ডiary : শুক্রাণু ৯ : অর্জুন বন্দ্যোপাধ্যায়


DIARY
AUTHOR
|শুক্রাণু ৯ : অর্জুন বন্দ্যোপাধ্যায়
উঠে দাঁড়ালেন অরুণ ঘোষ

তুমি জে.বি.এস. হ্যাল্ডেনের নাম শুনেছ?
ভদ্রলোকের সাথে কথা হচ্ছিল ভারত এবং মিডল্‌ ইস্টের কমিউনিস্ট আন্দোলন নিয়ে। সেজন্যেই যাওয়া ওঁর কাছে। জায়গাটা C.P.I.-এর দলীয় কার্যালয়। কোলকাতা। এন্টালী মার্কেটের কাছে। ভূপেশ ভবন। মখমলবাফের নাটকটা অনুবাদ করতে গিয়ে বুঝতে পারছিলাম আমার জ্ঞান সীমিত। পড়তে হবে আরো। কিন্তু, কমিউনিস্টদের কাজকর্মের তথ্য সব দেশেই চিরকালই গোপন। অন্যান্য যা তথ্যাদি পাওয়া যায় সেগুলো অন্যান্য রাজনৈতিক দল বা ব্যক্তির সমালোচনা। আমার দরকার ১৯৫০ থেকে ১৯৮০, এই সময়ে মিডল্‌ ইস্টে কমিউনিস্টদের কাজকর্ম ও মুভমেন্ট সম্পর্কে জানা। তো, ভূপেশ ভবনের এই লাইব্রেরিতে এরকম বইপত্র বা ডকুমেন্ট পাওয়ার একটি দুর্বার আশা নিয়ে সেখানে যাওয়া। আমার সামনে বসে থাকা, বা বলা উচিত আমি যাঁর সামনে বসে আছি সেই ভদ্রলোক এই গ্রন্থাগারের গ্রন্থাগারিক। দেখলে মনে হয় বয়েস ষাট-পঁয়ষট্টি। পরে জেনেছিলাম, বয়েস আশি। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের আলাপ-পরিচয় ও সৌজন্য বিনিময় আলোচনায় এবং আলোচনা ক্রমে তর্কে এবং তর্ক ক্রমে তুমুল তর্কে গিয়ে পৌঁছল। তাঁর চেয়ে অর্ধ শতক ছোট এই বাচ্চা ছেলেটির সাথে উনি কথা বলছেন। গলার শিরা ফুলিয়ে তর্কে তিনিও সমান দস্তুর। নিজে বামপন্থী আন্দোলন সক্রিয়ভাবে করছেন সেই ৫২ সাল থেকে। ৬২ সালের চীন ও রাশিয়া ইস্যুতে পার্টির ভাগ হয়ে যাওয়া দেখেছেন চোখের সামনে। এখনও ঝরঝর করে বলে দিতে পারছেন সেদিনের সেই মিটিঙে হরেকৃষ্ণ কোঙার কি বলেছিলেন, জ্যোতি বসু কি বলেছিলেন। বলছিলেন নিজের ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের অভিজ্ঞতা। ঝেড়ে গাল দিচ্ছেন নিজেদের। আবার আশায় চিকচিক করে উঠছে বৃদ্ধের অপাঙ্গ। যেবার ইংল্যাণ্ডে গেছিলেন, দেখার ইচ্ছে হয়েছিল সেই কয়লাখনি। যার কথা মার্ক্স লিখেছিলেন। এক বন্ধু তাঁকে নিয়ে গেছিলেন সেখানে। ক্যাপিটালিস্টরা কিভাবে মার্ক্সবাদের করা ক্রিটিসিজম থেকে নিজেদের শুধরেছে, উন্নতির চেষ্টা করেছে বলছিলেন সে কথা। যাই হোক, কি কথা থেকে উঠে এলো বিজ্ঞান গবেষণার কথা। আমি বরানগরে আই.এস.আই.-এর কাছে থাকি শুনেই বললেন কিনা জানি না, বললেন তুমি জে.বি.এস. হ্যাল্ডেনের নাম শুনেছ? আমি এই লাইব্রেরিতে এসছিলাম কতগুলো পুরনো বই, কাগজপত্র ঘাঁটতে। জানতাম না আমি একটা লিভিং হিস্ট্রির সামনে এসে পড়বো। সে প্রস্তুতি নিয়ে আসা হয়নি ফলত। এর কোনো প্রস্তুতি সম্ভব বলেও মনে হয় না। ফলে, আমার সামনে ইতিহাস নিজেই যখন তার পাতা ওল্টাচ্ছে, আমি নতজানু হয়ে আঁজলা পেতে বরং তার বিষ ও অমৃত নেওয়ার যোগ্য করতে পারি নিজেকে। না, জে.বি.এস. হ্যাল্ডেনের নাম আমি শুনিনি। ইতিহাস এবারে পরের পাতায় গেলেন। এঁর নামে এই কোলকাতায় একটা রাস্তাও আছে, বুঝলে হে? এখন যেখানে সায়েন্স সিটি, তার সামনের রাস্তাটা। ভদ্রলোক ইংল্যান্ডে থাকতেন। বায়োলজিস্ট ছিলেন। কমিউনিস্টও ছিলেন। বেশ কিছু রাজনৈতিক মতাদর্শের বিরোধিতার জন্যে বলে দেন ব্রিটেনের নাগরিকত্ব ছেড়ে দেবেন। অন্য যেকোনো দেশে যেতে তিনি প্রস্তুত। যেখানে তাঁর গবেষণা ও রাজনীতি চর্চার স্বাধীন সুযোগ থাকবে। নেহেরু তখন প্রধানমন্ত্রী। নেহেরু নিয়ে এলেন ওঁকে। ভদ্রলোক নাকি দেশ ছাড়ার আগে বলেছিলেন, অনেক বয়েস হল আমার। প্রায় ষাট হয়ে গেল। অনেকদিন জুতো মোজা পরেছি। এখন বাকি জীবনটা আর মোজা পরে কাটাতে চাই না। এ দেশে এসে সত্যিই আর জুতো মোজা পরেননি কখনো। পায়জামা পাঞ্জাবি আর চামড়ার চটিই পরতেন। নেহেরু ওঁকে পাঠিয়ে দিলেন কোলকাতায় প্রশান্ত মহালানবীশের কাছে। আই.