হারাতে হারাতে একা ( পর্ব ২৩) - বারীন ঘোষাল


১৯৬৭-র এপ্রিল, জামশেদপুর। বসন্তবিদায়ের রঙ গন্ধ টের পাই না। শুধু জয়তীকে দেখলে মন আনচান করে। সে পাশের পাশের বাড়িতে থাকে। মাঝে মাঝে গল্পগাছা, ঘনিষ্ঠতা, আলিঙ্গন, চুমু, কিন্তু গোপনে আড়ালে এসব আর ভাল লাগে না। বাড়ির দিকে তাকাই। বোন তখন গ্র্যাজুয়েট, এম এ-তে ভর্তি হবে রাঁচিতে, বাবা সঙ্গে গেল। ভাই ইঞ্জিনীয়ারিং পড়তে যাবে ম্যাঙ্গালোর, বাবা সঙ্গে গেল। এরা তো আমার না। সামান্য দুচার কথা ছাড়া আমাদের কোন গোপন কথা ছিল না যেমন ভাই-বোনদের মধ্যে হয়ে থাকে। বাবা স্বল্প আয়ের একজন শ্রমিক হয়েও তার নিজের ভাই বোন এবং খুড়তুতো ভাই বোনদের স্বাবলম্বী করে তোলার পেছনে যা পরিশ্রম করেছে, সেই সঙ্গে আমাদের পড়াশোনার জন্যও যা করণীয় করেছে, সবই তার নিজের বাহাদুরি – এবং সবাই সেটা স্বীকার করুক – শুধু এটুকুই চাইতোসেটা তার নিজস্ব অহমিকা। সেই কারণে “আমার শৈশব আমাকে দেননি” -- এই যে আমার মনে ধারণা জন্মেছে – অবহেলা মনে করেছি, অভিমান, রাগ, ক্রমে উদাসীনতা -- এই সংসার আমার না – আমি এখানে কি করছি – যত তাড়াতাড়ি পারি আমি পিতৃঋণ শোধ করে দেবো – হয়ত আমাকে পরিবেশ সচেতন গড়ে তোলার জন্য এটা তার শিক্ষা প্রণালী – শিশুমনে তা কোন ছাপ রেখে গেল বাবা নিজেই সচেতন ছিল না --  কেবল মাকে দেখি কী অপরিমেয় স্নেহ আজো আমার জন্য তুলে রেখেছে, সেটা তার নীরব দৃষ্টিতেই বোঝা যায়। সারাটা দিন বাইরে বাইরে কাটাই। পুরনো ক্লাবের জিমে, তাস ক্যারমের আড্ডায়, পাড়ার ছেলেদের যে ক’জনকে পাই – টো টো রোডবাজি, সুবর্ণরেখা, দলমা, দলবেঁধে জীবনে প্রথমবার দীঘা, ঢেউ, বালিয়াড়ি, বে-কাফের কফি আর ডর্মিটরি ফান ... একটা গিটার কিনলাম, এক টিচার, আকাশে বাতাসে কালবৈশাখি আসে, আমার জীবনে আর আসে না।
    ভাবলাম একটু বেড়িয়ে আসি। এই বেড়ানোটা আমার লেগেই আছে। চললাম চক্রধরপুর। খুঁজে পেতে বার করলাম গোবিন্দদের বাড়ি। বাবা মা দাদা দিদি বোন বিরাট সংসার। মেজদা এল- আই-সি তে, তারই বাড়ি বেরিয়ে এল। ওর আড্ডার ঠেকে গিয়ে স্থানীয় বন্ধুদের সাথে পরিচয় করালো, মাল খাওয়ালো, হাঁটতে হাঁটতে সবাই গিয়ে সঞ্জয় পাহাড়ের কোলে কারো নদীর ধারে বসে গান গল্প অরেঞ্জ চলল। এটা আমাকে ঝালুং-এর কথা মনে পড়ালো। ঝালুং-এ কমলা লেবুর মদ, আর এখানে পাতি গুড়কিতে কমলার সেন্ট মারা আর মশলা মেশানো। খেতে গা ফেরায় না। খারাপ লাগল গোবিন্দর আমেরিকা পাড়ি দেবার জন্য অতি উৎসাহে কাঠ খড় আয়োজনের গল্প। তাহলে ব্যাটা প্যাক হয়ে চলল বিদেশে। ভাল না লাগায় ওখান