ডiary : গালুডি ৩ : মৃগাঙ্কশেখর গঙ্গোপাধ্যায়


|

DIARY
AUTHOR
|খাওয়ার পর ঠিক হল, ধারাগিরি। সেটি কি বস্তু আমার কোন ধারণা নেই। আমি তো ভেবেছিলাম, আমরা ঘাটশিলা এসেছি। তার স্টেশনের নাম হয় তো গালুডি। ঘাটশিলা স্টেশন আসার পর বুঝলাম, না আমরা অন্য কোথাও যাচ্ছি। সৌরভ বলল অটোকে জিজ্ঞেস করি। অটো বলল, সেতো অনেক দূর। হাজার টাকা লাগবে। সৌরভ বলল কিছু কম করুন, সাতশোয় চলুন। সে বলল আটশো। আমি বললাম, না। ট্রেনে করে ঘাটশিলা গিয়ে ওখান থেকে অটো নিয়ে ঘুরলে দু শো লাগবে, তন্ময় জানাল। ট্রেনের সময় জানতে গিয়ে সে এক ঝামেলা, টিকিট কাউণ্টারে আমার ভাষা বুঝল না, নাকি ওখানে জগদ্দল স্টেশানের মতো এনাউন্সের লোক বসে থাকে, যারা ট্রেন চলে গেলে বলে, এক্ষুনি রাণাঘাট লোকাল চলে গেল। যাই হোক বিফল মনরথ হয়ে বেরোচ্ছি স্টেশন থেকে, দেখলাম, অনির্বান একজনকে পাকড়াও করেছে। অটোচালক। তাকে সাতশো টাকায় রাজি  করিয়েছে। সে রাজি হওয়ার পর। ছ’শো টাকায় যেতে বলছে। সে রাজি না হতে বলছে, সে কি গা তুমি না কইলা, আমি তোমার বন্ধু। বন্ধুর জন্য এটুকু করবা না। আচ্ছা সাড়ে ছশো দেব চল। ততক্ষণে গুড্ডু অটোতে উঠে ঘুমিয়ে পড়েছে। অটো চালকও কেমন করুণা কণ্ঠে বলছে, না না আমাকে সাতশো টাকা দিতে হবে। অনেক দূর। আমার অনেক পেট্রোল খরচ লাগবে। সৌরভ হঠাৎ করে রেগে গিয়ে বলল, তোরা থামবি, চলো সাতশোই দেব। অটো চলা শুরু করল। আমি সৌরভ সামনে। পিছনে, গুড্ডু, তন্ময়, অনির্বান, দেবরাজ- আমার সেই কেলানে বন্ধু। শহর ছাড়িয়ে অটো নামলো গ্রামের পথে। দূরে দু প্রান্তে পাহারের সাড়ি। তারপর সবুজ মাঠ। মাঝ খান দিয়ে রাস্তা। আমি কিছুক্ষণ পর খেয়াল করলাম আমি মাঝে মাঝেই অটো চালকের কাঁধে মাথা দিয়ে গুঁতো মারছি। যেটা উচিত নয়। কিন্তু আমি নিজেকে বিরত রাখতে পারছি না। আমি পিছনে ফিরে বললাম, প্লিস কেউ সামনে এসে বস। আমি ঘুমিয়ে পড়ছি। পিছনে গিয়ে বসার পর বেশ কিছুক্ষণ কি হয়েছে আমার মনে নেই। হঠাৎ সৌরভের চিৎকারে ঘুম ভাংলো। “মৃগাঙ্ক এ বলে কি রে! আমার কাছে জানতে চাইল, আমি এর আগে গেছি কি না। আমি বললাম ঘাটশিলা হয়ে গেছি আগে। গালুডি থেকে এই প্রথম। সে জানাল, তারও প্রথম বার।” অটোচালক জানালেন, চিন্তা করবেন না। আমি শুনেছি কি ভাবে যেতে হয়। আমি রাস্তায় জিজ্ঞেস করে ঠিক চলে যাব।

