বন্ধুদের কথাবার্তা ৩







বন্ধুদের কথাবার্তা

রাজর্ষি দাশ ভৌমিক



বন্ধুদের কথাবার্তা

৩.
ঈশ্বর কাউকে কাউকে কান দেন, বাকিদের বন্ধুবান্ধব।এটি একটি সৎ লাইন,যেমন একটি সৎ লাইন দিয়ে হেমিংওয়ে লেখা শুরু করতে বলেছিলেন।কানহীন, নেই-ই যখন তখন কর্তিত হওয়ার প্রশ্নই আসছে না, সেই দুর্ভাগারা বন্ধুদের কাছে গিয়ে শ্রুতঅশ্রুতকে বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য ঝোলাঝুলি করে।মুখনিঃসৃত অমৃতসুধা-বুঝবার জন্য ছোটা ব্রিস্টলে নিয়ে যেতে প্রতিশ্রুত হয়।অধরামাধুরি কি আর সাধে বলে, কার্লসবার্গ-ফিঙ্গারচিপসের পরেও দেবী সরস্বতী মর্ত্যধামে এসে সুরলাঞ্ছনা শেষ না করে হয়তো বা জেন্টস টয়লেটের পাশ দিয়েই বিদায় নেন।আমরা বন্ধুদের ঢেঁকুরের শব্দ শুনি, আমাদের অতৃপ্তি শব্দহীন কারণ কোন শব্দই তো অন্তরে প্রবেশ করেনি, যেটুকু প্রবেশ করেছিলো তা ওই সুর। সেই সুরের চরণ অনুসরণ করে পাকড়াও করি মতিউরকে, আমার বন্ধু।

কোলকাতায় যাদের রক্তে এখনো পাঠানি বিশুদ্ধতা রয়ে গেছে তেমন ঘরের ছেলে বলে নিজেকে দাবি করে থাকে মতিউর।সম্প্রতি মুক্তি পাওয়া একটি ড্রাকুলাবিষয়ক মুভিতে দেখলুম ট্যাগলাইন- every bloodline has a beginning। সন্দেহাতীত ভাবে মতিউরের ব্লাডলাইনের শুরুয়াৎ ও চলন জানা আমার উচিৎ ছিল, তাহলে হয়তো তাকে সঙ্গীতবেত্তা বলে ভাববার ভ্রম করে বসতাম না। সুরটুকুকে আঁশের মত মাছ থেকে সরিয়ে এনেছিলাম।পড়ে ছিল স্রেফ কথাকটি , উর্দুজবান, মাথায় ঢুকছিল না।মতিউর যদিও চিরকাল ‘পাঠভবন’, তবে নিকটাত্মীয়দের মধ্যে পরলোকগত দাদী ছিলেন উর্দুজবানে চোস্ত।দাদীর একটি উক্তি এই সেদিনও মতিউর খবরের কাগজে রাজমাতা নীতা অম্বানির পঁয়ত্রিশ লাখি শাড়ির ছবি দেখে স্মরণ করলো-বড়লোকেরা রঙবেরঙের হাগতেও পারে!উর্দুতে চোস্ত দাদী প্রবাদপ্রবচনগুলি বাংলাতেই বলতেন।

তেমন বন্ধুও ছিলেন, যিনি জগজিৎ সিং এর মৃত্যুতে আমার নিলির্প্তি দেখেশুনে বিন্দুমাত্র বিচলিত হন-নি, উলটে সরল স্বগোতক্তি করেছিলেন-সেই দিনটি কতই না রোমাঞ্চকর হবে যেদিন তুমি জগজিৎ সিং শোনা শুরু করবে এবং পুনঃ পুনঃ চমকিত হবে। তিনি ভবিষ্যতবেত্তা, মানুষের শেষের সে দিন দিব্যচক্ষে দেখতে পান। দুঃখের দিনের বিষের নাম জগজিৎ সিং।তার সুরমূচ্ছর্নায় কাহিল হয়ে সবে যখন একটু সুস্থ হবো হবো বোধ করছি, চোখে পড়লো শব্দদুটো-পারশিস্‌-এ-ঘম্‌।