থেকে পরদিনই চলে গেলাম রাউরকেলা। তপনের বাড়ি। আমার এই প্রথম। ওর দাদার বড় কোয়ার্টারে বেশ জায়গা হল। ওদের পরিবার তখন বার্মা ছেড়ে পাকাপাকিভাবে চলে এসেছে এদেশে। তপনের বাড়ির হাবভাব কথাবার্তা বেশ হাইফাই ধরণের। আমাদের মতো মধ্যবিত্ত চরিত্রের না। আমি টো টো করে ঘুরে বেড়ালাম কখনো তপনের সাথে, কখনো একা। মহানদী বেশ দূরে। তার পরে উঁচু পাহাড়। শহরে সাজানো শ্রমিকদের বাবুদের বাড়িঘর, পার্ক, স্ট্যাচু, কলোনি, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। কিছুই আমাদের জামশেদপুরের মতো না, হাতে ধরা যায় না। ডাক দেয়া যায় না। সেই আপনাপন নেই। এরকম কারখানার শহরে তো আমি মরে যাবো। তপনের মতো নিশ্চিন্তে বিদেশপাড়ির কথা যে ভাবতেই শিখিনি। কেবল সংসার থেকে নিজেকে আড়াল করতে চেয়েছি। আমার তাহলে কি কোন গতি হবে না মা ? ঈশ্বরে বিশ্বাস রাখাও শেখাওনি তোমরা। কাকে আমি আঁকড়ে ধরবো ? কোন খড়কুটো ? তাহলে একবার স্বপনের বাড়িও যাই। ওর বাবা মা ভাই বোনকে যেন চিনতাম।
    স্কুলের পাড়ার পুরনো বন্ধুদের অনেকে চাকরিতে, অনেকে অন্য শহরে পি-জি করছে, কেউ কেউ বিদেশে পড়তে গেছে, সবারই কেরিয়ার ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা আছে, অ্যাম্বিশন আছে। আমার নেই কেন ? কোন অ্যাম্বিশন ? কোনমতে একটা চাকরি জোগাড় করে স্বাবলম্বী হওয়া ছাড়া আর কোন চাহিদা নেই আমার। আর তো তিনমাস। তারপরেই হয়ে যাবে এপার ওপার। গল্প লিখি, বই পড়ি, চারু মজুমদার নামের একজনের নাম শুনতে পাই, তার কথা পড়ি, ছেলেবেলায় পড়া দাস ক্যাপিটাল ভেসে ওঠে। জলপাইগুড়িতে কানাঘুসো শুনতাম স্টাডি সার্কেল নাকি তৈরি হয়েছে কলকাতায়, সেখানে বিপ্লব আর মুক্তির কথা বোঝানো হচ্ছে কলেজের ছেলে মেয়েদের। খবরের কাগজ পড়ে, ছেলেদের গল্পে জানতে পারি জঙ্গল সাঁওতাল আর কানু সান্যালের কথা, নকশালবাড়ি, ফাঁসিদেওয়া নামের গ্রামের কথা, সেখানে নাকি বিপ্লব হয়ে গেছে। আমি চারপাশে তাকিয়ে তো কোন বিপ্লব দেখতে পাই না। বিপ্লবে আমার কাজ নেই। আমার মুক্তি চাকরিতে। তারপরই মনে ভেসে উঠল সেই গানটা ... আমি প্যাক করে পাঠাবো বাঁড়া লন্ডনে ... । এটা মনে পড়ার কারণ হল, গতকালই পার্থ প্রতিম ঘোষ আমার স্কুলের বন্ধু, বি-ই কলেজ থেকে ফাইনাল পরীক্ষা দিয়ে এসেছে আমার মতো, গানটা গাইছিল ... আমি প্যাক করে পাঠাবো... নু... নু... লন্ডনে ...। বললাম -– নু নু – কী রে ? ,
    পার্থ বলল – বাঁড়া। লন্ডনে যাবার প্ল্যান করছি তো, তাই গানটা মনে এল। কলেজের একটা ছেলে বানিয়েছে গানটা। দারুণ না ? শোন --- সে পুরোটা গাইল।
