাগজ খুললেই শুধু SCAM! RAPE! পারা যাচ্ছে না! মুক্তি চাই... মাথা থাকবে, ব্যথা থাকবে, আর ব্যথা সারানোর উপায়ও... থেকেই যাবে।

এসব ব্যথা তো একরকম, কিন্তু আরেকটা ব্যথা? যেটা ক্লাস সেভেন থেকে ঘুম লোপাট করা শুরু করেছিল, আর শিখিয়েছিল প্রথম কবিতা লিখতে... যে ব্যথাগুলো কোনোদিন সারাতে ইচ্ছে করেনি... ঐ ব্যথার চক্র আজও আমার নিউরনে ঘুরে বেড়াচ্ছে কিনা আমার জানা নেই, কিন্তু তারপরে কত চোখের জল–নাকের জলের ব্যথা এসেছে, কিন্তু ঐ ব্যথাগুলো ভুলিনি। প্রাইমারি থেকে সেকেন্ডারি স্কুল, তখনও শুধু ‘excessive talkative’ ছাড়া আর কোনও বদনাম নেই। বছর গড়াল, তারপরই হঠাৎ ইংরেজি পড়ায় বেশী মনোযোগ। আসলে যে মনোযোগের কেন্দ্রে তখন প্রথম ব্যথার চিনচিনে বুক। ‘হোমটাক্স’ (তখন যে উচ্চারণটা জানতাম) করলে আর রোজ পড়া পারলে যে হাসিটা ফেরত আসত সেটাই মনে হয় এখনও কোথাও জিইয়ে রেখেছে ঐ কাঁচা কবিতাগুলোকে। আমার ঐ ‘...সরকার উদ্যোগিত উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়’-এর সেই দিদিমণির ঠোঁটের কোণের এক চিলতে হাসি আর শাড়ীর আঁচল যে ব্যথাটা দিয়েছিল, তাকে আমার আর সারানো হয়নি, তাড়ানো হয়নি। তারপর কত ব্যথা... কফি হাউসের টেবিলে যাকে কোণাকুণি দেখার নিয়মিত অভ্যাস হয়েছিল, পরে জেনেছিলাম ওর নামও কোয়েল! আরেকটা ব্যথা আছে, যেটা প্রতিবছর লিটল ম্যাগাজিন মেলায় দেখা দেয়- আমি ঐ নাম না জানা ব্যথার ওড়না ধরে বলি, “ধুলো লাগছিলো”। সে হাসে, আমি ওদের পত্রিকা জমাই। আর আবার একবছরের জন্য লোপাট হয়ে যায়!

শরতের ছাতিম ফুরিয়ে গেলেও ব্যথা হয়, ব্যথা হয় আদর-ক্লান্ত শরীরে, ব্যথা হয় প্রিয় কবিতার প্রথম লাইনটা না মনে পড়লে। যখন “...আমার বুক টনটন করে ওঠে অথচ নির্দিষ্ট শোক নেই/সান্ত্বনার কথা মনে আসে না...” (চন্দনকাঠের বোতাম, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়) আর শুধু ‘feeling of pain’টা এমনভাবে থেকে যায়... থাকুক, নিউরনে ঐ ব্যথার চক্রগুলো থাকুক... ঘুরে বেড়াক, দানা পাক।

ডায়েরীর শেষ না হওয়া কবিতাগুলো। শব্দে না ফেলতে পারা অনুভূতিগুলো। কয়েকটা ব্যথা। যার কোনও ব্যাখ্যা নেই, ঠিক ভুলের হিসেব নেই। একটা শেষ আছে। খানিকটা এই রকম -
“Out beyond the ideas of wrongdoing and rightdoing,
there is a field. I’ll meet you there.

When the soul lies down in that grass,
the world is too full to talk about.
Ideas, language, even the phrase each other
                      doesn’t make any sense.” - Jalaluddin Rumi.




আড্ডা, সাবেকী ভাষায় Interview



আমার জীবন থেকে উঠে আসা সুর


এখনো অ্যানাউন্সমেন্ট হয় নাই, আসবে কি না জানা নাই

Comments