ডiary : পত্রলেখা : সৌম্যজিত চক্রবর্তী




|

DIARY
AUTHOR

|

পত্রলেখা 
সৌম্যজিত চক্রবর্তী
|


সাধারণ ... তবু সাধারণ না!


প্রথমেই যে দু-আনা কথা না বললেই নয়, কলামের নাম হঠাৎ করে ‘পত্রলেখা’ কেন? পত্রলেখা আমার একটি ‘পাওয়া’ নাম। হ্যাঁ, পাওয়া। মানুষের জন্মদিন আর জন্মগ্রহণ এই দুটো বিষয় আলাদা। জন্মদিন একটাই হয়, যদি না বার্থ সার্টিফিকেটে কেলেঙ্কারি থাকে, কিন্তু জন্মগ্রহণ বারংবার হয় বলেই আমার বিশ্বাস। তেমনই এক জন্মগ্রহনের সময় এক বান্ধবী শান্তিনিকেতনে সোনাঝুরির শনিবাসরীয় হাট থেকে একখানা দুর্দান্ত লাল রঙের খাতা আমায় উপহার দিলেন, সঙ্গে ছোট্ট একটি লেখাঃ 

‘পত্রলেখা, 
যদিও অকিঞ্চিৎ
তবু, শুধু কবিতার জন্য... শান্তিনিকেতন, ২০১৩।।’

তারপর থেকেই এই নামটা আমার বেশ পছন্দের হয়ে গেল। রবীন্দ্রনাথ আমার এই প্রাপ্ত নাম দেখে হেঁচকি তুলতেই পারেন, কারণ নাম গিয়েছে চুরি- তাঁর ‘পুনশ্চ’ কাব্যগ্রন্থে একখানি কবিতা আছে ঐ নামে। মনে পড়ছে? “দিলে তুমি সোনা-মোড়া ফাউন্টেন পেন/কতমতো লেখার আসবাব/.../লিখতে বসেছি চিঠি/সকালেই স্নান হয়ে গেছে/লিখি যে কী কথা নিয়ে কিছুতেই ভেবে পাই নে তো/একটি খবর আছে শুধু/তুমি চলে গেছ/সে খবর তোমারও তো জানা/তবু মনে হয়/ভাল করে তুমি সে জান না/তাই ভাবি, এ কথাটি জানাই তোমাকে/তুমি চলে গেছ।”

আমার বাল্যকালের বন্ধু মৃগাঙ্কশেখর একদিন বলল যে সে এমন কিছু লোকজনকে খুঁজছে, যাঁদের কিঞ্চিৎ আনকমন মানুষদের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ হয়েছে, এমন- যাঁরা একটু অন্যরকমভাবে জীবন কাটাতে ভালবাসে, আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের মত নন। আমার প্রথম প্রতিক্রিয়া ছিল, আচ্ছা ধর- এরকম? খাতা খুঁজে না পেয়ে যিনি প্রেমিকার ব্লাউজে অঙ্ক কষেন? সেরকম হলে চলবে? আমাকে পুরুষতান্ত্রিক শয়তান মনে হলে প্রেমিকার ব্লাউজকে নির্দ্বিধায় প্রেমিকের অন্তর্বাস দিয়ে পুনঃস্থাপন করে পুরো ব্যাপারটা ভেবে নিতে পারেন। যাই হোক, এসব দু’চার কথা হতে হতে এই কলাম লেখার আলোচনা এবং অতঃপর এই ধারাবাহিকের জন্মগ্রহণ। এখন ‘সাধারণ’ আর ‘সাধারণ না’-ই বা কাকে বলব?– তা নিয়ে বিস্তর জলঘোলা চলতেই পারে। আমার বিশ্বাস, একজন মানুষ স্থান-কাল-পাত্র ভেদে অতি সাধারণ অথবা অ-সাধারণ হতে পারেন। কিন্তু এই দুইয়ের সুক্ষ বিভাজিকার দিকে অতিরিক্ত মনোনিবেশ না করে, আমার চোখ দিয়ে দেখা বা অন্যের অভিজ্ঞতা, যা আর পাঁচটা অভিজ্ঞতার থেকে কিঞ্চিৎ আলাদা- সেইসব বলার তাগিদেই এই পত্রলেখা।