    ১৯৬৩-তে কপিরাইটের কথা জানা থাকলেও আমি এই গানের কপিরাইট করাতাম কিনা সন্দেহ। কলেজের ছাত্রসঙ্গীত কলেজ থেকে কলেজে, সময়ে গড়িয়ে যাবে সেটাই তো স্বাভাবিক। নিজেদের ছোটখাটো প্রেম আর হাসি মস্করা, সিগারেট, কখনো রাম, এই নিয়েই কেটে গেল তিনমাস। মাঝে মাঝে একা একা সুবর্ণরেখার পাড়ে জলের দিকে চেয়ে বসে থাকা, ডিমনা লেকের ওপারে দলমার দিকে – এভাবে দিন কেটে যায় যায় – খবর এল রেজাল্ট বেরিয়েছে, কলেজে গিয়ে মার্কশিট আর সার্টিফিকেট নিতে হবে।
    রেলওয়ে স্টুডেন্ট কনসেশন পেপার শেষবারের মতো সাইন করানো ছিল কলেজ থেকে। আমি বেরিয়ে গেলাম। শিয়ালদা-তে গিয়ে দেখি দার্জিলিং মেলের প্ল্যাটফর্ম আমাদের কলেজের ছেলেতে ঠাসা। ক্লাসের ছেলেদেরও পেয়ে গেলাম। গাদাগাদি করে বসে নিজেদের পুরনো কাসুন্দি ঘাঁটলাম মজাসে, নতুন প্রেমের খবর নিলাম তাড়িয়ে। সেই প্রেম শুধু মেয়েদের সাথে না, জীবনের সমস্ত নতুন আকর্ষণই নতুন প্রেম। আর ... আমি প্যাক করে পাঠাবো ... কলেজের ছাত্রসঙ্গীত চলল ট্রেন কাঁপিয়ে। ঘুম। সকালে নিউ জলপাইগুড়ি। ট্রেন বদল। কলেজ। রেজাল্ট। পাশ, তবে খুব খারাপ না বলা যায়। আবার, বোধহয় শেষবারের মতো, আমার ৫ বছরের রুমমেটরা – গোবিন্দ, তপন আর স্বপনের সাথে দেখা হল। জড়িয়ে ধরলাম। চোখের জল কখনো বিট্রে করে না। মার্কশিট আর সার্টিফিকেট নিয়ে সবাই ফিরলাম। ১৯৬৭’র ১২ই আগস্ট শেষবারের মতো কলেজ বন্ধুদের বিদায় জানালাম শিয়ালদায়। এবার জামশদপুরে ফিরতে হবে।
    তার আগে দুদিনের জন্য গিয়ে উঠলাম আমাদের বাঘাযতীনের বাড়িতে। কাকা অনিল ঘোষাল ততদিনে সি পি এম-এর লোকাল নেতা। দলবল নিয়ে অনশনে বসে বাঘাযতীন হল্টকে বাঘাযতীন স্টেশন বানিয়ে ছেড়েছেমোড়ের বাসস্টপ থেকে স্টেশন পর্যন্ত রাস্তা সরু হলেও পাকা হয়েছে।  আর সেখান দিয়ে প্যান্ট গুটিয়ে শাড়ি তুলে হাঁটতে হয় না। ভাল কথা। মল্লিকপুরে দিদিমার বাড়ি গিয়ে আমার সুন্দরী বুড়ি দিদিমাকে প্রণাম করে জড়িয়ে ধরলাম। ছোটবেলার সুখস্মৃতি যাদের ছোঁয়ায় জেগে ওঠে তারাই আমার প্রিয়। তার মধ্যে দিদিমা আমার সবথেকে প্রিয়। এরপর একবার দীপের বাড়িও গেলাম আর্ল স্ট্রিটে একবার মল্লিকবাজারের মুখে গোরস্থানে মাইকেলের সমাধিতে। ছুঁয়ে গেলাম যা কিছু প্রিয় আমার। জানি না আবার কবে। আদৌ।
    জামশেদপুরে গিয়ে মার্কশিট আর সার্টিফিকেট দেখালাম মা বাবাকে। বাবা বলল –- এবার লেগে পড়। মানে দরখাস্ত, ইন্টারভিউ, লোক ধরাধরি। মা বলল --- চান করে খেয়ে নিয়ে শুয়ে পড়। আচ্ছা, কার কথাটা ভাল লাগা উচিত আমার ?
