ডiary : আপেল বিচির মালা, দে এনে দে... : সৌম্যজিত চক্রবর্তী



DIARY
AUTHOR
আপেল বিচির মালা, দে এনে দে...
সৌম্যজিত চক্রবর্তী

ছেলেবেলায় মা-বাবা-দিদির সাথে অপর্ণা সেনের  যুগান্ত  দেখতে গিয়েছিলাম নন্দনে। টিকিটের হাহাকার ছিল, তাই এক্কেবারে সামনের সারিতে বসে ঘাড় উঁচু করে দেখেছিলাম সমুদ্র। তখন আমি নেহাতই ছয়-সাত বছরের। দীপক আর অনসূয়ার সম্পর্কের উচ্চ-মধ্য-নিম্নগ্রাম, তেলের জন্য উপসাগরীয় যুদ্ধ– এতকিছু মাথায় ঢোকেনি। কেবল সমুদ্রটুকুই মনে ধরেছিল। নতুন ক’রে  যুগান্ত  দেখেছি বেশ কয়েকবার- এখনও কোনও ক্লান্তি আসেনা, কোনও একঘেয়েমি লাগেনা; বরং নতুন নতুন মোড়কে খুঁজে পাই লোকনীতির সংজ্ঞা, আমাদের অস্তিত্ব, নিজগুণে পরিপূর্ণ আবার অসহায়-এমন কিছু সম্পর্ক, আর সবকিছু ছাপিয়ে সমুদ্রের উচ্ছল আর্তিতাই সমুদ্র বললেই আমার এখনও যুগান্ত ’র কথা মনে হয়, মনে হয় মৌসুমী ভৌমিকের স্বপ্ন দেখব বলে , মনে পড়ে মায়ের কোলে মাথা রেখে শোনা সেই গপ্পো- আমি হাঁটতে শিখেছিলাম সমুদ্রের সামনে।

কবে থেকে যেন বড় হয়ে গিয়েছি! বড়দের মত ক’রে কথা বলা, হাঁটাচলা, প্রেম করা- একে একে সব শিখেছি। এ হেন বড়বেলায় এসে চুপিচুপি ঘুরে বেড়ানো শুরু হল। কখনো বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে, কখনো প্রেমিকার সঙ্গে, আবার কখনো বা কেবল নিজের হাতটা ধরে বেরিয়ে পড়া। আমার গোটাকতক বদভ্যাস আছে, তার মধ্যে একটি হল- যন্ত্রের যন্ত্রণা এড়িয়ে সময় কাটানো। তাই সেলফোনবিহীন যাপন উপভোগ করতে মাঝেমধ্যেই বেরিয়ে পড়ি। ঘর ফিরে মায়ের বকুনিটা খেলে সেই উপভোগের ষোলকলা পূর্ণ হয়! এমনই এক বেরিয়ে পড়া হয়েছিল বছর দু'য়েক আগে- এক পাহাড়ি মেয়ের  প্রথম  সমুদ্র  দেখার ইচ্ছেডানা হয়ে। শীতকাল, দিঘা-তালসারি ছাড়া কিছু মাথায় এলনা। অতএব, হাওড়া ষ্টেশনের ওই বড় ঘড়িটাকে সাক্ষী রেখে আমরা জনা পাঁচেক রেলগাড়ি চেপে পৌঁছে গেলাম নিম্ন-মধ্যবিত্ত বাঙালির সবচেয়ে সস্তার মধুচন্দ্রিমায়- দু’টো দিনের জন্য সব ওলটপালট, সব অনিয়মের গলা জড়িয়ে ধরে আদর করতে।
আবার  যেদিন  তুমি /  সমুদ্রস্নানে  যাবে , আমাকেও  সাথে  নিও  নেবে  তো  আমায় ? / বলো ,  নেবে  তো  আমায় !
