সিনেমা - Benny’s Video - সোহম





সিনেমা
 | |সিনেমা – Benny’s Video
নির্দেশক – Michael Haneke
দেশ – Austria



সিনেমার জগতে মানুষের মনস্তত্ত্ব নিয়ে সিনেমা অনেক সৃষ্টি হয়েছে। তার বেশীরভাগই মানসিক রোগভুক্ত চরিত্রটিকে হয় ভিলেন হিসেবে উপস্থাপিত করে অথবা তার প্রতি আমাদের সমবেদনার উদ্রেক ঘটায়। মাইকেল হ্যানেকের সিনেমা ঠিক সেভাবে মনস্তত্ত্বকে উপস্থাপন করে না। এবং সেখানেই ওনার বিশেষত্ব। ওনার সিনেমায় মনস্তত্ত্ব ব্যক্তিকে ছাড়িয়ে সমাজে ঢুকে পড়ে, এবং তা এভাবেই দেখানো হয় যে সেটা একটি অতি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। দর্শকের তাই কখনই মনে হয় না যে চরিত্রটি তার থেকে আলাদা, এবং কখনও কখনও মনে হয় যে একি পরিস্থিতিতে হয়ত সেও একি কাজ করত। এবং অবচেতনের এই ভাবনাটা তাকে ভয় পাইয়ে দেয়। সে বুঝতেও পারে না কিন্তু সিনেমাটা তার ভেতরে প্রবেশ করে তাকে তার ভিত থেকে নাড়িয়ে দিয়ে যায়।
উপরোক্ত সিনেমাটিও হ্যানেকের অন্যান্য মনস্তত্ত্বের সিনেমার ধারার মধ্যে পড়ে। হ্যানেকের নাম হয়ত কেউ কেউ শুনে থাকবেন ‘Amour’ সিনেমাটির নির্দেশক হিসেবে। বলে রাখা দরকার, এই সিনেমাটা আমি দেখিনি এখনও, তবে যতটুকু শুনেছি এটি হ্যানেকের হাত থেকে তৈরী একেবারে একটা অন্য ধারার ছবি। সুতরাং ‘Amour’ দিয়ে ‘Benny’s Video’-এর চলচ্চিত্র নির্মাণ ও genre নির্ধারণ করা একেবারেই সম্ভব নয়। Benny’s Video হ্যানেকের তৈরী দ্বিতীয় ছবি ও একমাত্র একটি পুরস্কার প্রাপ্ত –European Film Academy Critics Award. বলাই বাহুল্য, 1992-এ তৈরী এই সিনেমাটি তখনকার সময়ের থেকে অনেক এগিয়ে ছিল। আজকের দুনিয়ার মানুষ যখন আরো বেশি আত্মকেন্দ্রিক ও অসংবেদনশীল হয়ে উঠেছে, নিজেকে টেলিভিশন, ভিডিও গেম, স্মার্টফোনের এক অবাস্তব জগতে মুড়ে রেখেছে, এই সময়ে হ্যানেকের ৯০-এর দশকের তৈরী সিনেমাগুলি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। একই ঘরানার অন্য একটি সিনেমা হয়ত দর্শকমহলে কিছু বেশী পরিচিত। সেটার নাম Funny Gamesতার একটা কারণ হল হ্যানেকে সিনেমাটি 2007-এ পুনর্নির্মাণ করেন। নিজেরই তৈরী দশ বছর পুরনো সিনেমা আবার বানানোর পিছনে কারণ নিশ্চয়ই আছে। হ্যানেকের ছবি বানানোর কেরিয়ার কেউ যদি ঘেটে দেখেন তাহলে দেখতে পাবেন যে উনি ২-৩ বছরে একটি ছবি বানান। এবং ওনার প্রতিটা ছবি সমাজের কোনও না কোনও অবক্ষয়কে তুলে ধরে। সম্প্রতিকালের ‘Amour’-ও সেই জায়গা থেকে সরে আসেনি।