    পত্রিকা দেখে কয়েক জায়গায় দরখাস্ত করলাম পোস্টে। তখন কম্পুটার নেট মোবাইল নেই। ডাকঘরই ভরসা। শুনলাম চাকরির বাজার পড়ে যাওয়ায় সদ্য পাশ করা ইঞ্জিনীয়ারদের ভারত সরকারের তরফে পছন্দসই কারখানায় বাৎসরিক ট্রেনিং-এর ব্যবস্থা করা হয়েছে ভাল স্টাইপেন্ডের বিনিময়ে। আমি বাড়ির পাশের টিস্কো কোম্পানিতে ট্রেনিং-এর জন্য আবেদন করলাম সরকারের কাছে। পাকা চাকরির আগে ব্যবস্থাটা মন্দ না। কল এল। ফুর্তি। এসপ্ল্যানেড ইস্টের একটা অফিসে পৌঁছতে হবে বিশেষ দিনে। সেখানে সরকার, টিস্কো আর শিক্ষামন্ত্রকের একজন ইন্টারভিউ করবে। একদিন আগেই রওনা দিলাম রাতের গাড়িতে। মার্কশিটটা সযত্নে মানিব্যাগে গুছিয়ে রাখলাম ব্যাক পকেটে। ট্রেনে উঠে বসেছি, পেছনটা খালি মনে হল। হাত দিয়ে দেখি পকেটমার হয়ে গেছে। হায় হায় ! এবার ? তাড়াতাড়ি নেমে পড়লাম। ভোঁদার মতো এর ওর মুখের দিকে তাকিয়ে পকেটমারকে খোঁজার চেষ্টা করলাম। ব্যর্থ মনোরথ হয়ে বাড়ি ফিরলাম। ভেবেছিলাম ঝাড় খাবো। কিন্তু অবাক ! বাবা সিম্পলি বলল --- এই থেকে যদি তোর শিক্ষা হয়ে থাকে তবেই মঙ্গল। কাল সকালে আবার যাস। পরদিন খানিকটা আগেই বাড়ি থেকে বেরোলাম। স্টেশনে টিকিট কেটে আগে ট্রেনলাইনের ওপর আধ কিলোমিটার হাঁটলাম লাইনের পাশের কাগজ কুটির দিকে চোখ রেখে। কি জানি চোর হয়তো ফালতু ভেবে ব্যাগ আর কাগজ পত্র ফেলে দিয়ে গেছেকিছুই পেলাম না।
    ইন্টারভিউ বেশ ভাল ভাবেই হল। ওরা বললেন --- তোমার হয়ে যাবে, তবে ৭ দিনের মধ্যে ডুপ্লিকেট মার্কশিট দেখাতে হবে এই অফিসে।
    কলকাতায় উঠেছিলাম বাঘাযতীনের বাড়িতে। কাকা একচোট জ্ঞান দিলো। চুপ করে রইলাম। পরদিনই রওনা দিলাম দার্জিলিং মেলে। জলপাইগুড়ি গভর্নমেন্ট ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজের প্রিন্সিপাল এন-সি-মজুমদার আমাদের ইলেকট্রিকালের হেড ছিলেন। বললেন --- ডুপ্লিকেট মার্কশিটের জন্য তোমাকে ইউনিভার্সিটিতে যেতে হবে। আমি ফরোয়ার্ড নোট লিখে দিচ্ছি, নিয়ে চলে যাও। কোথায় জানো তো ?  --- জানি স্যার, থ্যাঙ্ক ইউ।