সমুদ্রস্নানের শেষে পায়ের পাতায় নোনা আদর মাখছি তথাগত, সদ্য সিগারেট ধরিয়েছে একটা- সেটাই পাঁচভাগ হবে। এই ভাগাভাগিতে কারোর কোন আপত্তি নেই, অতিরিক্ত একটা টানের চাহিদা নেইতখন আমরা সবাই একই রঙের ভক্ত, একই গন্ধে মত্ত। যখন আপনার ভিজে আঙুলের স্বাদ নোনতা আর নিকোটিন সেই আঙুলে হলুদ মেশায়, নখের মধ্যে অল্পস্বল্প বালি বিরক্ত করে, কানের ভেতর জলের গর্জন মনে করিয়ে দেয়- আপনিও কখনো কারোর ভালো করতে চেয়েছেন, ঠিক সেই সময়ে সে এসে দাঁড়ায় মধ্যিখানে- একরত্তি ছেলে একখানা, হাতভর্তি আপেল বিচির মালা। ‘মালা নেবে? মালা?’ বাংলা বলতে শেখা পাহাড়ি মেয়েটা বলে ওঠে- ‘নেবই তো!’
‘কুড়ি টাকা করে’
-‘দু’টা তিরিশ টাকা হোবে না?’
‘না, পারব না’- আলতো মুখ বেঁকিয়ে বলে ছেলেটা। আমাদের বেশ মজা লাগে- পাহাড়ি মেয়ে আর সমুদ্রের ছেলের এই আলাপ। যুধাজিৎ একটা মালা নেড়েচেড়ে দেখেঃ ‘এ তো ছোট্ট মালা রে! এর দাম কুড়ি টাকা! নাহ্ নেব না। যা পালা।’
আমি ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করি- ‘নাম কি তোর?’ ছেলেটা আমার দিকে এমনভাবে তাকায়, যেন আমি কিছু একটা অন্যায় প্রশ্ন করেছি!
ঝাঁঝালো উত্তর- ‘নেবে কি না বল?’
আমি বলি-‘নেব রে নেব। বস্ এইখানে।’
বিনয়, ওর নাম। ও এসে, আমার পাশে বসে। পাহাড়ি মেয়ে ইতিমধ্যে বিনয়ের হাত থেকে মালা বাছতে শুরু করেছে। হাতের কর গুণে গুণে মেয়ে হিসেব করে, চিব্বো বস্তিতে ফিরে ক’জনকে সে বিনয়ের মালা দেবে? বিনয়ের সঙ্গে আমার কথা চলেঃ ওর ঘর বসন্তপুরে। বসন্তপুর, দিঘার কাছেই ছোট্ট একটা গ্রাম। ও সেখানকার কমললোচন হাই স্কুলে ক্লাস সিক্সে পড়ে, অঙ্ক করতে ওর মোটেই ভাললাগেনা, বরং ইতিহাস ওর বেশ লাগে। ওদের গ্রামে ছ’টা স্কুল, তার মধ্যে বড়দের দুটো। ওদের স্কুলে ছেলে-মেয়ে দুইই পড়ে, কিন্তু ওদের ক্লাসে মাত্র ৯ টা মেয়ে- ক্ষোভের সুরে জানায় বিনয়। ওর মুখ থেকে এই কথা শুনে আমি আমার দুর্ভাগ্যের কথা বলি যে আমার তো বয়েজ স্কুল ছিল, টিফিনবেলায় পাশের গার্লস স্কুলের জানলার দিকে তাকিয়েই সন্ধ্যা নেমে যেত! পাশ থেকে বন্ধুরা টিপ্পনী কাটে- হ্যাঁরে ভাই, ক্লাস সিক্সে তোর যেন কি একটা ছম্পর্ক- টম্পর্ক হয়েছিল! ও খিলখিল করে হেসে ওঠে। যাক্, তবে পছন্দ হয়েছে আমায়- মনে মনে খুব খুশি হই। ওকে আদর করে ‘বিনু’ ডাকার অনুমতিও পেয়ে যাই আপনাআপনি। বিনুদের গ্রামেও একটা গার্লস স্কুল আছে, সে স্কুলে মস্ত বড় ইঁটের পাঁচিল আছে, কিন্তু কোন খেলার মাঠ নেই! বিনুদের স্কুলে ইয়াব্বড় এক মাঠ আছে! আমার কৈশোরের কথা মনে আসে। আমাদের মিশন স্কুলের মাঠে ভবনাথ ইন্সটিটিউশনের মেয়েরা দৌড়তে আসত বছরে একবার, অ্যানুয়াল স্পোর্টসের দিনে। আর ওদের জন্য আমাদের খাঁচায় বন্দী করে রাখা হত! সেই রাগ জল হওয়া তো দুরস্থান, বরং ক্যাম্বিস বল হয়ে মেয়েদের জানলায় আছড়ে পড়ত পরদিন বড় টিফিনের সময়- মুহূর্তে সবকিছু মনে পড়ে যায়।
দুম্ করে কেমন বড় হয়ে গেলাম! বড়দের  মত  ক’রে  কথা  বলা , হাঁটাচলা ,  প্রেম করা -           একে  একে  ...
