ডiary : নেড়িটা, বুকু, অংশুমানদা আর বাবা : সৌম্যজিৎ চক্রবর্তী








Author
 দুপুর  ২:৪৫
আজ ৩রা অগস্ট। প্রায় সাত মাস পর আমি শান্তিনিকেতনে এলাম। প্রান্তিক স্টেশনে আমার জন্য নেড়িটা অপেক্ষায় ছিল। এতদিন পর সে আমায় দেখে চিনতে পারবে, তা ভাবিনি। কাছে এসে আমার নতুন জুতোয় নাক, মুখ ঘষে ঘষে খানিক আর্দ্র করল আমায় সে। মানুষের জুতোর সঙ্গে মনের কি কোন যোগাযোগ থাকে? হয়তো থাকে। কাঁধের ঝোলা থেকে ডালমুট বের করে প্ল্যাটফর্মেই বসলাম। কুকুর কি ডালমুট খায়? জানি না। কোনদিন খেতে দেখিনি। কুকুরপ্রেমীরা চিরকাল বিস্কুটের ওপর অগাধ ভরসা করে এসেছেন। আমিও তাঁদের দলেই ছিলামআজ দলবদল করে দেখলাম ডালমুট, মানুষ ও কুকুর দুইয়েরই বড় প্রিয়। একটা লোক অনেকক্ষণ ধরে আমাদের আশপাশ দিয়ে ঘোরাঘুরি করছেন। কি ভাবছেন তিনি? কি ভাবতে পারেন তিনি? মনে মনে বেশ কিছু কল্পনা করলাম- হয়তো মেয়ের বিয়ের কথা, বা ছেলের কলেজে পড়ার খরচের কথা, কিংবা ঘর ফেরার পথে ছোলা-মুড়ি কিনতে হবে কি না... এইসব! আবার হয়তো এসব কিছুই না, হয়তো আমাকে নিয়েই ভাবছেন- যে এই উন্মাদ ঠিক কতটা পশুপ্রেমী যে প্ল্যাটফর্মেই বসে পড়েছে নেড়িটার লেজ ঘেঁষে! প্রান্তিক স্টেশনে একটা মেঘলা দুপুরে এমনিই বসে দেখবেন। দুয়েকটা মেইল ট্রেন আর মাইকে খুচরো ঘোষণা ছাড়া কেউ আপনাকে বিরক্ত করবেনা, কথা দিলাম। এই নেড়িটার কোন নাম দেওয়া হয়নি। এর আগে আমি যতজনের সান্নিধ্য পেয়েছি, প্রত্যেককে কিছু না কিছু নাম দিয়েছি। তাড়া ছিল তাদের, তাই ছেড়ে গেছে আমায়। থাক, ওর নাম-বদনাম হওয়ার কোন দরকার নেই। ও আমার মতই পড়ে থাক প্রান্তিকে। একদিন সময় এলে গুটিগুটি পায়ে ঠিক চলে যাব দুজনেই। যেমনটা চলে গেছে বুকু, সম্পর্কে আমার মামা। ও কুকুর বড় ভালবাসত।  
... ওকে খুঁজতেই আজ রামপুরহাটে গিয়েছিলাম।

রাত  ১১:৫৫
ঘরে ঢুকে দেখলাম বহুদিনের অযত্নের ছাপ ফেলেছে মাকড়সার দল। টিকটিকিরা ছড়িয়ে রেখেছে প্রসাদ। এতো খাবার তারা পেল কোথায়, ঘরে তো কিছুই রেখে যাইনি! ঘরময় একটা গুমোট গন্ধ। জানালাদুটো খুলে দিতে একটু ঠাণ্ডা হাওয়া এল। সঙ্গে এল গান শোনাবার পার্টি। কোনমতে বিছানা-বালিশ ঝেড়ে শুয়ে পড়ছি।
ঘুমের সাথে আমার বহুদিন আড়ি। সহজে কাছে আসেনা সে। আদর করতে গেলে কেমন পালিয়ে পালিয়ে যায়।

রাত  ২:২০
...উঠে পড়লাম। অনেক কথা মাথায় ঘুরছে বারবার ক’রে। বুকু এখনো নিরুদ্দেশ। মা’কে সবকথা মন খুলে বলতেও পারছিনা, দ্বিধা কাজ করছে কোথাও যেন! আজ বহুদিন পর অংশুমানদা’র সাথে দেখা হল, আড্ডা হল। অংশুমানদা জিজ্ঞেস করছিলেন, “ কলকাতা কেমন আছে ? রেগে আছে ? যদি রেগে থাকে , তবে আমি খুশী হব ” আমি বলছিলাম- কলকাতা এখন সুখী আছে। যেটুকু রাগ হয়, সেটুকু কলেজ স্কোয়ার থেকে শুরু হয়ে একাডেমী ঘুরে ফেসবুকে এসে জল হয়ে যায়। নবারুণ ভটচায্যি চলে গেলেনফেসবুকীরা ‘‘এই মৃত্যু উপত্যকা...’’ লিখে স্ট্যাটাস দিল। আমার একসঙ্গে হাসি আর রাগ- দুটোই পাচ্ছে। কলকাতা ভালো নেই। অংশুমানদাঃ “ আমরা বোধহয় বড্ড বেশি সুখের ঘুম ঘুমাচ্ছি এখন আমাদের আর রাতদুপুরে ঘুম ভেঙে যাচ্ছেনা , একটু এপাশ-ওপাশও করতে হচ্ছেনা মানুষটা কত সত্যি কথা কত সহজে বলে দিতে পারেন!
... অংশুমান মিশ্র, সম্পর্কে আমার বন্ধু ও শিক্ষক।  

ভোররাত  ৪:৫০
ছেলেবেলায় বড়দিনে তাঁর কাছে একটা ক্রিসমাস ট্রি চেয়েছিলাম, তিনি কিনে দেননি। খুব দুঃখ পেয়েছিলাম। কিছুদিন আগে তিনি মেডিক্লেমের কাগজপত্র আমাকে বুঝিয়ে দিলেন। তিনি কি আমায় ছেড়ে চলে যাবেন? এখন আমার খুব অসুখ যে! এমন সময়... যেদিন আপনি চলে যাবেন, সেদিন ক্রিসমাস ট্রি নিয়ে আসব, আপনার মাথার কাছে রঙিন আলো দিয়ে সাজিয়ে রাখব।
... তিনি আমার বাবা।
না, আমি আমার বাবার মৃত্যুকামনা করিনি, করিওনা। এই কথাগুলো কেবল মাথায় ঘোরাফেরা করে।

বহুদিন পর ডায়েরি ’ র লেখাটাই তুলে দিলাম   এতটুকুও কাটাছেঁড়া করিনি !

Comments