আমি ছেলেবেলা থেকে বইয়ের মধ্যে বড় হয়েছি। মা-বাবার জমানো ইচ্ছেশক্তি এবং বিভিন্ন লাইব্রেরির দৌলতে রবীন্দ্র রচনাবলী, কালকূট রচনা সমগ্র, শরৎচন্দ্র, বঙ্কিম ইত্যাদি আমার জন্মের আগে থেকেই আমাদের বইয়ের তাকে নিজেদের জায়গা করে নিয়েছে। এরপর যাঁর যাঁর নিজেদের ইচ্ছেমত আমাদের ঘরে আস্তানা বেঁধেছেন অনেক লেখক- বাবার সংগ্রহ থেকে চুরি করে পড়া মিখাইল শলোখভ কিংবা দমিত্রি ফুরমানভ আমার ঘুম কেড়েছেন অনেক রাত। ওদিকে জয়দেব বসু’র আঠারো-তম জন্মদিনে (সেই ১৯৭৭ সালের কথা বলছি) তাঁর বন্ধুবর অসীম চট্টরাজের থেকে উপহার পাওয়া নিকোলাই অস্ত্রভস্কি’র ‘ইস্পাত’ কি ভাবে যেন আমার হাতে এল নতুন শতাব্দীর গোড়ার দিকে। ব্যস, বিপ্লব শুরু হল মনে মনে। তখন তো আর বুঝিনি, বিপ্লব কাহাকে কয়? উহা কয় প্রকার ও কি কি? উহার রং কি? পার্টিলাইনের বিশ্বাস এক জিনিস, আর যাপনে তাকে নিয়ে বাঁচতে শেখা আরেক জিনিস। সে দ্বন্দের অবসান আজো হয়নি, জানি হবেও না। এই দ্বন্দ্ব নিয়ে বাঁচতে শিখেছি, শিখছি। এরই মধ্যে মায়ের সংগ্রহে প্রতিদিন নতুন নতুন সংযোজন হয়। কখনো তসলিমা নাসরিন, কখনো জ্যোতিভূষণ চাকী, গোপাল হালদার, বিমল কর...আরও কত্তজন! আমার মা’কে কোনদিন বাছবিচার করে বই পড়তে দেখিনি, পুরস্কারের তালিকা মিলিয়ে বই কিনতে দেখিনি। তাই ইস্কুল-জীবনেই সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের সাথে পরিচয় হয়েছে বইয়ের তাকে। তো... এমন ঘরে জন্ম হওয়ার কিছু সুবিধা যেমন আছে, তেমন অসুবিধা ও আছে। সুবিধা হল এই যে, বই সংক্রান্ত কোন একটা সংশয় হচ্ছে, অমনি মাকে জিজ্ঞেস করলেই জানি, উত্তর আসবেই তক্ষুনি। আবার অসুবিধা, যেমন- কথায় কথায় এমন একখানা যোগসূত্র দিয়ে দেবেন, যে অতঃপর আমার ক্ষেত্রে ‘মুখ’ আর ‘মূক’ প্রতিশব্দ হয়ে যায়। ডায়েরি লিখতে গেলে এত অনুষঙ্গ চলে আসে কারণে-অকারণেই, নিজেই ভাবি অতিরিক্ত হয়ে যাচ্ছে কি? যদি দীর্ঘায়িত মনে হয়, নিজ গুণে ক্ষমা করে দেবেন। আসল কথায় আসি।