পাহাড়ি মেয়ে মুগ্ধ হয়ে আমাদের কথা শোনে, হাসে। জিজ্ঞেস করে, ‘তোমার বাড়িতে কে আছে?’ বিনুর মা খবরের কাগজ থেকে ঠোঙা বানায়, সে ঠোঙায় চপ, মুড়ি, চিংড়ি, কাঁকড়া সব ঠাঁই পায়। তেলমাখা সেইসব ঠোঙা ঠাঁই পায় সমুদ্রে- কে বলেছে, তেলে জলে মিশ খায়না? দিব্য খায়! আপেল বিচির মালা বানায় সপ্তাহে একদিন, একসাথে প্রায় শ’খানেক মালা বানিয়ে রাখে। কখনো নিজে আসে, কখনো বা বিনু এসে ফেরি করে আপেল বিচির মালা। সৈকতে এখন মানুষেরা আর আপেল বিচির মালা কিনতে চায়না। বিনু বলে, ফোরেনরা এলে এই একেকটা মালা পঞ্চাশটাকা দিয়ে কিনে নিয়ে যায়, ওর সাথে ফটো তোলে। আমি হেসে উঠি- ‘ফোরেনরা আবার কি রে! বল ফরেনার! এফ-ও-আর-ই-আই-জি-এন-ই-আর। নয়তো বল বিদেশী। আচ্ছা এই যে মেয়েটাকে দেখছিস (পাহাড়ি মেয়ের দিকে তাক করে), ওকে ফরেনার মনে হচ্ছে না?’ হো হো ক’রে হেসে ওঠে বিনুঃ ‘ধ্যাত, এতো বাংলা বলে! কিন্তু একটু চাইনিজ্ চাইনিজ্ দেখতে!’ পাহাড়ি মেয়ের জাতিস্বত্তা উথলে ওঠে। কি সুন্দর বিনুকে ভূগোল বইয়ের সুত্র ধরে বুঝিয়ে দেয় যে সে চাইনিজ নয়, সে এই বাংলারই মেয়ে। আমাদের ভারী ভালো লাগে। এই যে কলকাতার নামী স্কুল-কলেজে পড়া বাঙালি ছেলেমেয়েরা এখনো গোর্খাদের ‘চিঙ্কি’ বলে ডাকে, কোথাও যেন সপাটে থাপ্পড় লাগায় বিনুর হালকা ওই মাথা দোলানো- ‘হুমম বুঝেছি!’ কি হুড়োতাড়া ক’রে সময় এগিয়ে চলেছে! বিনুকে ছাড়তে মন চাইছেই না। বুঝতে পারছি, বিনুরও আমাদের ছেড়ে উঠতে ইচ্ছে করছেনা। মানুষ কতটা আপন হয়ে যায় মুহূর্তের মধ্যে! কে বলেছে, পাহাড় আর সমুদ্রের মধ্যে আড়ি? আমরা তো বন্ধু হতে দেখলাম।
এই ক’দিন আগে হিপ্পি আন্দোলন নিয়ে একটু লেখাপড়া করতে গিয়ে দেখলাম, আপেল বিচির লাভ-বিডস্ হিপ্পিদের এক ধরণের ফ্যাশন স্টেটমেন্ট ছিল। জন হকিন্সের লেখা পড়তে গিয়ে দেখি, আপেল বিচির মালার ব্যবহার শুরু করে তাসমানিয়ার আদিবাসীরা। আবার তাঁর লেখাকে রীতিমতো ‘আপত্তিকর’ দাবী করে র‍্যে নর্ম্যান লিখছেন যে আই-পিল গাছের (ভারতে এই গাছের নাম  সুবাবুল ) বিচির সাথে আপেল