একটি ব্যক্তিগত মনখারাপের গল্প - অরিনিন্দম মুখোপাধ্যায়


বিতনুর আজ মনটা ভালো নেই। অবশ্য তার মাঝে মাঝে এমন মনখারাপ করে। যেমন শীতের বিকেল হতে না হতেই সন্ধে নেমে আসাটা ওর একদম পছন্দ নয়। কোনো পুরনো বাড়ি দেখলে তার ইতিহাস জানতে তার মনটা কেমন করে। মাঝে মাঝে ছোটবেলার কথা হলেও ওর মনটা উদাস হয়ে যায়-- এইরকম আর কী। আবার কখনো জাস্ট এমনি এমনি মন খারাপ করে- তেমন কোন কারণ ছাড়াই। ওকে দেখলে অবশ্য এসব বোঝার জো নেই।নিজের মনখারাপ মনের মধ্যে লালন করে ও দিব্যি বাইরে হাসিখুশি থাকতে পারে--- মানে ওকে থাকতে হয়। বিতনু জানে এই তথাকথিত বিনা কারণে মনখারাপটা বেশিরভাগ মানুষই বোঝেনা। তাই মনখারাপের ধুয়ো তুলে অযথা দৃষ্টি আকর্ষণে তার ইচ্ছে নেই। এইসব সময়ে বাড়িতে থাকলে যেমন পুরনো গান বা বইতে, তেমনই অফিসে থাকলে ফাইলপত্তরে বুঁদ হয়ে ডুবে যায়। কম সময়ে অনেকটা কাজ করলে নিজেকে বেশ ওয়র্থ লাগে তার। মনটা একটু একটু করে ভালো হয়ে যায়।



কিন্তু আজ তার মন খারাপ এইসব আভ্যন্তরীণ কারণে নয়। একেবারে বাহ্যিক বা বলা যায়, লৌকিক কারণে। বিতনুদের ছোট পরিবার- সে, তার মা, আর তার বউ মঞ্জির। ওদের কোনো সন্তান নেই। সেটা অভিশাপ না আশীর্বাদ তা নিয়ে বিতনু আর মঞ্জিরের মধ্যে তর্ক বাঁধে প্রায়ই। মঞ্জিরের মতে একটা বাচ্ছা অন্তত দরকার। এ নিয়ে ওর মাঝে মাঝে মনখারাপ করে। বিতনুরও যে তা মনে হয়না এমন নয়। কিন্তু ওপর ওপর সে অন্য তর্ক করে। বলে, এই বেশ আছি। ঝাড়া হাত-পা। মেয়ে হলে কার সাথে প্রেম করবে, রাস্তায় কোন দানবের হাতে পড়বে তাই নিয়ে চিন্তা, আর ছেলে হলে সে নেশা করে ভোগে যাবে কিনা, সেই সব ভাবনা। অবশ্য এইসব ভাবনা ছেলে মেয়ে উভয়ত প্রযোজ্য। এসব বলে সে ব্যপারটাকে এড়িয়ে যায়। কিন্তু বিতনু বোঝে ব্যপারটা এত সরল নয়।



গতকাল রাতেই এই নিয়ে একটা গন্ডগোল হয়ে গেল। মা আর মঞ্জিরের মধ্যে। কথায় কথায় প্রসঙ্গটা উঠলো এবং মা একটা রূঢ় মন্তব্য করে বসলো। এর আগেও আত্মীয় বন্ধু অনেকেই এ নিয়ে মন্তব্য ও প্রশ্ন করেছে ওদের সামনে ও পেছনে। অক্ষমতার কথাও উঠেছে। এবং সেটা ঠিক কার, তা জানতে কম জেরা বিতনু ও মঞ্জির কে সহ্য করতে হয়নি। সে দেখেছে অন্য সব ক্ষেত্রে অক্ষম, মেরুদন্ডহীন মানুষও তাদের সামনে নিজেদের সন্তান উৎপাদনের সাফল্য নিয়ে স্লাঘা জাহির করেছে। বিতনু আজকাল এসবে আর পাত্তা দেয় না।



কিন্তু মা-ও সব জেনে, বিশেষত মঞ্জিরের কষ্ট বুঝেও এমন একটা কথা বলবে তা বিতনুও ভাবেনি। মঞ্জিরও এককথায় স্তম্ভিত হয়ে সোজা বেডরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল।সেই থেকে এখনো দুজনের বাক্যালাপ নেই। রাতে দুজনেই খায়নি। বিতনু অনেক সাধ্য-সাধনা করে ওদেরকে না খাওয়াতে পেরে একা একাই রাতের খাবার খেয়েছে। মঞ্জিরের সুন্দর চোখ দুটো লাল ও ফোলা দেখে বেশি না কথা বাড়িয়ে শুয়ে পড়েছে। মায়ের উপর তারও যে অভিমান হয়নি এমনটা নয়। মনখারাপ হয়েছে।



