অন্তর্বাস -সুবীর বোস






ক্লোজ সার্কিট টিভিতে কড়া নজর রাখছিল সহেলি। মাত্র দিন সাতেক আগে ও চাকরি পেয়েছে এক বহুজাতিক সংস্থার বিখ্যাত শো রুমে। এই শো রুমে কাস্টমার বলতে বিভিন্ন বয়েসী মহিলারা আর প্রোডাক্ট বলতে কেবল মহিলাদের বিভিন্ন ডিজাইনের কয়েক হাজার রকম অন্তর্বাস। সহেলির মূল কাজ আড়াল থেকে নজরদারি। এই দিন সাতেকের মধ্যেই সহেলি যে তার কাজটা বেশ ভালো রকম আয়ত্বে আনতে পেরেছে সেটা বোঝা গেল একটু পরেই।


একজন বয়স্ক মহিলা ক্যাশ কাউন্টারে পয়সা দিয়ে বেরোনোর আগেই সহেলি পাকড়াও করল তাঁকে। ম্যাডাম, আপনাকে আমার সঙ্গে একটু ভিতরের ঘরে যেতে হবে সহেলি বেশ বিনয়ের সঙ্গেই বলল।
“কেন? আমাকে ভিতরের ঘরে যেতে হবে কেন?” মহিলা বেশ গলা চড়িয়েই বললেন কথাগুলো।
“চিৎকার চেঁচামেচি না করে, লোকজনের ভিড় জমার আগে আমার সঙ্গে এলেই আপনার ভালো হবে।” সহেলি গলা নামিয়ে বলল।


সহেলির কথা শুনে বৃদ্ধা হঠাৎ করেই একদম চুপচাপ হয়ে গেলেন। সহেলি ফের বলল, ম্যাডাম, আসুন আমার সঙ্গে।

ভিতরের ঘরে সামান্য অনুসন্ধানেই বৃদ্ধার অন্তর্বাসের ভিতর থেকে বেরিয়ে এল একটি দামি অন্তর্বাস, যেটা উনি খুব ভদ্রভাবে বললে চুরি করে নিয়ে যাবার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু বোঝা গেলে উনি সহেলির দৃষ্টিকে ফাঁকি দিতে পারেননি।


প্রথমে মিনিটখানেক বিভিন্ন যুক্তি, তারপর কিছুক্ষণ চোটপাট। ব্যস, একটু পরেই বৃদ্ধা একদম ভেঙে পড়লেন। সহেলির দু হাত জড়িয়ে ধরে বৃদ্ধা কাঁদতে কাঁদতে বললেন, আমার কপালের দোষে সব গেছে। ছিল শুধু সন্মানটুকু। আজ বোধহয় সেটাও গেল।


সহেলি এই প্রথম বৃদ্ধাকে খুঁটিয়ে দেখতে গিয়ে দেখল বৃদ্ধা অবয়বে এখনও উজ্জ্বল, কিন্তু পোশাক এবং মাথার যত্নহীন চুল বলে দিচ্ছে যে উহার দিন গিয়াছে। সে ভিতরে ভিতরে একটু দুর্বল হয়ে পড়লেও নিজেকে সামলে নিল এই বলে ডিউটি ইজ ডিউটি।


সহেলির এই ভাবনার মধ্যেই বৃদ্ধা এবার সহেলির হাত ছেড়ে পায়ে হুমড়ি খেয়ে কাঁদতে কাঁদতে বললেন, “তুমি তো আমার মেয়ের বয়েসী। আচ্ছা তুমি বল, আমাদের মতো গরীবদের কি একটুও সাধ-আহ্লাদ থাকতে নেই। সব সুখ কি কেবল বড়লোকদের জন্যেই তোলা থাকবে? আমি তো আমার অনেক কষ্টে জমানো টাকা দিয়ে একটা অন্তর্বাস কিনেছি। কিন্তু কী যে হল লোভ সামলাতে না পেরে… অন্যটা… জিনিসটা এত সুন্দর… কিন্তু অত পয়সা কোথায় পাব…”


অমন কান্নাকাটির পরেও সহেলিকে নিরুত্তর দেখে বৃদ্ধা ফের বললেন, “দ্যাখো মা, যা দেখেছ, তুমিই দেখেছ আর কেউ তো দেখেনি। আমাকে কি এবারের মতো…”
“দেখুন এটা আমার ডিউটি। হয় আপনি ওই অন্তর্বাসের দাম দেবেন নয় আমাকে পুলিশ ডাকতেই হবে।”
“ঠিক আছে। ডাকো তোমার পুলিশকে। আমার অপরাধ বলতে তো গরীবী। দু বেলা এমনিতেই খেতে পাই না। পুলিশ নিয়ে গেলে তবু দু বেলা খেতে পাব। আমার শুধু চিন্তা আমার রুগ্ন মেয়েটাকে নিয়ে। বিছানায় শয্যাশায়ী সে মেয়ের জন্যেই নিয়ে যাচ্ছিলাম ওই অন্তর্বাসটা। গরীবের ঘোড়া রোগ! বোঝ এবার ঠ্যালা। আমাকে পুলিশে নিয়ে যাবে। সে তো জানতেও পারবে না আমি কোথায়। সে যাক, মা, তুমি পুলিশ ডাকো…”


বৃদ্ধার এমনতর আবেগী বিস্ফোরণের জন্য সহেলি তৈরি ছিল না। হঠাৎই যেন সে বিবেকের অন্য স্বর উপলব্ধি করা শুরু করে। বিশেষত বৃদ্ধার মুখে তাঁর অসুস্থ মেয়ের কথা শুনে তার মনে পড়ে এক চিলতে ঘরে ফেলে রেখে আসা তার মায়ের কথা। মনে পড়ে নিজের অসুস্থ মায়ের তার ঘরে ফেরা তক দরজার দিকে অপলক তাকিয়ে থাকার কথা। সে ভেবে দেখে যে সত্যিই ব্যাপারটা এখনও কেবলমাত্র সে এবং ওই বৃদ্ধাই জানে। ফলে ঝুঁকি নেই কিছু। এবং সে বৃদ্ধাকে বলে, “আপনি চলে যান। বাকিটা আমি দেখছি।”


আপ্লুত বৃদ্ধা এবার সহেলিকে জড়িয়ে ধরে বলেন, “আশীর্বাদ করি মা তুমি অনেক বড় হও।”
সহেলি টের পায় তার চোখের পাতা ভিজে উঠেছে।



মিনিট দুয়েক পরেই সেই বৃদ্ধাকে দেখা যায় মাথার চুল ঠিক করতে করতে দূরে রাখা একটা দামী গাড়িকে রিমোটে অন করতে। গাড়িতে ড্রাইভারের সীটে বসে একটা দামী মোবাইল অন করে বৃদ্ধাকে বলতে শোনা যায়, “ঋতুপর্ণা, সহেলি মেয়েটা এমনিতে নজরদারীতে বেশ চোস্ত। কিন্তু বড্ড আবেগী। এ কাজে এ মেয়ে চলবে না হে… এটা আমার মত… বাকিটুকু তোর হাতে ছেড়ে দিলাম…”

(হিব্রু দৃশ্যের ছায়া অবলম্বনে)











---

Comments