ঘুম - সুমন ধারা শর্মা







আজ কর্মবিরতি। আমি হারিয়ে যাচ্ছি। কাল হাজরার মোড়। পরশু পেন-স্ট্যান্ড থেকে ধুপ্‌ করে পড়ে যাব। বিবেকহীন। আমি হারিয়ে যাচ্ছি। আমার উদ্দেশ্যহীন হাঁটাচলা। কথাবলা। বেশি কী বলি? তর্কের খাতিরে কর্মবিরতি স্বাগত। কাল পেন-ডাউন। আমি করব না। কিন্তু, করতেই হবে। ধারালো অস্ত্র ভয় পাও? অথবা, সপাটে গালে একটা চড়। টেলিফোনের বিল উঠবে। তুমি কান ধরো। উঠবে-বসবে। যতক্ষণ না থামতে বলি। আমি জানি, তুমি কী জানো? আমার একটা ছড়া মনে পড়ল। অনেকেই পড়ে। কিন্তু, অন্যরা ভয় পায়। আমি টেনশন-ফ্রি। ওয়ান-টু-থ্রি। কে আছ? আমি ছাত থেকে লাফিয়ে পড়তে চাই। আমি দৌড়ে চলে যেতে চাই। অট্টালিকার চৌদ্দতলায় আমার জাঙিয়া শুকোতে দেব। কেউ আটকাতে গেলে ‘রে রে’ করে তেড়ে এলেই হবে। বাকিটা বিয়াল্লিশটা বসন্ত। আর, পঞ্চান্নটা হসন্ত। তুমি কামড়ালে তেড়ে যাই। পথে পথে ঘুরি। ঘুমোই। আমি জানি। তুমি জান না। অথবা, আমি পারি। তুমি পারবে না। এভাবে বললে, অহংকারী মনে হয়। আমি অহংকারী। তুমিও। সেভাবেই তোমাকে দেখেছি। বরাবর। অনেকগুলো প্রশ্নবোধক জিজ্ঞাসাচিহ্ন ছিল। একসময়ে। এখন নেই। এখন কেউ নেই। এখন রাত। ক’টা বাজে? বোধহয়, সাড়ে বারোটা-একটা হবে। সময়টা অন্ধকার রাত। রাস্তার ল্যাম্পপোস্ট মাতাল। ফুটপাথ থেকে থেকে উঠে পড়ছে হোর্ডিং কামড়াতে। দোয়াতহীন কালি এভাবে ঢেলে দেয় কেউ? হেডলাইটের আলোয় একটা লোক। সে ফুটপাথে ঘুমোয়। প্লাস্টিক জড়িয়ে মড়িয়ে। সকাল হলে সে তার বেডরোলটা কোনও দোকানের নিচে গুঁজে দেয়। সেখানে একটা কুকুর চারটে মাল্টিকালার বাচ্চা দিয়েছে। আমি, তার একটাও কিন্তু বাঁচবে না। কয়েকদিন পরে তারা চারটে পা আকাশের দিকে তুলে নোংরা নর্দমার পাশে ঘুমোবে। শেষ ঘুম। এভাবে বলতে নেই। আমাদের। আমরা সজাগ আছি। আজ রাত পোহালে কাল সকাল। কাল রাত পোহালে পরশু। একটার পর একটা দিন চলে যাচ্ছে। প্লাস্টিকের মমি রোজই রাত হলে ফুটপাথে শুতে আসে। দিনের বেলা কেমন গুঁজেমুজে থাকে, যেন মনে হয়, এরা কেউ নেই। শুধু আমি। আমিত্ব-এ পেয়েছে। অহং আর অহং। সলিপ্‌সিজ্‌ম্‌। কিন্তু, কেন? কেন-র উত্তর নেই। আমি বাঁধছি। নিজেকে। কাঠের সঙ্গে, খাটের সঙ্গে, দেওয়ালের সঙ্গে। ফের খুলে ফেলছি নিজেকে। আবার বাঁধছি। আবার খুলছি। রাস্তা দিয়ে অন্ধকার গাড়ি যাচ্ছে। গাড়ির ভেতরে কেউ বান্ধবীর হাত নিজের বুকের কাছে রেখেছে। কেউ নিজের হাত বান্ধবীর বুকের কাছে। এটা স্বাভাবিক। আমি স্বাভাবিক না। আমার জন্য একটাও অন্ধকার গাড়ি নেই। গাড়ির ভেতরে অন্ধকার নেই। একটা ফুটপাথ নেই, যার একপাশে আমি ঘুমোতে পারি। অথচ, সেই প্লাস্টিকমোড়া লোকটা...সেলোফেন-টাইপের...ঘুমে কাদা। আমি হাতড়াচ্ছি। অন্য ভাষায় বলা যায়, মাড়াচ্ছি। কার? বোধহয় নিজেরটাই।

