ডiary : শুক্রাণু ১১ : অর্জুন বন্দ্যোপাধ্যায়







Author


শুক্রাণু ১১ : হজম
অর্জুন বন্দ্যোপাধ্যায়

সাম্রাজ্য তো বহু প্রকার। তার জন্যে যুদ্ধও নানা রকম। নানা রকমের তার সাঁজোয়া বাহিনী। বিবিধ তার সমরাস্ত্র ও রণনীতি। মানুষের ধর্ম ও ধর্মাচরণও নানা প্রকার এই জগতে। আমি যদি বলি, আমার ভাষাটি, বাঙলা ভাষাটি আমার ধর্ম? অবাক হচ্ছেন? ধারে কাছে তো একুশে ফেব্রুয়ারি নেই। তাহলে হঠাৎ ভাষা নিয়ে পড়লাম কেন। আমি কিন্তু অবাক হচ্ছি না। কেন না, আমার শ্রীযুক্ত কম্পিউটারের কী-বোর্ডে বিস্ময়বোধক চিহ্নের বোতামটি হঠাৎ দেখছি কাজ করছে না। আমার একটি ভুল ধারণা ছিল। সাম্প্রতিককালে তা’ ভাঙছে। আমি ভাবতাম, আমার সমসাময়িক বন্ধু যাঁরা, বিশেষ ক’রে যাঁরা বাঙলায় লেখালিখি করেন, এই ভাষাটা নিয়ে ও এই ভাষার সাহিত্য নিয়ে পরীক্ষা ও চর্চা করেন, তাঁরা অন্ততঃ তাঁদের সন্তানদের বাঙলা মাধ্যম ইশকুলে পাঠাবেন। বাঙলায় তাঁদের শিশুর প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করতে তাঁরা অন্ততঃ সচেষ্ট হবেন। কিন্তু পর পর বেশ কয়েকজনের ক্ষেত্রে ধাক্কা খেলাম। প্রস্তুত হচ্ছি, আরো ধাক্কা খাওয়ার। এ’ বছর একুশে ফেব্রুয়ারিতে, আমার কিছু অনুজ বন্ধু কোচবিহারে আয়োজন করেছিল একটি কবিতা-পাঠ অনুষ্ঠানের। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে। ফেসবুকে দেখেছিলাম সে ছবি। অনুষ্ঠানস্থলে ইংরেজিতে বড়ো বড়ো ক’রে লেখা ইণ্টারন্যাশনাল মাদার্স ল্যাঙ্গুয়েজ ডে। কথাটি ইংরেজিতে না লিখলে দিনটি বোধয় যথার্থভাবে আন্তর্জাতিক হয়ে উঠতো না—  বাধ্য হয়েছিলাম ফেসবুকে ওদের অনুষ্ঠানের ছবির নীচে এ’ কমেন্ট লিখতে।  আহা রে বাঙালি। বৃক্ষরোপণ উৎসব তাকে শেখানো হয়। শেখানো হয় না গাছটাকে কি করে বাঁচিয়ে রাখতে হয়। মাতৃভাষা দিবসটা খুব জাঁকিয়ে উদ্‌যাপন করা চাই তার। কিন্তু ভাষাটাকে ভালোবাসতে শেখার দায় তার নেই। বাঙলায় আবার কেউ কথা বলে নাকি? আমার নিজের একটি বেয়াড়া স্বভাব আছে। নিজে যখন কর্পোরেট হাউসে জীবনের কি এক কুক্ষণে চাকরি করেছি, তখনও এই বেয়াদপি সযত্নে পালন করেছি। বাঙালির সাথে কদাপি বাঙলা ব্যতীত অন্য ভাষা নয়। আপনি হতে পারেন আমার কোম্পানির সিইও। হতে পারেন এমডি। আপনাকে আমি যখন চিঠি লিখব, নিশ্চিন্ত থাকুন আমি অন্ততঃ বাঙলাতেই লিখব। আপনি যদি এই ভাষাটি না জানেন, একমাত্র তখনই আমার এই বেয়াদপির ব্যতিক্রম হবে। কিন্তু আরো কিছু বেয়াদপ বাঙালি বন্ধুবর আছেন আমার, যাঁরা ফোন করেই ইংরেজিতে কথা বলতে থাকবেন। এবং