সিনেমাঃ 4 months 3 weeks and 2 days : সোহম চক্রবর্তী

|

সিনেমা –4 months, 3 weeks and 2 days
পরিচালক - CristianMungiu
দেশ –Romania

গাবিতা কতদিন যাবৎ অন্তঃসত্ত্বা সেটা আমরা সিনেমার নাম দেখলেই বুঝতে পারি। কিন্তু সে যে অন্তঃসত্ত্বা এবং তার বন্ধু ও রুমমেট ওটিলিয়া তাকে গর্ভপাতে সাহায্য করতে চলেছে সেটা সিনেমার প্রায় আধঘণ্টা পেরিয়ে যাওয়ার পর প্রকাশিত হয়। অথচ এই আধঘণ্টায় দর্শক ক্রমাগত ভাবতে থাকে যে কী ঘটতে চলেছে এই সিনেমায়। একটা কিছু যে ঘটতে চলেছে সেটা গল্পের শুরু থেকেই বোঝা যায় গাবিতা ও ওটিলিয়ার কথোপকথনের মাধ্যমে। কিছু একটা দু’জনে মিলে করতে চলেছে যা আর কাউকে তারা জানাতে পারছে না।

সিনেমার পটভূমিকায় ১৯৮৭-এর কম্যুনিস্ট আমলের একটি রোমানিয়ান শহর। গোটা শহরটা যেন প্রাণহীনতায় ভুগছে। শহরের চেহারা চরিত্রে কোথাও কোনও আনন্দ খুঁজে পাওয়া যায় না গোটা সিনেমাটায়। শুধু শেষে একটা বিয়ের খাওয়াদাওয়া আমোদ-আহ্লাদ চলে এক হোটেলে, যেটার একটা রেটোরিকাল ভূমিকা আছে সিনেমাটায়। সাধারণ সিগারেট কিনতে হয় দাঁড়িয়ে থাকা ফিরিওয়ালার থেকে। ব্যাপারটা বেআইনি ধরে নেওয়া যেতে পারে। সাধারণ নাগরিকের কাছে সবসময় পরিচয়পত্র থাকাটা আবশ্যক, যে কোনও সময় কোনও অথারিটি সেটা চেয়ে বসতে পারে।

এরকম একটা পারিপার্শিকতার মধ্যে গাবিতা তার ভ্রূণহত্যা করতে চায়। এটা নিশ্চয়ই আর বলার প্রয়োজন রাখে না যে ভ্রূণহত্যা একটি আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। তাই এই কাজটাও লুকিয়ে চুরিয়ে করতে হয় গাবিতাকে। তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে ওটিলিয়া। কোনোরকমে টাকা জোগাড় করে হোটেলে ঘরভাড়া করে এক ডাক্তারের সাথে চুক্তি করে গাবিতা ও ওটিলিয়া। সিনেমা যখন শুরু হয় তখন আমরা বুঝতে পারি যে দুজনে মিলে কোথাও একটা যাবে এবং তার জন্য সামনে যে কলেজের পরীক্ষা সেটাও হয়ত না দেওয়া হতে পারে। কিন্তু তা নিয়ে বিশেষ উদ্বিগ্ন নয় কেউ। অথচ দুজনের মধ্যেই একটা চাপা টেনশন লক্ষ্য করা যায়। ওটিলিয়া বেরিয়ে তার বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে দেখা করতে যায় কিন্তু তাকেও কিছু বলে না। এরপরের ঘটনায় আমরা দেখতে পাই ওটিলিয়া মিস্টার বেবে বলে একজনের সাথে দেখা করে তাকে সঙ্গে করে হোটেলের রুমে নিয়ে আসে। অতঃপর হোটেলের রুমে আমরা জানতে পারি আসল ব্যাপারটা কী।

সিনেমার মূল বৈশিষ্ট্য হল যে একটা মাত্র ঘটনাপ্রবাহের ওপর প্রায় দু’ঘণ্টা দর্শককে বসিয়ে রাখতে পারা। সাধারণ জীবনে যদি কারোও এধরনের পরিস্থিতি ঘটে তাহলে সে যা করবে কাহিনীর চরিত্রগুলি ঠিক সেরকমই আচরণ করেছে। কোনরকমের বাড়তি ঘটনা বা আকস্মিক ঘটনা ঘটে না সিনেমাটা জুড়ে। শেষপর্যন্ত গর্ভপাত সফল হয় এবং ওটিলিয়া ভ্রূণটা ফেলেও দিয়ে আসে সকলের চোখের আড়াল দিয়ে বেরিয়ে। তারপরেও এই সিনেমা হয়ত অনেকরকমের প্রশ্নই তুলে ধরে দর্শকের সামনে। ভ্রূণহত্যা পাপ ও আইনত দণ্ডনীয় জেনেও এই দুই কিশোরীর কোনও অনন্যোপায় থাকে না। সিনেমার শুরুতেই আমরা স্পষ্ট জানতে পেরে যাই যে গাবিতার প্রেমিক তাকে ছেড়ে চলে গেছে। এই অবস্থায় গর্ভবতী হলে যে প্রচুর সামাজিক সমস্যা ও নিজের কেরিয়ারের সমস্যা হবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু গর্ভপাত করিয়েও কি শেষ পর্যন্ত শান্তি পায় গাবিতা ও ওটিলিয়া। সেটা বুঝতে পারা যায় শেষ দৃশ্যে যখন একদিকে বিয়ের খাওয়াদাওয়া চলছে এবং প্রচুর খিদে পাওয়া সত্ত্বেও গাবিতা ও ওটিলিয়া তাদের কাছে পরিবেশিত মাংস খেতে পারছে না।

ওটিলিয়ার অভিনয় অসাধারণ। পুরো সিনেমাটা আমরা ওটিলিয়ার চোখ দিয়েই দেখতে পাই। সেই এই গল্পের নায়িকা যদিও আসল ক্রাইসিসটা গাবিতার। কিন্তু ওটিলিয়া এক আশ্চর্য বন্ধুত্বের কথা বলে, যেখানে তার নিজস্ব লাজলজ্জা ও সুখকর জীবনের স্বপ্নকে সে বাজি ধরে তার বন্ধুর জন্যে। বন্ধুর জন্যে সে কীভাবে নিজের আরামের গণ্ডির বাইরে বেরিয়ে এসে একটা গোটা দিন কাটায় সেটা দেখার জন্যেই দর্শক টানা বসে থাকে।

সবশেষে আসতে হয় সিনেমার নির্মাণগত দিকে। কাহিনীটি থ্রিলার না হলেও সবসময় দর্শক একটা সাসপেন্স অনুভব করতে থাকে। নির্দেশকের মুন্সিয়ানা এখানেই প্রকাশ পায়। ক্যামেরার কাজ অসাধারণ। একদম ন্যাচারাল লাইটিং ব্যবহার করেছেন সিনেমাটোগ্রাফার। বিভিন্ন জায়গায় হ্যাণ্ডহেল্ড ও ফিক্সড ফ্রেমের ব্যবহার সিনের ভেতরে মূল চরিত্রের মানসিক অবস্থা খুব সুন্দরভাবে বের করে আনে। ওটিলিয়ার বয়ফ্রেণ্ডের ঘরে ডিনার টেবিলের সিন আর ওটিলিয়ার বাস ধরার সিন মনে রাখবার মতো। ২০০৭ সালে কান চলচ্চিত্র উৎসবে গোল্ডেন পাম পুরস্কার জেতে এই সিনেমা, এবং তারপর আরো বহু চলচ্চিত্র উৎসবে বহু পুরস্কারে সম্মানিত হয়। |

Comments