    রওনা দিলাম। মাষকলাইবাড়ি থেকে বাসে শিলিগুড়ি, তখন বারোটা বাজে। খেয়ে নিয়ে আবার অন্য বাসে রামমোহনপুর চললাম। কোন আইডিয়া নেই কোথায় রামমোহনপুর, কতদূর, কেমন দেখতে আমাদের ইউনিভার্সিটি। ডুপ্লিকেট পেতে কত দেরি হবে। সবই অনিশ্চিত। দেখি একটা গ্রামের স্টপে বাস দাঁড়ালো, নাম নক্সালবাড়ি। গায়ে কাঁটা দিলো। পরের স্টপটাই ফাঁসিদেওয়া। আরি ব্যাস ! আমার চোখ ছানাবড়া। পাবলিক চুপ করে গেছে। যেন সন্ত্রস্ত। এই সেই নক্সালবাড়ি আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু ? খাসা জায়গা তো ! স্থানমাহাত্ম দেখে ভাবলাম এখানেই তো কোন একটা সাবজেক্টে মাস্টার করলে পারতাম। ওদের পেটের টানের লড়াইকে আমার রোমান্টিক মনে হল। আমি কি তবে বুর্জোয়া ? রামমোহনপুর জায়গাটা গ্রামিন, সবুজ সুন্দর, অনেক বড় ক্যাম্পাসের মধ্যে ছোটখাটো বিল্ডিং, সবে গড়ে উঠছে। আশেপাশে লোকজন বেশ কম।
     খুব সহজেই ডুপ্লিকেট মার্কশিট পেয়ে গেলাম। আমি হেভি খুশি। পকেটস্থ করলাম জেরক্স করে। কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে সন্ধ্যার মুখে শিলিগুড়ি চলে এলাম। আর কি। নিউ জলপাইগুড়ি আর দার্জিলিং মেল। সে সময় তেমন ভিড় হতনা দার্জিলিং মেলে। সোজা ফারাক্কা ব্রিজ দিয়ে যেতো। গঙ্গার রোমান্সটা মিস হতো। কলকাতায় থাকতে হবে কয়েকদিন সেই এডুকেশন অফিসের ডেট পর্যন্ত। আমি স্বপনের বাড়ি বিক্রমগড় যাদবপুরে উঠলাম। ওর বাবা আবার ট্রান্সফার হয়েছেন কলকাতায়। বাড়ির সবাই খুশি হল। ও নানা জায়গায় ট্রাই করছে। শেষে নির্ধারিত দিনে এডুকেশন অফিসে গিয়ে মার্কশিট জমা দিয়ে টিস্কোতে ট্রেনিং-এর অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার নিয়ে এলাম। ১-লা সেপ্টেম্বর জয়েন করতে বলেছে। স্টাইপেন্ড দেবে ৮০০ টাকা মাসে। তাই সই। বাবা আমাকে পড়ার জন্য গত পাঁচ বছর ১২০ টাকা করে দিয়ে গেছে। সেখানে ৮০০ টাকা অনেক। বাকি পরে দেখা যাবে। মাসীমাকে বললাম --
    --- পরশু বাড়ি যাবো মাসীমা, কাল শুঁটকি মাছ খাওয়ান। আপনার ওই রান্নাটা বেস্ট লাগে আমার। মনে আছে ? সেই ঝালুং-এ খেয়েছিলাম। এখনো মুখে লেগে আছে।
    --- কেন গ্যাস মারছিস শালা, বমির কথা বলে দিই ? চাপা স্বরে বলল স্বপন।
    --- এই মাইরি, না না, মনে ফুর্তি। বেলুন ফুটো করিসনা বে। ... ... ...