১৯৯৭ সাল, জুন মাসের তিন তারিখ। ইস্কুলে সম্ভবত গ্রীষ্মের ছুটি চলছে, ফলে ঘরেই বসে। সকালে গল্পের বই পড়া, দুপুরে ছুটির কাজ করা, আর বিকেলে একটু-আধটু খেলা– এইরকম অভ্যাস। আমাদের বারান্দায় একটা মাদুরে বসে কোন বই পড়ছি। কি একটা কারণে সেদিন বাবা যেন ঘরেই ছিলেন, মনে পড়ছে। সেদিন প্রচণ্ড গরম পরেছিল, বৃষ্টি বোধহয় হচ্ছিলনা অনেকদিন যাবত। এক মধ্যবয়সী (এই ধরুন, ৫০-৫২ বছরের হবেন) ভদ্রলোক এসে দাঁড়ালেন আমাদের বারান্দার সামনে, মাথার চুল আলুথালু, গায়ে সাদা রং ফিকে হয়ে যাওয়া বেশ ময়লা ধুতি-পাঞ্জাবী। একটু জল চাইলেন। আমি দৌড়ে গিয়ে মা’কে ডেকে আনলাম। গৃহস্থ বাড়ি বলে কথা- মা কিছুক্ষণের মধ্যেই দুটো সন্দেশ আর ঠাণ্ডা জল এনে মানুষটিকে দিলেন। তিনি তাঁর কাঁধ থেকে ঝোলাটা নামিয়ে মাদুরে বসলেন। জল খেয়ে, মৃদু হেসে আমার দিকে তাকিয়ে একটার পর একটা প্রশ্ন করতে শুরু করলেন- কোন ইস্কুলে পড়ি? কি পড়তে ভাললাগে? খবরের কাগজ পড়ি কিনা? বাবার চোখ-মুখ বিশেষ ভালো ঠেকছিল না আমার। বুঝতে পারছিলাম ভদ্রলোকের উদ্দেশ্য তখনো যেহেতু জানা হয়নি, তাই বাবার ঐ উশখুশ করা। ভদ্রলোক বিলক্ষণ তা বুঝেছিলেন বলেই আমার বিশ্বাস। তিনি ঝোলা থেকে হলুদ রঙের একখানা চটি বই বের করে আমার হাতে দিলেন। বইটার নাম ‘গল্প লেখার গল্প’। একটা কলমের ছবিও রয়েছে। নীচে লেখকের নাম মৃণাল গুহঠাকুরতা। মূল্য- কুড়ি টাকা মাত্র। আমি বইটা হাতে নিয়ে উল্টে-পাল্টে দেখতে শুরু করে দিয়েছি, অনেকগুলো ছোটগল্প রয়েছে। ইতিমধ্যে বাবার সঙ্গে তাঁর বেশ সখ্যতা জমে উঠেছে। কথায় কথায় বললেন, তাঁর বাড়ি সোনারপুরে। আরও অনেক কথাই হয়েছিল নিশ্চয়ই, সবকিছু আমার মনেও নেই। তবু অনেকদিন পরে যখন তাঁর লেখা ঐ বইটা খুঁজে পেলাম, চোখের সামনে ৩রা জুনের গুমোট দুপুরটা ভেসে উঠল। মানুষটা নিজের বই নিজেই ট্রেনে-বাসে চড়ে, পায়ে পথ হেঁটে বিক্রি করে বেড়াতেন। তাঁর লেখা বইগুলি বইপাড়ায় দেদার বিক্রি হওয়া তো দুরস্থান, ছোটখাটো প্রকাশকও ছাপতে চাইতেন না। ’৯৭ সাল অবধি তখনও তাঁর এগারো টি বই লেখা হয়ে গেছে। কোনটি ছোট গল্পের, কোনটি উপন্যাস। এই বইটি, যা আমার সংগ্রহে রয়েছে, তার ভূমিকায় লেখক লিখছেন- “প্রকাশক শ্রী প্রশান্ত তালুকদার, যিনি অনেক ঝুঁকি নিয়ে এ বই প্রকাশ করেছেন, তাঁকে অসংখ্য ধন্যবাদ।” প্রথম গল্প ‘গল্প লেখার গল্প’-এ লিখছেনঃ ‘শহরের মানুষ আমি। জম্ম-কম্ম আর জীবন সবই আমার শহরে মানে এই কোলকাতাতেই। নানারকম যান-বাহন পাকা-রাস্তা পাকা-বাড়ি আর ঠাসাঠাসি মানুষের বসতির সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক আমার বহুদিনেরই শুধু নয়, চিরকালের। সাহিত্যে বা কাব্যে ছাড়া পল্লবঘন আম্রকানন, দিগন্ত প্রসারিত শূন্য প্রান্তর বা রাখালের খেলাগেহ ইত্যাদির সঙ্গে বাস্তব পরিচয় ছিল না আমার কোনকালেই। ... অনভ্যস্ত মন বিদ্রোহী হয়ে ওঠবারই কথা। কিন্তু আমি মনকে সে সুযোগ দিলাম না।’ আবার ‘ভগবান নেই’ গল্পে তিনি নিজের জীবনের কথাই যেন লিখে ফেলেছেন- ‘আজকের দিনটা স্বতন্ত্র। শরীরের অবস্থা আজ আরও খারাপ। ... এদিকে ঘরে মালক্ষ্মী বাড়ন্ত। আমি তো চাকরি করিনা। লেখাটাকেই পেশা হিসেবে নিয়েছি। বই বিক্রির অর্থেই চলছে না চলার মধ্য দিয়েই। আজও চলবে। অতএব, করুণাসাগর বিদ্যেসাগর হবার সাধ মনে জাগলেও সব ধামা-চাপা দিয়ে রাখা ছাড়া গত্যন্তর নেই। ... জানেনতো বই লিখে খাই- তা’ একটা বই কিনুনতো! আমার লেখা বই। দিন দশ টাকা! সব দরকার না মিটলেও দশ টাকায় আটা, সকালের চাল, ছেলের সকালের জলখাবার ও বিড়ি কিনে দশ পয়সা রইলো পকেটে। কাল সন্ধ্যে পর্যন্ত লড়তে পারবো যাহোক।’ আর ‘মনের মানুষ’-এ বলছেন, ‘নতুন রঙধরা মনে প্রথম যৌবনের একদিন সকাল, দশটা। সেদিন রবিবার। সারা শহরের আজ বিশ্রাম। ঘেরা বারান্দায় দাঁড়িয়ে ঊর্মিমালার মনে হলো, একজনের ছুটি নেই কেন তবু আজ? ওঁদের কারখানাটা কেমন- রবিবারেও ওয়ার্কারদের ওভারটাইম খাটায় দুটো টাকার লোভ দেখিয়ে!’