ধীরে ধীরে ভুলে যাচ্ছি ভাষা। ভুশ্‌ করে হাওয়া বেরিয়ে আসে। প্রতিবার উচ্চারনে গোলমাল হয়। ভাল করে বললে বলা যায়, আমি হারিয়ে যাচ্ছি শুকনো লতাপাতার জঙ্গলে। শুয়ে আছি কোথাও না কোথাও। অথচ, সেই প্লাস্টিক জড়ানো লোকটা কেমন ঘুমোচ্ছে দেখ। ওটা আমার প্রতিকৃতি। আমার সারা গায়ে প্লাস্টিক। রাবিশ। চুন। প্লাস্টার অব্‌ প্যারিস। আমি ঘুমোলে ঠান্ডা নিশ্বাস ছাড়ি। লোকে দেখেছে। আমি শুঁকলে একটা হড়হড়ে কেরোসিনের গন্ধ বের হয়। আমাকে যদিও ভাল করে দেখা যায় না। আমি আসলে একটা লুব্রিকেটেড মানুষ। লুব্রিকেটেড আবার ফ্যাব্রিকেটেড-ও। ভালোবাসি। ভালোবাসি। ফুটপাথ ছাড়তে ছাড়তে অনেক লোক এসে যায়। কেউ কারও জায়গায় শোবে না। কেউ কাউকে ভালোবাসবে না। কেউ কারও অধিকারে হস্তক্ষেপ করবে না বলে কথা দিয়েছে। শেষরাতে কেউ কেউ বসে থাকে, পরের লোক জায়গা দেবে হলে জানিয়েছে। কিন্তু, ছক্কা পড়তে পড়তে তো অনেক দেরি। আমার জামা দিয়ে কেমন ঘামের গন্ধ বের হয়। আমার আগের লোকটা এই মাত্র ট্রেনের তলায় চাপা পড়েছে। খবরে প্রকাশ। আমাকেও সেই রাস্তায় হাঁটতে হবে। সেই একই রাস্তায়। আমার ভাল লাগে না। অশান্তি। টেনশন। কিছুই না। আমায় সেই আগের জায়গায় ফিরিয়ে দেখয়া হোক। কিন্তু, সেখানেও বিপদ। রক্ত দিলে ভাত দেবে। নাহলে, বিদ্যুত্চালিত হান্টার। সার্কাসের বাঘেরা পিছু হটে। আমরা এগিয়ে যাই। বিশাল কিছু করতে পারব না। কিন্তু, যেতে আপত্তি কোথায়? সেই লোকটার একটা কাপড়ের জামা জোটেনি। সেই প্লাস্টিক জড়িয়ে শুয়ে থাকে। প্লাস্টিকও তাকে পয়সা দিয়ে কিনতে হবে। দেখা যাক, আর কী কী হয়। কী-ই বা হবে? লোকটার সামনে নিজেকে দাঁড় করাই। আমি বিনম্র। অনেকটা চিরঞ্জীবের মতো। কারও বাড়ি যাই না। নিজের বাড়িতে বসে লিখি। একমনে। লোকটা আমাকে দেখল। নিশ্চিন্তে। ছোট্ট করে একটা ধমক দিল।


এখন ঘুমোচ্ছি। পরে আসবেন।

কখন এলে আপনার সুবিধা হবে?
 

জ্বালাচ্ছেন কেন? পরে আসবেন নাহয় এক সময়ে।

কেন আসব জিগ্যেস করলেন না?

কী হবে?

তাও!

তাহলে বলুন।

না থাক। পরেই না হয়...

ভাল কথা। যদি দেখেন ঘুমিয়ে আছি। জাগাবেন না দয়া করে। আমাদের ঘুম কিনতে হয় তো!