মূল সিনেমাটা নিয়ে কথা না বলে নির্দেশক ও তার ঘরানা নিয়ে অনেকটা কথা হয়ে গেল। তার দুটো কারণ। এই ছবিটা বা হ্যানেকের অন্য সব ছবি নিয়ে কথা বলার আগে ওনার সিনেমার ঘরানাটা বুঝে নেওয়া দরকার। নাহলে ওনার সিনেমা তৈরীর পিছনে যে কারণ ও প্রাসঙ্গিকতা কাজ করেছে সেটা আমরা ধরতে পারব না। এবং সেটা না পারলে সিনেমাটার উদ্দেশ্যটাই মাটি হয়ে যাবে। দ্বিতীয় কারণ হল সিনেমাটার গল্প খুবই সংক্ষিপ্ত। সেটা একটা প্যারাগ্রাফেই শেষ হয়ে যাবে। তাই সেই গল্পের আগে ও পরে কিছু থাকা দরকার। এবং গল্পটা দেখলে সেই আগে ও পরেটা স্বাভাবিকভাবেই মনের মধ্যে উঁকি মারতে থাকে। তাই সেটাকে লিখে ফেলার প্রয়োজনীয়তা আছে। একটা সিনেমা শুধু একটা মনোরঞ্জন হিসেবে পেশ হতেই পারে, তাতে কারো আপত্তি তোলার কিছু নেই। কিন্তু সেটা যখন একটা শিল্প ও একইসাথে সমাজের আয়না হিসেবে উপস্থিত হয়, তখন সেটাকে নিয়ে কিছুক্ষণ চর্চা করা কাম্য।