'কথা ঠিক যে মা এই বয়েসেও দু'হাতে তিনজনের এই সংসার আগলে রেখেছে। বাবা চলে যাওয়ার পর থেকে ঘরে বাইরে সবকিছুই মা'ই সামলায়। সেই জন্যই মঞ্জির নিজের খেয়ালে গান-বাজনা নিয়ে আর বিতনু অফিস আর তাদের কর্মচারী-সংগঠন নিয়ে পড়ে থাকতে পারে। তাছাড়া মা অসম্ভব গুণী। মায়ের মতো হাতের কাজ খুব কম জনেরই দেখা যায়। এখান ওখান থেকে কুড়িয়ে আনা কাঠের টুকরোটাকরা দিয়ে মা কি সুন্দর সব ভাস্কর্য বানায়। মঞ্জির সোৎসাহে এসব কাজে মা’কে সাধ্যমতো সাহায্য করে। দু’জনের মধ্যে এমনিতে সম্পর্ক ও বোঝাপড়া দারুণ। বরং বিতনুও মাঝেমাঝে কোনও কোনও ব্যাপারে দু’জনের মিলিত আক্রমণে বিদ্ধ হয়। কিন্তু আপাতত পরিস্থিতি সম্পূর্ণ আলাদা।



দোতলার বারান্দায় চেয়ারে বসে বিতনু কালকে রাতের কথা ভাবছিল। বাড়ির এসব ঘটনা তো আছেই, তারপর আবার আজ রোববার বলে সে বাজারে গিয়েছিল। গিয়ে তো মাথায় হাত। কুমড়ো চল্লিশ টাকা কিলো, বেগুন সত্তর, পটল আশি...আলু নেই। তার মাথাটা গেছে আরও গরম হয়ে। মনখারাপ তো ছিলই, এখন যোগ হয়েছে রাগ। বাজার থেকে ফিরে মনটা একটু অন্যদিকে দেবে বলে সে খবরের কাগজটা হাতে নীল। সেটার প্রথম পাতাতেই শব্দবাজির প্রতিবাদ করায় একজনের খুন হয়ে যাবার খবর...তার মেজাজ আরও চড়ে গেল। প্রতিদিন কাগজে এরকমই সব কাণ্ডের সম্ভার। বিতনুর কেমন অসহায় লাগে।



গত পরশুদিন অফিসে তার সঙ্গে অজয়দার কথা হচ্ছিল। অজয়দা বিতনুর থেকে বছর পাঁচেকের সিনিয়র। সব বিষয়ে আলোচনা করার একটা অদ্ভুত ক্ষমতা আছে। তাই আড়ালে তাকে এস.জে. বলে ডাকা হয়। এস.জে. --- অর্থাৎ সবজান্তা। তা অজয়দা বলছিল,--- ভাই আমরা মোটামুটি ভালো একটা সরকারি চাকরি করি, আমরাই বাজারে গিয়ে হিমসিম খাচ্ছি, আর যাদের দিন আনি দিন খাই, তারা কীভাবে সামলাচ্ছে? তারপর ধরো দুটো মেয়ের পড়াশুনোর খরচ। আটত্রিশ পারসেন্ট ডি. . বাকি মানে মাসে প্রায় বারো হাজার টাকা। তোমার কত লস হচ্ছে?



---ওই মাসে দশ হাজার মতো


---ভাবো তাহলে!



বিতনু মনে মনে ভাবে তাদের সন্তান নেই। থাকলে মাসে অন্তত পাঁচহাজার টাকার ধাক্কা। তাতেও কুলোতো কিনা কে জানে। তার কেমন স্বার্থপরের মতো আনন্দ হয়। দুঃখটা কেন যেন কমে আসে তার।



অজয়দা চালিয়ে যায়--- আমার কাজের মেয়েটাকে সেদিন বললাম, কি রে, কি দিয়ে ভাত খাচ্ছিস? বলল, এই তো কাল ফুলকপি কিনলাম। শুনে তো আমি হাঁ! বললাম, সে কি রে, অত দাম! কি বলল জানো?


---কি?


---বলল, মরশুমের জিনিস খাবনি?


---আমাদের রত্নাও বলেছে দাম বাড়লেও খেতে তো হবে! আর আমি তো তোমাদের মতো লেক মাক্কেট বাজার করি না। বালিগঞ্জ স্টেশনে যাবার সময় অনেক সস্তায় মাল কিনে নে যাই। আচ্ছা, এত দাম বাড়লেও লোকের খুব একটা হেলদোল নেই কেন বলতে পারেন?