তাই নাকি? ঠিক আছে। ঠিক আছে।

ফিরে এলাম। অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেওয়ার অনেক সুবিধা। বুঝলাম। তবে, লোকটার অঙ্গে প্লাস্টিক জড়ানো বলে বোধহয় আন্ডার-এস্টিমেট করেছিলাম। শহর রাতারাতি বদলায় নি তাহলে। ঠিক আছে। নিজের ফ্ল্যাটে ফিরে এসে বসলাম। জানলাটা খুলব খুলব করেও খুললাম না। লোকটা দাম্ভিক তাহলে। নিজেকে বললাম। হয়ত তা-ই ওর জন্য প্লাস্টিক বরাদ্দ হয়েছে। যদিও, আমার ঈর্ষা হচ্ছে। নিশ্চিন্ত? একটা লোক? এই শহরে? ভাবা যায়? ভাবা হয়ত যায়। কিন্তু, আমি ভাবতে পারছি না প্রেজেন্টলি। তাহলে, একটু পরে আবার যাব? কিন্তু, আজ যদি সারাদিনই সে ঘুমোয়। তাকে ঘুম কিনতে হয়। ডায়েরিটা নোট করে রাখলাম ব্যাপারটা। আমার বেশ চিন্তা হল। কিন্তু, হিসেব করে দেখা গেল, আমাকে এই ফ্ল্যাটে ঘুমটা কিন্তু কিনতে হয় না। সেই প্লাস্টিক জড়ানো লোকটা হয়ত খেতে পায় না। কিন্তু, কষ্ট করে ঘুমটা তাকে কিনতেই হয়। তার বয়ানমতো। নিজেকে নিয়ে সারাদিন ব্যস্ত থাকি। জানিও না এইসব। আমার ঘুম পাচ্ছে। আমাকে একটু কষ্ট করতে হবে। বিছানা থেকে উঠে গিয়ে নাইটল্যাম্পটা জ্বেলে দিয়ে চাদরটা টেনে নিতে হবে।


বিব্রত বোধ করলে মানুষের মুখের চেহারা পালটে যায়। আমারও যায়। তবে, সে সময়ে আয়নার সামনে না দাঁড়ালে বোঝা মুশকিল! আসলে, আমরা নিজের মুখের এক্সপ্রেশনগুলোকে এখন গিয়ারের মতো ইচ্ছে করেই চেঞ্জ করে রাখি। আমাদের সুবিধা হয়। লোকে মিস্‌লিড্‌ হয়। মজা। মজা। অফুরান মজা। লোকটা শেষপর্যন্ত আমাকে বিকেল পাঁচটায় টাইম দিয়েছে। একটা চায়ের দোকানে। আমি যাবই। আমি যাবই। সময়মতো পৌঁছে দেখলাম, সে নেই। তিনকাপ চা মেরে দিলাম। আরও কিছুক্ষণ পরে সে এল। আজ দু’টো প্লাস্টিক। লোকে দেখে নাক সিঁটকাল। আমি না। তবে, লোকে তো জানে না, এর জন্যই আমি ঘন্টাখানেক বসে আছি। সে দিব্যি এল। বসল। এককাপ চা তাকে অফার করতেই হবে। সে বলল,

বিস্কুট-টিস্কুট?

ক’টা?

গোটা চারেক।

তারপর? ঘুম হল?

তাতে আপনার কী প্রবলেম?

না। এমনি এমনি বললাম।

এমনি বলে কোনও কথা হয় না। আপনার নিশ্চয়ই কোনও উদ্দেশ্য আছে। তাই আমার পেছনে ফেউয়ের মতো লেগে আছেন। মতলবটা বলুন তো মশাই?

না। আপনাকে ঘুমিয়ে থাকতে দেখে আমার ভাল লাগছিল। আমার একটা প্রোপোজাল আছে।

ধুর বাবা। আবার প্রোপোজাল কেন? সোজা ভাষায় কথা বললেই হয়!

বলছি, আপনি যদি আমার বাড়িতে কিছুদিন থাকেন!

সে কী কথা? আমি বাড়িতে থাকব কেন? আমার একটা স্ট্যাটাস আছে!

হ্যাঁ, সে তো আছেই। তবুও, যদি...।

কিন্তু, আমি বাড়িতে থাকতে যাব কেন বলুন তো? এটা তো বেশ মজার ব্যাপার মশাই।

যদি কিছু পয়সা-টয়সা দিই? মানে, আমার আপনাকে দেখে বেশ লোভ হচ্ছিল।

কী লোভ?