সিনেমার শুরুতে আমরা একটা হোমমেড ভিডিও দেখি যাতে একটা শুয়োরকে একটা লম্বাটে ধরনের হাতে ধরা বন্দুক (হয়ত পাইপগান জাতীয় কিছু, দুঃখিত আমি বিশেষ বন্দুক চিনি না) দিয়ে কপালে গুলি করে মারা হয়। এটা বেনির রেকর্ড করা একটা ভিডিও তাদের গ্রামের ফার্মে কোন একদিন শুয়োর মারার সময়। ভিডিওটা রিওয়াইণ্ড করে আবার গুলি করার মুহূর্তটা দেখানো হয়। এরপর আমরা একটা পার্টির ভিডিও দেখতে পাই যেখানে বেনির দিদি ইভা একধরনের জুয়া খেলা বানায় ‘পাইলট’ নামে। পার্টির মাঝখানে বেনির বাবা ও মা চলে আসায় পার্টি গুটিয়ে নিতে হয় ও ইভা তার নিজের আপার্টমেণ্টে চলে যায়। এরপর বেনির ঘরে এসে বেনির বাবা তার দিদির পার্টি সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করে ও বেনি নিরুৎসাহে উত্তর দিয়ে যায়। এবং আমরা বেনির ঘর দেখতে পাই যেখানে একটা বিশাল টিভি ও ক্যামেরার সেটআপ রয়েছে। তার জানালা সব পর্দা দিয়ে ঢাকা কিন্তু জানালার বাইরের দুনিয়াটা সে একটা ক্যামেরায় বন্দি করে টিভিতে চালিয়ে রাখে সর্বক্ষণ। এটা থেকেই বোঝা যায় কতটা সে বাস্তব দুনিয়া থেকে বিমুখ হয়ে পড়েছে। টিভিতে ভিডিও বাদে নানান প্রোগ্রাম আর খবর আমরা দেখতে পাই গোটা সিনেমা জুড়েই মাঝেমধ্যে, যেগুলো সবই কোনও না কোনও অবক্ষয়ের ছবি তুলে ধরে দর্শকের সামনে। পরের উইকেণ্ডে বেনির বাবা মা বেরিয়ে যায় বেনিকে একা রেখে। ব্যাপারটা খুবই নিয়মিত এটা বোঝাই যায় বেনির কোনরকম হেলদোল না দেখে। তার জন্য খাবারদাবার সব মজুত করে রাখা আছে ফ্রিজে এই খবরটা সে তার মায়ের লিখে যাওয়া একটা চিরকুটে দেখতে পায়। সামান্য খাওয়াদাওয়ার পর সে তার নিয়মিত ভিডিও স্টোরে যায় এবং সেখান থেকে ভিডিও ভাড়া করে। স্টোরের বাইরে এক অচেনা মেয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভিডিও দেখছে দেখে সে কৌতূহলী হয়ে তার সাথে কথা হলে ও তাকে ঘরে নিয়ে যায়। সেখানে কথাবার্তা খাওয়াদাওয়ার পর প্রথম দৃশ্যের সেই শুয়োর মারার ভিডিওটা তারা আবার দেখে। বেনি পাইপগানটা একটা ডেস্ক থেকে বার করে লোড করে ও নিজের বুকে ঠেকিয়ে মেয়েটাকে বলে ট্রিগার টিপতে। মেয়েটা বন্দুকটা নিয়ে রেখে দেওয়ায় বেনি ওকে ভিতু বলে ভ্যাঙায়। মেয়েটা তখন বেনিকে ভিতু বলে ও নিজের পেটে বন্দুকটা ঠেকিয়ে বেনিকে ট্রিগার টিপতে বলে। বেনি ট্রিগার টিপে দেয় ও মেয়েটা মেঝেতে পড়ে যায়। মেয়েটা পড়ে যেতেই আমরা টিভি স্ক্রিন দেখতে পাই যেখানে এই গোটা ঘটনাটা রেকর্ড হচ্ছে। মেয়েটা মেঝেতে ঘষ্টাতে ঘষ্টাতে ফ্রেমের থেকে বেরিয়ে যায় ও চিৎকার করতে থাকে। বেনি থতমত খেয়ে যায়, মেয়েটাকে চুপ করতে বলে ও সে চুপ না করায় শেষ পর্যন্ত পাইপগানটা আবার লোড করে নিয়ে যায় ও মেয়েটাকে গুলি করে। এভাবে আরো একবার গুলি করার পর মেয়েটা মারা যায়। এরপর আমরা দেখি বেনির আপাত শান্ত মনোভাব। সে খাওয়াদাওয়া করে, মেয়েটার লাশটা আলমারিতে ঢোকায়, রক্ত মোছে, তারপর বন্ধুর সাথে বিকেলে একটা পার্টিতে যায় ও রাতে বন্ধুর বাড়িতেই কাটিয়ে দেয়। পরদিন বাড়ি ফেরার পথে সে তার মাথা নেড়া করে ফেরে, সম্ভবত একধরনের অনুতাপের বশবর্তী হয়ে, যেটার অন্য কোনও বহিঃপ্রকাশ আমরা দেখতে পাই না। বাড়িতে সে বাবার কাছে তিরস্কৃত হয় ও এখানে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের কথা ওঠে। বস্তুতঃ, সিনেমাটি জার্মান ভাষায় এবং তার মধ্যে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের উল্লেখ মনে করিয়ে দেয় যে মানুষের প্রাণের মূল্য এই দুনিয়ায় আর সিকিটিও নেই। বাস্তব দুনিয়াতেও রোজই আমরা নতুন নতুন হিংসার কথা শুনতে থাকছি। চারিদিকে এতো হিংসার মধ্যে বেড়ে ওঠা শিশুরা ও কিশোররা কি সেটাকেই স্বাভাবিক বলে মনে করে নেয়? এতটাই স্বাভাবিক যে নিজে যখন কাউকে খুন করে ফেলে, তখন তার একবারও কিছু মনে হয় না।

