ব্যথার পূজা হয়নি সমাপন | অয়ন




| |                             ব্যথা সমীপেষু... | অয়ন ঘোষ




[চিত্রণ: লর‍্যা বারবোসা, নিউ জার্সি]

একটি ছোটো শিশু যখন প্রথমবার হাঁটতে শেখে, প্রথমবার দৌড়োয়, প্রথমবার ‘মা’ বলে ডাকে, তখন মায়েরা যতটা আনন্দিত হয় ঠিক সেরকমই ব্যথারা ব্যথা দিয়ে আনন্দিত এবং উল্লসিত হয়। তবে ব্যথার কামড় আর মশার কামড়ের মধ্যে কিন্তু বিস্তর ফারাক। যখন আমি ছোটো ছিলাম এবং যেদিন আমায় প্রথম মশা কামড়েছিলো, সেদিন প্রচন্ড ব্যথা অনুভব করেছিলাম। মা বলেছিলেন, ‘সব ব্যাথার ওষুধ আছে বাবা!’ তারপর থেকে মশা কামড়ালে শুধু চুলকোতো। ব্যথা লাগেনি আর। কিন্তু আস্তে আস্তে যত বড় হচ্ছিলাম ততই মালুম হচ্ছিলো আসলে সব ব্যথার ওষুধ হয় না।

তখন গরম কাল। আমাদের দো-তলা বাড়িটার রান্নাঘর ততক্ষণ খোলা থাকতো যতক্ষণ মা রান্নাঘরে থাকতেন। আমি রান্নাঘরের একটি কোনায় গুটিয়ে বসে থাকতাম। কখন বাগান থেকে ধবধবে সাদা বেড়ালটা ঝপ্‌ করে লাফিয়ে পড়বে রান্নাঘরের মেঝেতে। ছোটবেলা আমরা যেরকম বাবার ভয়ে সারাক্ষণ জুজু হয়ে থাকতাম, ঠিক সেরকমই বেড়ালটা মায়ের ভয়ে রান্নাঘরের জানলায় এসে বসে থাকতো। এর থেকে বেশি এগোলে খুন্তির বাড়ি বরাদ্দ ছিলো যে। বেড়ালটা সেটাও জানতো। তারপর রান্না-বান্না হয়ে গ্যালে পরে মা ‘হুস্‌ হুস্‌’ করে বেড়াল তাড়িয়ে জানলা বন্ধ করে দিতেন। মা কিছুই বুঝতে পারতেন না। আমি বুঝতাম। এই বুঝি বেড়ালটা ব্যথা পেলো! আমি ছুটে গিয়ে বাগানের দিকে গ্যালে বেড়ালটাকে আর দেখতে পেতাম না।

জীবনের চরমতম শারীরিক ব্যথা অনুভব করি ছেলেবেলারই কোনো এক গরম দুপুরে। চলন্ত টেবিল ফ্যানের ব্লেড ধরার জন্য এতটাই উদগ্রীব হয়ে পড়েছিলাম যে একটা আঙ্গুল প্রায় বাদই চলে যেতে বসেছিলো। প্রথমটায় বাবা ঘরে ঢুকে আমাকে এই অবস্থায় দেখে দুটো চড় কষিয়ে দিলেন। উফ্! সে কি ব্যথা... ব্যথার ওপরে ব্যথা। যেন শপিং মলে এসেছি। ‘বাই ওয়ান,গেট টু’

তারপর যখন আমাদের বাড়িটা প্রথম এবং শেষবারের জন্য ছেড়ে দিতে হয়েছিলো, তখন একেবারে মুষড়ে গ্যাছিলাম। সেদিনের মতো বড় ব্যথা আজ পর্যন্ত পাইনি। বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে বাবা কয়েকটা ছবি ক্যামেরাবন্দী করছিলেন। আমি জানতাম আমার কোনোদিন কোনো ছবির দরকার হবে না। আমি যতদিন বাঁচবো এই বাড়িটা আমার সাথে মরে গিয়েও বেঁচে থাকবে। আমি শুধু স্মৃতি হিসেবে কয়েক ঢিপি আনন্দমেলা, শুকতারা আর ইন্দ্রজাল কমিকস ছেড়ে এসেছিলাম চিলেকোঠার ঘরটাতে। আমি বুঝেছিলাম আমি সেইদিন যত না ব্যথা পেয়েছিলাম তার থেকে কয়েকগুণ বেশি ব্যথা ঠাওর করেছিলো বাড়ির ওই সাদা বেড়ালটা। যে কিনা আমার জন্মের আগে থেকে সন্তান প্রসব করেও তখনও হাঁপিয়ে যায়নি।
 | |

Comments