ঘুমের। ওই যে ভোঁশ ভোঁশ করে দিব্যি নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছিলেন না, আপনাকে জাস্ট্‌ অমিতাভের মতো লাগছিল মশাই। এক্কেবারে অমিতাভ!

কম্‌প্লিমেন্ট দিচ্ছেন। তো আমির না কেন? শাহরুখ না কেন? আপনি মশাই, পরিষ্কার বুঝতে পারছি, লবিবাজি করছেন। আপনি জানেন না, আমি বেঁটে বলে, লোকে আমাকে অমিতাভ বলে। দুগ্‌গিবাজি পেয়েছেন?

না না। আমি অতশত জানি না দাদা।

আবার ‘দাদা’? এরপর কি পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করবেন নাকি?

বললে তাও করতে পারি। কিন্তু, একটা রাত আপনাকে আমার পোশাকে আমার বাড়ির বিছানায়, এসি টেসি সব আছে, শুতে হবে। আপনার কোনও অসুবিধা হবে না। প্লিজ্‌ দাদা। আমি চ্যাং-ওয়াহ্‌ থেকে খাবার আনিয়ে দেব। শুধু প্লাস্টিক জড়িয়ে একরাত ফুটপাথে শোব। জানেন, কতদিন নাক ডাকিয়ে ঘুমোই নি মশাই। দশতলার ফ্ল্যাটে মশা নেই ঠিক কথাই। কিন্তু, একটা কথা জানেন, সেখানে ঘুমও নেই। কিস্যু নেই। শুধু স্ট্রাকচারটাই যেন গিলতে আসে।

বুঝছি, বুঝছি। একটা শকুন দেখেছি সকালে। তখনই বুঝছি। শহরে মড়ক আসবে। মড়ক। ভদ্দরলোক বলে প্লাস্টিক জড়িয়ে ফুটপাথে শোবে। আমি কি তাহলে কমোডে হাগব নাকি?

হ্যাঁ হ্যাঁ সেরকমই তো কথা!

যাঃ শালা। বসে বসে হাগা। হবে?

কেন হবে না? একটা ক্লাসিক ধরিয়ে নিলেই হবে!

ওহ্‌! তা আপনার বউ টউ?

নেই।

মরে গেছে?

কী যে বলেন! ঘুরতে গেছে বাপের বাড়ি। দিনদশেক। এসেই কোমর বাঁধবে। আপনি দাদা একটু আমার একটা ব্যবস্থা করে দিন দাদা!

মহা নাছোড়বান্দা লোক তো মশাই আপনি। আমার ঘুম কেড়ে নিতে চাইছেন। তবে, আপনি ভদ্দরলোক। কথায় একটু যেন ব্যথা আছে ব্যথা আছে, মনে হচ্ছে। আর দেখুন, আমার আবার দয়ার শরীর। কথা ফেলতে পারি না কারও!

বাঁচালেন!


কিন্তু কেউই বাঁচে নি। কেউই বাঁচে না। কেউই কখনও প্লাস্টিক জড়িয়ে ঘুমের কথা ভাবে নি। ভাবি নি আমিও। অথবা, আমার আশেপাশের লোকজন। প্যাকেজের কবিতা লিখে লিখে হাত-পা গুলো রোগা রোগা হয়ে গেছে আজকাল। কাব্যি করে কথা বলি। ভাল না লাগলেও। অথচ, একটা লোক প্লাস্টিক জড়িয়ে দিব্যি ঘুমোতে যায় ফুটপাথে। আমার স্থবিরভাবটাই কেমন গুবলেটিং মনে হয়। তবে, তুমি কি কবি নয়? লোকদেখানো ঝিংচ্যাক কবিতা ফেলে দাও ফেলে দাও। আঠার মতো প্লাস্টিক জড়িয়ে নাও। তারপর, দিব্যি একটা ঘুম। কী? খুব একটা খারাপ লাগবে কি?






এই মাসের অন্যান্য গল্পগুলি:
কর্ত্রী -সরোজ দরবার   ডুয়েল - তন্ময় ভট্টাচার্য্য   একটি ব্যক্তিগত মনখারাপের গল্প - অরিনিন্দম মুখোপাধ্যায় অনাথবাবু ও হাওয়াবাড়ি -- ইন্দ্রনীল চক্রবর্তী   কুলীন বনবিহারী - একটি অসুখপাঠ্য অনুগল্প।। - অতীন্দ্রিয় চক্রবর্তী

Comments