এস.আই.-তে। সেখানে বায়োলজির একটা বিভাগ খোলা হল তখন। তাঁর প্রধান হলেন এই হ্যাল্ডেন। থাকতেন, তুমি এখন যেখানে থাকো, তার কাছেই। ওই ডানলপে। তো, তখন খুব ব্রেন ড্রেন হত এ দেশে। মেধাবী ছাত্র গবেষকরা চলে যেতেন বিদেশে। দেশের কোনো কাজেই আসতেন না তাঁরা। এই দেখে ভদ্রলোক একটা দারুণ কথা বলেছিলেন। আমি তো এতোদিন ইংল্যাণ্ডে বসে গবেষণা করেছি। সেখানে ল্যাবরেটরিগুলো এখানকার চেয়ে অনেক ভালো। অনেক উন্নত। ঠিকই। এখানে এখনও সেরকম ব্যবস্থা নেই। কাল যদি মিস্টার মহালানবীশ আমাকে বলেন যে, মিস্টার হ্যাল্ডেন, আমি দুঃখিত, আপনাকে এই ল্যাবটা আমরা আর প্রোভাইড করতে পারছি না। আমি তখন ওনাকে বলব, ঠিকাছে। আপনি আমাকে একটা কাগজ আর পেন্সিল দিতে পারবেন তো? উনি নিশ্চই সেটুকু পারবেন। আমি দেখেছি, এই আই.এস.আই.-তে বিরাট আমবাগান আছে। কাগজ আর পেন্সিলটা নিয়ে আমি সেখানে চলে যাব। সারাদিন ঘুরবো। অনেক পাখি আসে ওখানে। আম গাছগুলোতে এসে বসে। ফল খায়। আদ্ধেক খেয়ে ফেলে দেয়। আমি কাগজে নোট করবো, কোন সিজনে কি কি পাখি আসে। কত পাখি আসে। তারা ঐখানেই ঐ আমবাগানেই বাসা বানায় কিনা। বানালে, সে বাসাগুলো কিরকম। আর গাছগুলোয় প্রচুর পোকা হয় দেখেছি। কিছু পোকা হয় গাছের ওপরের দিকে। মানে পাখি যে ফলগুলো আদ্ধেক খেয়ে ফেলে দেয়, সেইজন্য ঐসব গাছে ওপরের দিকে পোকা। আর কিছু গাছের নীচের দিকেও পোকা আছে। মানে, ঐ জায়গার মাটিতে কোনো সমস্যা আছে। আমি অন্তত একবছর ধরে এই সবকিছু ঐ কাগজে নোট করবো। এইভাবে আমি যদি একবছর পুরো ব্যাপারটাকে ঠিকঠাক সার্ভে করতে পারি, এবং তার স্ট্যাটিস্টিক্যাল ডকুমেন্ট কালেক্ট করতে পারি, একজন বায়োলজিস্ট হিসেবে আমার মনে হয় আমি ভারতে আম চাষে কিছু অবদান রেখে যেতে পারব।
   ততক্ষণে প্রায় সন্ধে হয়ে এসেছে। উঠে দাঁড়ালেন অরুণ ঘোষ। আমিও দাঁড়ালাম। অনেক ঝুরিওয়ালা একটা বিরাট বটগাছের গোড়ার সামনে একটা-দুটো পাতা নিয়ে তিরতিরে দুব্বো চারার মতোই দেখতে লাগছিল নিশ্চই আমাকে তখন। ঘর থেকে বেরোতে বেরোতে বলছেন, আমি একটা বই লিখছি জানো? বই সংক্রান্ত যত শব্দ আছে, যত টেকনিক্যাল টার্ম আছে বই সংক্রান্ত, সেগুলোর বাঙলা পরিভাষা নিয়ে একটা বই। সেরকম একটা ডিকশনারি। যে বাঙালি ছেলে-মেয়েরা লাইব্রেরি সায়েন্স নিয়ে গবেষণা করতে আসবে তাদের এই বাঙলা পরিভাষাগুলো কাজে দেবে হয়তো। বলে, মাথায় পাতলা হয়ে যাওয়া শাদা চুলে বাঁ-হাতটা অল্প ছুঁইয়ে তরতর করে নেমে গেলেন তিনতলার সিড়ি দিয়ে।            |

Comments

  1. পড়তে পড়তে মনে হচ্ছিল তোমার পরনেও সৌম্য বক্তাটির মত ধুতি হাফশার্ট বাঁ-কবজিতে চামড়ার ঘড়ি থাকলে অপূর্ব দেখাতো। শুক্রানু নামটাই আমার পছন্দ ছিল না, এখনো নেই। বড় দেঁতো মনার্কির গন্ধ পাই। সাজেস্ট করেছিলেম শুকরান বা শুকরানা, ঘটনাচক্রে কৃতজ্ঞতাস্বীকারের এক দু চরন থেকেই যাচ্ছে প্রতিটি প্রতিবেদনের শেষে, বেদনা মুঠো মুঠো ছড়িয়ে চলে যাচ্ছে অর্ধপক্ষকালের দিকে।

    ReplyDelete

Post a Comment