ভুল ইংরেজিতে। এবং কি ভীষণ আত্মবিশ্বাসে। তখন আমাকেও বেয়াদপির মাত্রা বাড়াতে হয় বিদ্যাসাগরীয় বাঙলা কিম্বা বিদ্যাপতীয় মৈথিলী-তে কথা ব’লে। আমার প্রেমিকার কাছে সেদিন শুনলাম এক মজার ঘটনা। ওঁর এক আত্মীয় যাচ্ছেন ট্রেনে চেপে কোথাও। পাশের সহযাত্রী বাঙালি ভদ্রলোকটি দীর্ঘক্ষণ কথা বলে যাচ্ছেন ইংরেজিতে। খানিক বাদে, প্রেমিকার আত্মীয়টি বললেন, দাদা, আমি তো একেবারেই ইংরেজিটা জানি না। আপনি তো দেখছি ভীষণই সড়গড় এটায়। আমার একটা উপকার করতে পারেন? ইঙ্গভাষী বঙ্গজন জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে আছেন উপকার প্রার্থীর দিকে। ভদ্রলোকটি বললেন,
মরিব মরিব সখি নিশ্চই মরিব
কানুহীন গুণনিধি কারে দিয়া যাব।।
এইটের একটা ইংরেজি অনুবাদ করে দিতে পারেন আমায়? এরপর ইঙ্গভাষী বঙ্গজনের মুখটা কল্পনা করতে পারবেন রসিক যে-জন।
       সম্প্রতি আমার ঘনিষ্ঠ এক বন্ধু বাবা হয়েছেন। আমার সময়ের বাঙলা কবিতার ক্ষেত্রে বন্ধুটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একজন বলেই বিশ্বাস করি আমি। এই সময়ের উল্লেখযোগ্য একটি পত্রিকার সম্পাদনার সাথেও তিনি যুক্ত গত দশ বছর ধ’রে। তো, সদ্য পিতা হওয়া এই বন্ধুটি সেদিন বলছিলেন, তিনি তাঁর পুত্রটিকে ইংরেজি মাধ্যম ইশকুলেই পাঠাবেন। আমার প্রশ্ন ও প্রতিবাদের উত্তরে তিনি বললেন, তাঁর অঞ্চলে বাঙলা মাধ্যম ইশকুল যে-ক’টি আছে, সেইখানে যে-ছাত্রেরা পড়তে আসে, তারা মধ্য ও নিম্নমেধার। তো, আমার এই বন্ধুটি চান না যে তাঁর পুত্রটিও সেই মধ্য ও নিম্নমেধার ছাত্রকুলের মধ্যে গিয়ে একটি প্রতিযোগিতাহীন পরিবেশে বেড়ে উঠুক।
       ইংরেজি, এই ভাষাটির প্রতি আমার কোনো বিদ্বেষ-বিষ নেই। গত এক-দেড় বছর ধ’রে নিয়মিত অনুবাদের কাজ করার জন্যে এই ভাষাটির সাহায্য তো আমায় নিতেই হয়। ইরানের ফারসি ভাষার কবি আবদোলরেজায়েই-এর সাক্ষাৎকার নেবার সময় ইংরেজিতেই নিতে হয়েছিল। আমি তো ফারসি জানি না। কিন্তু আবদোলরেজায়েইও পরিষ্কার ব’লে দিয়েছিলেন যে উনিও একটা গোটা সাক্ষাৎকার দেওয়ার মতো ইংরেজিতে দড় নন। একটা অসাধারণ কথা বলেছিলেন উনি সেই সাক্ষাৎকারে। ‘[কবিতা হ’ল] ছায়াদের নিঃশ্বাস ফেলার শিল্প। প্রত্যেকটা শব্দ একটা ছায়া। লাইনের মাঝখান দিয়ে হাঁটছে, পাতা জুড়ে। ইংরেজি আমার মাতৃভাষা নয়, ফলে আমি যখন ইংরেজিতে লিখি, সেই ছায়া তখন আমার আঙুল থেকে অনেক দূরে থাকে। ফারসিতে লেখা আমার কবিতা, আর তার ইংরেজি অনুবাদের মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে। যেমন একটা ফুলের গন্ধে আর দোকানের পারফিউমের গন্ধে পার্থক্য থাকে। একজন কবির পক্ষে সবথেকে বড়ো দুর্ভাগ্য দেশের বাইরে নির্বাসনে থাকা, যেখানে তাকে বিদেশি ভাষায় লেখালিখি করতে হয়।  
