ভিঞ্চির আঁকা মোনালিসার ভ্রু নেই








DIARY
AUTHOR




“মোনালিসার ভ্রু” - মৃগাঙ্কশেখর গঙ্গোপাধ্যায়
‘ লিওনার্দো দা ভিঞ্চির আঁকা মোনালিসার ভ্রু নেই। রিসার্চ করে দেখা যায় ছবিটি আঁকার সময় তাতে ভ্রু এঁকেছিলেন শিল্পী। কিন্তু পরে তা কোনভাবে উঠে যায়। ’


 আমার এক বন্ধু ছিল। তার সাথে বনে বাদাড়ে ঘুরে বেড়াতাম। তখনও স্কুলে ঢুকি নি। ও সকালে উঠে চলে আসত আমাদের বাড়ি। একসাথে পড়তাম। তারপর বেড়িয়েপরা। অনেকদূর দূর চলে যেতাম। তখনও রহড়া অজপাড়া গাঁ। বাঁশ বন। জঙ্গল। খেঁজুর বন। আর টিকলক দা দের বাড়ি পেরোলেই বিশাল মাঠ। মাঠ পেরোলে ফিশারির পাঁচিল। সেই পাঁচিল ধরে হাঁটতে থাকা। মাঠটা  নীচু জমি। স্যাঁতস্যাঁতে। ঘাস কাদা র মাঝামাঝি। আমরা দুই বন্ধু হাঁটতে হাঁটতে পেরোতাম। মাঠের শেষে তখন একটা কুড়ে ঘর। আমরা উঁকি মেরে দেখতাম। কাউকে দেখা যেত না। ঘরের দরজাটা ভেজানো থাকতো। ড্রাগন বলত, ঢুকবি? দেখবি ভেতরে কি আছে। আমি ঠিক সাহস পেতাম না। ড্রাগন আমার বন্ধুর নাম। পাড়ার সবার দেওয়া। কটা চোখ ওর। আমাদের ধারণা ছিল ও ঘর ডাইনি বুড়ির। কুঁজো হয়ে ঝুঁকে পড়া এক বুড়ি। সারাদিন এখানে সেখানে ঘুরে শাক পাতা জোগার করে আনে। শুকনো পাতা জ্বালিয়ে আগুন ধরায়। সেদ্ধ হয় সেসব। দূর থেকে দেখেছে ড্রাগন। বলেছে, তোর বইয়ে যে ছবিটা আছে না একদম সেই রকম। আমি মাকে জিজ্ঞেস করি। মা বলতে পারে না। কেউ জানে না এ বুড়ি কোথা থেকে এসেছে। মাঝের বিশাল মাঠটা আমাদের পাড়া থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে এক কুঁড়ে ঘরকে। 

ডাক্তার বলেছিল এলোপেসিয়া। তখন ওয়ান। মিশনে ভর্তি হয়েছি সবে। চুল পড়ে যাচ্ছে সমস্ত। একমাসের মধ্যে আমি আয়নায় দাঁড়ালে এক অন্য মুখ। রাস্তায় বেরলে সবাই হা করে থাকে। জিজ্ঞেস করে কি হয়েছে। সাথে পেয়াজের রস, পঞ্চমুখী জবা বেটে লাগাও, এই ডাক্তার সেই কবিরাজ। বাবা একটা টুপি কিনে দিল। টুপি পড়া শুরু। স্কুলে টুপি নিয়ে বন্ধুদের ছোঁড়াছুড়ি। এক বন্ধুর গাঁট্টা ছিল প্রচণ্ড। হঠাৎ করেই একটা অন্য জগতে ঢুকে গেলাম। কলেজে ঢোকার পর কিছুটা কমল। তাও ‘পা’ ‘জাদু’ ‘আলাগ’। একদিন একবন্ধু চেঁচিয়ে উঠল, এই তোর ভ্রু নেই।
ঐন্দ্রিলার সাথে আলাপ হয়েছিল অরকুটে। সবে কলেজে উঠেছি। কিন্তু নিজে থেকে কোন দিন দেখা করার কথা বলতে পারি নি। আমাকে আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের মত দেখতে না। টুপি দিয়ে চোখটা যতটা পারি ঢেকে নিতাম। বাবা উইগ কিনে দিল। কিন্তু সে পরা কষ্টকর। মাথার পিছনে একটা পিন চেপে বসে থাকে। মাথার শিরায় চাপ পড়ে। যন্ত্রণা হয়। ঐন্দ্রিলাই প্রথম জোর করে দেখা করায়। আমি ওকেই প্রথম দেখেছিলাম, আমার এই আলাদা হওয়াটা ওর কাছে খুব একটা গুরুত্ব পায় না। শ্বাসের স্বাভাবিক চলাচল এভাবেই শুরু হয়। 
সেদিন ঘরটার সামনে অনেক ভিড়। আমি ড্রাগন সেদিনও দূর থেকেই দেখছি। একটা হাড়জিড়জিড়ে দেহ ঘরটা থেকে বেরিয়ে আসছে। দুটো মানুষ কাঁধ আর পা ধরে বের করছে। শুইয়ে দিচ্ছে মাটিতে। ড্রাগন পাশ থেকে ফিস ফিস করে বলে, ডাইনিরাও কি মরে যায়?

Comments