গাড়ি ঢুকল গ্রামের জনবসতিতে। এখানে মানুষের মাটির ঘর। ঘরের গায়ে ছবি আঁকা। রঙ টানা। বাড়ির ভেতর চারপাশে ঘর মাঝে উঠোন। গরু ছাগল ভেড়া চড়ে বেড়াচ্ছে। আকাশে দূরে মেঘ নেমেছে। পাহাড়ের ওপর। হাওয়া দিচ্ছে। বাড়ি ঘর শেষ হয়ে এবার শুধু সবুজ মাঠ। তাতে ছাতা মাথায় দাঁড়ানো। লাল পাড় সাদা শাড়ি। নিশ্চল। কৃষ্ণকলি, ঠাকুর বুঝি একে দেখেই লিখেছিলেন। অটো হঠাৎ থেমে গেল। জানাল, সে আর চিনতে পারছে না রাস্তা। বুঝতে পারছি না, কি বলা উচিত। কি করা। বললাম, জিজ্ঞেস কর কাউকে। আশে পাশে কেউ নেই। সামনে একটা পাঁচিল ঘেরা আকাশি বাড়ি। পাকা বাড়ি। তন্ময় এগিয়েছে সেই দিকে। আমি শুনতে পাচ্ছিলাম একটা শব্দ। মোরগকে সাপে ধরলে যে আওয়াজ তৈরী হয়। তেমন। আমি সেই শব্দ ধরে এগোতে এগোতে, দেখলাম, আওয়াজটা আসছে সেই বাড়ির ভেতর থেকে। আমি কাছে পৌঁছে চোখ রাখলাম, বন্ধ গেটের ফাঁক দিয়ে। বাড়ির গায়ে খোদাই করা, ভূত বাংলো। ওপরে একটা হাড়ের আকৃতি। যাকে বলে দিনের বেলায় ভূত দেখা। আমি তন্ময় মিলে বাড়িটার চারপাশে ঘুরে ফেললাম। কেউ নেই। শুধু ভেতর থেকে মোরগের ডাক। ততক্ষণে আমাদের অটো এগিয়ে আসছে, সরু মাটির পথ ধরে। দেবরার অটোর বাইরে গলা বের করে কি যেন একটা গান গাইছিল। আমরা উঠে বসলাম। সৌরভ জানাল। ভুল করে তিন কিলোমিটার ভুল পথে এসেছি আমরা। এবার ফিরে চলা। আকাশের কালো থেকে নেমে আসছে সাদা এক পর্দা। দূরে। একটা মেঘ তখন বৃষ্টি ঝরাচ্ছে। বাকিরা না না কাজে ভীষণ ব্যস্ত। অটো ক্যানেলের পাশ ধরে এগিয়ে চলেছে। সে এক অদ্ভুত রাস্তা। মনে হচ্ছে ঘোড়ার পিঠে রয়েছি। একপাশে ক্যানেল। অন্য পাশে খাদ। নীচে জনবসতি। কখনো জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে সরু রাস্তা ধরছে। কখনো আদিবাসী পল্লী। ততক্ষণে চার ঘণ্টার অটো জার্নি হয়ে গ্যাছে। তার সাথে একাধিক ভুল রাস্তা।

তন্ময় বলল এই তো এই রাস্তা। চিনতে পারছি। পাহাড়ের গা বেয়ে উঠতে থাকছে। অন্য পাশে খাদ। এর মধ্যে একবার ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। চেঁচামেচিতে ঘুম ভেঙ্গেছে। নামতে বলছে অটো থেকে। নামতে গিয়ে দেখি, নামার জায়গা নেই। খাদের কিনারে এসে অটো দাঁড়িয়েছে। এবার রাস্তা তার থেকে ভালো। লাল কাঁকুড়ে পথ। এক পাহাড় পেঁচিয়ে উঠে গেছে। নীচে নদী। কি নদী জানি না। আর ঘন জঙ্গল। অদ্ভুত পাখির ডাক। কিছুটা গিয়ে অটো থেমে গেল। এত ঘন জঙ্গল আর যাওয়া যাবে না। আমি বসতিতে নেমে এসে এক ষাটের গোড়ার মানুষকে পেলাম। তিনি কাঠ কাটছিলেন। বললাম, ধারাগিরিটা কিভাবে যাব। বললেন, একা চিনে যেতে পারব না। তিনি দেখিয়ে দিতে পারেন। তাকে কিছু দিলেই হবে। আমি বললাম, চল। সে আমাদের রাস্তা দেখিয়ে নিয়ে গেল। তন্ময়ের মুখ দেখে বুঝলাম, এবার যেন প্রকৃতি প্রেম দেয় না। ঝরনা শুকিয়ে গ্যাছে। আগের সেই ধারা নেই। চারপাশে খাতে জল নেই। শুধু রেখাটুকু আছে। ও বলে একটা শব্দের কথা সেই শব্দও খুঁজে পাচ্ছে না। এরপর কিছুটা এগিয়ে একটা ছোট খাদ মত। তিন ফুট চওড়া। দুটো সরু গাছের ডাল পাতা। মানুষটা বলেন, চলে যাও এর ওপর দিয়ে। বুঝি এর ওপর দিয়ে যাওয়া মানে নিশ্চিত ভাবে নীচে পড়া। তার থেকে লাফ ভালো। সৌরভ দেখলাম, ভীষণ একটা মানসিক প্রস্তুতি নিচ্ছে লাফ দেওয়ার সময়। অনির্বাণকে বুস্ট আপ করতে হল এক প্রস্ত। কিছুটা এগোতে একটা আওয়াজ। মাটিতে পাথরের ফাঁক দিয়ে জলের ধারা। বাঁক ঘুরতেই সামনে নীচু পাহারের গা বেয়ে নেমে আসছে জল। সে এক অদ্ভুত সুন্দর।  | |

Comments