বিচি যোগ ক’রে হাতের বালা, মালা ইত্যাদি তৈরি শুরু করে ফিলিপিন্সের আদিম লোকেরা। বিতর্ক আছে এখনো। তবে ষাট-সত্তরের দশকে হিপ্পি আন্দোলনের সাথে এই আপেল বিচির মালার যোগ যে আছে, তার নিদর্শন মিলেছে। হিপ্পি আন্দোলন তো ছিল এক ধরণের প্রতি-সংস্কৃতির বাহক, সে কমবেশি অনেকেই জানেন। মূল্যবান পাথরের জ্যুয়েলরি ব্যবহারে কোন পারিপাট্য নেই, বরং বোটানিক্যাল অলংকার হিসেবে আপেল বিচির মালা দাগ কেটে যায় হিপ্পি ঘরানায়। স্কিপ্ স্টোনের ‘হিপ্পিজ্ ফ্রম এ টু জেড্’-এর ঐ লেখাটা একটা চরম সত্যঃ  আমাদের  প্রত্যেকের  মধ্যেই  একটা  ছোট্টখাট্টো  হিপ্পি  আছে  । বব্ ডিলন ’৯২ সালে বলেছিলেন, People today are still living off the table scraps of the sixties. They are still being passed around - the music and the ideas. আমার বিশ্বাস যে অনেকের জীবনই আমার মত অনেক কিছু নিয়ে ঘেঁটে আছে, আবার ঘেঁটে দেখলে অনেক কিছু খুঁজেও পাওয়া যায়। এই যে ক’দিন ধরে হিপ্পি আন্দোলনের নাড়ীনক্ষত্র ঘেঁটে দেখছি, দেখতে দেখতেই খুঁজে পেয়ে গেলাম পত্রলেখা’র অষ্টম কিস্তি। বিশ্বাস করুন, বিনুর কথা আপনাদের বলাই হত না হয়তো! এখন লেখাটা লিখছি, রেডিওতে সবিতা চৌধুরীর রূপকুমারী  মেয়ে  মান  করেছে  /  বাঁধবে  না  চুল ,  সে  বাঁধবে  না  রে  /  হলুদ  গাঁদার  ফুল ,  দে  এনে  দে ...  বাজছে। আমি লেখাটার নামও ঠিক করে ফেললাম- ‘আপেল বিচির মালা, দে এনে দে...’। ক্লাস সিক্সের সেই একরত্তি ছেলের  মুখটা বড় মনে পড়ছে। ওর সাথে একটা ফটো তুলেছিলাম আমরা পাঁচজন। বলেছিলাম, পরেরবার আসলে বসন্তপুরে ওর ঘরে গিয়ে ফটোটা দিয়ে আসব ঠিক।

কথা রাখিনি। আবার দিঘা গিয়েছিলাম এই ’১৪-য়। বসন্তপুর যাওয়া হয়নি। শুধু চেয়েছি, একটিবারের জন্য সে এসে দাঁড়াক আমাদের মধ্যিখানে- যখন ভিজে আঙুলের স্বাদ নোনতা আর নিকোটিন সেই আঙুলে হলুদ মেশায়, নখের মধ্যে অল্পস্বল্প বালি বিরক্ত করে, কানের ভেতর জলের গর্জন...... এবারে আস্তে আস্তে মিশে যায় ব্যক্তিগত হিসেবনিকেশের চোরাবালিতে।   |

Comments