যাই হোক, সেই রাতেই বেনি তার মাকে তার খুব করার ভিডিওটা দেখায়। আমরা বেনির মায়ের মুখ দেখি এবং দর্শক হিসেবে ঘটনাটা ঘটার সময় আমরা যেভাবে টিভির পর্দায় একবার এদিকে একবার ওদিকে তাকিয়ে দেখেছিলাম, বেনির মাও ঠিক সেভাবে দেখে গোটা বিষয়টা। দর্শককে এভাবেই হ্যানেকে বেনির থেকে বের করে বেনির মায়ের সাথে তাদের একাত্বতা সৃষ্টি করেন। বেনির বাবা ও মা আলোচনা করে ঠিক করে যে মেয়েটির দেহটি সরিয়ে ফেলতে হবে কারণ তখনও কেউ কিছু জানে না এই ব্যাপারে। বেনিকে নিয়ে বেনির মা বেরিয়ে যায় ইজিপ্টে। সাতদিন পিরামিড, সমুদ্র, ইত্যাদি দেখার মাঝে একদিন বেনির মা নিজেকে আর ধরে রাখতে না পেরে কান্নায় ভেঙে পড়ে। বেনি বুঝে উঠতে পারে না তার মায়ের কান্নার কারণ, বা হয়ত বুঝেও তার বহিঃপ্রকাশ করে না।সাতদিন পর ফিরে এসে বেনি দেখে সব নিঁখুত তাদের ঘরে। তার বাবা মেয়েটার দেহ ছোট ছোট করে কেটে কোনভাবে সেটা সরিয়ে ফেলেছে। নিজের ঘরে ঢুকে সে দেখে তার জানলার সব পর্দা নামিয়ে ফেলা হয়েছে। যেই ঘরটাকে আমরা আগে অন্ধকারে ঢাকা একটা ঘর দেখেছিলাম সেই ঘর এখন আলোয় ঝলমল করছে। এরপর বেনির স্কুলে একটা কনসার্টে আমরা বেনিকে গাইতে দেখি, যে গানের মানে হল পৃথিবীতে যতই কিছু ঘটে যাক, আমি শান্ত থাকব। সমাজের অবক্ষয় ও হিংসার পরিপ্রেক্ষিতে মানুষের চুপচাপ মেনে নেওয়াকে হ্যানেকে এখানে তিরস্কার করে যান।

কিন্তু এত কিছু করেও শেষরক্ষা হয় না। বেনির বাবা মায়ের রাতের সেই আলোচনা বেনির কাছে টেপ করা ছিল আমরা সেটা দেখতে পাই, এবং ভয়েসওভারে একজন পুলিশ জিজ্ঞেস করে যে বেনি এখন কেন ওদের কাছে এসেছে। বেনি কিছু বলতে পারে না। বেনির বাবা মাকে নিয়ে আসা হয় এবং বেনি তাদের দেখে অচেনা কারো সাথে মুখোমুখি হওয়াতে যে ‘দুঃখিত’ বলে সেরকম বলে পাশ কাটিয়ে চলে যায়। এখানেই সিনেমার শেষ হয়।

গোটা সিনেমাটা দেখাতে গিয়ে হ্যানেকে কোথাও কোনওরকমের ওঠানামা করেননি, তা ক্যামেরা হোক, সাউণ্ড হোক, ডায়লগ ডেলিভারি হোক। এবং এখানেই তার মুন্সিয়ানা। এইভাবেই সিনেমাটাকে একটা স্বাভাবিক জীবন হিসেবে হ্যানেকে আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন। আর যতই সিনেমাটাকে বাস্তবের কাছাকাছি নিয়ে এসেছেন তিনি, ততটাই দর্শকের অবচেতন মনটাকে ধাক্কা দিয়ে গেছেন। সিনেমার মূল টার্নিং পয়েণ্টগুলো উনি ধরেছেন ভিডিও রেকর্ডিং-এর ভঙ্গিমায়। যেটা সিনেমাটার মূল চরিত্র বেনির নেশা এবং বাস্তব দুনিয়াতেও অনেকেরই। যারা ভিডিও দেখতে ভালোবাসেন, অথচ বাইরের চলমান দুনিয়াটার থেকে নিজেকে আলাদা করে রাখেন। এভাবেই তৈরী হয় এক অদ্ভূত মানসিক অসুস্থতা, যা আমরা হয়ত টেরও পাই না। উপরন্তু, তাকে স্বাভাবিক বলেই মেনে নেই। যেমন স্বাভাবিক বলে মেনে নিয়েছি ঘণ্টার পর ঘণ্টা টিভি, কম্প্যুটার, মোবাইল ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকা এই জীবনটাকে। যেমন স্বাভাবিক বলে মেনে নিয়েছি আসল পৃথিবীর রক্তপাত, হিংসা, হত্যা ও মানুষের কমতে থাকা জীবনের মূল্যকে। | |

Comments