    একদিন বাবার সাইকেলে টিস্কোর ট্রেনিং ডিপার্টমেন্টে গিয়ে রিপোর্ট করলাম। সেখানে আমরা মোট ৩০ জন। টিস্কো কারখানার ম্যাপ খুলে বোর্ডে ঝুলিয়ে আমাদের বোঝানো হল শহরের মধ্যে কারখানার অবস্থান, গেট, বিভিন্ন শপ, পথঘাট, ক্যান্টিন, ইত্যাদি। সেফটি ট্রেনিং দেওয়া হল প্রথমে। মেডিকাল সেন্টার। স্ল্যাগপাহাড়ের ওপরে রেললাইন। সেখানে ট্রলিতে গরম স্ল্যাগ নিয়ে একটা ইঞ্জিন গিয়ে দাঁড়ায়। আর একজন মানুষ ট্রলিগুলো একে একে উল্টে দেয়। বাইরে পুরো আকাশ লাল হয়ে যায়। জামশেদপুর থেকে রোজ আমরা সেই লালিমা দেখি। এমনকি ঝাড়গ্রাম থেকেই জামশেদপুরগামী ট্রেন বাস-এ বসেও এই পুলক নজরে পড়ে। দ্বিতীয় আর একটা ব্যাপার আমাদের মন কাড়লো। কারখানার ঠিক মধ্যখানে দুটো বিশাল পুকুর আছে। এতে সুবর্ণরেখার জল পাম্প করে আনা হয় প্রথমে একটা পুকুরে। সেই জল পাম্প করে বিভিন্ন শপে গরম লোহাকে ঠান্ডা করার পর এনে দ্বিতীয় পুকুরে ফেলা হয়। সেটা ফিল্টার করে আবার প্রথম পুকুরে। এই সাইকল চলতেই থাকে। পুকুরপারে কিছু গাছপালা ঝোপঝাড় হয়ে রয়েছে। আমরা আরামসে তার মধ্যে বসে আড্ডা মারার জায়গা খুঁজে বার করলাম। ৫ জন করে ৬টা দলে ভাগ করা হল আমাদের, আর ৬টা ট্রেনিং শপ ভাগ করে দেয়া হল। আমরা ৫ জন হলাম আমি আর মুরারী পাত্র আমার কলেজের, দুজনেই ইলেক্ট্রিকাল, রামায়ন শর্মা সিন্দ্রীর, অজয় কাম্বলে বোম্বাই কলেজের আর মনি কুন্ডা কর্নাটক কলেজের। আমি বাড়িতে থাকব আর বাকিরা হোস্টেলে। আমাদের জমে গেল তাড়াতাড়িই। সকাল ৭টা থেকে শুরু, মাঝখানে জলখাবারের সময় সবাই পুকুরপারে, দুপুরে লাঞ্চে ক্যান্টিনে দেখা, বিকেল ৫-টায় কারখানার ছুটিতারপর বাড়ি। সাইকেলটা আমাকে দিয়ে বাবা অন্য ব্যবস্থা করে নিয়েছে। কখনো আমরা সবাই হোস্টেলে বা দোকানে বসে চা, পান, টুকিটাকি খাবার খাই, রামায়ন, অজয় আর মনি’র দেশের, কলেজের গল্পগুলো শুনি, নতুন লাগে। খুব মজা।
    ১-লা অক্টোবর মাইনে পেলাম ৮০০ টাকা। পকেটটা গরম মনে হল। আরাম। গর্ব। বাড়ি এসে বাবাকে খামটা দিয়ে দিলাম। আমাকে ১০০ টাকা দিয়ে বাবা রেখে নিলো। শোধ শুরু হল আমার সেই প্রথমবার। টাকাটা আমি গিয়ে মায়ের হাতে দিলাম। মা আমাকে ফেরত দিয়ে বলল --- খুব খুশি হয়েছি তোর ওপর, নে স্বপন, তুই রাখ এটাআমি জীবনে ভুলবনা সেদিনের কথা
   
    প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছিল আমার ঠাকুর্দা। তারপর থেকে প্রতিটা স্কুলে কলেজে  কলকাতা জলপাইগুড়ি চাকরিতে আমি একাই গিয়ে সব ম্যানেজ করে বেরিয়ে এসেছি --- এরকম ভাবতে ভাল লাগে, আমার অহমিকা বোধহয়, কিভাবে যেন হারিয়ে গেলাম সংসার থেকে। এখন আমার মনে আর কোন ক্ষোভ রইল না।
                                 [প্রথম খণ্ড শেষ]
                                     -------------                  

Comments