সন্তানহারা মায়ের দুঃখের সঙ্গে বুকে শেল বেঁধার তুলনা করা হয়ে থাকে। লক্ষণের শরীর থেকে শেলকে বেড় করে যখন সেই শক্তিশেলকে রাখবার জায়গা পাওয়া যাচ্ছে না তখন এক সন্তানহারা রমনী এগিয়ে এসে নিজের বুকে শক্তিশেলকে ধারন করেন।সন্তানহারা রমনীর বুকে প্রখর শক্তিশেলও তৃণবৎ হয়ে রয়ে গেল। মধ্যবিত্তের গলায় ট্যাংরা মাছের কাঁটাও বুঝি অনুরূপ ফোটে।আমার হৃদয়ে তেমনি আবদ্ধ রইলো-পারশিস্‌-এ-ঘম।মানে কি!জানা দরকার।
একটু নজর ঘোরালেই দেখা যাবে চতুর্দিকে উর্দুবিশেষজ্ঞ বন্ধুবান্ধব গিজগিজ করছে, থার্ড ল্যাঙ্গুয়েজ বলে একটি বিষয় খাঁটি বাপ-মাহারা বঙ্গীয় মধ্যশিক্ষা বোর্ডের সিলেবাসে থাকে-যেখানে প্রায় সকলেই স্যানসকৃট নেয় এবং গোদাবরী তীরের বিশাল বৃক্ষটির নিচেই নিজেদের শিক্ষার বজরাটিকে আজন্মকালের জন্য ভিড়িয়ে নিশ্চিন্ত হয়।কেলাস এইটে নিয়ম ছিল প্রতি ধাতুরূপ-শব্দরূপ মিসটেকে দশটি করে উঠবোস, অনেকের কোমল হৃদয়ে নিশ্চয় এই সব দাগ দ্গদগে রয়ে গেছে। তো সেই বিভীষিকাময় তিনটি ভাষাশিক্ষার প্রাচীর পেরিয়ে বঙ্গীয়যুবকূল কি করে চর্তুর্থ ভাষা হিসেবে উর্দুকে রপ্ত করলো তা বুঝতে সমস্যা হচ্ছিলো।মতিউর বললো-উর্দু শেখাটা আসলে নিচু ক্লাসের ব্যাপার নয়, হাই ক্লাসের।মতিউরকে কমিউনিস্ট বলে জানতাম,সকালের চা-ও হবস্‌বমের বইয়ের উপর না রেখে খায় না।আমি দুহাত উলটে দিলাম-ভাষাশিক্ষাতেও ক্লাসস্ট্রাগল, ভেবেছিলাম স্যানসকৃটেই স্ট্রাগলটা প্রপার ছিল, এখন দেখছি আপারক্লাসেও উঠে এসেছে।মতিউর ভুল ভাঙিয়ে দিল-না ভাইটি, এ ক্লাস আক্ষরিক ক্লাস,তবে ক্লাস সেভেন-এইট নয়, ফার্স্ট ইয়ার-সেকেন্ড ইয়ার, নিদেনপক্ষে ইলেভেন-টুয়েলভ।মানে, যে বয়সে মানুষ প্রেমে পড়ে এবং অবধারিত ভাবে ব্যর্থ নয়, বাল্যপ্রেমে যতখানি অভিশাপ থাকে তার থেকে অভিশাপে বাল্যপ্রেম থাকে ঢের বেশি-বাল্যে এ সত্যটি বোঝা যায় না কি না!ফলতঃ আলতাফ রাজা শোনা শুরু করে এবং বর্ষার দিনে রাম খায়।আমি বললাম-আমি তো বৃষ্টি না হলেও রাম খাই।মতিউর মাথা নাড়লে-সকলে অতটা ডিক্লাসড হতে পারে না।আমি আলোচনাকে পুনরায় আসল খাতে ফিরিয়ে আনি-হ্যাঁ, আমাদের সকলের উর্দুভাষাশিক্ষা আলতাফ রাজা একাডেমীতেই।

-আমার নয় যদিও, জানিসই তো, আমার রক্তে উর্দু জবান।আমি আলতাফ রাজাকে অস্বীকার না করে পারি না,কি সব গান-পহলে তো কভি কভি ঘম্‌ থা, আব তো হর পল হি তেরে ইঁয়াদ সাতাতি হ্যায় ইত্যাদি।যেন পায়েসের মধ্যে বিরিয়ানির মাংস।শুনে, বিবাগী মাদীমদ্দারা বর্ষার দিনে রাম খেয়ে উদ্দাম নাচছে।মতিউর বলে চলে-এভাবে যখন একটু পয়েজড্‌ হয়, উর্দু জ্ঞান হোক বা না হোক, গজলের চলনটা মনে বসে যায় তখন সাহস করে জগজিৎ সিং-তালাত মাহমুদে ঢুকে পড়ে আর আজীবন বন্দী হয়ে যায়, সাহসটাই আসল, মেজাজটাই রাজা।মতিউর আমার পিঠে এক কোমল রদ্দা চাপায়।