       যে বাঙালি ছেলেমেয়েগুলো ইংরেজি মাধ্যম ইশকুলে গিয়ে ব্যা ব্যা ব্ল্যাক শিপ বা টুইঙ্কল টুইঙ্কল লিটল স্টার শিখবে, তারা খগেন্দ্রনাথ মিত্র বা অবন ঠাকুর বা দক্ষিণারঞ্জন পড়বে না ব’লে যে দুঃখ হয় তা’ নয়। তাদের মধ্যে কেউ কেউ নিশ্চই পড়বে। ইংরেজি মাধ্যমেই পড়াশোনা করা আমার এর’ম অনেক বন্ধুই আছেন যাঁরা যথেষ্ট মনোযোগ দিয়ে বাঙলা সাহিত্যটা পড়েছেন, এবং পড়েন। এবং নিজেদের মধ্যে কথোপকথনের সময়েও তাঁরা সাধারণ বাঙলাটাই ব্যবহার করে থাকেন। বরং ভয় হয়, বাঙলা শব্দের ছায়া সেই শিশুদের আঙুল থেকে হয়ত দূরে সরে যাবে। একটা ফুল থেকে আজীবন যদি দোকানের পারফিউমের গন্ধ বেরোতে থাকে। কে চুরি ক’রে নিল সেই শিশুর থেকে তার গায়ের গন্ধ।
       দোষ কোনো ভাষার নয়। একটা ভাবনা বলি আমার। যত রকমের বাঙলা অভিধান দেখেছি আমি, এপার বাঙলার কি ওপার বাঙলার, সংসদ হোক কি হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের, চলন্তিকা হোক কি বাঙলাদেশের বাঙলা অভিধানগুলো, আমার মনে হয় সব ক’টা অভিধান সাম্প্রদায়িক। পশ্চিমবাঙলার ভৌগোলিক পরিসীমায় হিন্দু-জনগোষ্ঠীর সংখ্যাধিক্যের ফলে এ’ রাজ্যের বাঙলা অভিধানগুলোতে তৎসম, তদ্ভব, সংস্কৃত-ঘেঁষা শব্দ বেশি। আবার বাঙলাদেশে ইসলাম ধর্মাবলম্বী মানুষের সংখ্যাধিক্যের দরুণ ও’ দেশের অভিধানে বেশি আরবি-ফারসি শব্দ। ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্‌ অনেক খেটে অনেক পরিশ্রমে করেছিলেন বাংলাদেশের আঞ্চলিক ভাষার অভিধান। বাঙলা ভাষায় যুগান্তকারী এক কাজ। কিন্তু কোনো অখণ্ড বাঙলা অভিধান আমরা এখনও দেখতে পেলাম না, যেখানে পশ্চিমবঙ্গীয় এবং বাঙলাদেশীয় প্রমিত বাঙলার সাথে একইসঙ্গে সমস্ত আঞ্চলিক বাঙলাও থাকবে। অভিধানে ইঁদুরের পাশে জায়গা নেবে রাজবংশী শলায়া [ইঁদুর] বা আত্মীয়ের সাথে থাকবে শাকাই-ও। শকড়ি বা সকড়া-র সঙ্গে হুক্কৈড়কেও আমরা দেখবো জ্বলজ্বল করছে। কিন্তু না, অত্যন্ত যত্নে সংখ্যালঘুর ভাষাকে দাবিয়ে রাখার অশেষ চেষ্টা এখনও জীবিত। ভাষার মাধ্যমে এ’ এক মৎসান্যায়। যেখানে রাষ্ট্রের শীলমোহর পাওয়া প্রশাসনিক ভাষা, নাগরিক ভাষা অধিক-ক্ষমতাশালী হয়ে, কর্তৃত্বপরায়ণ ক্ষমতার দিক থেকে তার চেয়ে নীচে থাকা ভাষাকে গিলে খাবে। সে গিলছে গিলুক। বলি, হজম হবে তো?

Comments