ডiary : কিছু বিপ্লব বদল হল মধ্যগগনে ।২। : সৌম্যজিত চক্রবর্তী



DIARY
AUTHOR

–এর পর...
ওকে আমি ‘বন্ধু’ বলে ডাকি, ওর সাথে বি.টি. রোডের ধারে বসে আড্ডা দিই, এটা আমার ‘শিক্ষিত’ বন্ধুদের গায়ে একটু লাগে- হাজার হোক, অটোওলা ব’লে কথা, কলোনিতে থাকে, রাস্তায় স্নান করে, ভাড়া নিয়ে বচসা করে, খিস্তি দেয়, বাংলা খায়... আরও কত কিছু আছে ওর ‘মানুষ না’ হওয়ার মার্কশিটে! “ তোর এতকিছু আছে, এত পড়াশোনা করছিস্, পোফেসর হবি, ছেলে পড়াবি, তবু তুই আমার এই --- কথা শুনে কি কব্বি, বলত? ছাড়, একদিন চল পিকনিক্ করি। আমি মউ’কে ও নিয়ে যাব। ”  প্রসঙ্গঃ আমার বর্তমান, ভবিষ্যৎ এবং অবশ্যই আমাদের জমার খাতায় অবহেলায় পড়ে থাকা তিন বছরের একটা না হওয়া পিকনিক্হুতোম কতবার যে চেয়েছে, আমার সাথে একটা কোথাও যাবেকোথাও একটা- সেটা দিঘা হতে পারে, হতে পারে সুন্দরবন, হতে পারে ব্যান্ডেল। আমি ওকে কথা দিয়েও কথা রাখতে পারিনি। হুতোমের কথা শুনতে শুনতে আমার মনে হয় যে সেই সত্তরের দশকেও কি এমন কোন দুটো বন্ধু ছিল- যারা ঠিক আমদেরই মতন? এই যে আমার আর হুতোমের মধ্যে চরম অর্থনৈতিক অসাম্য, জীবনধারার অসাম্য- এত কিছু সয়েও নিশ্চয় দুটো মানুষ বন্ধু ছিল সেই সময়েও।
একটা মেয়ে- হুতোম তার নাম জানেনা। মেয়েটা এক ছেলের সাথে মাঝেমধ্যে আসত কলোনি’র গলিতে চা আর প্রজাপতি বিস্কুট খেতে। দু-একবার হয়তো সিনেমাও দেখেছে ওরা, শ্রীমা হলে। হয়তো সেই সিনেমার টিকিট টা কোন একবার বুগা’র কাছ থেকেই কিনেছিল ওরা। মেয়েটা বোধহয় কোন কলেজে পড়ত, ছেলেটাও। মেয়েটাকে ভালোলাগত বুগা’র। কিন্তু ওইটুকুই, তার বেশি কিছু কোনদিন মনে হয়নি। আসলে হুতোম বলতে পারছিল না যে, বুগা’র ওইটুকুর বেশি কিছু মনে হওয়ার মত সাহস কিংবা অধিকার ছিলনা। একটা টিকিট ব্ল্যাকার-টার্নড পুলিশ ইনফর্মারের ভালোলাগার, ভালবাসার অধিকার নিয়ে বোধহয় গণতান্ত্রিক, জন-গণ-মন-তান্ত্রিক অধিকার রক্ষা কমিটি, আরও ছাইপাশ যত কমিটি- এরা কোনদিনই খুব আগ্রহ দেখাননি। সুতরাং, মেয়েটার কথা শুনেই যদি ভাবেন যে আমি প্রেমের গল্প ঢুকিয়ে দিচ্ছি এই কিস্তিতে, সে গুড়ে বালি। আগেই বলেছি, দেড় মাসের মত সময় বুগা’কে খড়দা স্টেশনে ‘পাগল’ হয়ে কাটাতে হয়েছিল। সেই সময় ওই মেয়েটাকে বুগা দেখতে পেত প্রায় প্রতিদিন। যে সন্ধ্যেবেলায় শিয়ালদা যাওয়ার ট্রেনে উঠতে গিয়ে শুকু ধরা পড়ে, সেদিন বুগা ওই মেয়েটাকে ছুটে যেতে দেখেছিল...সাদা পোশাকের পুলিশেরাও ছুটেছিল মেয়েটার পিছনে। বুলেটের শব্দ অন্ধকারের ভেতর থেকে। ডাউন ট্রেন টা ছেড়ে গেল খড়দা। কিছুক্ষণ পরে মেয়েটাকে নিয়ে বুগার সামনে দিয়ে প্যারেডের ঢঙে হেঁটে গিয়েছিল মহামান্য শাসকের প্রিয়পাত্র’রা। চাপ চাপ রক্তও হেঁটে গিয়েছিল মেয়েটার একটা পা জড়িয়ে ধরে। বুগা’র সেদিন ছুটি হয়ে গেলমেজবাবূ সকলের অলক্ষ্যে মিহি গলায় বলে গেলঃ কাল একবার চা খেতে আসিস্ বিকেলের দিকে। আগামি বিকেলে বুগা জানতে পেরেছিল যে চা খাওয়া’র  অর্থ   হল ‘পেমেন্ট’। বাসায় ফিরে একটা বিড়ি ধরিয়ে হুতোমের মা’কে সে বলেছিল- “পরশু আবার দেখা করতে বলেছে। দূরে কোথাও যেতে হবে, মনে হয়। সেরকমই কথা হল। কাল ছুটি আছে। চালের যে’কটা টালি ভেঙে গেছে, কাল সকালে আমি বাজার থেকে নিয়ে আসব। টালিগুলো লাগিয়ে দিতে হবে। হ্যাঁ গো, মেয়েটাকে ওরা মেরে ফেলবে না তো?  হুতোমের কথা শুনে আমার গায়ের রোম খাড়া হয়ে উঠেছিল। চোখে জল চলে এসেছিল। না, মেয়েটার কথা ভেবে নয়, ওই নোনা আব্দারটুকু বুগা’র জন্যই বরাদ্দ ছিল।  


(ক্রমশ) 

Comments