আমি সহমত না হয়ে পারি না, সকল কার্যের পিছনেই কারণ থাকে, খুঁজে পেতে দেখলে কারণটিকে আবিষ্কার করা তেমন কঠিন কিছু নয়।কিভাবে কিশোরকুমার শুনছি বা ডনোভানে আবিষ্ট হলাম-তারও নিশ্চই জটিল পজিটিভনেগেটিভআর্থিং এর জটাজুট পেরিয়ে উৎপত্তিস্থল আছে।জগজিৎ এর উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশের মত স্পষ্ট কোনটিই নয়-স্বয়ং অবধূত বিরচিত মরুতীর্থ হিংলাজ যেন জগজিৎ,প্রেমতৃষ্ণায় ছাটি ফেটে যেতে যেতে প্রজন্ম-প্রজন্মান্তর জগজিৎ নাম্নী মরুদ্যানের দেখা পাচ্ছে। না কি প্রকৃতপ্রস্তাবে-মরীচিকা!

সবিনয়ে নিবেদন করি , আমার কপাল মন্দ, আমার প্রেমিকারা এভাবেই জগজিৎকে খুঁজে পেয়ে থাকলেও আমার দর অতটা উঁচু নয়। নিতান্তই একটি গান, একটি সুর, একটি বাক্যের সামনে থতমত বসে পড়া। ইঁহা রোজ নিঁগাহে গিঢ়তি হ্যায়,ইঁহা রোজ কেয়ামত হোতি হ্যায়।এটুকু দিব্যি বুঝেছি-কাছাকাছি রবি ঠাকুর লিখেছেন-তোমার চোখে দেখেছিলাম আমার সর্বনাশ।বাঙালির মত মিশেলপটু কেউ নয়, বিরিয়ানিতেও আলু গুঁজে তবে ছেড়েছে।জগজিৎ-এ রবি ঠাকুর গুঁজে একজনই লিখতে পারতেন, এবং লিখলে সে যে কি চিজ্‌ হত-সৈয়দ মুজতবা আলি।কিন্তু সে কায়রোও নেই, সেই বন্‌ও নেই রে ভাইটি। আছে ছোটা ব্রিস্টলে ফিশ ফিঙ্গার, মতিউর, ধর্মতলার সমাবেশের শেষের জ্যাম টপকে বাড়ি ফেরার চিন্তা।

মতিউরের কাছে জানতে চাই-এই লাইনটা শুধু একটু বুঝিয়ে দে তাহলেই হবে। মতিউর গাল পাড়ে-কমিউনাল বলে।সে অসাধারন সিস্টেম অ্যানালিস্ট, ব্যাডমিন্টন প্লেয়ার সেসব নিয়ে কোন দিন টুঃ শব্দও না করে উর্দুর প্রয়োজনে তাকে ধরতে এসেছি,ইত্যাদি।আমি আরেক প্লেট ফিশ ফিঙ্গার অর্ডার করে মতিউরের উচিৎক্ষোভকে যথাসাধ্য প্রশমিত করার চেষ্টা করি। মোলায়েম গলায় জানতে চাই-মাছটা কি ভালো নয়, এই নে কাসুন্দি।

পুরানো কাসুন্দির যতই নিন্দেমন্দ হোক, পুরানো কাসুন্দিই গজলের অর্থ বুঝতে সহায়ক হয়।পুরানো কাসুন্দি পেলেই গজল-অচলদের ভাগ্য খুলে যায়, মানের পরত বোনচায়নার প্লেটে পড়ে থাকে।মতিউর বেশ করে ফিশ ফিঙ্গার কাসুন্দিতে মাখিয়ে বলে-ভেবেছিলো, ওর দুঃখের কথা জানতে এসেছে, কিন্তু বলাও যাচ্ছে না, আবার চুপ থাকাও মুশকিল।কারণ...কারণ... কারণ ওই সাবা আফগানিকেই জিজ্ঞেস করে নে, যে গজলটা লিখেছে।

কারণ জানবার জায়গা ছোটা ব্রিস্টল নয়, সে তো কারনের জায়গা।ফিশ ফিঙ্গারের শেষ একটি পিস কাসুন্দিতে মাখিয়ে অর্ধতৃপ্ত হয়ে বিলের দিকে তাকাই। মাছের কাঁটা গলায় বেঁধে, বুকে বেঁধে ফিশ ফিঙ্গারের দাম।


---




Comments