বন্ধুদের কথাবার্তা ২







বন্ধুদের কথাবার্তা



রাজর্ষি দাশ ভৌমিক





বন্ধুদের কথাবার্তা

২.

মোমো বললো – যে চোখ হাসতে গেলে কুঁচকে যায়, সে চোখে কি কাজল লাগে!

বললাম-চোখের ডাক্তার লাগলেও লাগতে পারে।

মোমো বললো-যে বুকে মাথা রাখা যায়, সে বুকে কি তিল লাগে!

বললাম-থাকলে ভালো স্বপ্ন দেখা যায়।

মোমো বললো- যে গালে হাসলে টোল পড়ে সে গালে কি রুজ মাখতে হয়!

আলোচনাটা এরপর যেদিকে গড়িয়ে চললো,পাঠকপাঠিকাদের আর অতদূর নামাতে ইচ্ছে করছে না।অল্পবয়েসে অল্পে-সন্তুষ্ট হয়ে যাওয়া যেত।ডিমের ঝোল দিয়ে একথালা ভাত সাবড়ে দেওয়া কোন ব্যাপারই ছিল না।এখন উঁকিঝুঁকি দিয়ে দেখি সয়াবিনের ডালনা লুকানো থাকে যদি ! এ যদি বন্ধুর বাড়ি হয় তবু। বন্ধুত্বের সঙ্গে অবিশ্বাসও বাড়ন্ত নেই আর।চোখ,কান,গাল ইত্যাদি নিয়ে বেজায় খুঁতখুঁতে মোমো প্রেমের জন্য জীবনে কিছু কমতি রাখেনি।পুরী-দীঘার হলিডেহোম মালিকরাও নাকি চেনা হয়ে গেছিলো।

যে যুগের গল্প সে যুগে এক বোর্ডারের কম্পিউটারের মেমরির সাইজ ছিল দশ গিগাবাইট।সে দশ জিবিতেই ডস গেমস,ক্লাসনোটস, জীবনশৈলীর যাবতীয় কিছু।আর র‍্যাম ছিল একশো বিরানব্বই মেগাবাইটের।প্রকৃত প্রস্তাবে একশো আঠাশ, তার সঙ্গে অতিরিক্ত চৌষট্টি। এই অতিরিক্তটুকুকে নিয়ে তার গর্বের অন্ত ছিল না।এই সেদিন বত্রিশ গিগাবাইটের একখানি পেনড্রাইভ কিনে অবাক হয়ে ভেবেছি আট গিগাবাইট আর বত্রিশ গিগাবাইটের পেনড্রাইভের একই আয়তন হয় কি করে!

মিটসেফ বস্তুটিকে মনে পড়ে, মধ্যবিত্ত বাঙালি জীবনে যে বস্তুটির বর্নবিপর্যয় ঘটেছিল মিশচেফে।কাঠের একখানি ওয়ার্ডরোব,জালি দেওয়া তার দরজা-যাতে প্রয়োজনীয় হাওয়াবাতাস চলতে পারে অথচ পোকামাকড়ের নাগাল থেকে খাবারদাবার দূরে থাকবে।ফুলকাকা রাজনীতি করতেন, ছুটির দিনে দুপুরের সপরিবারে খাওয়ার আসরে তার দেখা নেই, ঘড়ির কাঁটা বিকেলের দিকে ঢলে পড়তো।ঠাকুমা ওবেলার খাবারদাবার মিশচেফে তুলে,কাকার আন্দাজমত ভাতডালতরকারি স্টিলের থালা দিয়ে ঢাকা দিয়ে চান করতে যেতেন।কোনদিন বেশি খাবারদাবার রান্না হয়ে গেলে তিনতাকের মিশচেফে আর কুলোতো না।আমাদের দৈনদ্দিনও অমন একটা নির্দিষ্ট আয়তনের খোপে নিয়তিতাড়িত চলছিল,একশো আঠাশ পেরিয়ে অতিরিক্ত চৌষট্টি মেগাবাইটের সাফল্য পাওয়ার কথা ছিল না,দশ গিগাবাইটের মস্তিষ্কের মধ্যেই সঞ্চিত হয়ে যাচ্ছিলো বান্ধবীর দিদির ছেলের নাম, মদ বলতে গোটা তিনেক ব্র্যান্ড।রাম,হুইস্কি,ভদকা-প্রত্যকের একটা একটা করে।জিন খাই না।যে কারনে মেন্থল সিগারেট টানি না।এই অতিরিক্ত পৌরুষ ধরে রাখতে পারা গেল কি না, তা অন্য গল্প ।কম্পিউটার সায়েন্স পড়া বান্ধবী তখনও সুদূর,কেউ হাতে ধরে বুঝিয়ে দিচ্ছে না মেমরি বড় হয়ে গেলেও পেনড্রাইভের সাইজ বাড়ে না।




কুড়ি বাইশ বছরে যদি জানতেম কেবলমাত্র ভালো রাঁধতে পারে বলে একটি মেয়েকে ভালোবেসে ফেলা যায় তবে নিজেদের অল্পেসন্তুষ্টির মাহাত্ম্য নিজেদের চোখের সামনে খুলে যেত।সেজন্য অপেক্ষা করতে হল আরো কতগুলি বছর।যতদিন না মুরাকামি এসে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন।তখন মনে পড়লো-আমরি বাংলাতেও কে যেন বলেছিলেন -ইতি ভালো রাঁধতে পারে,এরপর আমি আর অন্য কোনদিকে তাকাইনি। ততদিনে বড্ড দেরি,অল্পেসন্তুষ্টির দিনগুলি অন্তর্হিত।চতুর্দিকে একটা কিনলে আরেকটা ফ্রি আবহাওয়া, ডিসকাউন্ট কুপনে খিদে বিকিয়ে যাচ্ছে।তড়িঘড়ি ব্লাউজ সরিয়ে দেখে নেওয়া তিল আছে কিনা কিংবা রাঁধার সঙ্গে চুলও কতখানি বাঁধতে পারে।

কৈশোরের নিঃসঙ্গতার সাদা চোখটিকে ধূসর করে একটা গল্প বলেছিলে ইন্ডিয়ান ওশানস এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা অসীম।অসীম আর নেই, সাক্ষাতকারটি হয়তো ডকুতে থাকবে।অসীম কৈশোরেই পিতৃহারা হন, স্কুলে যান না। সারাদিন একটা কালভার্টে একখানি দাবার বোর্ড সাজিয়ে পথ চেয়ে বসে থাকতেন, যদি কেউ একহাত খেলে যায়, যার হাতে হয়তো অসীমের মতই অঢেল সময়। এই বিপুলা মেমরিস্পেসের কথা ভেবে বাক্যরহিত হয়ে পড়ি।



Comments