---আসলে কি জানো ভাই, তোমার আমার লাইফস্টাইল আর এদের ব্যাপারটার মধ্যে অনেক ফারাক আছে। কলকাতায় তো একশ’ টাকা একমিনিটে ফাঁকা। এদের কিন্তু তেমনটা নয়।


---তা যা বলেছেন। গ্রামে, এমনকি মফঃস্বল শহরে এখনও টাকা ওড়ানোর সুযোগ সেভাবে নেই।


---আমার বড় মেয়ের তো মাসে দু’হাজার টাকা হাতখরচ লাগে। তাও বলে এতে কিছুই হয়না। একদিন সাউথ সিটির ফুডকোর্টেও বন্ধুদের নিয়ে খাওয়া যায় না। বোঝো...



অজয়দা বলে যেতে থাকে আর বিতনুর মনে হতে থাকে এসব ছাড়াও তার এল. আই. সি. , জি. পি. এফ. , ফিক্সড ডিপোজিট, মেডিক্লেম এসব আছে। রত্নাদের এসব বালাই নেই। অবিশ্যি সারদা আছে। কিন্তু তা তো জলে। ওরা একটু এদিক ওদিক হলেই ধার করে। কোনওরকমে দিনটা চালিয়ে নেওয়া। আজকে বাঁচে কালকের কথা না ভেবেই। তার সাথে বিতনু এও বোঝে যে তারা ক্রমশ ভোগবাদী সংস্কৃতির শিকার হয়ে যাচ্ছে, তাদের পরের প্রজন্ম আরও বেশি করে। আবার বিতনুর তাদের সন্তানহীনতার কথা মনে পড়ে। মঞ্জিরের দুঃখের কথা, মায়ের হতাশার কথা। মনটা কেমন উদাস হয়ে যায়। অনাগত সন্তানের পক্ষে কতটা বাসযোগ্য হত তাদের মধ্যবিত্ত পৃথিবী!



কিন্তু সে শুনেছে একজন সবজি-বিক্রেতা বলছিল জিনিসপত্র বিক্রি হচ্ছে না। মানুষ কিনতে পারছে না। বিতনুর তাদের বাড়ির কাজের মেয়ে রত্নার জন্য খুব চিন্তা হয়। মেয়েটির শরীর প্রায়ই খারাপ যায়। কিন্তু ঠিকমতো ডাক্তার দেখায় না। কি হবে ওদের, ওদের সন্তানদের ভবিষ্যৎ? মনে মনে ভাবে তার বন্ধু ডাক্তার অলকের কাছে ওকে একবার নিয়ে যাওয়া যায় কি না। এসব ভাবতে ভাবতে বিতনু টের পায় ওর রাগ আবার মনখারাপে বদলে যাচ্ছে।



---এই তোরা খাবি আয়।



বিতনু চমকে ওঠে। মা তোরা বলছে মানে তাকে আর মঞ্জির দু’জনকেই ডাকছে। বরফ তাহলে একটু গলেছে। এখন মঞ্জির এই ডাকে সাড়া দিলে হয়।



চাপা একটা উত্তেজনা নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। বাড়ির পরিবেশটাও যদি একটু ঠিকঠাক না থাকে, তাহলে সে যায় কোথায়!



খাবার টেবিলে মঞ্জিরও এসেছে। যদিও মুখ এখনও গম্ভীর। মা একে একে খাবার এগিয়ে দেয়। ভাত, মুলো দিয়ে মটর ডাল, পোস্তবড়া আর ডিমের ঝোল। সবকটা’ই মঞ্জিরের প্রিয় খাবার। চুপচাপ খাওয়া চলতে থাকে। মা মঞ্জিরকে বলে---আরেকটু ভাত নে, মঞ্জির!



---লাগবে না, মা!


---এখনও রেগে আছিস, মা!



এবার মঞ্জির আর পারে না। উঠে গিয়ে এঁটো হাতেই মা’কে জড়িয়ে ধরে। মা’ও কেঁদে ফেলে। আর এই দৃশ্যের সামনে বসে কর্মচারী আন্দোলনের নেতা বিতনু ভুলে যায় জিনিসপত্রের দাম বাড়া, ডি. . না পাওয়া নিয়ে তার সমস্ত ক্ষোভ। তার যাবতীয় কারণ সহ ও বিনা কারণের মনখারাপ।

এভাবেই সবাই ব্যক্তিগত আনন্দ দুঃখ দিয়ে ভুলে যেতে চায় বৃহত্তম সামাজিক প্রতিকূলতা, বঞ্চনা, কষ্ট, পরাজয়

...

Comments