বিশ্বাস করবেন কি না জানিনা, এই লেখা পড়ে চোখেদের বমি পায়। গিলে খেতে আসে আমাদের সভ্যতা। এই শহরের আকাশ অনেক লেখকের নামে চোখ বন্ধ ক’রে লাটাইয়ে সুতো ছেড়েছে, আবার এই শহরেরই বুকে অনেক লেখককে পায়ে হেঁটে বই বিক্রিও করতে শিখিয়েছে। আমরা অমুক পড়ি, তমুক আওড়াই। কথায় কথায় কত্ত সংস্কৃতি চর্চা করি। তাঁর লেখাকেই সঙ্গী করে বলি- ‘পরনে কিছুই নেই- সম্পূর্ণ নিরাভরণ, উলঙ্গ।’ সুমন চাটুজ্যের ‘গানওয়ালা’ আর অঞ্জন দত্তের ‘শুনতে কি চাও তুমি’ শুনে বড় হয়েছি আমি। আমার জীবনে কোন গানওয়ালা, কোন খেলনাওয়ালা- কেউ না, কেউ আসেনি। এসেছিলেন ঐ বইওয়ালা। দারিদ্র্যের সাথে সৎ ভাবে মাথা উঁচু করে লড়াই করার সাহস যে মানুষটি মজ্জায় মজ্জায় ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি বিখ্যাত হতে পারেন নি। হয়তো হতেও চানও নি। শুধু ছেলের জলখাবারের টাকাটা জোগাড় করেছেন নিজের বিদ্যে বেচে। প্রেমের গল্পে পুঁজিবাদী আগ্রাসনকে তীব্র শ্লেষের ছলে এফোঁড় ওফোঁড় করে ছেড়েছেন। শহুরে জীবন যাপন করে ধানক্ষেতের আষাঢ়ে গপ্পো করেননি, চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন একজন অখ্যাত লেখকের জীবন। আমি জানি না, কারুর সৌভাগ্য হয়েছে কিনা মৃণালবাবু, আমার বইওয়ালার লেখা পড়ার! জানি না, তিনি আজ কোথায়, কিভাবে বেঁচে আছেন? আদৌ আছেন কিনা? আমার এই মানুষটিকে অনন্যসাধারণ মনে হয়েছিল। যিনি আর পাঁচটা মানুষের মত দশটা-পাঁচটা করেননি। নিজের শিল্পকর্ম, তা সে যে মানেরই হোক না কেন, তার হাত ধরে পথ হেঁটেছেন। মৃণাল গুহঠাকুরতা, আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আপনি আমাদের মধ্যেই আছেন। খুঁজে নেব আমরাই।

ঐ যে বলেছিলাম, বিপ্লব কাহাকে কয়? একটি বিপ্লবের ঠিকানা হল- কামরাবাদ, পোঃ সোনারপুর, জেলা- দঃ ২৪ পরগণা, পিন- ৭৪৩৩৬৯। কেউ বিপ্লবের সন্ধান পেলে জানাবেন।

---




 |

|

Comments